শাহবাগ মঞ্চকে কেন্দ্র করে এবার লক্ষ্য করা গেল পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব। শাহবাগীদের প্রতিরোধ ও তাদের বিচারের দাবিতে হেফাজতে ইসলাম এর ব্যানারে আলেম সমাজের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে শুক্রবার বাদ জুমা রাজপথে আন্দোলনে নেমে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের মাওলানা হাফেজ উবায়দুল্লাহ। সম্মানিত এই মাওলানার বড় ছেলে জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি হুসাইন আহমদ তফছির শাহবাগ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকারের প্রধান সহযোগী। হাফেজ উবায়দুল্লাহ তার ছেলের ইসলামবিদ্বেষী কর্মকান্ডে ভীষণ ক্ষুব্ধ। শুক্রবার বাদ জুমা হেফাজতে ইসলামের মিছিল শেষে আয়োজিত সমাবেশে তিনি শাহবাগের ধর্মবিদ্বেষী বগারদের বিরচদ্ধে বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি ধর্মবিদ্বেষীদের সহযোগিতা করার জন্য নিজ ছেলেকেও প্রতিরোধের ঘোষণা দেন। ছেলেকে সরাইলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
পিতা-পুত্রের সুসম্পর্কের বিষয়টিকে সব সমাজে, সব ধর্মেই বিশেষ গুরচত্ব দেয়া হয়েছে। পিতাকে ভক্তি করার, মান্য করার বিষয়টিও সমাজে স্বীকৃত। আর পিতাকে মান্য করতে গেলে তার উপদেশকেও মান্য করতে হয়। আলোচ্য ঘটনায় লক্ষ্য করা গেলো ভিন্ন চিত্র। পুত্র পিতার পক্ষে না চলে চলছে ভিন্ন পথে। পিতার পথ ইসলামের পথ, আর পুত্রের পথ তথাকথিত প্রগতির পথ। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বে চিত্রটি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেলো শাহবাগ মঞ্চে। পুত্র যোগ দিয়েছে বগার ইমরান এইচ সরকারের সাথে আর পিতা যোগ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের সাথে। একজন ইসলামে পথে অপরজন তথাকথিত প্রগতির পথে। আসলে দ্বন্দ্বের এই চিত্র এক পিতা পুত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশে হাজারো পিতা-পুত্রের মধ্যে এখন এমন দ্বন্দ্বের চিত্র লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এর কারণ কি? আজ কি পিতার পথে প্রগতি নেই, নেই মুক্তির বার্তা? না কি পুত্র পিতার পথ না বুঝে, না চিনেই ভিন্ন পথে যাত্রা শুরচ করেছে? আমাদের সমাজে এই প্রশ্নটি আজ বড় হয়ে উঠেছে। অনেকেই আজ প্রশ্ন করছেন। পিতা পুত্রের এই দ্বন্দ্ব কি বাস্তব ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, এই দ্বন্দ্ব কি একেবারেই অনিবার্য ছিল, নাকি কোনো বিভ্রান্তি কিংবা ষড়যন্ত্রের কারণে দ্বন্দ্বের এমন একটি রূপ আমাদের সমাজে বিনির্মিত হয়েছে? আমাদের সমাজে রাজনীতি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়, নির্বাচনে বিজয় লাভের লক্ষ্যে অনেক সংঘাত-সংঘর্ষ হয় কিন্তু পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের আসল কারণ উৎঘাটিত হয় না। ফলে মীমাংসার পথও হয় রহিত। তাই স্বাধীনতার ৪২ বছরেও এ বিষয়টি জাতির জন্য এক বড় ট্রাজেডি হয়ে রয়েছে।
আমাদের দেশে রাজনীতিকে বিশেষণ করলে কয়েকটি শব্দ বেরিয়ে আসে। বাঙালি, বাংলাদেশী, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলাম। জনগণের সামনে এই শব্দগুলো যে ব্যাখ্যা করা হয় এবং যেসব শোভন শব্দ উচ্চারণ করা হয়, তার সবগুলোই আমাদের ধর্ম ইসলাম ধারণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের বহু রাজনীতিবিদ জ্ঞান সীমাবদ্ধতার কারণে এবং ঈমানের দুর্বলতার কারণে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন না। আর যারা উপলব্ধি করতে পারেন তারাও ক্ষুদ্র স্বার্থের কারণে জ্ঞানপাপীর ভূমিকা অবলম্বন করে চলেছেন। তারা মনে করেন, সমাজে একটি দ্বান্দ্বিক অবস্থা বিরাজমান থাকলেই তাদের লাভ, ফলে জনগণ ঐক্য ও সংহতির আলোয় যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চেয়েছিলো তা আজো অর্জিত হতে পারেনি। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের রাজনীতি যেভাবে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে তাতে আমাদের সমাজ ক্রমেই মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। আমরা সবাই বাংলাদেশী, এটা আমাদের নাগরিকত্বের পরিচয়। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে কারোই এ পরিচয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। আর বাংলা মাতৃভাষা হওয়ার কারণে বাঙালি পরিচয়ে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যদি যার যার ধর্ম পালনের স্বাধিকার বোঝায়, তাতে দোষের কিছু লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যদি শুধুই ইহলৌকিকতা কিংবা ধর্মহীনতাকে বোঝানো হয় তাহলে তাতে অবশ্যই আপত্তি ঘোষণা করবে দেশের জনগণের ৯০ ভাগ মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা। নাস্তিক্যবাদকে অবলম্বন করে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতারণাপূর্ণ বুলির বদলে যদি সমাজতন্ত্র বলতে অর্থনৈতিক সুবিচারকে বোঝানো হয়, তাতেও এদেশের জনগণের তেমন কোনো আপত্তি থাকবে না। এতক্ষণ যেসব শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো, নানা বিভক্ত ঐসব শব্দাবলীর নির্যাসকে যদি একটি শব্দের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তাতে তো কারো আপত্তি থাকার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। এখন এই শব্দটি যদি ‘ইসলাম’ হয় তাহলেই বা আমরা আপত্তি করতে যাবো কেনো? বাংলাদেশে পিতা-পুত্রে দ্বন্দ্ব তথা শাহবাগ মঞ্চের ও হেফাজতে ইসলামের দ্বন্দ্বের রহস্যটা এখানেই সুপ্ত রয়েছে। মুসলমান অনেকেই আজ এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ যে ইসলাম অন্যান্য মতবাদের মতো কোনো মানবরচিত মতবাদ নয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, অঞ্চল, বর্ণ বা কোনো শ্রেণীর স্বার্থে কোনো মানুষ ইসলামী মতবাদ রচনা করেনি। যে স্রষ্টা আকাশমন্ডলী, পৃথিবী, প্রকৃতি ও অসংখ্য নেয়ামতরাজি মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তিনিই ইসলাম ধর্ম তথা ইসলামী মতবাদের রচয়িতা। এ মতবাদ প্রকৃতির মতোই স্বচ্ছ, সুন্দর ও ব্যাপক। মতবাদে সব মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও মুক্তি। কিন্তু আমরা তা অর্জন করতে পারিনি। এর কারণ আমাদের অজ্ঞতা এবং কায়েমী স্বার্থের প্রভুত্ব। এ মন্দ কারণগুলো দূর হলে পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের কারণও দূর হবে। বিষয়টি উপলব্ধি করলেই সব মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন