সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

ভক্তি বা বিদ্বেষের অন্ধত্ব নয়, চাই স্বচ্ছ মূল্যায়ন


মীযানুল করীম

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস ব্যাপকভাবে পালনের সূচনা সম্ভবত স্বাধীনতার পরপরই। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চের দিনটির আগেপরে দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। ‘মিত্রবাহিনী’ হিসেবে বিজয় দিবসে আগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সেনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন হয়েছিল দুই দিন আগে ১৫ মার্চ। আর দুই দিন পরে ১৯ মার্চ ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৫ বছরমেয়াদি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন তার প্রথম বাংলাদেশ সফরে ঢাকায়। বহুল বিতর্কিত এবং ব্যাপকভাবে সমালোচিত চুক্তিটির মেয়াদ শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ’৯৭ সালে আর বাড়ায়নি।
১৭ মার্চ পালনের সবচেয়ে বেশি তোড়জোড় দেখা যায় ১৯৭৫ সালে। এটাই জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর শেষ জন্মদিন। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, তথা একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সুবাদে তখন তিনি সর্বময় ক্ষমতা ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী। সে বার দলে দলে লোকজন সারি বেঁধে তার ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়েছেন ফুল নিয়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তা ও কর্মী নির্বিশেষে অনেকে বহুদূর হেঁটে মিছিল করে সেখানে হাজির হয়েছেন। তখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর এ দেশের মানুষের যা স্বভাব, তাতে এটা ধরে নেয়া যায়Ñ অনেকে সাড়ম্বরে শোভাযাত্রা ও ফুল নিয়ে গিয়েছেন সরকারের ভক্ত সেজে কৃপাদৃষ্টি অর্জনের জন্য।
আগের বছর, ১৯৭৪ সালের এই দিনে ঢাকায় ঘটেছিল অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক একটি রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি। তখনকার বৃহত্তম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ সেদিন বিভিন্ন দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করেছিল। রমনা পার্কের পাশের সে বাড়ির অদূরে তখন পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর গুলিতে প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছিল বলে বিরোধী দল দাবি করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। সে ঘটনায় জাসদের দুই শীর্ষনেতা মেজর (অব:) এম এ জলিল এবং আ স ম আবদুর রব গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। তারা ১৯৮০ সালে মুক্তি লাভ করেন, যদিও ’৭৫ সালে অল্প কয়েক দিন জেলের বাইরে ছিলেন।
সরকার মুজিবের জন্মদিনটি ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ এবং আগামী দিনের নাগরিক। বিগত দিনের ইতিহাস তাদের জানাতে হবে দলীয় নয়, জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। ইতিহাস বিকৃতি যেমন মারাত্মক অন্যায়, তেমনি এই বিকৃতি রোধের কথা বলে বিশেষ উদ্দেশ্যে খণ্ডিত বা রঞ্জিত ইতিহাস তুলে ধরাও অন্যায়। কারণ, এর পেছনে উদ্দেশ্য মগজধোলাই। থাকে না পূর্ণ সত্যের উপস্থাপন। Half truth is more dangerous than lie (অর্ধ সত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর)। তাই শিশুদের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে, জানতে দিতে হবে। ফরমায়েশি ও পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসে পছন্দের মানুষকে ফেরেশতা বানিয়ে অপছন্দের মানবকে নির্দ্বিধায় দানব হিসেবে দেখানো হয়। ইংরেজিতে এই দুটো প্রবণতাকে যথাক্রমে Deification I Demonization  বলা হয়।
ভক্তি ও বিদ্বেষ দু’টিই মানুষের সহজাত। তবে সীমা লঙ্ঘন করে উভয় ক্ষেত্রেই মানুষ ‘অন্ধ’ হয়ে যায়। শেখ মুজিবের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন, এমন লোক নিশ্চয়ই আছে। তবে তার সমালোচনা কিংবা তার দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের যুক্তিসঙ্গত নিন্দা বা বিরোধিতা মানেই নিঃসন্দেহে তার প্রতি বিদ্বেষের প্রমাণ নয়।
মুজিবের সৌভাগ্য, তার জীবদ্দশায় তাকে অকথ্য ভাষায় প্রকাশ্য গালমন্দ করে এখন কেউ কেউ তার শুধু ‘সমর্থক’ নয়, শতভাগ অনুসারী হওয়ার দাবিদার। অবশ্য বর্ণ বদলানো এসব মানুষের নীতিনিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সততা নিয়ে মানুষ বেজায় সন্দিহান। তাদের অনেকে এখন ক্ষমতাবান এবং মুজিবের উত্তরসূরির আশীর্বাদধন্য। অপর দিকে, যারা দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং আদর্শের নিরিখে মুজিব সরকার এবং তার প্রশাসনিক ভূমিকার সমালোচনা করতেন, তাদের বেশির ভাগই এখনো সে অবস্থানে রয়েছেন। তবে ইতোমধ্যে অনেকেই এটা মেনে নিয়েছেন যে, ‘শেরেবাংলা’ বলতে যেমন এ কে ফজলুল হককেই বোঝানো হয়, ‘মজলুম জননেতা’ বললে মওলানা ভাসানীকেই বোঝায়, তেমনি ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে অভিহিত করা হয় শুধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই। তাই লক্ষ করা যায়, বিশেষত গত এক দশকে আওয়ামী লীগের বহির্ভূত কিংবা বিরোধী, নানা মহলের অনেকেই (কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ) মুজিবের নামের আগে বঙ্গবন্ধু বলে থাকেন। এটা জোরজবরদস্তির ফল নয়; আন্তরিক শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি’ ধারণ ও লালনের দাবি যারা জোরগলায় করে আসছেন, তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধা ও সৌজন্য দেখাচ্ছেন? এ ক্ষেত্রে Reciprocity বা পারস্পরিক বিনিময় না থাকলে জাতীয় অঙ্গনে রাজনৈতিক সমঝোতা, সহনশীলতা ও সহাবস্থানের প্রত্যাশা বৃথা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় একটি বিষয়। তা হলোÑ মাঝে মাঝে অনেক সুধীজন পরামর্শ দেন মুজিব ও জিয়াÑ এই দু’জনকে হেয় বা অশ্রদ্ধা না করতে। এই দু’জন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরস্পর বিপরীত দু’টি শিবিরের প্রতীক ও প্রতিভূতে পরিণত হয়েছেন। নিজ নিজ শিবিরের সবার কাছে তারা পরম শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। তবে প্রতিপক্ষের তীব্র সমালোচনার টার্গেট।
এবার অতিভক্ত প্রসঙ্গ। ‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটার অর্থ বাংলার সুহৃদ। বাংলা ভাষায় অন্যান্য শব্দের মতো ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটিও প্রচলিত অতীতকাল থেকে। বাংলায় পবিত্র কুরআন শরিফের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন। তিনি ছিলেন শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কারক। ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের একটি সাময়িকীর সম্পাদনা করেছেন তিনি। কাকতালীয়ভাবে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো গিরিশ সেনেরও (১৮৩৫-১৯১০) মৃত্যু দিবস। দৈনিক নয়া দিগন্ত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের স্মরণ করে আসছে তাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে। কয়েক বছর আগে একবার ১৫ আগস্টে যথারীতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ওপর সম্পাদকীয় ও বিশেষ নিবন্ধের পাশাপাশি ভাই গিরিশ সেনের ওপর সংক্ষিপ্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ওই দিনই দুপুরে জনৈক ব্যক্তি ফোন করলেন। তিনি সাঙ্ঘাতিক রকম বিুব্ধ। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “আপনারা আজ লিখেছেন, গিরিশ চন্দ্র সেন ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এসব কোত্থেকে পেলেন? তখন ‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটা কিভাবে আসলো?” অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন হুমকি, ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দযুগল শুধু একটি ক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার করা হলে ‘অসুবিধা হতে পারে’।
এই লোকটি মুজিবের প্রতি ভক্তি দেখাতে গিয়ে যে অন্ধত্ব ও অজ্ঞানতা দেখিয়েছেন, মুজিব বেঁচে থাকলে তাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতেন। লোকটি বাঙালি জাতির অন্যতম গৌরব, গিরিশ চন্দ্র সেন সম্পর্কে না হয় জানেন না। কিন্তু এটাও কি জানেন না যে, ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ১৯২০ সালে মুজিবের জন্মের বহু আগে থেকেই প্রচলিত। কারণ, এটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত। এই অন্ধ ভক্তের ঘটনায় একটা চুটকি মনে পড়ছে। শিক্ষক ছাত্রকে বলছেন, ‘অক্সিজেন আবিষ্কার হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে।’ বোকা ছাত্র শুনে তো হতবাক। সে বলল, ‘স্যার, তাহলে এর আগে মানুষ বাঁচত কী করে?’
স্মর্তব্য, এখন ‘বঙ্গবন্ধু’ মানে শেখ মুজিব হলেও আমাদের দেশে এই উপাধিটি প্রথম পেয়েছিলেন জনপ্রিয় বাগ্মী, লেখক ও সমাজ সংস্কারক মুন্সী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭)। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন শেখ মুজিবের জন্মেরও বহু আগে। মুজিবের জন্মের ১৩ বছর আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯০৭ সালে।
‘জাতির পিতা’ কথাটা সুপরিচিত। কয়েকটি দেশে এর বহুল ব্যবহার দেখা যায়। যিনি কোনো একটি দেশ বা জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন, অথবা এ ক্ষেত্রে যার অবদান সর্বাধিক বলে স্বীকৃত, তাকে জনগণ শ্রদ্ধাভরে ‘জাতির পিতা’র মর্যাদা প্রদান করে থাকে। ভারতে গান্ধী এবং পাকিস্তানে জিন্নাহ জাতির জনকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলার এই সম্মান প্রাপ্য। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ‘জাতির পিতা’ কথাটা রাজনৈতিক ও অবিধিবদ্ধ। তুরস্কে মোস্তফা কামালের বিরাট অবদান ছিল দেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায়। আবার এটাও সত্য, তিনি ছিলেন কঠোর কর্তৃত্ববাদী শাসক। তুরস্কে আতাতুর্ক বা তুর্কি জাতির পিতা হিসেবে তার মর্যাদা সংবিধান ও আইনে নির্ধারিত। বাস্তবে তার প্রতি শ্রদ্ধার আতিশয্যকে অনেকেই ব্যক্তিপূজা মনে করেন। ভারতে কিছু দিন আগে প্রকাশ পায় যে, গান্ধীজীকে ‘জাতির পিতা’ বলাটা প্রায় সবার কাছে গ্রহণীয় হলেও এর সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। পাকিস্তানের সংবিধানে কী লেখা আছে, জানি না। তবে আমাদের স্কুলজীবনে দেখেছি, তৎকালীন পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন মহল ‘জাতির পিতা’র বিষয়ে উৎসাহী হলেও সরকারবিরোধী মহল এটাকে গুরুত্ব দিত না। অনেকে বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘জাতির পিতা’ প্রসঙ্গটি অপ্রয়োজনীয় বিধায় এর স্বীকৃতি নেই। বাস্তবে এর সাথে জনগণ বা রাজনৈতিক মহলের আবেগ-অনুভূতি এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা জড়িত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রাণপুরুষ হিসেবে গণ্য। মুক্তিযুদ্ধে দৈহিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তিনি স্বাধীনতাকামী জনগণের মনে ছিলেন সমুপস্থিত। তখন তার নাম ছিল মুক্তি সংগ্রামের অনন্য প্রেরণা। এ হিসেবে এখন দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে মুজিব ‘বাংলাদেশের স্থপতি’রূপে স্বীকৃত। ‘জাতির জনক’ হিসেবে তার উল্লেখ দেখা যায় জাতীয় রাজনীতির একটা বড় অংশে। যারা তা বলেন না, তারাও স্বীকার করেন যে, এ দেশের মানুষকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের পথ বেয়ে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয় এবং ১৯৭১ সালে তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা। ‘জাতির পিতা’র স্বীকৃতি ও প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যাপার। এটা মূলত আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয় নয়। এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত আবেগ ও স্পর্শকাতরতার একটি ঘটনা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম শাসন আমল। তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান। আয়োজক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এর সচিব মুখলেছুর রহমান বক্তব্যে শেখ মুজিবের প্রতি যথারীতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে। এ সময় ‘জাতির জনক’ কথাটা কেন বাদ পড়ল, তার প্রতিক্রিয়ায় সাথে সাথে আওয়ামী লীগের দু’জন ‘তরুণ তুর্কি’ নেতা ছুটে গিয়ে সচিবকে অপদস্থ করলেন। তাদের অশোভন আচরণে সবাই বিস্মিত ও মর্মাহত হলেও মুখ খুলে কিছু বলেননি মান-ইজ্জতের ভয়ে। যে দু’জন সেদিন সরকারের একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেছেন, কিছু দিন পরই তাদের রাজনৈতিক লাঞ্ছনা শুরু। একজন ২০০১ থেকেই নিজ দলে পরিত্যক্ত। অন্যজন কিছু দিন আগে একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, দলে পদ তো হারিয়েছেনই, নেত্রীর ধারেকাছেই যেতে পারেন না। আমরা যেন না ভুলি, অন্ধ বিদ্বেষ ও অন্ধ ভক্তি দু’টিই মানুষকে সীমালঙ্ঘনে উসকিয়ে দেয়।
কোনো বড় নেতাকে বিশেষণ ছাড়া শুধু তার নাম দিয়ে উল্লেখ বা সম্বোধন তার জন্য মোটেও অমর্যাদাকর নয়; বরং সেটা মানুষের সরলতা ও আন্তরিকতার বহুল প্রচলিত বহিঃপ্রকাশ। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা এবং শেখ মুজিবের অতি ঘনিষ্ঠ তোফায়েল আহমেদ এবার ১৭ মার্চ প্রথম আলোয় যা লিখেছেন, তা থেকে উদ্ধৃৃতি দেয়া যায়। তিনি বলছেন, ‘‘একবার আমাদের গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ালো। হঠাৎ একটি শিশু, কত বয়স হবে, সাত কি আট, গাড়ির কাছে এসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলছে, ‘আসসালামু আলাইকুম, মুজিব সাহেব।’ তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু শিশুটির হাত ধরে আদর করলেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।’’ এ ঘটনায় প্রশ্ন জাগে, মুজিব কি সেদিন ভেবেছিলেন তার নামের আগে বিশেষণ না বসিয়ে বাচ্চাটি বেআদবি করেছে?
তোফায়েল আহমেদ তার লেখায় বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু কখনোই মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। কখনোই রাজনৈতিক বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন না।’ অথচ এখন ক্ষমতাসীন হিসেবে আওয়ামী লীগের ছোট, বড় ও মাঝারিÑ সব নেতা যে অকথ্য ভাষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চরিত্র অবিরাম হনন করে চলেছেন পরিকল্পিতভাবে, তাতে তারা কি নিজেদের বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবি করতে পারেন?
১৯৯৬ সালে পালিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৫তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান ছিল পরপর দুই দিন। উদ্বোধন পর্বে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদপাঠক বিখ্যাত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা দেয়া হলো। পেশাগত কাজে আমি উপস্থিত ছিলাম মঞ্চের পাশে। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা (এখনো দলের কাজে সক্রিয়) বক্তৃতায় সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই বলে বসলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্মের পরদিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। অত্যধিক আবেগপূর্ণ এই কথাটি বলার উদ্দেশ্য যত মহৎ হোক, বাস্তবতা কিন্তু মোটেও তা নয়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্যই তুলে ধরে। নেতাদের প্রতি অতি শ্রদ্ধাবশত বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় দিই না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেনÑ কথাটা বেশি বলে থাকেন এবং বারবার উচ্চারণ করেন তার প্রিয় দল আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু তার আদর্শের ধারক-বাহক হওয়ার দাবিদারেরা নেতার নাম ব্যবহার করে যে রাজনীতি করে আসছেন, তা জাতিকে সুসংহত নয়, বিভাজন-অনৈক্য-হিংসা-হানাহানির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট দলটি ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে যেখানেই থাকুক, তার রাজনীতির ধরন অভিন্ন থেকে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সপক্ষ-বিপক্ষ সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার মহান লক্ষ্যে ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন। তার মাঝে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল না। এসব গুণ তার উত্তরসূরিদের মাঝে কতটুকু বিদ্যমান, জনগণ সেটা ভালোভাবে উপলব্ধি করছে।
মুজিবের জন্মদিনে আমাদের কর্তব্য, জাতির স্বাধিকার সংগ্রামের এই মহানায়কের যথাযথ মূল্যায়নে সবাই সচেষ্ট থাকা। ভক্তি ও বিদ্বেষের অন্ধ মানসিকতা নয়, তথ্যের আলোকে এবং যুক্তির ভিত্তিতে স্বচ্ছতার সাথে তার সংগ্রামী জীবনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিত। তিনি জীবনে নানা জুলুম-নির্যাতন সয়েও সংগ্রামের পথে অপশক্তিকে পরাজিত করে লক্ষ্যে উপনীত হয়েছিলেন। তেমনি এ যুগেও যারা নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে জনগণের অধিকার হরণ করে স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেবে, তাদের পরাজয় ঘটবে নিশ্চিতভাবে। ক্ষমতান্ধ শাসকেরা মনে করেন, তাদের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ এবং আসনটি স্থায়ী। তাদের জন্য মুজিবের ভাষায় বলতে হয়Ñ ‘আল্লার মাইর, দুনিয়ার বাইর।’

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads