মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৩

সাম্প্রতিক গণআন্দোলন ও কিছু কথা



 মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়ার পর সারাদেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে এ পর্যন্ত ১৫০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে জামায়াত-শিবিরকর্মী। নারী-শিশুসহ সাধারণ জনগণ, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ। বিরোধী দল মিছিল করলেই পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়ে গুলীবর্ষণ করেছে। বিশেষ করে বগুড়া, সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, সাতকানিয়ায় হতাহতের সংখ্যা বেশি। গত ২৮ ফেব্রচয়ারি ২০১৩ তে বাংলাদেশের ইতিহাসে একদিনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক লোককে (৭০ জনেরও বেশি) পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডাররা গুলী করে হত্যা করেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই হত্যাকান্ডকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। সরকার ও সরকারদলীয় মিডিয়া এসব কিছুকে জামায়াত-শিবিরের তান্ডব বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে গ্রামের নারী-পুরচষ শিশুসহ সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অদক্ষতা, সরকারি দলের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার, ধর্ম প্রচারক মাওলানা সাঈদীকে ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয়া, শাহবাগ চত্বরের মাধ্যমে জাতিকে বিভক্তি ও নাস্তিক ব­গারদের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাহীন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ জনতা সরকারি অফিসেও হামলা ও ভাংচুর করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জনতা একজন প্রতিমন্ত্রীর বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, বগুড়ায় আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে। দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। অনেক জায়গাতেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরেও হামলা হচ্ছে। সরকার সমস্ত দোষ জামায়াত শিবিরের কাঁধে চাপাচ্ছে। বিরোধী দল বলছে এ হামলার জন্য সরকারি দলই দায়ী।
 শেখ হাসিনা সরকার যুদ্ধ অপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াত-শিবিরের এতটা প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে হবে বলে ধারণা করেনি। জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা এখন জেলে। জেলা ও থানা পর্যায়ের ১৫০০০ এর বেশি নেতা-কর্মী জেলে রয়েছে। মামলা রয়েছে লক্ষাধিক নেতা-কর্মীর বিরচদ্ধে। পুলিশের হামলায় আহত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শত শত নেতা-কর্মী। সরকার মিছিল দেখা মাত্র গুলী করেও রাজপথের আন্দোলন থেকে জামায়াত শিবিরকে বিরত রাখতে পারেনি। বরং দেখা যাচ্ছে থানা পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কেউ নিহত কিংবা গ্রেফতার হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিকল্প নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করছে। জামায়াত বাংলাদেশের একটি সুসংগঠিত আদর্শবাদী দল। দেশের প্রত্যেকটি উপজেলায় দলটির শাখা উপশাখা রয়েছে। বিপুল সংখ্যক লোক প্রতিটি উপজেলাতেই জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামোটাই এমন যে নেতৃত্বের কোন পদ শূন্য হলে পরবর্তী জন দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। এজন্য গণগ্রেফতার, গণনির্যাতন করে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো ও আন্দোলনকে ধ্বংস করা যাবে বলে মনে হয় না। জামায়াত শিবিরের জীবন বাজি রাখা এই সাহসি ভূমিকার কারণে সাধারণ জনতা এই আন্দোলনে দলে দলে শামিল হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দল, ওলামা-মাশায়েখগণ সরকার কর্তৃক গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্মদ্রোহিতার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছে। সরকার পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে চলে গেছে। সরকার সমর্থক কিছু কিছু মিডিয়া সরকারকে আরো হার্ড লাইনে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। তবে অনেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণের কথা বলছেন।
বর্তমানে এই আন্দোলন থেকে বিরোধী দলের পিছনে হটার কোন সুযোগ নেই। তবে বিএনপি জামায়াত ও শিবির নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে আন্দোলন যেন সহিংসরূপ ধারণ না করে। কারণ সহিংসতা থেকে সরকার আন্দোলনকে ভিন্নপথে চালিত করতে পারে। ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ­বের সময় দেখা গেছে সরকারের সাভাক বাহিনী তেহরানে একটি সিনেমা হলে আগুন লাগিয়ে এর দায়ভার চাপিয়েছিল আন্দোলনকারীদের ওপর। বর্তমানেও সংখ্যালঘুদের বাড়ি ঘরে হামলা, কিছু বিশেষ ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গের নিকটজনদের হত্যা করে এর দায়ভার বিরোধী দলের ওপর চাপানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলন হচ্ছে কায়েমী স্বার্থবাদী, লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, বিদেশী প্রভুদের পদলেহনকারী সেক্যুলার ও নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠীর বিরচদ্ধে তৃণমূল নিমণবিত্ত সাধারণ মানুষের আন্দোলন। ইতিহাস ও সভ্যতার নিয়মানুযায়ী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। শেখ হাসিনা সরকারও পাখির মত গুলী করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চিন্তা করলে ভুল করবে। বিএনপি-জামায়াতসহ সকল জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক দলের উচিত হবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া। গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করার মধ্যেই দেশের বর্তমান সংকটের সমাধান নিহিত এই বিষয়টি নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads