বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানকে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত করে শেষ বিদায় জানাল। রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময়ে তিনি চিরবিদায় নিলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভেদ-বিভাজনের মাত্রাহীন কোলাহলের ভেতরও সমগ্র জাতি একসাথে শোক প্রকাশ করল। ব্যথাতুর স্মৃতি বহন করেও একটি কফিনের পাশে পুরো দেশবাসী দাঁড়িয়ে গেল। অকল্পনীয় বেদনাবিধুর ঐক্যতানের সুর বাজল সর্বত্র। প্রজাতন্ত্রের সন্তানতুল্য নাগরিকেরা প্রজাতন্ত্রের অভিভাবকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোনো কার্পণ্য করেনি। আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমানকে বাঙালি ও দলীয় ভাবনার ভেতর সীমাবদ্ধ রাখলেও বাঙালি-অবাঙালিসহ নৃগোষ্ঠী দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই তাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখেছে, শুধু বাঙালির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়। তাই দল-মত নির্বিশেষে অতীত ভুলে এক কাতারে শামিল হওয়ার এমন নজির এ জাতি বহুবার স্থাপন করেছে। কিন্তু শাসকেরা তা বোঝেও না, সম্মানও করে না। দলান্ধ রাজনীতির কাছে জাতীয় ঐক্যকে বলি দিতে তাদের বুক কাঁপে না।
রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর মিডিয়ায় এলো বিকেল সাড়ে ৪টার পর। অনলাইন নিউজ পেপার ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ দেয়া শুরু হলো পৌনে ৫টার দিকে। সরকার নিশ্চয়ই আরো আগেই খবরটি পেয়ে থাকবে। তার পরও গভীর রাত পর্যন্ত মন্ত্রিসভার একটি জরুরি বৈঠকের খবর পেলাম না। শোক প্রস্তাব গৃহীত হলো না। বিলম্বে তিন দিনের শোক, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও গার্ড অব অনারের মতো রাষ্ট্রাচার তো গতানুগতিক বিষয়। পরদিন সকাল ১০টার পর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। মনে হয়েছে সরকার সমন্বয়হীন ও দায়হীন অবস্থায় ছিল। বিষয়টা অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো বিষয় নয়। মানসিক দৈন্যের ব্যাপার। মনে হলো সরকার অনেকটা রেওয়াজ রক্ষার রাষ্ট্রাচারের বাইরে যেতে পারল না। তা ছাড়া মনে হয়েছে সরকারের কাছে দেশের সিটিং রাষ্ট্রপতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতার মৃত্যুটাই ভাবার বিষয়। সেই তুলনায় বিরোধী দল অধিকতর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা হরতাল প্রত্যাহার করেছে। বিরোধীদলীয় নেতার সফর পিছিয়েছে। শোক প্রকাশে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। বিরোধীদলীয় নেতা পরিবেশ-পরিস্থিতি ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে বঙ্গভবনে দ্রুততার সাথে ছুটে গিয়ে কফিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিরোধী দলের আচরণ ও তৎপরতা ছিল দেশের রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের তাড়না থেকে উৎসারিত। আর সরকারি দলের আচরণ ছিল সমন্বয়হীন ও একজন দলীয় নেতার প্রতি খানিকটা দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। জিল্লুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ছন্দপতনের ঘটনা নেই বললেই চলে। বরং আওয়ামী লীগের দুর্দিনে তিনি ঝলসে উঠেছেন। র্যাট ক্যাটের উৎপাতের প্রেক্ষাপটে এক-এগারোর দৈত্য তার ঘাড় মটকাতে পারেনি। তখন তিনি আমাদের মতোই দুই নেত্রী ও গণতন্ত্রের পক্ষে, ছদ্মবেশী সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুক টান করে দাঁড়িয়েছেন।
সেই দুঃসহ স্মৃতি আওয়ামী লীগ ভুলে গেলেও বিরোধী দল সম্ভবত ভোলেনি। বিরোধী দল একবারও বলেনি কিংবা স্মরণ করতে চায়নি এই রাষ্ট্রপতির রেওয়াজ রক্ষার সংসদীয় ভাষণেও বিরোধী দলকে নিন্দাবাদের বক্তব্য মুসাবিদা করে দিয়েছে সরকার। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে দলীয় আচরণের দায় চাপিয়েছেন সরকারের নির্বাহীরা। বিচারপতি নিয়োগে দলীয় বিবেচনার দায়ও রাষ্ট্রপতির ওপর চাপিয়েছেন তারা। বিতর্কিত সংবিধান সংশোধনীর মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে এই সরকার। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার এখতিয়ারের অপপ্রয়োগে বাধ্য করে দলীয় খুনিদের সাজা মওকুফ করে নেয়ার দায়ও সরকারের। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির কিঞ্চিৎ ক্ষমতা ব্যবহারের যে সুযোগ, সরকার তা-ও প্রয়োগের সুযোগ দেয়নি। এ কারণেই বঙ্গভবনে সাহসী, সংবেদনশীল ও গণতন্ত্রমনা জিল্লুর রহমানকে আমরা সেভাবে পাইনি।
আমরা এ-ও প্রত্যক্ষ করলাম, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী পুলিশ প্রজাতন্ত্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের পাখির মতো গুলি করে মারল, গণহত্যা চালাল, আইন প্রয়োগের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগের তর্জনী বঙ্গভবনকে নাড়া দিতে পারেনি সরকারি কৌশলের কারণেই। আমরা এটাও জানি সংবিধান রাষ্ট্রপতির জন্য কোনো স্বাধীন চিন্তা প্রয়োগের সুযোগ রাখেনি। তার পরও কথা থেকে যায়, রাষ্ট্রপতি দলের হন না, দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সম্ভবত ভদ্রতা ও কৃতজ্ঞতার ভারে তিনি এতটা ম্রিয়মাণ হতে বাধ্য হয়েছেন। এখন প্রশ্নÑ তিনি যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করলেন, তারা সেটাকে করুণা ভাবেননি তো? তার পরও বলব, বার্ধক্য ও অসুস্থতা রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে না ধরলে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্নতর হতেও পারত।
এখন শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাঁক ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। জাতীয় ঐক্যের যে সীমিত আবহ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানোর সময়। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট অবশ্যই স্পিকার হবেন। তার যোগ্যতা ও সাংবিধানিক অবস্থান দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে তুলে দেয়। তবে আরেকজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে অনেক কিছু ভাবার দায় রয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি কমিটেড নন, দেশ-জাতির প্রতি কমিটেড একজন সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রপতি করা সময়ের দাবি। রাজনৈতিক স্থবিরতা ও সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার এটাই মোক্ষম সময়। যে ক্রান্তিকাল আমরা অতিক্রম করছি, সামনে সঙ্কট উত্তরণের যে প্রশ্ন; সে ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধরনের দাবি পূরণের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ হাতছাড়া না করে গ্রহণ করলেই আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা রক্ষা করা সম্ভব হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশস্ত পথও খুলে যাবে।
আল্লাহ এই পৃথিবীতে কাউকে কম গুরুত্বপূর্ণ করে সৃষ্টি করেননি। আবার অপরিহার্য করেও সৃষ্টি করেননি। সবাইকে মৃত্যু পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে নষ্ট, ভ্রষ্ট, নাস্তিক, আস্তিক, কাফের, মুশরেক, মুনাফেক, মুরতাদ কারো কোনো বাহুবল খাটে না। কোনো দুর্বিনীতও মৃত্যু ঠেকাতে পারে না। মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারে না কোনো দুরাচার ও ক্ষমতাধর শাসক; স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার, একনায়ক; মুনী, ঋষী, পীর-মাশায়েখ কেউ মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারেন না। কারো কোনো আস্ফালন কিংবা ক্ষমতার জোর মৃত্যুর কাছে অর্থহীন। জন্ম-মৃত্যুর বাগডোর অতিক্রম করার সাধ্য কারো নেই।
বঙ্গভবনে দুই গজ দূরত্বে থেকেও প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা কেউ কারো দিকে তাকানোর দায় বোধ করেননি, এই এক বেদনাদায়ক ঘটনা। একটি লাশের কফিন তাদেরকে সেখানে টেনে নিলো; কোন তালাবদ্ধ বিবেক কিংবা অচ্ছুৎ রাজনীতির দেয়াল তাদেরকে কাছে থেকেও দূরে সরিয়ে রাখলÑ এ প্রশ্ন ছোট নয়, গৌণও নয়। দায়টা কারো কম নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দায় ছিল বেশি। জাতি সবই প্রত্যক্ষ করল। প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা জনগণের নেই। থাকলে তাৎক্ষণিক অভিশাপ ঢেলে দিত। তবে সেই অভিসম্পাত মনে পুষে রেখেছে, কখন যে জনগণের দীর্ঘনিঃশ্বাস ক্ষমতা কাঁপিয়ে দেয় বলা কঠিন। তার আগেই বিভক্ত জাতির সামনে ঐক্যের সুর তুলে সঙ্কট উত্তরণের বাঁশি বাজিয়ে দেশ, জাতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে রক্ষা করুন। তবেই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতির আত্মা শান্তি পাবে। গণতন্ত্রও মুক্তি পাবে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার দলনের পরিবর্তে শপথে বলীয়ান ও সমঝোতায় বিশ্বাসী জাতিও দিশা খুঁজে পাবে। তা না হলে জিল্লুর রহমানের মতো মরে প্রমাণ করতে হবে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দলীয় ক্ষমতা তাকে দলের ঊর্ধ্বে নেয়নি, তবে মৃত্যু তাকে সেখানে নিয়ে গেছে। HI’� � / �w � p n lang=BN style=’font-family:Vrinda;mso-hansi-font-family: SutonnyMJ;mso-bidi-language:BN’>গত কয়েক দিনে সরকার ১৭০ জন লোককে হত্যা করেছে। এক দিনেই করেছে ৬৬ জনকে হত্যা। এ রকম ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। আর রক্তাক্ত হাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলে বসেছেন, এ হত্যার জন্য দায়ী বিরোধীদলীয় নেত্রী। মসজিদে মসজিদে তালা লাগিয়ে দিয়ে মুসল্লিদের লাঠিপেটা করে তিনি বলেছেন, বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন মানুষ নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারেনি। এটাকে প্রলাপ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বলতে তিনি কসুর করছেন না। এতে মানুষ আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন