এমন একপেশে ভূমিকায় ক্ষতির মাত্রাই বাড়ে
একপেশে ভূমিকা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য সহায়ক নয়। গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য পরমত-সহিষ্ণুতা যেমন জরচরি, তেমনি জরচরি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার সাহস। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের বুলি অহরহ উচ্চারিত হলেও গণতান্ত্রিক সমাজের শর্তগুলো যেন অনেকেই ভুলে যেতে বসেছে। ফলে দমন-অবদমন ও সহিষ্ণুতাই যেন সমাজের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ একদিকে আতঙ্ক অপরদিকে শংকিত পর্যবেক্ষক মহল। কোনো দেশের সরকার যদি ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টিকেই অনিষ্ট হিসেবে বিবেচনা করে এবং দমন-অবদমনের পথকে বেছে নেয় তখন গণমাধ্যমে সঙ্গত ও বস্ত্তনিষ্ঠ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সমাজে একটি ভারসাম্যমূলক পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক শ্রেণীর গণমাধ্যম একপেশে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা শাহবাগ মঞ্চের রাজনীতিপ্রবণ তরচণ প্রজন্মের আন্দোলনে উস্কানিদাতা হিসেবেও কিছু গণমাধ্যম কর্মীর ভূমিকা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ফাঁসি, জবাই, আগুন জ্বালাওসহ বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো বক্তব্যকে ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ। এমন অবস্থা গত চার দশকে গড়ে ওঠা গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ও বস্ত্তনিষ্ঠতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তাই গণমাধ্যমের সচেতন অংশ এখন বলছেন, এ্যাক্টিভিস্টরা জার্নালিস্ট হওয়ায় জার্নালিজম এখন এ্যাক্টিভিজমে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমকে তারা নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। গত কিছুদিন তাদের এমন প্রবণতার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছায় গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্য ও দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু গণমাধ্যম কর্মীর একপেশে ভূমিকা যে বাংলাদেশকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কত বড় ক্ষতি সাধন করেছে, রাজনৈতিক উত্তেজনায় এখন তারা হয়তো সে বিষয় উপলব্ধি করতে পারছেন না।
কিছু গণমাধ্যম কর্মীই যে শুধু একপেশে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তা নয়, দেশের পুলিশ বাহিনীকে সরকার এখন ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের’ বদলে সরকারি দলের স্বার্থরক্ষায় একপেশে ভূমিকা পালনে বাধ্য করেছে। দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের বিক্ষোভ দমনের জন্য দলীয় কর্মীদের পুলিশকে সহায়তা করার জন্য নির্দেশ দেন। কিংবা বিরোধী দলকে দমনের জন্য পুলিশ যখন সরকার দলীয় ক্যাডারদের সহযোগিতার জন্য নেমে পড়েন, তখন পুলিশ কি আর রাষ্ট্রের পুলিশ থাকে? পুলিশকে এমন অপব্যবহার করার কারণে শুধু যে সরকারের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে তা নয়, ইমেজ নষ্ট হচ্ছে পুলিশেরও। পুলিশ যখন সরকারি দলের ক্যাডারদের সাথে একাকার হয়ে যায়, তখন পুলিশ ভাবমর্যাদার সংকটে পড়ে যায়। এমন অবস্থায় পুলিশের উপর হামলা চালাতেও মজলুম পক্ষের কেউ কেউ আর কুণ্ঠিত হয় না। পুলিশ এভাবে ভাবমর্যাদার সংকটে পড়লে তা দেশের জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছু কিছু গণমাধ্যম এ বিষয়টিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশেষণের পরিবর্তে বিরোধী দলকে পুলিশের উপর হামলার কারণে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গিতে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রবণতা তৎপর রয়েছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো, প্রতিটি নাগরিকের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান এবং মানবাধিকার রক্ষা। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারেন কিন্তু বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, শাহবাগ মোড়ে মঞ্চ সাজিয়ে কিছু যুবক যখন জয়-বাংলা †¯vগান দিয়ে ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই করো’, ‘আগুন জ্বালাওসহ বিভিন্ন হিংসাত্মক কথা উচ্চারণ করছে, তখন পুলিশ তাদের সযত্নে পাহারা দিচ্ছে, প্রশাসন তাদের খাওয়া-দাওয়া, পানি সরবরাহসহ মোবাইল টয়লেটের ব্যবস্থা করছে। আর যারা শাহবাগ মঞ্চে প্রজন্মের সাথে কণ্ঠ মিলাচ্ছে না কিংবা ভিন্নমত প্রকাশ করছে তখন একই পুলিশ বাহিনী তাদের নির্বিচারে গুলী করে হত্যা করছে। রাষ্ট্রের এমন আচরণকে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক আচরণ বলে বিবেচনা করা যায় না। বরং অনেকেই রাষ্ট্রের এমন আচরণকে ফ্যাসিবাদী আচরণ বলে চিহ্নিত করছেন। সরকার ফ্যাসিবাদী না হলে মাত্র একদিনে পুলিশ কি করে ষাটজন নাগরিককে গুলী করে হত্যা করে? আমরা জানি, যে কোনো ক্রিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া আছে। নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিক্রিয়া কখনো রাষ্ট্র কিংবা সরকারের জন্য শুভ হয় না। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় সরকার হয়তো বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে না। এমন অবস্থায় জাতীয় স্বার্থে বস্ত্তনিষ্ঠ বিশেষণের মাধ্যমে গণমাধ্যম বিষয়টি সরকারকে বোঝাবার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু গণমাধ্যমের একটি উলেখযোগ্য অংশ যদি সঙ্গত ভূমিকা পালনের পরিবর্তে বরং ভুল কাজে সরকারকে উস্কে দেয়, তখন সরকার ও রাষ্ট্রের ক্ষতি অনিবার্য হয়ে ওঠে এমন অবস্থা জাতির কাঙিক্ষত নয়। বিষয়টি সংশিষ্টরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন