নুরেমবার্গ হলো জার্মানির ব্যাভোরিয়া প্রদেশের একটি শিল্পপ্রধান বড় শহর। এখানে ১৯৪৫ সালে ২১ নভেম্বর গঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। যে ট্রাইব্যুনাল করেছিল ২৪ জন জার্মান নাৎসি নেতার বিচারÑ যারা জড়িত ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে। এই সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল একজন মার্কিন, একজন ব্রিটিশ, একজন ফরাসি ও একজন সোভিয়েত বিচারককে নিয়ে। এই ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছিল চারটি আদালত। একটি আদালত বিচার করেছিল নাৎসি নেতাদের ষড়যন্ত্রের (Conspiracy of Nazism); আগ্রাসী সামরিক অভিযান (Wars of aggression); যুদ্ধাপরাধ (War crimes); এবং মানবতার বিপক্ষে অপরাধ (Crimes against humanity) সমূহের নাৎসি ষড়যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়, নাৎসি দর্শন গঠন ও তার সমর্থনে বাহিনী কর্তৃক অন্য রাষ্ট্র অধিকারের যুদ্ধকে। যুদ্ধাপরাধী বলতে ধরা হয়, যুদ্ধবন্দীদের হত্যা অথবা দুর্ব্যবহার : বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা, তাদের সহায়সম্পদ লুণ্ঠন ও যুদ্ধের প্রয়োজন ব্যতীত বেসামরিক ঘরবাড়ি ধ্বংস। মানবতার বিপক্ষে অপরাধ বলতে গ্রহণ করা হয়, কোনো বিশেষ মানবধারা (Race), ধর্ম সম্প্রদায় (Religious group) অথবা ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসীদের হত্যা ও নির্মূলের অভিযানকে (Extermination) এবং এক জায়গার মানুষকে অন্য জায়গায় জোর করে নিয়ে যেয়ে বাস করতে বাধ্য করাকে। ২৪ জন নাৎসি নেতাকে এসব অপরাধে অভিযুক্ত করে দাঁড় করানো হয় বিচারের কাঠগড়ায়, যাদের মধে ১২ জনকে দেয়া হয় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ। এই ১২ জনের মধ্যে ১০ জনের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয় ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে। বিখ্যাত নাৎসি নেতা গোয়েরিংয়ের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি জেলে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আর বোরমানকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। প্যাপেন (Papen), সাক্ট (Schacht), ফ্রিসকে (Fritsche) নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদের প্রদান করা হয় বিভিন্ন মাত্রার কারাদণ্ড।
এই ছিল বিখ্যাত নুরেমবার্গের রায়। এ সময় নুরেমবার্গের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একজন নাৎসি নেতা বলেছিলেন, আমাদের বিচার হচ্ছে। কারণ আমরা যুদ্ধে হেরেছি। যুদ্ধে হেরে যাওয়াটাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। আমরা যুদ্ধে হেরে না গেলে আমাদের কোনো বিচার হতো না। আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য পেতে পারতাম প্রশংসা, এখনকার মতো কোনো নিন্দা নয়। অনেক দিন আগের কথা : আমি তখন স্কুলে উঁচু কাসের ছাত্র। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তাম। মনে আছে এসব কথা। আমি পড়েছিলাম সংবাদপত্র। সে সময় নিয়মিত সংবাদপত্র আমি পড়তাম। জানতে ইচ্ছুক হয়ে পড়েছিল বিশ্বরাজনীতির ধারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপান ছিল এক পক্ষে। অপর পক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাপান জয় করেছিল বার্মা (মিয়ানমার)। জাপান এসে পড়েছিল বাংলাদেশের দোরগোড়ায়। জাপন কয়েক দিনের জন্য দখল করেছিল মহেশখালী। বোমা ফেলেছিল তখনকার বাংলার রাজধানী কলকাতায়। যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বিশেষ বিবেচ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সামরিক নেতাদেরও বিচার করার জন্য বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। দেয়া হয়েছিল তাদেরও শাস্তি। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনাল নুরেমবার্গের মতো অতটা খ্যাতি পায়নি। জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে উদ্ভব ঘটে নাৎসি রাজনৈতিক দর্শনের। নাৎসি দার্শনিকেরা বলেন, আর্যরা ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। জার্মানরা বহন করছে খাঁটি আর্য শোণিতের ধারা। জার্মানরা হলো আর সব জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ। তাই জার্মান জাতির অধিকার আছে, বিশ্বের নানা দেশ জয় করে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করার। নাৎসিরা গণতন্ত্রে বিশ্ববাস করত না। তারা বিশ্বাস করত অতি মানবের (Superman) নেতৃত্বে। নাৎসিদের কাছে তাদের নেতা হিটলার ছিলেন একজন অতিমানব। হিটলার অবশ্য নাৎসি দলের প্রতিষ্ঠাতা নন। যখন তিনি নাৎসি দলে যোগ দেন, তখন এর সদস্যসংখ্যা ছিল সাতজনের মতো। কিন্তু হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি দল দ্রুত গড়ে উঠতে থাকে। আর একপর্যায়ে এসে জার্মান রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারা অবশ্য গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করেনি। হিটলার প্রথম ক্ষমতা দখল করেন ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু পরে হয়ে ওঠেন জার্মান ডিকটেটর (Dictator)। নাৎসিরা ছিল চরমভাবে ইহুদিবিদ্বেষী। তারা বহু ইহুদিকে হত্যা করেছিল। একটি হিসাব অনুসারে প্রায় ৬০ লাখ। তবে অনেকে এই হিসাবটাকে এখন মনে করেন অতিরঞ্জিত বলে। নুরেমবার্গ বিচারে নাৎসি নেতাদের দেয়া হয়েছিল শাস্তি।
আমাদের দেশে এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার হচ্ছে। এই বিচারকে কিছু বাম বুদ্ধিজীবী তুলনা করতে চাচ্ছেন নুরেমবার্গের সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সাথে; কিন্তু এই তুলনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধের কোনো তুলনা চলে না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথেÑ যার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল অঞ্চলজুড়ে। আর ধ্বংসযজ্ঞ ছিল ভয়াবহ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন ছিল। ক্ষমতা ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতে। কিন্তু ইয়াহিয়া হিটলার ছিলেন না। তিনি হিটলারের জার্মান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন উত্তর আফ্রিকার বেনগাজিতে। জার্মান সেনাপতি রোমেলের প্রতি তার ছিল বিশেষ শ্রদ্ধা; কিন্তু তিনি অগণতান্ত্রিক মনভাবাপন্ন ছিলেন না, হতে চাননি ডিকটেটর। তার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম সাবেক পাকিস্তানে হতে পেরেছিল একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই নির্বাচনের সব কৃতিত্ব ছিল তার। ১৯৭১-এ ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়। পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে ভারতের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মান বাহিনী পৃথক পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল বৃটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও সোভিয়েত সেনাপতিদের কাছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল কেবলই ভারতীয় সেনাপতির কাছে; মুক্তিযুদ্ধের কোনো বাংলাদেশী সেনাপতির কাছে নয়। এই যুদ্ধটা তাই আইনের দিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেনি। চিহ্নিত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে।
ভারত সব পাক যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে গিয়েছিল ভারতে। কাউকেই রাখে না বাংলাদেশে। পাকবাহিনীকে হিটলারের বাহিনীর মতো বলা যায়নি আগ্রাসী বাহিনী। কারণ, পূর্ব পাকিস্তান ছিল সাবেক পাকিস্তানের অংশ। আর পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ছিল সাবেক পাকিস্তানের বাহিনী হিসেবে। এই বাহিনীতে ছিল পাঞ্জাবি আধিপত্য। তারা সাধারণভাবে পরিচিতি পেয়েছিল খান সেনা হিসেবে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বলা চলে না হানাদার বাহিনী। কারণ সাবেক পাকিস্তান ছিল আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র এবং জাতিসঙ্ঘের সদস্য। তাই নুরেমবার্গে হিটলারের বাহিনী সম্পর্কে যে রকম অভিযোগ ওঠানো সম্ভব হয়েছিল আগ্রাসী শক্তি হিসেবে, পাকবাহিনীর ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য হতে পারেনি। ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে হয়েছিল সিমলা চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে ছাড়া পেয়ে যায় সব বন্দী পাক সৈন্য। কারো বিচার করা হয়নি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। কারণ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে কেবল ভারতীয় বাহিনীর কাছে, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়। ভুট্টো বলেছিলেন, তারা পাকবাহিনীর কেউ যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তার বিচার করতে রাজি আছেন। কিন্তু এই বিচার হতে হবে পাকিস্তানে। আর বিচার হতে হবে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে (Court Martial) পাকিস্তানের আইন অনুসারে। কিন্তু যে কারণেই হোক, পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি চাপা পড়ে যায়। শেখ মুজিব এ বিষয়ে দেখাননি কোনো উৎসাহ। শেখ মুজিব ভুুট্টোকে বাংলাদেশে আসতে আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৪ সালে ২৭ জুন ঢাকায় আসেন। তাকে দেয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা। শেখ মুজিব চান পকিস্তানের সাথে সব বিবাদ বর্জন করে সখ্য স্থাপন করতে। ভুট্টো শেখ মুজিবকে পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিব চাননি পাকবাহিনীর যুদ্ধাপরাধের বিচার। এ দেশে যারা পাকবাহিনীর সহযোগিতা করেছিল, তাদেরও বিচার চাননি তিনি। কিন্তু বর্তমানের আওয়ামী লীগ সরকার করছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যুদ্ধাপরাধ বলতে বিবেচিত হচ্ছে পাকবাহিনীর সহযোগিতা করাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ বলে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। যারা পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করেন, তারা সেই সহযোগিতা করেন একটা বৈধ দেশে বৈধ বাহিনীর সাথে। পাকিস্তানকে সমর্থন করা তাই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে; কিন্তু সেটা একতরফাভাবে হয়নি। বাঙালিরা প্রচুর বিহারী হত্যা করেছে। সেটাকেও ধরতে হবে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে; কিন্তু সেটা ধরা হচ্ছে না। বিচার করা হচ্ছে কেবলই জামায়াতে ইসলামী নেতাদের। আর বলা হচ্ছে, জামায়াত একটা জঙ্গিবাদী দল। একে তাই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৯৭১-এ জামায়াত চায়নি সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে যাক। কিন্তু পরে জামায়াত মেনে নিয়েছে পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশকে। জামায়াত করেছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি। বিএনপির সাথে হাত মিলিয়ে গঠন করেছে সরকার। সে সরকার দেশ শাসন করেছে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে। এই সরকারে যে দু’জন জামায়াত নেতা মন্ত্রী ছিলেন, তারা রেখেছেন দক্ষতার স্বাক্ষর। জামায়াতকে তাই দল হিসেবে এখন আর বলা চলে না অগণতান্ত্রিক।
ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখ থেকে আরম্ভ হয় শাহবাগ চত্বরে সমাবেশ। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিলাত থেকে বাংলাদেশে আসেন সায়িদা ওয়ার্সি। সায়িদা ওয়ার্সি হলেন, বৃটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েল্থ দফতরের সিনিয়র প্রতিমন্ত্রী। তিনি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জামায়তকে নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না; বরং উচিত হবে তাকে আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করা। আদর্শিকভাবে একটা দলকে মোকাবেলা করা হলো গণতান্ত্রিক পন্থা। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে অগ্রসর হতে হয় নানা আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে, কোনো বিশেষ দলকে নিষিদ্ধ করে নয়।
শাহবাগ চত্বর থেকে এখনো দাবি তোলা হচ্ছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার। বলা হচ্ছে, জামায়াত একটি মুসলিম মৌলবাদী জঙ্গি দল। কিন্তু জামায়াত দল হিসেবে কোনো জঙ্গি তৎপরতা দেখাচ্ছে না। দেশে যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তবে জোটবদ্ধ হয়ে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর নির্বাচনে জিতে গড়তে চাচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকারÑ যেমন সে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে অতীতে করেছে। সে এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষারই পক্ষে। জামায়াত এখন আর কোনো ইসলামি বিপ্লবের কথা বলছে না। বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাচ্ছে একটি কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র হিসেবে। কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা ইসলামের পরিপন্থী নয়। কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে আহার্য প্রদান করতে (সূরা-২; ২৭৩ – ১৭৬)। ইসলাম গণতন্ত্রের পরিপন্থী ধর্ম নয়। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা (Government by discussion)। কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে (সূরা-৪২; ৩৮)। ইসলাম মানুষকে অগণতান্ত্রিক হতে বলে না। তাই ইসলামি রাষ্ট্র বলতে, গণতান্ত্রিক কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রকে অবশ্যই গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী সেটাই করতে যাচ্ছে। জামায়াতকে তাই এখন ধরা হচ্ছে একটি মধ্যপন্থী ইসলামি দল হিসেবে। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামায়াত সম্পর্কে পোষণ করছে এই রকমই মনোভাব। তারা বাংলাদেশে জামায়াতকে মনে করছে না একটা জঙ্গি মৌলবাদী ইসলামি দল হিসেবে। তাই তারা চাচ্ছে না জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হোক। কিন্তু শাহবাগ চত্বর থেকে উঠছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি। আর এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ করছে শাহবাগ চত্বরের দাবিকে সমর্থন। ভারতও শাহবাগ চত্বরের দাবিকে সমর্থন দিচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা The Times of India-†Z ejv n‡q‡QÑ India backs Shahbagh protest (27.02.2013)। ভারতের জাতীয় নিরপত্তা সংস্থার উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বলেছেনÑ ভারত বাংলাদেশের তরুণদের সমর্থন করছে। কারণ শাহবাগ চত্বরে সমবেত তরুণেরা হলেন মুক্তমনা। তারা বহন করছেন মুক্ত মনের পরিচয় (Open-mindedness)। এর আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ঢাকায় এসে শাহবাগ চত্বরের তরুণদের প্রকাশ্যে জানিয়েছেন সমর্থন। ভারতের এই সমর্থন আমাদের ভাবিত করছে। আসলে কী চাচ্ছে ভারত? আমাদের বাম বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, নুরেমবার্গ বিচারের কথা। কিন্তু বাংলাদেশে যে বিচার হচ্ছে, সেটা কোনো সামরিক ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। নুরেমবার্গ বিচারের সময় আইন বদলাতে হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে দেখা গেল আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্টকে বেঁধে দেয়া হলো বিচারের সময়সীমা। এ রকম সময়সীমা সংবিধান অনুসারে বেঁধে দেয়া যায় কি না, আমরা তা বলতে সক্ষম নই। কিন্তু এ রকম সময়সীমা বেঁধে দেয়ার ফলে বিচার করতে হবে খুবই তাড়াহুড়া করে। আর বিচারে তাই থাকবে ভুল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কে এ দেশের মানুষের মনে সৃষ্টি হতে পেরেছে নানা সন্দেহ। আওয়ামী লীগ বলছে, সে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। কিন্তু গত বছর দুর্গাপূজার সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেনÑ দুর্গাপূজা হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির পরিচায়ক। দুূর্গাপূজা অবশ্যই বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে; কিন্তু তা বলে বাংলাদেশের মুসলমানের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না। কোনো দেশেই মুসলমানেরা বহু দেবদেবীতে বিশ্বাস করেন না। আর তারা সব দেশেই মূর্তিপূজার (বুতপরস্তী) ঘোরবিরোধী। মুসলমানেরা নিরাকার এক আল্লাহর এবাদত করে থাকেন। মসজিদ মুসলমান সংস্কৃতিতে পালন করে বিশেষ ভূমিকা। মসজিদ কেবল প্রার্থনার স্থান নয়। মসজিদ ছিল এবং হয়ে আছে মুসলমানদের মতবিনিময়ের স্থান। মসজিদে মুসলমানেরা আলোচনা করেন, নানা বিষয়ে গ্রহণ করেন সিদ্ধান্ত। মসজিদ হয়েছে মুসলমানদের শিক্ষাকেন্দ্র। বেশির ভাগ মসজিদের সাথে স্থাপিত হয়েছে মাদরাসা। মসজিদ হয়েছে মুসাফিরের আশ্রয়স্থল। মসজিদকে কেন্দ্র করে রূপলাভ করেছে মুসলিম স্থাপত্য ও নকশাকলা।
বলা হচ্ছে, যারা মসজিদে বসে রাজনীতি করছেন, তারা ইসলামের অমর্যাদা করছেন; কিন্তু ইসলামে মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থান হয়ে থাকেনি। মসজিদকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। আজ আমরা বাংলাদেশে দেখছি মসজিদকে নির্ভর করে ‘হেফাজতে ইসলাম’ আন্দোলনের উদয় হতে। মসজিদ থেকে বের হতে দেখা যাচ্ছে বর্তমান সরকারবিরোধী মিছিল। এই মিছিল বের হতো না, যদি না আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকে পড়তে চাইত। মা দুর্গাকে বলত না বাঙালি সংস্কৃতির উৎস। আওয়ামী লীগের আচরণ এ দেশের মুসলিম মনকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে, যেটা খুবই সঙ্গত। আমি একজন বয়জীর্ণ ব্যক্তি। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে শয্যায় শুয়ে। বাইরের বিশ্বের সাথে আমার যোগাযোগ এখন খুবই কমে এসেছে। শুয়ে শুয়ে টেলিভিশন দেখি। টেলিভিশনে দেখলাম, পুলিশ একজন মুসল্লির দাড়ি ধরে টানছেÑ যেটা পুলিশের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পড়ে না। দৃশ্যটি দেখে আমি মানসিকভাবে আহত হলাম। পুলিশ বাহিনী আছে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে। কিন্তু পুলিশের এই আচরণ দেশকে ক্ষুব্ধ না করেই পারে না। আজ হেফাজতে ইসলাম আন্দোলন জোরালো হতে বাধ্য। কারণ, জনমত ক্রমশ ঝুঁকে পড়বে এই আন্দোলনের প্রতি। ধর্ম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে এবং করছে। কারণ, ধর্ম আমাদের মূল চেতনাকে প্রভাবিত করে। নিয়ন্ত্রিত করতে চায় আমাদের রাজনৈতিক দর্শনকে।
শাহবাগ চত্বরের একজন নেতাকে বলতে শুনলামÑ যার যার ধার্ম, তা তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু হিন্দু কাপালিকেরা নরবলি দিয়েছেন। কোনো হিন্দু যদি এখন নরবলি দিতে চান, আমরা কি তাকে সমর্থন করব? একসময় হিন্দুরা তাদের বিধবাকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মেরেছেন। হিন্দুরা যদি এখন চান সতীদাহ প্রথাকে ফিরিয়ে আনতে, আমরা কি তবে সেটাকে সমর্থন দেবো? খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। হিন্দু মন্দিরে মন্দিরে থেকেছে দেবদাসী। মন্দিরকে ঘিরে প্রশ্রয় পেয়েছে গণিকা প্রথা। আমরা কি সমর্থন দেবো এ রকম প্রবণতা? ধর্মটা কেবলই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাপার নয়। এর ওপর নির্ভর করে সমাজজীবন; মানুষের নীতি চেতনা। আর এক কথায়, ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা (Scale of values)। গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর মতামত গুরুত্ব পায়। মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোতে ইসলাম তাই হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম। রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা। কিন্তু সব রাষ্ট্রই গঠিত মানুষকে নিয়েই। মানুষের ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্রই চলতে পারে না।
শাহবাগ চত্বরে একজন তরুণকে বলতে শোনা গেলÑ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়। কিন্তু যে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা লাভ করেছি, তার এখনো একটা রাষ্ট্রধর্ম আছে। ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রধর্ম হলো অ্যাংলিকান খ্রিষ্ট ধর্ম। বিলাতের রাজারানী কেবল দেশরক্ষক নন; তারা হলেন বিশ্বাসেরও রক্ষক (Defender of faith)। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক খুবই উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু তাদের আছে রাষ্ট্রধর্ম। আমাদের বাড়ির কাছে মালয়েশিয়ায় হয়ে উঠেছে একটা উন্নত গণতন্ত্র। কিন্তু যেহেতু তার বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান, তাই তার রাষ্ট্রধর্ম হয়েছে ইসলাম। রাষ্ট্রধর্ম থাকা মানে একটা দেশ ধর্মান্ধ হওয়া নয়। বাংলাদেশও একটা ধার্মান্ধ দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে না। ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দাবি করে। কিন্তু কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আমরা যতটুকু জানি, গোমাংস ভক্ষণ করা চলে না। কারণ হিন্দুদের কাছে গো-মাতা পূজনীয়।
এই উপমহাদেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেইÑ যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলের বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে মুসলিম বাংলাভাষী জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। আজকের বাংলাদেশের ভিত্তি হলো বাংলাভাষী মুসলিম জাতীয়তাবাদ। ভাষা এর একটি মূল্যবান উপাদান; কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। এই জাতীয়তার শুরু আমাদের উপলব্ধিতে থাকতে হবে। না হলে সম্ভব হবে না বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করে বোঝা। জামায়াত বর্তমান পাকিস্তানে একটা জনপ্রিয় দল নয়। কিন্তু বাংলাদেশে হয়ে উঠেছে একটা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল। কারণ জামায়াত প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাভাষী মুসলিম জাতীয়তাবাদের। আর সেই সাথে বিরোধিতা করছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের। অন্য দলও একই কারণে হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশে জনপ্রিয়। বাংলাভাষী মুসলিম জাতীয়তাবাদকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে। আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম নুরেমবার্গর বিচার নিয়ে। যুদ্ধের পরপর পশ্চিম জার্মানিতে গড়ে ওঠে খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল, যা জার্মানিকে দেয় উন্নয়নের বিশেষ মাত্রা। উল্লেখ্য যে, জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মর্কেল খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক দলের একজন নেতা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন