যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা ছিল ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। অথচ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতেও এ অঙ্গীকার ছিল না। ২০০৯ সালে সংসদের প্রথম অধিবেশনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে একটি প্রস্তাব পাস করে। সে মোতাবেক সরকার বিচারপ্রক্রিয়া আরম্ভ করে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ বিচারপ্রক্রিয়াকে দলীয়করণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনি প্রক্রিয়ায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলে আওয়ামী লীগ। তারা এককভাবে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়ক বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়। তারা এককভাবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, বিচারপতি, তদন্তকারী ও প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহায়ক ব্যক্তিদের যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য দু’টি আইন প্রণয়ন করা হয়। একটি ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আইন ’৭৩ এবং অপরটি হলোÑ দালাল আইন। প্রথম আইনে বিচারের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের মধ্য থেকে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। দালাল আইনে এ দেশের বেসামরিক সহায়তাকারীদের প্রায় লাখখানেক মানুষকে আটক করা হয়েছিল। তাদের প্রায় ৩৫ হাজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ১০ হাজারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযোগ গঠন করা হয়। প্রায় সাত হাজার ব্যক্তির বিচার করা হয়; ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় একজনকে। এরপর বঙ্গবন্ধু চারটি অপরাধে অভিযুক্তদের ছাড়া বাকি সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন।
বর্তমানে সংশোধিত যুদ্ধাপরাধী আইনটি আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য বারবার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার কোনো কারণ ছাড়াই এসব প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে। সরকার এসব নিরপেক্ষ ও খ্যাতিসম্পন্ন সংস্থাকে উপেক্ষা করে তাদের কথিত ‘আন্তর্জাতিক’ বিচারকে অভ্যন্তরীণ বিচার এবং যুদ্ধাপরাধকে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধ বলে ঘোষণা দেয়। এসব কারণে বিচারিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়। সরকার বিচারব্যবস্থাকে এই দলীয়করণ এবং একলা চলো নীতি গ্রহণ সত্ত্বেও এখন তারা বিএনপির প্রতি আবদার করছে তাদের কার্যক্রমে সমর্থন করার। তাদের ধামাধরা মিডিয়া আর দলান্ধ সুশীল ব্যক্তিরা বিএনপিকে নানাভাবে নিন্দিত করতে সচেষ্ট দেখা যায়। নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে তাদের শক্তিশালী মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
যেসব গুরুতর অপরাধের জন্য কিছু ব্যক্তিকে বিচারাধীনে আনা হয়েছে, তা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শেখ মুজিব চারটি গুরুতর অপরাধের অপরাধী ছাড়া আর সবাইকে মাফ করে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এসব অভিযুক্ত ব্যক্তির মাধ্যমে খুন, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্য অপরাধ হয়ে থাকলে স্বাধীনতার প্রথমলগ্নে এসব অভিযোগ উত্থাপন হওয়ার কথা পূর্বোক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এদের অনেকে বারবার বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং বিপুল ভোটে জিতেছেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীও হয়েছেন।
স্কাইপ সংলাপ প্রকাশের পর প্রমাণিত হয়েছে, কিভাবে সরকার অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে সচেষ্ট। তারা এমনকি বিচারকদের প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট ছিল। স্কাইপ কেলেঙ্কারির হোতা বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘সরকার একটি ফাঁসির রায় চায়।’ আসামিপক্ষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। সেফহোমের কর্মকাণ্ড, সাক্ষীদের দীর্ঘ দিন সেখানে অবস্থান এবং ১৫ জন সাক্ষীর অনুপস্থিতিতেই তাদের সাক্ষ্য হিসেবে পুলিশ ইনস্পেক্টরের পেশ করা লিখিত বক্তব্য গ্রহণ, আসামিদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী গুম হয়ে যাওয়া (আদালতের সামনে থেকে) এবং এ ব্যাপারে সরকারের রহস্যময় নিঃস্পৃহতা ইত্যাদি কারণে সচেতন মানুষের মনে নানা সন্দেহের উদ্রেক স্বাভাবিক।
এত দিন দু’টি ট্রাইব্যুনালে বিচারিক কাজ চলছিল। প্রথম ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতি নিজামুল হকের বিদেশে অবস্থানরত কোনো এক জিয়াউদ্দিনের সাথে স্কাইপ সংলাপের দরুন এবং তাদের এ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ফলে প্রথম ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর রায় দিতে দেরি হয়ে যায়। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল একটি রায়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে ফাঁসি দেন। অন্যটিতে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়। এ রায় আওয়ামী ও বাম মহলের পছন্দ হয়নি, তাই তারা তাদের ব্লগারদের মাধ্যমে শাহবাগ চত্বরে একটি আন্দোলনের সূত্রপাত করে। প্রথমে বামপন্থী গোষ্ঠী প্রধান ভূমিকা রাখে, পরে ছাত্রলীগ মঞ্চ দখল করে নেয়। তারা তাদের এ নাটককে ‘বাংলার মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলন’ হিসেবে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হলো। এতে তাদের পক্ষের সব টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এসব মিডিয়ার প্রপাগান্ডায় একটি অতিরঞ্জিত ইমেজ সৃষ্টি পরিকল্পিত হয়। পরে ব্লগারদের নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আসল চেহারা জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চে সরকারের সর্বাত্মক সহায়তা, ফ্রি খাবার এবং গানবাজনা, নাটক দিয়ে বেশ কিছু মানুষকে সেখানে উপস্থিত করাতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ লোকসংখ্যা বাংলার ১৬ কোটি মানুষের কত শতাংশ! ফাঁসি চাই, জবাই করোÑ দাবিগুলোর মাধ্যমে সরকার নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রশ্রয় দিয়েছে। উসকানি দিয়ে দেশে হানাহানি ও সহিংসতার ব্যাপ্তি ঘটাচ্ছে। ছোট শিশুদের দিয়ে এসব হিংসাত্মক স্লোগান উচ্চারণ করিয়ে তাদের সহিংসতায় দীক্ষা দেয়া হচ্ছে। ফাঁসির অভিনয় করতে গিয়ে দুই শিশু প্রাণ হারিয়েছে।
কোনো কোনো মন্ত্রী পর্যন্ত গণজাগরণ মঞ্চের সাথে তাল মিলিয়ে বিরোধী সংবাদপত্রকে হুমকি দিচ্ছেন। নাস্তিক ব্লগারের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে বিভ্রান্তি ছড়াতে নানারকম মিথ্যা যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। কে ইসলামবিরোধী এবং কে ইসলামের পক্ষের, তার ফতোয়াও দেয়া শুরু করে দিয়েছেন মন্ত্রীরা।
কয়েকজন ব্লগারের সাম হোয়ার ইন, মুক্তমনা, ধর্মকারী, নূরানীচাপা সমগ্র প্রভৃতি ব্লগে ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মক আঘাত এবং আদালত অবমাননার কারণে এসব ব্লগ বন্ধ করে চিহ্নিত ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রাতুল সারওয়ার ও ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন। শুনানির পর গত বছর ২১ মার্চ রিট আবেদনটি গ্রহণ করে উচ্চ আদালত ‘মহান আল্লাহ, রাসূল সা: ও ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারী ব্লগগুলো কেন স্থায়ীভাবে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হবে না’ মর্মে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। আদালত ওই সব ব্লগ ও ব্লগারের বিষয় অনুসন্ধান করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিটিআরসি, র্যাব, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতি নির্দেশনা এবং রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পিটিশনে উল্লেখ করা ওয়েবসাইট ব্লগগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশও দিয়েছিলেন। আওয়ামী সরকার এ ব্যাপারে একবছরেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এখন উল্টো এদের রক্ষার্থে নানা রকম অপকৌশল আঁটছে। অন্য দিকে সরকার আলেম-ওলামা ও ধর্মবিশ্বাসীদের এ ব্যাপারে প্রতিবাদের জন্য হতাহত করছে। ঢিলের বিপরীতে গুলি ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে। স্বঘোষিত নাস্তিকের প্রতি ‘শহীদ’ খেতাব আরোপ করতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা একটুও ইতস্তত করছেন না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন