হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
আমি বিস্মিত ও লজ্জিত হই যখন দেখি আল্লাহ, রাসূল ও পবিত্র কুরআন সম্পর্কে যারা কটূক্তি করেছে তারা এ দেশেরই সন্তান এবং মুসলমান নামধারী। কিন্তু যে ভাষায় তারা কুরআন ও নবী রাসূল সম্পর্কে কটূক্তি করেছে তা ইহুদি-খ্রিষ্টান বা অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী এ ধরনের কথা বলেনি বরং তারা রাসূল (সা:) ও পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বিপুলভাবে প্রশংসা করেছেন।
এখানে আমি কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছিÑ প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী জর্জ বার্নাড শ আমাদের রাসূল সম্পর্কে বলেছেনÑ ‘আমি এ মানব শ্রেষ্ঠ মানুষটি (রাসূল সা:) সম্পর্কে গভীরভাবে গবেষণা করেছি। আমার অভিমত হচ্ছে, তাঁকে বিশ্ব মানবতার ত্রাণকর্তা হিসেবে অভিহিত করা উচিত। আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো একজন মহান ব্যক্তি যদি গোটা আধুনিক পৃথিবীর সর্বময় নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, তাহলে একমাত্র তিনি এই ঝঞ্ঝা বিুব্ধ এবং বিভক্ত পৃথিবীর সব সমস্যা সমাধান করতে পারতেন।’
মাইকেল হার্ট নামে একজন খ্রিষ্টান লেখক ও গবেষক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী লিখেছেন। তাতে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ সা:কে প্রথম স্থান দিয়েছেন।
‘যে মহামানবের পদচারণায় পৃথিবী ধন্য হয়েছে, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য, মা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিতাচার, আমানতদারি, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ। যিনি ছিলেন একাধারে ইয়াতিম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত, যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, ন্যায়বিচারক।’ আমাদের পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বিশ্ব বিজয়ী নেপোলিয়ান বলেছেনÑ ‘আমি বিশ্বাস করি সে দিন বেশি দূরে নয়, যে দিন পৃথিবীর সব দেশের জ্ঞানী ও শিতি মানুষকে কুরআনের নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। কারণ একমাত্র পবিত্র কুরআনের নীতিগুলোই সত্য যা মানব জাতিকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে।’ প্রিয় সহযাত্রী ভাইয়েরা, আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ সা: পৃথিবীর সর্ব মহলে কেন সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছেন? কারণ তিনি সব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা এবং অন্য ধর্মের প্রতি জোর জুলুমের বিরুদ্ধে আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে বক্তব্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে আল কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছেÑ
‘লাকুম দিইনুকুম ওয়া লিয়াদিন’
অর্থাৎ- ‘তোমাদের ধর্ম তোমার, আমাদের ধর্ম আমার’।
তাই কোনো ধর্মের প্রতি কোনো আঘাত ইসলাম পছন্দ করে না। আল কুরআনে আরো বলা হয়েছেÑ
‘লা ইকরাহা ফিদ্দিন’
অর্থাৎ- ‘দ্বীন বা ধর্ম সম্পর্কে জোর জবরদস্তি নেই।’
সুতরাং, আমরা কুরআন ও ইসলামের মর্মবাণী অনুযায়ী কখনো কোনো সাম্প্রদায়িকতা বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর কোনো প্রকার হামলা সমর্থন করতে পারি না।
সম্প্রতি যে মুষ্টিমেয় দুর্বৃত্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ের ওপর আঘাত হেনেছে তারা অবশ্যই ইসলামের ও আমাদের শত্রু। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক এবং সব ধর্মের সম্প্রীতির দেশ। তাই আমরা এই সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, আমরা এই সম্প্রীতি অুণœ রাখব, কারণ এটা হচ্ছে আমাদের ধর্মের নীতি।
আমি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, মসজিদ-মাদরাসা, ইয়াতিমখানার প্রতি সর্বদা সজাগ ছিলাম। দেশের শীর্ষস্থানীয় এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম মরহুম হাফেজী হুজুর, শর্ষিণার বড় পীর সাহেব, চরমোনাইয়ের বড় হুজুর, বাইতুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সাবেক খতিব মাওলানা উবায়দুল হক সাহেব, লালবাগের সাবেক খতিব প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম সাহেব, মরহুম মাওলানা আবদুল মান্নান, আল্লামা আজিজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনীসহ বর্তমানের বিভিন্ন আলেম-ওলামার সাথে আমার সুগভীর সম্পর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে আজীবন। আমি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ঘোষণা, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি এবং মসজিদ, মাদরাসা ও ইয়াতিমখানার পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করেছিলাম। আপনারা দোয়া করবেন যত দিন আমি বেঁচে থাকি তত দিন যেন ইসলামের সেবা করে যেতে পারি এবং নাস্তিক মুরতাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে যেতে পারি। সে জন্যই আমি শুরু থেকেই জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় উলামা পার্টি গঠন করেছিলাম। আজ দেশের শীর্ষস্থানীয় দেশবরেণ্য উলামাগণ যারা জাতীয় উলামা পার্টিতে যোগদান করেছেন আপনাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক মোবারকবাদ।
আপনারা জানেন, আমি যখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেছিলাম, তখনো একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলেছিলেন, আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে, ধর্মনিরপেতা হারিয়ে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্র ও সমাজ সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা কি জানেন, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। এমনকি যে গ্রেট ব্রিটেনকে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেতার সূতিকাগার বলা হয়, সেই গ্রেট ব্রিটেনের রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রেট ব্রিটেনের হাউজ অব লর্ডসে চার্চের ধর্মযাচক ও বিশপের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ব্রিটেনের রানী চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান। ব্রিটেনের রাজা বা রানীকে অবশ্যই একজন প্রোটেস্টান খ্রিষ্টান হতে হয়। অন্য ধর্মের কেউ কোনো দিন ব্রিটেনের রাজা বা রানী হতে পারবেন না। রাজা বা রানীর অভিষেক হয় চার্চ অব ইংল্যান্ডে।
ব্রিটেনে এখনো ব্লাসফেমি আইন আছে। এই আইন অনুযায়ী কেউ যদি প্রকাশ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেন তাকে শাস্তি পেতে হয়। অন্য দিকে বাংলাদেশে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। আমাদের আলেম-ওলামাদের জন্য জাতীয় সংসদে কোনো রিজার্ভ সিট নেই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ যেকোনো ধরনের মানুষ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান হতে পারেন। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অন্য দিকে ব্রিটেন সত্যিকার অর্থে একটি প্রোটেস্টান খ্রিষ্টান রাষ্ট্র।
আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকাই, তাহলে দেখি সেখানে ধর্ম রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সব দলের প্রার্থী নিজেকে একজন সত্যিকার খ্রিষ্টান হিসেবে তুলে ধরতে চান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধান বিচারপতি, সিনেটর, কংগ্রেসম্যান প্রত্যেকেই বাইবেল ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করেন। তাহলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয়ে গেল?
এখন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নেই, এমনটি নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের সংবিধান অনুযায়ী একটি ধর্মনিরপে রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতে এখনো আছে আরএসএস বিজেপির মতো কট্টোর হিন্দুধর্মভিত্তিক দল। আছে মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলামা হিন্দসহ অনেক মুসলিম ধর্মীয় দল। শুধু ভারতে নয়; অনেক পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশে যেমনÑ জার্মানি, ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন ইত্যাদি দেশে এখনো খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আছে। তাহলে প্রতীয়মান হচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থারই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এখন আমি সম্প্রতি সাড়া জাগানো শাহবাগ চত্বর সম্পর্কে দু-একটি কথা বলবÑ
আমি সব সময় নতুন প্রজন্মের তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে সমর্থন করি। কিন্তু আমি কিছু কিছু বিষয় ভেবে দেখতে তাদের আহ্বান জানাব। সম্প্রতি তারা শাহবাগ চত্বর থেকে কিছু কিছু নির্দেশ ও কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাদের এসব কার্যক্রম দেখে মনে হয় দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাককালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যখন গণবিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন বঙ্গবন্ধু বিকল্প সরকারের প থেকে এ ধরনের বহু নির্দেশ ও কর্মসূচি দিয়েছিলেন, যা দেশের জনগণ বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছিল এবং সরকারি প্রশাসন তা বাস্তবায়িত করেছিল। কারণ তিনি ছিলেন জনগণের নির্বাচিত অবিসংবাদিত নেতা। আজ শাহবাগ চত্বরের নেতৃত্বকে ভেবে দেখতে হবে তারা কি সেই পর্যায়ে পৌঁছেছেন? দেশে কি গণবিপ্লব শুরু হয়েছে? তারা কি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি? এবং তারা কি বিকল্প সরকার গঠন করেছেন?
সরকারকেও আমি আহ্বান জানাব তাদের কার্যক্রম, বক্তব্য ও নির্দেশ প্রদান সম্পর্কে আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করুন। পরিশেষে আমি দেশের বর্তমান সর্বনাশা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট অভিমত তুলে ধরতে চাই। এখনো সময় আছে রাজনৈতিক সংলাপ ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হানাহানি সহিংসতা ও রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। আমাদের ভুললে চলবে না যে, আমরা একই দেশের নাগরিক। কোনো কোনো প্রশ্নে এমনকি মৌলিক প্রশ্নেও আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি বা দলের চেয়ে দেশ অনেক বড়। দেশের অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমাদের জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান সঙ্কট থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। যে পরিস্থিতি সৃর্ষ্টি হয়েছে তাতে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তার সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে আমরা এখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ এসে গিয়েছি। এখন আমাদের সম্মুখে রক্তয়ী গৃহযুদ্ধের দানব তার বিষাক্ত থাবা এবং আসুরিক চেহারা নিয়ে অপো করছে। এ জন্য সব প্রকার দূরত্ব অবসানকল্পে সরকারকে রাজনৈতিক সব দলের সাথে অর্থবহ সংলাপ শুরু করতে হবে; যাতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে একটি স্বচ্ছ ও নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। একমাত্র নির্বাচনই দেশকে বর্তমান সর্বগ্রাসী সঙ্কট, নৈরাজ্য ও রক্তপাত থেকে রা করতে পারে। ইতোমধ্যেই আমি ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছি। এই বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের সাথে আমি ও আমার দল শিগগিরই আলোচনা শুরু করব। আলোচনার মাধ্যমে আমার প্রস্তাব গৃহীত হলে আমি খুশি হবো। আবার অন্য কোনো সর্বসম্মত ফর্মুলা যদি উদ্ভাবিত হয় আমি তা মেনে নেবো। আমি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই।
রাজনীতিবিদেরা যদি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে ভবিষ্যতে তাদের চরম মাশুল দিতে হবে। এমনকি গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। সাংবিধানিক শাসন ব্যাহত হতে পারে।
ওলামায়ে কেরামের প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বানÑ জাতীয় জীবনের সঙ্কটময় মুহূর্তে আল্লাহ-রাসূল নির্দেশিত পথে আপনাদের ইতিহাস নির্ধারিত ভূমিকা পালনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসুন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ইসলামের ওপর এই সাময়িক বিপদ আমরা আমাদের ঈমানি শক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে পারব।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন