গত ৫ মার্চ জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম প্রধান শিরোনাম ছিল ‘সংসদে মহাজোট এমপি : রাসূল সা: ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন’। সংবাদের বিবরণে বলা হয়, জাতীয় সংসদের গতকালের অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কথিত বামপন্থী নেতা ও জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, রাসূল সা: যখন মক্কায় ছিলেন তখন তিনি ছিলেন ধর্মপ্রচারক। রাসূল সা: মদিনায় গিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি মদিনা সনদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যারা মদিনা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন, তাদের মদিনা থেকে চলে যেতে বলেছেন।’
মোহাম্মদের উম্মাহর বিরোধিতার জন্য রাসূল বনু কুরাইজার ৬০০ লোকের কল্লা কেটে দিয়েছেন। রাসূল যদি ৬০০ বিদ্রোহীর বিচার করতে পারেন, তবে আমি কেন আমার বাবা-মা, ভাই-বোন হত্যার বিচার করতে পারব না? তাহলে আমরা কেন বাঙালি উম্মতের বিরোধিতাকারীদের বিচার করতে পারব না?
‘… রাসূলের কিতাব খুলে দেখেন, আমি যা বলেছি তার ব্যতিক্রম কিছু হলে আমাকে প্রস্তরাঘাত করতে পারবেন।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান বলেন, হজরত মুহাম্মদ সা: ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। মইন উদ্দীন খান বাদলের বক্তব্যেও এ বিষয়টি বোঝা গেছে।’ Ñদৈনিক আমার দেশ ও অন্যান্য পত্রিকা ৫ মার্চ ‘১৩।
ইসলামধর্মের যিনি প্রচারক ও প্রবর্তক, তিনি কি না ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, এমন আজগুবি কথা কোন সুস্থ মানুষ বলতে পারে বলে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যেহেতু খবরটি অনেক জাতীয় সংবাদপত্রে একযোগে শিরোনাম হয়ে ছাপা হয়েছে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই বাংলাদেশের সংসদে বক্তব্যটি সরকারদলীয় দুই এমপির মুখে উচ্চারিত হয়েছে, সেহেতু বিষয়টিকে শুধু নিন্দনীয় বলে উড়িয়ে দেয়ার বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণেই ইসলামি মহল থেকে এর বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ উঠেছে।
আমাদের মতে, রাসূল সা:কে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আখ্যা দেয়া ছাড়াও পত্রিকায় প্রকাশিত দুই এমপির বাকি কথাগুলোও আপত্তিকর ও ভ্রান্তির ছলাকলার মিশেল। বাদল সাহেবের প্রথম কথা ‘রাসূল মক্কায় যখন ছিলেন তখন ছিলেন ধর্মপ্রচারক’। এ বক্তব্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বা তা শ্রোতা ও পাঠকদের মনে এই বার্তাটি পৌঁছে দেয় যে, মদিনায় গিয়ে রাসূল সা: আর ধর্মের ধার ধারেননি, বরং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, মদিনা সনদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারীদের মদিনা থেকে বহিষ্কার করেছেন; বিশেষ করে ‘মুহাম্মদের উম্মাহর’ বিরোধিতার জন্য রাসূল সা: বনু কুরাইজার ৬০০ লোকের কল্লা কেটেছেন।
এই সংক্ষিপ্ত ও অসত্য বক্ত্যব্যটি যখন সাধারণ শিক্ষিত সমাজ ও নতুন প্রজন্ম শুনবে, পড়বে ও চর্চা করবে, তখন রাসূল সা: ও ইসলামের ব্যাপারে তাদের জ্ঞান ও চিন্তা কতখানি বিষাক্ত হতে পারে, তার সঠিক আন্দাজ করেই এই বাম নেতা ইতিহাস বিকৃতির জঘন্য কর্মটি সম্পাদন করেছেন।
তাদের প্রতিটি আপত্তিকর উক্তির দালিলিক জবাব দেয়ার সুযোগ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে নেই। তাই অতি সংক্ষেপে বলতে চাই, মক্কায় নবীজী সা: ইসলামের আকিদা বিশ্বাসের প্রচার ও অনুসারীদের নৈতিক চরিত্র গঠন করে যে ভিত্তিভূমি রচনা করেন, তার ওপরই মদিনায় গিয়ে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। রাসূল সা:-এর মক্কার ১৩ ও মদিনার ১০ বছর, মোট ২৩ বছরের কর্মজীবনই আল ইসলাম। যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি একাকার। কাজেই ইতিহাস সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা নিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে ‘রাসূল সা: ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন’ বলে কোটি কোটি মুসলমানের অনুভূতিকে বিক্ষত করার জবাব তাদের অবশ্যই দিতে হবে।
রাসূল সা: মদিনায় বসবাসরত অন্যান্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীকে মদিনা সনদের আওতায় নিয়ে আদর্শ নগর রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। বাদল সাহেব বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে শুধু বললেন, ‘রাসূল মদিনা সনদ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যারা মদিনা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন, তাদের মদিনা থেকে চলে যেতে বলেছেন।’ এতে তিনি মদিনার বনু নযির গোত্রকে খায়বারে বহিষ্কার করার কথাই বুঝিয়েছেন এবং রাষ্ট্র্রের বিরোধিতাকে এর কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। অথচ এর কারণ নিছক মদিনা রাষ্ট্রের বিরোধিতা ছিল না, বরং তা ছিল চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও রাষ্ট্রপ্রধান মহানবী সা:কে হত্যার জঘন্যতম ষড়যন্ত্র। তার মানে, এখানেও প্রকৃত সত্যকে আড়ালে রেখে প্রকারান্তরে রাসূল সা:-এর পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আর নিজেকে একেবারে সাধুসজ্জন হিসেবে তুলে ধরে বলছেন, তিনি কি না প্রস্তরাঘাত খেতে প্রস্তুত আছেন।
তা ছাড়া বর্তমান বাংলাদেশে তাদের সরকার যখন জঘন্যতম গণহত্যার উন্মত্ততায় বেসামাল, তখন রাসূল সা:-এর জীবন থেকে এই কল্পিত দলিল খাড়া করে প্রভুর মনোরঞ্জনে ইতিহাস জ্ঞানের বাহাদুরি দেখাচ্ছেন। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের অসত্য বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার তাগিদে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, এত সংক্ষিপ্ত কলামে বনু নযির ও বনু কুরাইজার ব্যাপারে রাসূল সা:-এর গৃহীত পদক্ষেপের বর্ণনা দেয়া বিরাট এক নদীকে একটি ছোট্ট লোটায় ঢুকানোর মতোই দুঃসাধ্য চেষ্টা।
বনু নযির ও বনু কুরাইজা ছিল মদিনার দুই বৃহৎ ইহুদি গোত্র। মদিনা সনদ মূলে মুসলমানদের সাথে তাদের চুক্তি ছিল মদিনা রাষ্ট্রের জাতীয় সংহতি, নিরাপত্তা ও অনাক্রমণের। চতুর্থ হিজরিতে মদিনার বাইরের নজদ এলাকার বনু আমের গোত্রের আবু বারা আসেন মদিনায়। রাসূল সা: ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন তাকে। তিনি সে আহ্বান গ্রহণ বা বর্জন না করে বললেন, বরং আপনি একটি ধর্মপ্রচারক দল প্রেরণ করেন নজদ এলাকায়। দেখুন, মানুষ তা কতখানি গ্রহণ করে। ধর্মপ্রচারকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলেন আবু বারা। রাসূল সা: ৪০ জন বাছাই করা সাহাবির একটি শিক্ষকদল প্রেরণ করলেন নজদ এলাকার গোত্রগুলোর উদ্দেশ্যে। ‘বীরে মাউনা’ নামক স্থানে পৌঁছে দলপ্রধান হারাম ইবনে মিলহান রদ. প্রথমে কট্টর ইসলামবিদ্বেষী আমের ইবনে তুফায়লের কাছে রাসূল সা:-এর পত্রখানি হস্তান্তর করেন। আমের পত্রখানির প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে পত্রবাহক মিলহানকে হত্যা করেন। তারপর অন্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে বনু আমেরের সাহায্য চান। কিন্তু আবু বারা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিধায় বনু আমেরের লোকেরা ইবনে তুফাইলের ডাকে সাড়া দেন নি। পরে বনু সুলাইম গোত্রের সাহায্য নিয়ে শিক্ষক সাহাবী প্রতিনিধিদলের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় একটু দূরে থাকায় প্রতিনিধিদলের এক ব্যক্তি প্রাণে রক্ষা পান। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে তিনি মদিনার উদ্দেশে রওনা হতে সক্ষম হন।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় রাসূল সা: এতখানি মর্মাহত হয়েছিলেন যে, ৪০ দিন পর্যন্ত ফজরের নামাজে, কাফেরদের জন্য অভিশাপ কামনা করে ‘কুনুতে নাযেলা’ পাঠ করেন। আমর ইবনে উমাইয়া রদ মদিনায় ফেরার পথে দু’জন লোকের সাক্ষাৎ পান। জানতে পারলেন, তারা বনু আমের গোত্রের লোক। আমর ইবনে উমাইয়ার ধারণা ছিল, তার অনুপস্থিতিতে বনু আমেরের লোকেরাই তার ২৯ জন সাথীকে হত্যা করেছে। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। তারা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে দু’জনকে হত্যা করে রাসূল সা:-এর দরবারে গিয়ে পুরো বিষয়টি জানালেন।
হজরত আফসোস করে বললেন, আমর তো বড় ঝামেলাই বাধাল। এখন এই দু’জনের হত্যার মুক্তিপণ পরিশোধ করতে হবে। তবে এত টাকা পাবো কোথায়? প্রতিবেশী ইহুদি গোত্র বনু নযিরের কাছে এ বিষয়ে কিছু সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। তারা সম্মত হলে রাসূল সা: আবু বকর, উমর ও আলী রহ -কে সাথে নিয়ে বনু নযিরের মহল্লায় গেলেন। রোদ তেতে উঠলে একটি বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে তারা বসলেন। এরই মধ্যে তাদের মাথায় চাপল মারাত্মক ইহুদি বুদ্ধি। যে বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে নবীজী বসেছেন, সেখানে আপ্যায়নের ব্যবস্থা হবে আর ছাদের ওপর থেকে একটি বিরাট পাথর গড়িয়ে তার মাথার ওপর ফেলা হবে। ঠিক হলো, উমর ইবনে জাহাশ ইবনে কাব এ কাজটি সন্তর্পণে আঞ্জাম দেবে।
হঠাৎ নবীজী তিন সাহাবীর মাঝখান থেকে উঠে গেলেন। ওহিযোগে তাকে জানানো হয় ইহুদিদের জঘন্য ষড়যন্ত্রের কথা। তিনি কোথায় গেলেন, তিন সাহাবি টেরই পেলেন না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তিনি মদিনায়। শুরু হলো বনু নযিরের বিরুদ্ধে হজরতের যুদ্ধ প্রস্তুতি। বনু নযির করজোড়ে বলল, আমরা বুঝতে পেরেছি। শুধু দয়া করুন, আমাদের পরিবার-পরিজন আর বাহনবোঝাই মালামাল নিয়ে দেশান্তরে চলে যাওয়ার সুযোগ চাই। বাকি সম্পদ আপনার। কুরআন মজিদের পুরো সূরা হাশর নাযিল হয় এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে।
এতবড় ঐতিহাসিক ঘটনা ও বিশ্বাসঘাতকতার ছিটেফোঁটাও উল্লেখ না করে রাসূল সা: নিছক বিরুদ্ধ মত পোষণের কারণে মদিনা থেকে বিরোধীদের বের করে দিয়েছিলেন বলে দাবি করে বাংলাদেশের সংসদে বক্তব্য দেয়া আর বিরোধী মতের লোকদের ওপর দমন-পীড়নের পক্ষে মিথ্যা ব্যাখ্যা সাজানো ইসলামের ইতিহাসের প্রতি নিশ্চয়ই ক্ষমাহীন অপরাধ। আমরা এর প্রতিকার চাই।
অনুরূপ ‘মুহাম্মদের উম্মাহর’ বিরোধিতার জন্য রাসূল সা: বনু কুরাইজার ৬০০ লোকের কল্লা কেটে দিয়েছেন বলে বাদল সাহেব যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পেছনের মানসিকতা আরো স্পষ্ট। কারণ, এখানেও মূল বিষয় নিছক বিরোধিতা বা বিদ্রোহী তৎপরতা ছিল না; বরং তা ছিল জাতীয় অস্তিত্বের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ও চরম বিশ্বাসঘাতকতা।
ঘটনার সারসংক্ষেপ: পঞ্চম হিজরিতে একদল ইহুদি নেতা মক্কায় কুরাইশদের গিয়ে বললেন, উহুদ যুদ্ধে মার খাওয়া মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার এখনই সময়। আপনারা নেতৃত্ব দেন, গোটা আরব আপনাদের পেছনে আছে। বনু গাতফানের কাছে গিয়েও একই প্রস্তাব দিলেন। দেখতে দেখতে এক বিশাল বাহিনী রণউন্মাদনায় মেতে উঠল। রাসূল সা: খবর পেয়ে দেশ প্রতিরক্ষায় অন্য রকম প্রস্তুতি নিলেন। সালমান ফারসি রহ- এর পরামর্শে মদিনার চারপাশে খনন করা হলো খন্দক বা পরিখা। দীর্ঘ এক মাসে খনন কাজ শেষ হলে দেখা গেল, কুরাইশ ও গাতফানের নেতৃত্বে ১০ হাজার সৈন্যের বিশাল শত্রু বাহিনী হাজির। কমসংখ্যক মুসলমানের সতর্ক পাহারার ফলে পরিখা পার হয়ে মদিনা আক্রমণের শত্রুবাহিনীর একের পর এক চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এরই ফাঁকে বনু নযিরের নির্বাসিত যুদ্ধবাজ নেতা পরিকল্পনা করেন, মদিনার ভেতর থেকে আঘাত করতে হবে। তাহলেই মুসলমানদের প্রতিরক্ষাব্যূহ ধসে পড়বে। তিনি বনু কুরাইজার গোত্র প্রধান কাব ইবনে আসাদের দ্বারস্থ হলেন। কাব তাকে দুর্গে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। বললেন, মুহাম্মদ সা:-এর কাছ থেকে বিশ্বস্ততার পরিপন্থী কোনো আচরণ পাইনি আর তুমি বিপর্যয়ের সওদা নিয়ে এসেছ। কিন্তু হুয়াই নাছোড়বান্দা, শেষ পর্যন্ত তিনি কাবের বাড়িতে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং তাকে জানান, মুহাম্মদকে দলিত মথিত নিশ্চিহ্ন করার জন্য ১০ হাজার সৈন্যের বিরাট বাহিনী চার দিক থেকে ঘেরাও করেছে। ভেতর থেকে তোমার সামান্য সাহায্য পেলেই ইসলাম ও মুসলমান বলতে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। কাব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন এবং ঘোষণা দিলেন : হ্যাঁ, এখন থেকে মুসলমানদের সাথে আমাদের কোনো চুক্তির অস্তিত্ব নেই।
চরম ভীতিকর পরিস্থিতি দেখা দিলো তখন মদিনার আকাশে। নারী শিশুদের মধ্যে শোনা যাচ্ছিল কান্নাধ্বনি। চার দিকে অমানিশার ঘনঘটা। যেকোনো সময় পেছন থেকে বনু কুরাইজার আক্রমণ আর পরিখা ডিঙিয়ে কুরাইশ ও গাতফানের চতুর্মুখী আক্রমণের বুক দুরুদুরু আতঙ্ক।
এহেন পরিস্থিতিতে গাতফান গোত্রের নাঈম ইবনে মাসউদ রহ:-যার ইসলাম গ্রহণের কথা তখন পর্যন্ত কেউ জানত না, হজরত সা:-এর এজাজত নিয়ে এক কূটনৈতিক মিশন চালান, যার ফলে কাফেরদের ঐক্য তছনছ হয়ে যায়। বনু কুরাইজা যুদ্ধে সহযোগিতা দেয়ার জন্য শর্ত দেয় কুরাইশ ও গাতফানের নেতৃস্থানীয় লোকদের জিম্মি হিসেবে তাদের কাছে রাখতে হবে। তা কি হয়! এরই মধ্যে নেমে আসে আসমানি সাহায্য। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় শত্রু বাহিনী। দীর্ঘ এক মাসের অবরোধে কুরাইশ বাহিনী ব্যর্থতা ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে রাতের আঁধারেই মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু শেষ হয়েও শেষ হয়নি এ যুদ্ধ। আল্লাহ পাকের নির্দেশ আসে, এখনই বনু কুরাইজার দফা রফা করতে হবে। বনু কুরাইজাকে অবরোধ করে রাখা হয় ২৬ দিন।
ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকে বনু নযিরের মিত্র ছিল খাজরাজ গোত্র আর বনু কুরাইজার মিত্র ছিল আউস গোত্র। খাজরাজ ও আউস গোত্র ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে আগের মৈত্রীর রেশ থেকে যায়। ফলে সাব্যস্ত হয় যে, বনু কুরাইজা আত্মসমর্পন করলে আউস গোত্রের সাদ ইবনে মুয়ায রাহ: তাদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তির ব্যাপারে যে ফয়সালা দেবেন, সেটিই সবাই মেনে নেবে।
হজরত সাদ ছিলেন খন্দক যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত। বনি কুরাইজার ঘটনার মাত্র কয়েক দিন পরেই তিনি সেই জখমে ইন্তেকাল করেন। তিনি দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে বনু কুরাইজার চরম বিশ্বাস ঘাতকতার দায়ে ফায়সালা দেন, বনু কুরাইজার প্রাপ্তবয়স্ক সব পুরুষকে শিরñেদ করা হোক। এর সমর্থনে কুরআন এবং খন্দক যুদ্ধের মূল্যায়নে আল্লাহ পাক নাজিল করেন কুরআন মাজিদের সূরা আহজাব। এবার দেখুন, ইতিহাসের এই জঘন্য অধ্যায়টিকে বাদল সাহেব তার কথিত বাঙালি উম্মতের বিরোধিতাকারীদের ওপর প্রয়োগ করার কিভাবে কসরত দেখিয়েছেন।
ছাত্র জীবন থেকে আমি বামদের প্রতি এক ধরনের সম্মানবোধ পোষণ করি। বাম নাস্তিকদেরও দেখেছি, এরা সত্যনিষ্ঠ, স্বার্থ-বিত্তের প্রতি উদাসীন, বিশেষ করে জুলুম অবিচার ও পশ্চিমা সাম্র্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তবে কতক আদর্শচ্যুত বামকেও দেখা যায়, যারা জীবনভরের নীতিনিষ্ঠতাকে অর্থ ও পদের বেদিতে বলি দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত নন। মইন উদ্দীন খান বাদল নিজের অবস্থান নিজেই মূল্যায়ন করে দেখাতে পারেন। স্বাধীনতা-উত্তর জাসদের বিপ্লবী আন্দোলন ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান এ দেশের তরুণ প্রজন্মের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আওয়ামী নির্যাতন ও লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তখন পাখির মতো গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়েছিল হাজার হাজার জাসদ কর্র্মী। সেই জাসদের বর্তমান সভাপতি হালুয়া রুটির কাছে আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে সেবাদাসগিরির মঞ্চে যেভাবে করছেন, তা দেখে সেদিনের প্রাণ বিসর্জন দেয়া তরুণদের আত্মারা বিদ্রƒপের পাথর বর্ষণ করছে তার প্রতি। মিনায় জামারায় হাজীরা শয়তানকে যে পাথর ছোড়েন আমাদের মনের আঙ্গিনা থেকেও সেই পাথরকণা অহরহ উৎক্ষেপিত হচ্ছে নীতিভ্রষ্ট নবী নিন্দুকদের প্রতি।
হয়তো অজ্ঞতা বসতই তিনি রাসূল সা:-এর মিশন আর মদিনা ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাসকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছেন। মদিনা রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের চরম স্বৈরাচারী সরকারকে সমান্তরাল করার অসাধুতা দেখিয়েছেন। বাঙালি উম্মতের আজগুবি দাবি তুলে নিজের অজ্ঞতাই প্রকাশ করেছেন। তাকে এখন বলতে হবে তার বঙ্গালী নবী কে, ধর্মগ্রন্থ কোনটি বা সে ধর্মের নাম কী। শাহবাগে রঙ্গমঞ্চ সাজিয়ে আর পার্লামেন্টে ইসলামের বিরুদ্ধে যেভাবে কামান দাগাচ্ছে তার পরিণতি সম্পর্কে আমরা শঙ্কিত। মাননীয় স্পিকারের কাছে আমাদের জোর দাবি, ৪ মার্চ সংসদে দেয়া অজ্ঞতাপূর্ণ বক্তৃতা এক্সপাঞ্জ করতে হবে। রাসূল সা: ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে অসত্য বক্তব্য সংসদের কার্য বিবরণীতে রেকর্ড হয়ে থাকবে, তা এ দেশের মানুষ সহ্য করবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন