সিরাজুর রহমান
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ তখন জমে উঠেছে। ভারতবাসী প্রায়ই দেশের সর্বত্র জনসভা করছে, অগ্নিঝরা ভাষায় বিদ্রোহের বাণী ছড়াচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসকেরা স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন। সুতরাং ক্ষেত্রবিশেষে সেসব সিদ্ধান্ত ভিন্ন হতো প্রায়ই।
পাঞ্জাবে পুলিশ-প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিন্যান্ড ডায়ার। গণজাগরণের আশঙ্কায় তিনি প্রদেশের সর্বত্র সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেলেন, ১৫ থেকে ২০ হাজার লোকের এক জনসভা অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন ডায়ার। ভারতবাসীর অবাধ্যতার শিখা বরাবরের মতো নিভিয়ে দিতে মনস্থ করলেন তিনি। একটি মেশিনগান এবং ৫০ জন রাইফেলধারী নিয়ে তিনি স্বয়ং জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজির হলেন। প্রথমেই তিনি পার্কের ফটক বন্ধ করে জনতার পালানোর পথ বন্ধ করে দিলেন। তারপর নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন।
এক বিবরণে বলা হয়েছিল যে, ১০ মিনিট ধরে অবিরাম গুলিবর্ষণ চলে। অন্য এক বিবরণ অনুযায়ী তাদের দেয়া বুলেট নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত সিপাহিরা অবিরাম গুলি চালিয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকারি বিবরণ অনুযায়ী ৩৭৯ জন নিহত এবং আনুমানিক ১১০০ জন আহত হন। অন্য দিকে ভারতীয় কংগ্রেসের বিবরণে বলা হয়েছে যে, নিহত হয়েছেন এক হাজার এবং আহত হয়েছেন ১১০০ জন।
এই নৃশংস হত্যায় ভারতবর্ষজুড়ে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তখন যোগাযোগব্যবস্থা বর্তমানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। তা সত্ত্বেও এবং বিলম্বে হলেও বিশ্বমিডিয়ায় এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রকাশিত হয়। বিশ্বসমাজে ব্রিটিশের বহু সমালোচনা হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার ডায়ারকে বাধ্যতামূলক অবসরে বিলেতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে সাবেক ঔপনিবেশিকদের মধ্যে তিনি খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ও দিকে ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে আন্দোলন দমনে মিনিমাম ফোর্স ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে ব্রিটিশ এবং ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা একমত যে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতবাসীর হৃদয়ে এখনো জাগরূক। ভারতীয় ঐতিহাসিকেরা সে স্মৃতি তাদের ভুলতে দেননি। বর্তমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গত মাসে ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে গিয়েছিলেন। তিনি শিখ রীতি অনুযায়ী হলুদ পাগড়ি পরে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে শ্রদ্ধা জানান এবং তারপরে যান জালিয়ানওয়ালাবাগে। তিনি স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পার্ঘ্য দেন এবং ১৯১৯ সালের সে ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু শিখ নেতারা তাকে বলে দেন যে, ব্রিটিশ সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই তাদের গ্রহণযোগ্য হবে না। ডেভিট ক্যামেরনের এই ভারত সফরে বিশেষ কিছুই ফল লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না।
ইতিহাস কেন, কোনো কিছুর জন্যেই ধৈর্য ধরার অবকাশ বাংলাদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিকের নেই, বিশেষ করে আওয়ামী লীগদলীয় রাজনীতিকদের। তারা হিসাবে ভুল করেন, ভুল হিসাব অনুযায়ী ছক তৈরি করেন এবং সে ছক অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন। এ দলের নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বেপরোয়া লম্ফনে সবার অগ্রে আছেন। গদি লাভের জন্য কোনো অঙ্গীকার দিতেই তার আপত্তি নেই। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও বহু অঙ্গীকার তিনি দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল ১০ টাকা কেজি দরে চালপ্রাপ্তি, দ্রব্যমূল্য সামালে আনা, কৃষকদের বিনামূল্যে সার সরবরাহ করা, রাতারাতি বিদ্যুৎ ঘাটতির সমাধান, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদ ও সম্পত্তির বিবরণ নিয়মিত প্রকাশ করা, প্রথম মেয়াদেই পদ্মার ওপর বহুমুখী সেতু নির্মাণ এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
শেখ হাসিনার সরকার কোন কোন অঙ্গীকার পূরণ করেছে এই তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখতে পাঠকদের অনুরোধ করছি। শেষ দু’টি অঙ্গীকার পূরণের চেষ্টা তারা করেছে কিন্তু তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অসাধুতা উভয় ক্ষেত্রেই সঙ্কট সৃষ্টি করে। চুরি ও দুর্নীতি পদ্ম সেতু নির্মাণে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংক তবু টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগে তারা দুর্নীতির দায়ে প্রধান অভিযুক্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিচার দাবি করে। যত দূর জানা যায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আপসবিহীন আপত্তির কারণে আবুল হোসেনের বিচারে সরকার বিমুখ। অতএব বিশ্বব্যাংকও টাকা দেবে না। অন্য কোনো উৎস থেকেও অর্থায়ন পাওয়া যাচ্ছে না। এখন জনসাধারণকে আবারো প্রতারণা করার উদ্যোগ চলছে। নদী-শাসনের নামে কিছু মাটি কাটাকাটি করে ভোটদাতাদের বোকা বানানোর চেষ্টা হবে, বলা হবে পরের বার গদি পেলে তারা সেতু তৈরি করবে।
এ বিচার কেন সঠিক সুবিচার নয়
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশের মানুষ নীতিগতভাবে খুশি হতে পারত; কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য যুদ্ধাপরাধী বলে শনাক্ত করা ১৯৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মতিতে ভারত আগেই পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দিলো। তারপর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের জন্যও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন তিনি। এরপর শেখ হাসিনা নিজে জামায়াতে ইসলামীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৮৬ সালের ১৯ এপ্রিল বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দল স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের সাজানো সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মাত্র দু’দিন পরে জামায়াতের সাথে গোপন সমঝোতা করে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ৬ মে ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে অংশ নেবে।
পরবর্তী ষড়যন্ত্র আরো সাংঘাতিক। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে জামায়াতকে সাথে নিয়ে শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে লাগাতার হরতাল ও সন্ত্রাস শুরু করেন। আজ যাদের বিচার করে শেখ হাসিনা ফাঁসি দিতে চান ১৯৯৬ সালে তাদের পাশে বসে তিনি ষড়যন্ত্র করেছেন, আন্দোলনের কলাকৌশল এঁটেছেন। মাওলানা নিজামী তখন তার প্রধান রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। দেশের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দ্রুত সংবিধান সংশোধন (ত্রয়োদশ সংশোধনী) করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করেন। জুন মাসের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেত্রী জামায়াত নেতাদের দোয়া নিয়ে আসেন। নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াতের অল্প কয়েকজন সংসদ সদস্যের সমর্থন সরকার গঠন করতে পরোক্ষভাবে হলেও সাহায্য করেছে।
এত কিছুর এবং ৪২ বছর পরে শেখ হাসিনা আবার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন। কিন্তু বহু কারণে এ বিচারের প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। প্রথমত, একাত্তরে যারা বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছেন (তারা তখন পাকস্তিানি নাগরিক ছিলেন, তাদের অজুহাত ছিল যে তারা পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছিলেন) তাদের অনেকে পরে আওয়ামী লীগেও ঢুকে পড়েছেন। তাদের কেউ কেউ এখন আবার প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়। বর্তমান সরকার তাদের বিচারপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করেনি, শুধু যারা জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপিতে ছিলেন তাদেরই অভিযুক্ত করে বিচারে তোলা হয়েছে কারোই আর সন্দেহ রইল না যে, এই বিচার-বিচার খেলা একটা রাজনৈতিক চাল ছাড়া আর কিছু নয়।
একাত্তরের রাজাকারেরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গেছে, বহু পরে হাত-পা বাঁধা তাদের কঙ্কালগুলো কোথাও নদী কিংবা জলাভূমিতে পাওয়া গেছে। ২০০৮-২০১৩ সময়ে বহু রাজনৈতিক কর্মীর লাশ ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নদীতে কিংবা জলাভূমিতে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী, রাজধানীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলম, সাভারে র্যাব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দু’জন ছাত্রকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের এবং অন্য আরো বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। একাত্তরের রাজকারদের যদি বিচার করতে হয় তাহলে এ যুগের রাজাকার বর্তমান সরকারের দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও মহিউদ্দীন খান আলমগীরের বিচার অবশ্যই হতে হবে।
ন্যায় বিচার সরকারের বন্ধু নয়
ট্রাইব্যুনালের বিচারের গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কেই বিশ্বসমাজ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। যেভাবে তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছেÑ দেশী ও বিদেশী আইন বিশেষজ্ঞরা সেটাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিমত দিয়েছেন। বিদেশী আইনজ্ঞ, এমনকি পর্যবেক্ষকদেরও ট্রাইব্যুনালে আসতে দেয়া হচ্ছে না, অথচ ট্রাইব্যুনালের প্রথম প্রধান বিচারপতি মামলা পরিচালনার কলাকৌশল ইত্যাদি নিয়ে ব্রাসেলসে অবস্থিত এক ব্যক্তির সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা ও পরামর্শ করেছেন। এমনকি ওই বিচারপতি সে ব্যক্তিকে এ আভাসও দিয়েছেন যে, সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী অভিযুক্তদের ফাঁসি দেয়া হলে পুরস্কার হিসেবে তার পদোন্নতিরও আশা আছে।
বিচারের আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা অনর্গল ঘোষণা করেছেন যে, অভিযুক্তদের সবার ফাঁসি হবে। তাদের কেউ কেউ আগাম বলে দিয়েছিলেন সেসব ফাঁসির রায় কোন তারিখের মধ্যে দেয়া হবে। অর্থাৎ বিচারকদের আগাম নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল সরকার, তা সত্ত্বেও সরকারের গঠন করা ট্রাইব্যুনাল, তাদের প্রসিকিউটর আর তাদের নিযুক্ত বিচারক যখন কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন তখন সরকারের প্রতিক্রিয়া উন্মাদ আচরণের মতোই মনে হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের কিছু ক্যাডার, বহু ভারতীয় এজেন্ট এবং কিছুসংখ্যক ধর্মদ্রোহী, ইসলামবিদ্বেষী ও নাস্তিকদের দিয়ে শাহবাগের মোড়ে একটা তাণ্ডব সৃষ্টি করে। তারা ফাঁসি চাই, জবাই করো ইত্যাদি সেøাগান তোলে, শিশুদের কপালে আর গালে সেসব সেøাগান লিখে দেয়। কারো মনেই কোনো সন্দেহ রইল না যে, বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই শাহবাগ সার্কাসের উদ্দেশ্য ছিল। চাপের মুখে বিচারকদের সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী রায় দিতে বাধ্য করা যে সত্যিকারের সুবিচার নয়, ন্যায় ও বিবেকের দৃষ্টিতে তার কোনো মূল্য নেই, সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না।
আইন ও সুবিচার সম্পর্কে এই হচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোভাব। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সরকার কোনো কোনো বিচারক সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিল না। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গজারি কাঠের লাঠিধারীদের মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট প্রদণি করেন। স্পষ্টতই বিচারকদের ভয় দেখানো, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই ছিল উদ্দেশ্য। বর্তমান দফায় গদি পেয়ে এ সরকার গোটা বিচারব্যবস্থাকে দলীয়করণ করে, কট্টর আওয়ামী লীগপন্থী বিচারকদের দিয়ে আদালত ভর্তি করে ফেলে। তার পরেও ট্রাইব্যুনালের ব্যাপারে সরকারের কাণ্ডকারখানায় তাদের বিচার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আস্থা সম্পূর্ণ উঠে গেছে। শাহবাগের তামাশা আর গজারি কাঠের লাঠির মিছিল মূলত একই বস্তু।
সে জন্যই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল যখন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। সে দিন ও পরে জামায়াতের দু’দিনের হরতালে অসংখ্য মানুষ পথে বেরিয়ে এসেছিল। এদের সবাই অবশ্যই জামায়াতের সদস্য কিংবা সমর্থক নয়। চার বছর ধরে সরকারের অত্যাচার ও নির্যাতন দেশের মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সবাই এখন জামায়াতের সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। অত্যাচারের বাড়াবাড়ি করে সরকার এখন গোটা বাংলাদেশকেই জামায়াতি করে দিয়েছে।
এই হত্যা যুদ্ধাপরাধ
বৃহস্পতিবারের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ এবং রবি ও সোমবারের হরতালে পুলিশের গুলিতে নিহতদের সংখ্যা এক শ’ ছাড়িয়ে গেছে। স্পষ্টত এবং বাহ্যতই অনেক নিরীহ ব্যক্তি, এমনকি নারী ও শিশুও আছে নিহতদের মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, অবশ্যই তারা জামায়াতের সমর্থক কিংবা জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন নন। কিন্তু গত সোমবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা পুলিশের বাড়াবাড়িতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বাড়াবাড়ি করার কারণে সাধারণ মানুষ জীবন দিচ্ছে। পুলিশ কিছু সময় এমন কাজ করে যা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। যেকোনো মানুষের হত্যা মানেই শোচনীয়, ঘৃণ্য। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেকোনো মানুষ মারা গেলেই আমরা দুঃখ পাই। জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা দমনে পুলিশ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে যেভাবে গুলি করছে তা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ কী? মাত্র কিছুকাল আগে রাজধানীর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ তার বানিহীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘শিবির দেখলেই গুলি করবা।’ অথচ তিনি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যত্র বলেছেন কাউকে জামায়াত কিংবা শিবির বলে শনাক্ত করা সহজ নয়। অর্থাৎ পুলিশ না চিনে না জেনে গুলি করছে, মানুষ মারছে। এবং তাদের নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা তারও ওপরের কোনো শক্তিধর ব্যক্তি। এই নির্দেশ ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের গুলিবর্ষণের নির্দেশের সমতুল্য অমানবিক অপরাধ। ইতিহাসের রায়ে ডায়ারের বর্বরোচিত নির্দেশের ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে যেমন নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে তাতে এই সরকারের পতনও ত্বরান্বিত সুনিশ্চিত হবে।
একাত্তরে রাজাকার ও আল বদররা যাদের হত্যা করেছে তারা আমাদের অতি প্রিয় ছিলেন। তাদের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে। নীতির দিক থেকে সেসব হত্যার বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত। বিগত চার বছরে আওয়ামী সরকারের রাজাকার ও আল বদরের হাতে অথবা তাদের নির্দেশে যারা খুন হয়েছেন, গুম হয়েছেন, তারাও সমানই আমাদের প্রিয়, তাদের জন্যও আমাদের প্রাণ কাঁদে। রাজনীতির যুদ্ধে এদের ঘাতকেরাও সমানই যুদ্ধাপরাধী। এই ঘাতকদেরও বিচার অব্যশই হতে হবে, অন্যথায় যুদ্ধাপরাধের বিচার ফাঁকা প্রহসনে পরিণত হবে।
(লন্ডন, ০৫.০৩.১৩)
serejurrahman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন