শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

ভারত আবারও আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় আনতে চায়



 পাঠকদের নিশ্চয়ই ভারতের বহুল প্রচারিত ও প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘আউটলুক’-এর নাম মনে পড়বে। অন্য অনেক কারণ বা উপলক্ষের কথা বাদ দিলেও ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রচয়ারি পিলখানা হত্যাকান্ডের সময় এবং পরবর্তী দিনগুলোতে এর ভূমিকা ছিল অসাধারণ। বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের সময় ‘আউটলুক’ই অনেক গোপন খবর ফাঁস করেছিল। ভারত যে বাংলাদেশকে তার ‘রাডার’-এর বাইরে যেতে দেবে না এবং সে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই যে পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যা করা হয়েছিল সে খবরও আমরা ‘আউটলুক’-এর বদৌলতেই জানতে পেরেছিলাম। এভাবে শুরচ করার কারণ হলো, সে ‘আউটলুক’ই সম্প্রতি এমন আরো একটি খবর প্রকাশ করেছে, যা দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীদের প্রচন্ডভাবে নাড়া তো দিয়েছেই, আতংকিতও করে তুলেছে। ম্যাগাজিনটির ‘দ্য মনসটার ব্রেথস এয়ার’ শিরোনামে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই আবারও ক্ষমতায় আনতে চায় এবং এ ব্যাপারে দেশটি তার কৌশল চূড়ান্ত করছে। রিপোর্টে ভারতের এই কৌশল ও উদ্দেশ্যের পাশাপাশি বিএনপি সম্পর্কে শুধু নয়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কেও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু তথ্য রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, জামায়াতকে মৌলবাদী দল বলা হলেও দলটি কখনো হিন্দুদের বিরচদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়ায়নি। ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলো যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের টার্গেট করে হত্যাকান্ড চালিয়ে থাকে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সে রকম কোনো রেকর্ড নেই। এখানেই জামায়াতের তাৎপর্য। বিগত কিছুদিনে বাংলাদেশে যে ৮৪ জন নিহত হয়েছে তাদের সবারই মৃত্যু ঘটেছে পুলিশের গুলীতে। গত ডিসেম্বরে ঢাকায় বিশ^জিতের হত্যার পেছনেও ছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াত বা ইসলামী অন্য কোনো দল নয়। ‘আউটলুক’ আরো লিখেছে, ভারতের মুসলমানদের মতো বাংলাদেশের হিন্দুরা ‘তলোয়ারের নিচে’ বসবাস করছে না। সুষমা স্বরাজ, স্মৃতি ইরানী. মিনাক্ষী লেখি ও নির্মলা সীতারমনের মতো ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেত্রীদের উদ্দেশে ‘আউটলুক’ লিখেছে, তাদের একথা শুনে খুশি হওয়া উচিত যে, ইসলামী মৌলবাদী দল বলা হলেও জামায়াতে ইসলামী দলের গঠনতনত্রে ৩৩ শতাংশ পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রেখেছে।
জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতের প্রভাব সম্পর্কেও বিশেষ ইঙ্গিতসহ কিছু তথ্যের উলে­খ করেছে ‘আউটলুক’। বলেছে, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৮০টি আসনে জয়ের জন্য জামায়াতের ভোট অত্যন্ত গুরচত্বপূর্ণ। যার অর্থ, প্রকৃতপক্ষে জামায়াতই এ ৮০টি আসনের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু জামায়াত বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র, আওয়ামী লীগের নয়। সে কারণে জামায়াতের ব্যাপারে ভারতের মনোভাব নেতিবাচক। ভারত চায়, জামায়াত যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৎপরতা চালাতে না পারে। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ভারত ‘সঙ্গে’ রাখতে চায়- যেমনটি দেশটি রেখেছিল লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে। ভারত চায়, যুক্তরাষ্ট্রও ইসলামপন্থী মৌলবাদী দল জামায়াতকে শত্রচ শিবিরে ঠেলে দিক এবং ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার দলগুলোর পক্ষে দাঁড়াক। অন্যদিকে জামায়াতের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও মনোভাব কিন্তু ভারতের মতো নয়। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন জানাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র বরং জানিয়ে দিয়েছে, এই বিচারে কোনোরকম অনিয়ম এবং মানবাধিকার লংঘন করা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সহ্য করবে না। কথাটার মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে চলেছে, যা শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে জামায়াতের পক্ষে। ‘আউটলুক’-এর রিপোর্টে অন্য একটি চমকপ্রদ তথ্যও জানা গেছে। সে তথ্যটি হলো, বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিকল্পনা রয়েছে তার মধ্যে জামায়াত একটি অত্যন্ত গুরচত্বপূর্ণ অংশ বা ফ্যাক্টর। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তনের ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভবত ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে জামায়াত একটি নির্ধারক শক্তি হিসেবে স্থান পেয়েছে। ভারত তাই বলে পিছিয়ে যায়নি। এ অবস্থার মধ্যেই দেশটি শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে কৌশল চূড়ান্ত করছে বলে জানিয়েছে ‘আউটলুক’।
ভারত যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটানোর সমগ্র কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে সে কথা অনেক আগেই সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জেনে গেছে। এজন্যই একদিক থেকে ‘আউটলুক’-এর খবরটি মোটেও নতুন নয়। কারণ, তথাকথিত ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন থেকে ১/১১ ঘটানো এবং ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া পর্যন্ত সমগ্র ঘটনাপ্রবাহে ভারতের প্রত্যক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে এখন আর কথা বাড়ানোর দরকার পড়ে না। সবাই জানেন। ওদিকে কড়ায়-গন্ডায় ঋণ শোধ করার মাধ্যমে শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে ধারণা পরিষ্কার করে চলেছেন। মাঝখানে বাংলাদেশেরও যে কিছু- বাস্তবে অনেক কিছু- চাওয়ার ও পাওয়ার আছে, সে ব্যাপারে কিন্তু কিছুই জানা যাচ্ছে না। এজন্যই ‘আউটলুক’-এর রিপোর্টে বিস্ময়ের কোনো উপাদান নেই। তা সত্ত্বেও বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে আসলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রতিক দমন-নির্যাতন ও মারমুখী অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে। ‘আউটলুক’-এর খবর সত্য হলে এমন মনে করাটাই সঙ্গত যে, গণহত্যা এবং দমন-নির্যাতনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করে দেয়ার কৌশল আসলে ভারতই নিয়েছে। অর্থাৎ ভারতের পরামর্শ, সমর্থন ও উৎসাহেই সরকার গণহত্যাসহ ফ্যাসিস্ট কর্মকান্ড চালাচ্ছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা সম্ভবত ধরে নিয়েছেন, এভাবেই তারা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনতে পারবেন। সেটা তারা ভাবতেই পারেন, অন্যদিকে যুগে যুগে প্রমাণিত সত্য হলো, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করলেই বাংলাদেশের জনগণকে দমন করা বা ইচ্ছাধীন করে ফেলা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে এমন কোনো দল বা নেত্রীকে ক্ষমতায় আনা যায় না, যার বা যাদের বিরচদ্ধে দেশের স্বার্থবিরোধী ভূমিকা পালন করার অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা অবশ্য অনুমাননির্ভর কোনো আলোচনার পক্ষপাতী নই। একটি কথাও আবার না বলে পারা যায় না। কথাটা ভারতীয়দের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি-চিন্তা ও পরিকল্পনা সম্পর্কিত। কারণ, ‘আউটলুক’ এতদিনে যে খবর প্রকাশ করেছে সে ধরনের খবর কিন্তু অতীতে অনেক উপলক্ষেই জানা গেছে। এসব খবরের প্রধান বিষয় হিসেবে সব সময় থেকেছে জামায়াতে ইসলামী। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, ২০১১ সালের ২৯ জুন নয়াদিল­xতে ভারতীয় সম্পাদকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশে ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। কারণ ব্যাখ্যার জন্য কি না তা জানা না গেলেও পরের নিঃশ্বাসেই মনমোহন সিং বলেছেন, অন্তত ২৫ শতাংশ বাংলাদেশী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এবং তারা তীব্র ভারতবিরোধী। তারা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর পরামর্শে কাজ করে। এসব ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ কারা এবং তাদের ওপর কাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তা নাকি ভারত সরকারের জানা নেই! বৈঠকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ‘ব্যাপক সহযোগিতা’ দিয়ে চলেছে। এই সহযোগিতার জন্যই ভারত বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। বৈঠকে মনমোহন সিং একাধিকবার জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ‘ব্যাপক’ সহযোগিতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে ‘খুবই ভালো’।
মনমোহন সিং-এর বক্তব্যে সে সময় তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল সঙ্গত কারণে। বাংলাদেশ যতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রই হোক অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এভাবে মন্তব্য করতে পারেন না। তার কথাগুলোও ছিল মারাত্মক এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ। বাংলাদেশে ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে বলেই তিনি থেমে পড়েননি, একই সঙ্গে বিশেষ ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী শুধু তীব্র ভারতবিরোধী নয়, আইএসআইয়ের অনুসারীও! পরের বাক্যে জামায়াতকে তিনি ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীও বানিয়ে ছেড়েছিলেন। তিনিই আবার বলেছিলেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো কাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তা নাকি তার জানা নেই! অন্য কেউ বললে কথাগুলোকে হয়তো ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে পাশ কাটানো যেতো। কিন্তু মনমোহন সিং শুধু বিরাট দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন, কথাও তিনি যথেষ্ট মেপেই বলে থাকেন। এজন্যই আপত্তি উঠেছিল। কারণ, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রকারান্তরে তিনি বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীসহ ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’গুলোই বাংলাদেশে ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটাতে পারে, যার পেছনে থাকবে আইএসআই-এর ভূমিকা! বলার অপেক্ষা রাখে না, মূলত জামায়াত বিরোধী মনোভাব ও উদ্দেশ্য থাকায় অর্থনীতির পন্ডিত হয়েও মনমোহন সিং অংকের হিসাবে গোল বাঁধিয়ে ফেলেছেন। তিনি খেয়ালই করেননি, ‘২৫ শতাংশ বাংলাদেশী’ বলতে প্রায় চার কোটি মানুষকে বোঝায়। জামায়াতের পেছনে এত বিপুল মানুষের সমর্থন থাকলে আর যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ অন্তত ক্ষমতায় আসতে পারতো না। ভারতের পক্ষেও এত ‘ব্যাপক’ সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হতো না।
মনমোহন সিং অবশ্য মুখ ফস্কে হলেও একটি সত্য প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। সে সত্য হলো, বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে জামায়াতে ইসলামীকে উৎখাত করার যে কর্মকান্ড বহুদিন ধরে চলছে তার পেছনে প্রধান ভূমিকা রয়েছে ভারতের। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথাই ধরা যাক। এ ব্যাপারে প্রথম জানা গিয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে লেখা প্রধানমন্ত্রীর একটি চিঠি থেকে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র‌্যাপ ঢাকা সফরশেষে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে রিপোর্ট দেয়ার পরপর হিলারি ক্লিনটন টেলিফোনে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। হিলারি-হাসিনার সে কথোপকথনে চমকে দেয়ার মতো অনেক কথাই প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন হিলারি ক্লিনটন বলেছিলেন, তারা রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র‌্যাপকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন ‘ভারতের অনুরোধে’। দ্বিতীয় তথ্যটি ছিল অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরচতর। হিলারি ক্লিনটনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ‘ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই’ বিচারের কাজ হাতে নিয়েছে! শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে হিলারি ক্লিনটন বারবার সংশয় প্রকাশ করতে থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলেন, এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ‘ভারতের রাষ্ট্রদূত’ আপনাকে বিস্তারিত অবহিত করবেন এবং বুঝিয়ে বলবেন। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা দরকার। বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের হলেও একদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তারা ‘ভারতের অনুরোধে’ স্টিফেন জে র‌্যাপকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন, অন্যদিকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তারা ‘ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরচ করেছেন এবং এ সম্পর্কে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ‘ভারতের রাষ্ট্রদূত’ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করবেন। দুটি কথার মধ্য দিয়েই পরিস্কার হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পেছনে সকল কলকাঠি নাড়ছে আসলে ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ভারতের অনুরোধে তৎপর হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারও তেমনি ভারতের নির্দেশই বাস্তবায়ন করছে মাত্র।
মনমোহন সিং-এর কথার মধ্য দিয়েও জামায়াতের বিরচদ্ধে ভারতের সংশি­ষ্টতার দিকটিই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘যে কোনো সময়’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটতে পারে কথাটার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার সরকারকে আগেভাগে সতর্ক করেছিলেন। সেই সাথে বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে হলেও জামায়াতকে চিহ্নিত করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, কারা এই পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এখানে উদ্দেশ্যে কোনো রাখঢাক করেননি মনমোহন সিং। সরাসরিই উস্কানি দিয়ে বলেছিলেন, জামায়াত যেহেতু ‘যে কোনো সময়’ পটপরিবর্তন তথা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে পারে সেহেতু সরকারের উচিত জামায়াতকে শায়েস্তা করা। সব মিলিয়েই আরো একবার পরিষ্কার হয়েছে, কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আসামী বানানো থেকে শুরচ করে জামায়াতের বিরচদ্ধে দমন-নির্যাতন চালানো পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে ‘হাত’ রয়েছে আসলে ভারতের। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের ইচ্ছা পূরণ ও হুকুম তামিল করে চলেছে মাত্র। বাস্তব ক্ষেত্রেও মনমোহন সিং-এর ওই বক্তব্যের পর জামায়াত বিরোধী দমন-নির্যাতন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। যার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয়েছে গণহত্যা এবং বিরোধী দলকে দমন-নির্যাতনের ভয়ংকর কর্মকান্ড। ভারতের নীতিনির্ধারকরা হয়তো ভেবেছেন, এভাবে দমন-নির্যাতন চালানো হলেই জামায়াত তো বটেই, বিরোধী সব দলই নির্মূল হয়ে যাবে। তেমন অবস্থায় আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে আনাটা খুবই সহজ হবে। অন্যদিকে ভারতের ভাবনা ও চাওয়াটাই যে সব নয় সে ব্যাপারে কিন্তু নানামুখী ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। জামায়াতের ব্যাপারে মার্কিন মনোভাব সম্পর্কে ‘আউটলুক’-এর রিপোর্টেই তথ্য রয়েছে। এদিকে সর্বশেষ উপলক্ষে এক বিবৃতিতে হত্যাকান্ডসহ পুলিশের নির্যাতনমূলক কর্মকান্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্রিটেন। দেশটির সিনিয়র পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারোনেস ওয়ার্সি এক বিবৃতিতে সহিংসতা ও হত্যাকান্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি তদন্তের আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, ন্যায়সঙ্গত দাবির জন্য এ ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্রিটিশ মন্ত্রী বিশেষ করে সরকারের প্রতি সংযম দেখানোর আহবান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তারা অব্যাহতভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং করবেন। উলে­­খ্য, ব্রিটেন শুধু নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডাসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ, ওআইসি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশে পুলিশের বাড়াবাড়ির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারাও হত্যাকান্ড ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ারও আহবান জানিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার এই মনোভাব ও বক্তব্য বিশেষ করে সরকার এবং ভারতের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি-মনোভাব ও কর্মকান্ড সম্পর্কেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। সুতরাং এমন আশা করার অর্থ ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে যে. ভারত চাইলেই আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা যাবে। মাঝখানে অবশ্যই আরো অনেক নির্ধারক বা ফ্যাক্টর রয়েছে- যাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে আউটলুক নিজেই জানিয়ে রেখেছে। এরপর রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় দলগুলোও। সবচেয়ে বড় নির্ধারক হিসেবে জনগণ তো রয়েছেই। এদের সবাই কিন্তু সরকারের পাশাপাশি ভারতের দিকেও লক্ষ্য রাখছে। অতএব সাধু সাবধান!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads