শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৩

তবে কি সঙ্ঘাত অনিবার্য?


গণতন্ত্রে মতা হস্তান্তরের একমাত্র ন্যায্য উপায় হলো নির্বাচন। এই নির্বাচন হতে হবে অবাধ-নিরপে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মতায় অধিষ্ঠিতরা বরাবর এই বাস্তবতা ভুলে যায়। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে তৎকালীন মতাসীন আওয়ামী লীগ বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল এবং এতে করে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন-আকাক্সা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও মতার গ্রহণযোগ্য হস্তান্তরপ্রক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক বিরোধ উত্থাপিত হয়েছিল। পরে নানা (জীবন ও সম্পদ) ত্যাগের বিনিময়ে মতা    হস্তান্তরের একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হলেও তা দেশের বিবদমান রাজনৈতিক পগুলোর সমঝোতার প্রেেিত ব্যবস্থাটি দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল। বর্তমান মহাজোটের সরকার মতায় এসেই এক-এগারোর জুজুর ভয় দেখিয়ে এবং আদালতের নির্দেশনার দোহাই দিয়ে ব্যবস্থাটি বাতিল করে সাংঘর্ষিক রাজনীতির যে পটভূমি তৈরি করেছিল, বর্তমানে সঙ্ঘাতময় রাজনীতির ভয়াবহতা সেই পটভূমিরই কিছুটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

গণতান্ত্রিক সমাজে যেকোনো ইস্যুতে মতপার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মতপার্থক্যের বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। গঠনমূলক বিতর্কের মাধ্যমে যেকোনো ইস্যুভিত্তিক মতপার্থক্য থেকে নির্যাস নিয়ে একটি গণ-ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আর এই বিতর্ক শুধু প্রতিপরে সাথেই নয়, বরং নিজ দলের মধ্যেও হওয়া জরুরি। এজন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীর, দলপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মীর নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে যে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হয় সেই বক্তব্যই অধস্তন এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে বাধ্য হন। শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো বক্তব্যের গঠনমূলক সমালোচনার অধিকারও তাদের থাকে না। এমনকি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলীয় ম্যান্ডেটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও সংসদে দলের গঠনমূলক সমালোচনার অধিকার পান না। তা ছাড়া শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ঘিরে থাকে স্তাবকের দল। তৈলমর্দনে যারা চ্যাম্পিয়ন। গণ-আকাক্সা-আকুতি সেই স্তাবকদের ভেদ করে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছাতে পারে না। ফলে প্রধান দুই দলের শীর্ষ দুই নেত্রীকে গণমানুষের মনোভাব বুঝতে ওই স্তাবকদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ কারণেই নিজ নিজ মতার মেয়াদ শেষে শীর্ষ নেতৃত্বকে কথিত নানা অপকর্মের ছুতোয় পরবর্তী শাসনামলে বিভিন্ন মাত্রায় আইন-আদালতের মুখোমুখি হতে হয়। আর তখন স্তাবকের দল লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
রাজনীতিতে প-বিপরে বিদ্যমানতা গণতন্ত্রের অলঙ্কার। এই অলঙ্কারবিহীন গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রেরই নামান্তর। রাজনীতির প-বিপরে মধ্যে যেকোনো মতভেদ দূর করতে সংলাপের আয়োজন গণতান্ত্রিক রীতি। বাংলাদেশেই যে কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন সংলাপের দাবি উচ্চারিত হয়, তা নয়। উন্নত-অনুন্নত সব গণতান্ত্রিক দেশেই মতভেদ দূর করতে সংলাপের আয়োজন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেই এ ধরনের সংলাপের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। এটা যেমন সত্য, তেমনি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে একদল গণতান্ত্রিক অনুভূতিপ্রবণ নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। যারা নিজেদের মতার চেয়ে জন-আকাক্সার প্রতি বেশি সংবেদনশীল। আমাদের সমাজে এই অনুভূতিসম্পন্ন নেতৃত্বের বড়ই অভাব। আর এ কারণেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আত্মসমালোচনার চেয়ে প্রতিপরে কঠোর সমালোচনায় অভ্যস্ত। যার ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরস্পরের গণতান্ত্রিক অনুভূতি তিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সেই সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পারস্পরিক সম্পর্কও ঝুঁকিতে পড়ছে। গণতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক জরুরি। যদিও সেই সম্পর্ক সুরায় কার্যকর কোনো নীতি কেউ অনুসরণ করে না। গত ১৮ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা সম্পর্কে যে অপ্রাসঙ্গিক কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, তা এই দুই শীর্ষ নেতৃত্বের সম্পর্ককে জমাট বাধা হিম শীতল বরফে পরিণত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতা ম্যাট্রিকুলেশন পরীায় কোন কোন বিষয়ে পাস করেছেন এবং কোন কোন বিষয়ে ফেল করেছেন তার বিবরণ একজন প্রধানমন্ত্রীর দেয়া মোটেই সমীচীন নয়। একটি বিশেষ বিষয়ে বিরোধী নেত্রীর পাসের দতা নিয়ে তিনি যে কটা করলেন তা-ও গ্রহণযোগ্য নয়। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য মোটেও প্রত্যাশিত নয়। বরং বিদ্যমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মানুষ তার কাছ থেকে দিকনির্দেশনামূলক দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করেছিল। কিন্তু হতাশার বিষয়, সেটা পাওয়া গেল না।  এর আগে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুব-উল আলম হানিফ বিরোধীদলীয় নেতাকে রক্তচোষা ডাইনি বলে অনর্থক কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। এক দিকে এ ধরনের তীব্র বিদ্রƒপাত্মক ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য অন্য দিকে সংলাপের আহ্বানে সাধারণ মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত। আসলে কোন্টা সত্য, সংলাপের আহ্বান না প্রতিহিংসাপরায়ণ বক্তব্য। আর এ ধরনের বক্তব্য যখন মাতসীনদের প থেকেই আসছে, তখন বিরোধী দলের প্রতি সংলাপের আহ্বান যে সরকারের এক ধরনের রাজনৈতিক তামাশা তা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। এমন একটি বাস্তবতায় সঙ্কট নিরসনে ব্যবসায়ী নেতাদের প থেকে দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতাদের এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এই সংলাপের সম্ভাবনা এবং ফলপ্রসূতা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। অতীতে এ ধরনের সংলাপ-সংলাপ নাটক একাধিকবার মঞ্চস্থ হলেও উভয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনড় অবস্থানের কারণে তা ভেস্তে গেছে। সেই সংলাপের দুই দুলের দুই কাণ্ডারি আবদুল মান্নান ভুঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের আবদুল জলিল এখন আর আমাদের মাঝে নেই। তবে সেই দিনের সংলাপের ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই যে এক-এগারোর পটভূমি তৈরি হয়েছিল- সেই শিা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিতে পারেননি বলেই আপাত প্রতীয়মান হচ্ছে। সুতরাং ব্যবসায়ী নেতারা নিশ্চয় সেই দিকটা গভীরভাবে ভেবে দেখবেন এবং শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে সংলাপ সফল করার প্রতিশ্র“তি আদায় করবেনÑ এমন প্রত্যাশাই জনগণের।
অবাধ নিরপে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন কর্তৃপ কে হবে তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে, তবে মতাসীনদের অধীনে যে স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে না তা নিয়ে জনমনে কোনো সন্দেহ নেই। জনগণের এই ঐকমত্যকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের যে গোঁ মতাসীনেরা ধরেছে, তার জন্য জনগণ এই সরকারকে ম্যান্ডেট দেয়নি। আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে পার পাওয়া সম্ভব নয়। আদালত আরো দুই টার্ম এমন ব্যবস্থার পে মতামত দেয়ার পরও তা সরকার কেন আমলে নিলো না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। আর এই ইস্যুতে বিরোধী দলের কঠোর কর্মসূচির কারণে জনগণের জানমালের যে য়তি হচ্ছে তার দায়ও সরকারকেই নিতে হবে। কেননা একটি মীমাংসিত ইস্যুতে এ ধরনের অহেতুক হস্তপে অবান্তর ও অযৌক্তিক। সালিশ মানি তালগাছটা আমারÑ এ অবস্থান থেকে সরকারের সরে আসা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় সঙ্কট বাড়বে, সহিংসতা বাড়বে। একটি সরকারকে জনগণ নির্বাচিত করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নতি করতে। জনগণের জানমালকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে নয় এবং বিরোধী পকে নিপীড়ন-নির্যাতন করতে নয়। অথচ এ সরকার কথাই বলছে বন্দুকের ট্রিগারে হাত দিয়ে। বিগত কয়েক সপ্তাহে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রায় ১৭০ জন মানুষকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। প্রধান বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে বানচাল করে দিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় খালেদা জিয়া যখন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গণহত্যার কারণে ভবিষ্যতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেনÑ তখন ল্যভ্রষ্ট বাম রাজনীতিক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু খালেদা জিয়াকে অতীত অপকর্মের জন্য মামলা মোকাবেলার হুমকি দিয়েছেন। এসব কিছু ল্যভ্রষ্ট বাম রাজনীতিকই যে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে রাজনীতিকে সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতি তাদের আস্থা নেই। কারণ, স্বচ্ছ নির্বাচন হলে এবং নৌকায় সওয়ার হতে না পারলে তাদের জামানত যে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে, তারা তা ভালোভাবেই জানেন। এসব বামের প্রভাবেই আগে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ হলেই সংলাপ হবে বলে সরকার কৌশল নিচ্ছে। ব্যাপারটা হলো বিএনপি-জামায়াতকে ত্যাগ করুক, আর মহাজোট নির্বাচনের মাঠে জামায়াতবিহীন বিএনপিকে ধরাশায়ী করুক। বিএনপি অবশ্য এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করুক বিএনপি জামায়াতের সাথে থাকবে না। কিন্তু নিবন্ধিত কোন্ দলের সাথে বিএনপি থাকবে না থাকবে, তা সরকার ঠিক করে দিতে পারে না। এটা একান্তই বিএনপির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। সুতরাং জন-আকাক্সিত সংলাপ প্রশ্নে মতাসীন এবং বিরোধীদের অবস্থান একেবারেই দুই মেরুতে এবং দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এমতাবস্থায় সংলাপের যেকোনো পদপে সাধুবাদ পেতে পারে, কিন্তু তার সফলতার সম্ভাবনা ক্রমেই ীণ হয়ে যাচ্ছে এবং সঙ্ঘাতের যে ত্রে প্রস্তুত হচ্ছে তা কাম্য নয়।
একটি তালাবদ্ধ গুমোট ঘরে বন্দী বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ। এই তালাবদ্ধ ঘরের চাবি আছে শুধু একজনেরই হাতে। তিনি আর কেউ নন,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তালা খুলে তালাবদ্ধ সেই ঘরে একটু অক্সিজেন প্রবেশের সুযোগ করে দেয়ার আকুতি গণমানুষের। আজকের প্রধানমন্ত্রী সেই জন-আকুতি আমলে নিয়ে বদ্ধ ঘরের তালা খুলে দেবেন- নাকি ঘরের কপাটটা আরো শক্ত করে আটকানোর ফন্দি করবেন, তা তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এমনটি হলে বদ্ধঘরের সমগ্র মানুষ তাদের জীবনের অধিকার আদায়ে সেই ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। এতে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র কোনো কিছুরই মঙ্গল হবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads