বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৩

দুর্বৃত্তত্রয়ীর রাজ্যে জনগণ


আলমগীর মহিউদ্দিন

এক কথায় একটি অবাস্তব অবস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সময় কাটাচ্ছে এক অসম্ভব অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। এর স্বীকৃতি দিয়েছেন ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তিরা মাত্র একটি বাক্যে। এরা বলেছেন, বেডরুমের নিরাপত্তা এরা দিতে পারবেন না। কথাটা সত্যি। বেডরুম একান্ত ব্যক্তিগত এলাকা। কিন্তু বাংলাদেশের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডগুলোর অনেকই এই শয়নকক্ষে হয়েছে। তবে শয়নকক্ষও নিরাপদ থাকে, যখন হত্যাকারীরা জানে এবং বিশ্বাস করে দেশের আইনের শাসন নিরপেক্ষ ও ত্বরিত, আর বিচারব্যবস্থাও প্রভাবিত নয়। আর সমাজের ক্ষমতাবানেরা অনুভব করবে আইন অন্ধ এবং তা সমভাবে প্রয়োগ হয়। অন্যায়কারীরা জানবে রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারীরাও জবাবদিহিতার আওতায় এবং এরা দায়িত্বে অবিচল ও সৎ। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ সবখানে থাকে নির্ভয়। পথ চলতে তাদের কোনো দ্বিধা থাকবে না। ছিনতাই হওয়ার শঙ্কা থাকবে না, মৃত্যু তো নয়ই। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়বে না, গুম বা হুমকি তো নয়-ই। কিন্তু এমনটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারছে না। কারণ, এখন সমাজ ও রাষ্ট্র অশান্ত এবং যেন এর শেষ নেই। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই শান্তিপ্রিয়, নিরীহ এবং ধর্মভীরু। কেন এমনটি হচ্ছে? এর অনেক কারণ থাকবে স্বভাবতই। তবে একটি প্রধান কারণ, এই সাধারণ মানুষ বেশির ভাগ সময় এদের নেতা এবং শাসকদের দিয়ে হয় নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত। আর নিষ্পেষণের প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে থাকে যারা শান্তিপ্রিয় ও ধর্মভীরু। সমাজের একটি ুদ্রাংশই অন্যায়-অবিচারের সাথে জড়িত থাকে এবং সমাজের বৃহদাংশ শান্তিপ্রিয় ও ধর্মভীরু। সে জন্যই এই ুদ্রাংশ নানা ছলে, কলে-কৌশলে ক্ষমতা দখল করে। এই ুদ্রাংশ বিশ্বাস করে ক্ষমতা এবং অর্থ দিয়ে সব ইচ্ছা পূরণ সম্ভব। তাই ক্ষমতা দখল  এবং রক্ষার জন্য এরা সব কিছু করে বা করতে প্রস্তুত থাকে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় ভয় ধর্মভীরু সমাজের মানুষকে।
কারণ, এরা সত্য বলতে পছন্দ করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এবং মিথ্যাচারকে নগ্ন করে। যেকোনো তথ্য অবিকৃত অবস্থায় একটি সত্য। ক্ষমতাবানেরা এই সত্যকে সবচেয়ে বড় ভয় করে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক এবং গ্রন্থকার গ্রেগ গ্রানডিন বলেছেন, এই সত্যকে প্রতিরোধ করতে ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতাসীনেরা ‘দুর্বৃত্তত্রয়ীকে’ (আনহোলি ট্রিনিটি) ব্যাপক ব্যবহার করছে। এই ত্রয়ী হলো ‘খুনি দল (ডেথ স্কোয়াড), গুম (ডিসঅ্যাপেয়ারেন্স) এবং অত্যাচার (টরচার)। গ্রানডিন যেন বাংলাদেশীদের কাছে অতি পরিচিত চিত্রের নিখুঁত বর্ণনা করছেন। তিনি বলেছেন “এই ডেথ স্কোয়াড হলো ‘কানডেস্টাইন (গোপন) প্যারামিলিটারি ইউনিট’ যারা কোনো আইনের আওতায় কাজ করে না। অথচ সব সরকারি শান্তিরক্ষী ও গোয়েন্দা সংস্থার ‘ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড লজিস্টিক’ (তথ্য এবং আনুষঙ্গিক সহায়তা) ব্যবহার করে। ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় অথবা সাধারণ বেশে এরা যেকোনো ব্যক্তিকে যেকোনো সময় উঠিয়ে নেয়  জিজ্ঞাসাবাদের নামে এবং পরে কোনো এক স্থানে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।”
অধ্যাপক গ্রানডিন দণি ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে মার্কিনী গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র কর্মকাণ্ড বর্ণনা করতে গিয়ে এ বর্ণনা দিয়েছেন। তার মতে, একমাত্র ভিয়েতনামেই এমন ৮০ হাজার ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি অবশ্য মন্তব্য করেছেন, ১৯৬০-এর এই দুর্বৃত্তত্রয়ীর চর্চা এখন আরো সূক্ষ্মতর হয়েছে প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে। তবে লক্ষ্যবস্তুর কোনো পরিবর্তন হয়নি। তা হলো ধর্ম এবং এর অনুসারী ধর্মভীরু জনগণ।   কেননা তারা ভালো মানুষ এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। আর সত্য হলো নৈতিকতার ভিত্তি, যা শুধু ধর্ম থেকেই উৎসারিত।
এবং এ কথা এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনও এক বক্তব্যে জোর দিয়েছেন।  তিনি বলেছেন,   ”Of all the dispositions and habits  which lead to political prosperity, religion and morality are indispensable supports. In vain would that man claim tribute to patriotism who should labor to subvert these great pillars of human happiness these firmest props of duties of men and citizens… reason and experience both forbid us to expect that national morality can prevail in exclusion of religious  principles.” এ উক্তিটিতে ওয়াশিংটন স্পষ্ট বলেছেন, রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম এবং ধর্মপ্রসূত নৈতিকতা অপরিহার্য। কারণ, তার মতে, সত্যিকারের মানবকল্যাণকামী রাজনৈতিক সাফল্য শুধু ধর্ম ও নৈতিকতার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সম্ভব। যে ব্যক্তি এ দু’টিকে বাদ দিয়ে অথবা এ দু’টিকে ধ্বংস  (Subvert করে দেশপ্রেমের দাবি করে, সে একেবারেই বিফল (Vain) ও ভণ্ড। আবার তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা নির্মাণ ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়া সম্ভব নয়। আর একে তিনি মানব আনন্দ ও সুখের স্তম্ভ (great pillars of human happiness) বলে আখ্যায়িত করেছেন। হয়তো বা সে কারণেই সেকুলারিজমের প্রধান বক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং ডলারে ধর্মীয় অনুভূতির প্রতিফলন লক্ষণীয়। অবশ্য অনেকেই সেকুলারিজমকে গত শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আন্দোলনকারী নতুন ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করে বর্তমানের বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘাতের মূল নায়ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এরা এই সঙ্ঘাতের কারণ হিসেবে সেকুলারিজমের পূর্ণ জাগতিক এবং বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করে বলেছেন, আধ্যাত্মিকতানির্ভর নৈতিকতা যে নিবিড় সামাজিকবন্ধন নির্মাণ করে অন্যায় ও অবিচার প্রতিরোধে সক্ষম, তা এই মতবাদ করতে পারে ন। বরং সেকুলারিজম সৃষ্টি করে সমাজ বিভেদ এবং ধনী-দরিদ্র ও অন্যান্য  বিবাদ। বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ধর্মীয়-অনুশাসনহীন অন্য যেকোনো ব্যবস্থা সমাজের বা রাষ্ট্রের বাঁধন সুদৃঢ় করতে পারে না। এর জন্য ওইসব ব্যবস্থাকে তাদের অবস্থান ও ক্ষমতাকে রক্ষা করতে অস্ত্র এবং পাশবিক শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। এ জন্যই ধর্মীয় নৈতিকতাহীন সেকুলারিজমনির্ভর রাষ্ট্রে আইনব্যবস্থার  সামান্যতম দুর্বলতা অথবা অনীহা সামাজিক অশান্তি ও অসন্তোষ সৃষ্টি করছে। পরিবার এবং সমাজ ভেঙে যাচ্ছে। কেননা, সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তি নৈতিকতার মাধ্যমে বলীয়ান না হওয়ার কারণে সামাজিক অশান্তি ও অসন্তোষ প্রতিরোধ করতে পারছে না। বিভক্তি সৃষ্টি হচ্ছে। শোষকের সংখ্যা বাড়ছে এবং শাসিতদের পাশবিক শক্তি দিয়ে স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে।
এ কর্মকাণ্ডগুলোকে একগুচ্ছ মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা অবিরত। বিখ্যাত লেখক ড্রেসডেন জেমসের (উৎবংফবহ ঔধসবং) একটি বিখ্যাত উক্তি প্রায়ই আলোচিত হয় এবং সেটা যেন বাংলাদেশের জন্যই বলা হয়েছিল। জেমস বলেছেন, “When a well-packaged web of lies has been sold gradually to the masses over generations, the truth will seem utterly  preposterous and its speaker a raving lunatics” . এ দেশে এমন মিথ্যার কতকগুলো ঝুলি বারবার জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের কাছে সত্যকে অপাঙ্ক্তেয় করে ফেলা হয়েছে। তাই এমন বড় যন্ত্রণায় জার্মান কবি ও লেখক টাডুজ বরোস্কি  (Tadeusz Borowski) চিৎকার দিয়ে উঠেছেন। বিশ্বে এখন না নৈতিকতা আছে, না বিচার (The world is ruled by neither justice nor morality; crime is not punished nor virtue rewarded, one is forgotten as quickly as the other. The world is ruled by power and power is obtained by money) ।
বরোস্কি যেন বাংলাদেশের প্রতিদিনের ঘটনার বিবরণ তিন ডজন শব্দে ধারণ করেছেন। এখানে প্রতিদিন খুন হচ্ছে, তার বিচার হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়  শক্তি এ সপ্তাহে এক দিনেই যত হত্যা করল, তা অতীতের যেকোনো আন্দোলন, এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনে যে গণহত্যা  হয়েছিল, তার যেকোনো দিনের রেকর্ডকেও ম্লান করেছে। তবে এর প্রতিবাদ ঠিক তেমনি ব্যাপক হচ্ছে না কেন? এর অন্যতম কারণ হিসেবে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ  বর্ণনা করেছেন। ড্রেসডেন জেমসের ভাষায়, জাতিকে তারা একগুচ্ছ মিথ্যা দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করে তীব্র প্রচারণার মধ্য দিয়ে তা জিইয়ে রাখা হচ্ছে। ভয় এবং মোহের রাজ্য সৃষ্টি করে প্রতিবাদের সাহস ও ভাষা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এটা শুধু ক্ষমতার জন্য এবং নিজেদের অনাচার ও অযোগ্যতা ঢেকে ফেলার জন্য। যে কাজটি হিটলার করেছিল তা সুচারুরূপে অনুসরণ করা হচ্ছে। হিটলার জনগণ যেন সত্য তথ্য  জানতে না পারে এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে ঐক্য গড়তে না পারে সে জন্য কোনো সংবাদমাধ্যমকে সামান্যতম সত্যকথনের সুযোগ দিত না। বাংলাদেশে এমনটি বারবার ঘটছে। বিভিন্ন আকারে। একবার সব সংবাদপত্র বন্ধ করে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা করা হয়েছে শুধু জনগণ যেন সত্য না জানতে পারে।
এখন পদ্ধতি পাল্টিয়ে একযোগে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শক্তি প্রয়োগ করে সংবাদমাধ্যমকে সত্য থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। যারা স্বেচ্ছায় ক্ষমতাবানদের সহযোগিতা করে সত্যকে আবৃত রাখছে, তাদের জন্য থাকছে ক্ষীরের সমুদ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে এমন সংবাদমাধ্যমকে প্রেসটিটিউট (Presstitute) বলে বর্ণিত হচ্ছে।  উইকিপিডিয়ায় বলছে শব্দটি  Prosititute (বেশ্যা) এবং  Press (সংবাদপত্র) এই দু’টি শব্দ একসাথে মিশিয়ে  তৈরি করা হয়েছে। অন্য কথায়, এর অর্থ হবে সরকারি গুণ গাইলে তা হবে বেশ্যা সাংবাদিকবৃত্তি। মজার কথা এর প্রতিবাদ কেউ করছে না।
গত চার দশকের ইতিহাস একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দু’টি ধারা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে। একটি ধারা জনগণকে দু’ভাগে ভাগ করে প্রচারণার উন্মাদনার মধ্য দিয়ে ভীতির রাজ্য কায়েম করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে অথবা অগণতান্ত্রিক শক্তির আগমনের পথ তৈরি করে। এই ধারা জনগণের আবেগকে পুঁজি করে সঙ্ঘাত-হিংস্রতা-উগ্রতার উন্মাদনা সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে চায়। এই ধারা শুধু সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে এবং একই পথে বিদায় নিয়েছে। অপর ধারাটি কোনো দৃশ্যমান প্রচেষ্টা ছাড়াই জনগণের সমর্থন পেয়ে ক্ষমতাসীন হলেও প্রতিপক্ষ ধারাটি তাদের নির্বিঘœ যাত্রার অনুমোদন দেয় না। শঙ্কা, সঙ্ঘাতময় নিরবচ্ছিন্ন সময়ের জন্য কর্মকাণ্ড চালায়। এমনিভাবে কিছু সময় ছাড়া চার দশকের সমাপ্তি ঘটেছে। এখন জনগণ বিভাজনকারী ধারার সঙ্ঘাতসঙ্কুল সময়ের মধ্যে। অতীতে এ সময়ের অন্তে দেখা গেছে অভাবনীয় ঘটনার আমদানি। ফলে শুধু সাধারণ মানুষের হয়েছে যন্ত্রণা আর প্রভূত ক্ষতি। যাকে এই যন্ত্রণাদানকারীরা অভিহিত করেছে গ্লানি ও কলঙ্ক মোচনের সামান্য প্রতিদান। এখন মানুষ শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছেই আর্তি জানায়। সেটুকুও সইতে রাজি নয় এ ক্ষমতাবানেরা। তারা সেকুলারিজমের ধুয়া তুলে দাবি করে জনগণ সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্তি জানাবে অতি সংগোপনে, কোনো প্রার্থনালয়ে (মসজিদ, মন্দির ইত্যাদি) প্রকাশ্যে নয়। এর প্রতিফলন দেখা গেল দেশের প্রধান প্রার্থনালয় অর্গলবদ্ধ। কোনো প্রার্থনাকারী সাধারণ মানুষ ভয়ে তার কাছে যায়নি। কারণ, হয়তো আরো যন্ত্রণা তাদের ওপর চাপত। তাই তাদের প্রার্থনাÑ কবে শেষ হবে এই দুর্বৃত্তত্রয়ীর রাজত্ব।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads