বাংলাদেশ এখন আতঙ্ক ও রক্তপাতের জনপদে পরিণত হয়েছে। হানাহানি রক্তপাতকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চপর্যায় থেকে উসকে দেয়ার এ রকম প্রবণতা আগে দেখা যায়নি। এ দেশটি যখন কলোনি যুগে ছিল তখন ব্রিটিশরাজের একটি নীতি ছিলÑ শাসিতদের মধ্যে বিভক্তি নিয়ে এসো, এক পক্ষকে আরেক পক্ষের সাথে নানা ইস্যুতে লাগিয়ে দাও, এরপর নির্বিঘেœ শাসন করো। সে নীতি স্বাধীন দেশে অনুসৃত হবে তা ভাবা হয়নি। এখন বাস্তবে সেটিই হচ্ছে। বাইরে থেকে অন্তরালে কেউ যেন কলকাঠি নাড়ছে আর একান্ত বাধ্যগতভাবে নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে ভেতরে। যারা বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রকের কাজ করছেন তাদের স্বার্থ এ দেশের কল্যাণ-অকল্যাণের সাথে সম্পর্কিত নয়। তাদের পরামর্শে বাংলাদেশ দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও লাভ তাদের, শক্তিহীন পরগাছা হয়ে থাকলে তাতেও নেই কোনো ক্ষতি। হানাহানির বীজ রোপণ করার পর যে বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তৃত করছে, তাদের এই সঙ্ঘাতে যে পক্ষই মারা যাক তাতে তাদের কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তাদের কর্তৃত্ব দরকার মাটির ওপর, মানুষের কী হলো তাতে কিছু আসে যায় না।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর সারা বাংলাদেশ এক রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। যারা এ রায়কে বিচারের মোড়কে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের আয়োজন মনে করেছেন তারা এর প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছেন। রায় ঘোষণার পর দীর্ঘ আট ঘণ্টাব্যাপী সেই বিক্ষোভ প্রতিবাদ দমনের নামে পাখির মতো গুলি করা হয়েছে। পুলিশের এই গুলি করার মহোৎসবে ৭০ জনের মৃত্যুর খবর বের হয়েছে। এ সংখ্যা হয়তো ইতোমধ্যে আরো বেড়েছে। কিন্তু কেন এই রাস্তায় নামামাত্র মানুষের ওপর গুলির নির্দেশ? কেন এক দিনে পুলিশের গুলিতে এত মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড? এমনও শোনা যাচ্ছে, নির্দেশ এসেছে প্রয়োজনে দুই হাজার মারা গেলেও চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে কী পরিণতি হবে এই জনপদের?
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় খবর বেরিয়েছে, ভারতের মদদে বাংলাদেশের শাহবাগে জাগরণ মঞ্চ হয়েছে। এই মঞ্চ থেকে দুই সপ্তাহ ধরে ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই করো’ সেøাগান তোলা হয়েছে। একই দেশে এখন দুই ধরনের দৃশ্যপট। এক দিকে রাস্তায় দেখামাত্র গুলির নির্দেশ, অন্য দিকে পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রটেকশনে পোলাও বিরিয়ানি ও অন্য সব সরবরাহ নিশ্চিত করে রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশের আয়োজন। এই দ্বৈধতা কি বাংলাদেশের মানুষ বোঝে না? লাশের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করা বাপ্পাদিত্য বসুরা ফাঁসির দাবি জানাবে আর বাংলাদেশের খ্যাতনামা একজন আলেমকে প্রমাণহীনভাবে ‘দেল্যা রাজাকার’ বানিয়ে দেয়া প্রাণদণ্ড মানুষকে মেনেই নিতে হবে? শাহবাগে যেসব ব্লগার জাগরণ মঞ্চ বানিয়েছে তারা যদি মহানবী সা: ও তাঁর পরিবারের প্রতি অকল্পনীয় কুৎসা রটনা করেÑ তা কি জনগণকে মুখ বুঝে মেনে নিতে হবে? বাংলাদেশে ইসলাম ও স্বাধীনতা মুখোমুখি কোনো সময় ছিল না। ১৯৭১-এর চেতনা ছিল শোষণ ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে চেতনা। সে সময়ের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের উদ্যোগ তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার নিয়েছিল। কিন্তু সেটি নিয়ে তখন অগ্রসর হয়নি সরকার। এখন এ বিচারের কথা বলে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে ফাঁসির আয়োজনকারী এ দেশের কেউ নয় বলে ভাবার যথেষ্ট যুক্তি থাকতে পারে। আল্লাহর রাসূলের প্রতি কুৎসা ও অব্যাহত ঘৃণা ছড়ানোর পর দেশের মানুষ হত্যার মহোৎসব দেখল বৃহস্পতিবার।
সংবিধান অনুযায়ী ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশা-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের পরিচয় তারা বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিকমাত্রই সংবিধান অনুসারে আইনানুগ সমান ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী। এই অধিকার বলে সবার নিরাপদ জীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহাল থাকা অবস্থায় দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নির্বিচারে নাগরিকের প্রাণহানি ঘটতে পারে না। অনেক দিন ধরেই পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারের প থেকে বলা হচ্ছেÑ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ‘নাশকতা’ ‘তাণ্ডব’ ও ‘সহিংসতা’ দমন করতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি চালাতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ধানক্ষেতে তাড়া করে গুলি করে মারা হয়েছে। পুলিশের হাতে আটক অবস্থায় গুলি করা হয়েছে। ইট-পাথর ছোড়ার জবাব দেয়া হয়েছে বুকে গুলি করে।
বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের একটি সদস্যদেশ। সার্বজনীন মানবাধিকারেও স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। মানবাধিকার সনদ অনুসারে এ বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে জাতিসঙ্ঘের কোনো সদস্যদেশ গুলি চালাতে পারে না নির্বিচারে হত্যার জন্য। জাতিসঙ্ঘের অষ্টম কংগ্রেসে গৃহীত ‘আইন প্রয়োগকারী বাহিনী বলপ্রয়োগ ও অস্ত্রের ব্যবহার বিষয়ক মূলনীতি’ অনুযায়ী বিােভকারী জনতা ও রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সাথে দায়িত্বশীল আচরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে পুলিশের। অথচ এখন গুলি চালানো পুলিশ বাহিনী ও সরকারের নীতিগত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
আইনের শাসনের জন্য প্রয়োজন ক্ষমতাসীনদের আইনের পক্ষপাতহীন প্রয়োগের মানসিকতা এবং স্বচ্ছ ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিকীকরণের অভিযোগ অনেক পুরনো। রাজনৈতিক দলগুলো বিচার বিভাগে পেশাগত যোগ্যতার ওপরে রাজনৈতিক আনুগত্যকে স্থান দিয়েছে। নিয়োগ পদোন্নতিকে সরকারের কথা শোনার মানদণ্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পৃথিবীর যেখানে এ ধরনের অবস্থা হয়েছে সেখানে রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দলবাজ ধরনের লোকদের নিয়ে রাজনৈতিক বিচারের আয়োজন করতে দেখা যায়।
স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং দেশে-বিদেশে এই বিচার নিয়ে বিতর্কের কারণে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না সে প্রশ্ন ব্যাপকভাবে উঠেছে। এর পরও বিচারের একটি নিজস্ব গতি আছে। কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করে গুলি করে গণহত্যার মতো ঘটনা বাংলাদেশের অস্তিত্বের গভীরে আঘাত করবে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের বর্তমান সঙ্কটে এ বিষয়টিকে দিতে হবে বিশেষ গুরুত্ব।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন