বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৩

শপথের কথা ভুলে গেছেন তারা



একটি দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ কী? জনগণের জানমাল রক্ষা, নাকি গুলী করে হত্যা কিংবা পঙ্গু করে দেয়া। বাংলাদেশে আন্দোলন, বিক্ষোভ ও হরতাল নতুন কোনো বিষয় নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার হরতালের বিরুদ্ধে এখন খুবই নিষ্ঠুর আচরণ করছে, অথচ বাংলাদেশে হরতালের চ্যাম্পিয়ন হলো আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হরতাল করেছে এ দলটি। সে দলটি আজ হরতালের বিরুদ্ধে এত ক্ষুব্ধ আর নিষ্ঠুর কেন? এর রহস্য কী? পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, গত চার বছরে সরকারের ব্যর্থতা পর্বত প্রমাণ। এ সরকারের আমলে এত বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, অপশাসন এত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে, এর পরিণতি আগামী নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে তা এক প্রকার নিশ্চিত। তাই আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে না পারে সেজন্য ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। বিরোধী দল যখন জাতীয় আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলছিলো, তখন সরকার জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যে সৃষ্টি করলো শাহবাগ-নাটক। যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায়ের ব্যাপারে শাহবাগ মঞ্চ ডিক্টেড করার আন্দোলন শুরু করলো। এর প্রতিবাদে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ভক্তরাও মাঠে নামলো। ফলে দেশে সৃষ্টি হলো এক সংঘাতময় পরিবেশ এমন পরিস্থিতেতে লক্ষ্য করা গেলো সরকারের দ্বৈত আচরণ সরকারের পুলিশ বাহিনী শাহবাগ-মঞ্চের আন্দোলনকারীদের জামাই আদরে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে বিরোধীদলের আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো হচ্ছে গুলীবৃষ্টি সরকারের এমন আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, তারা শপথের কথা ভুলে গেছেন। সরকারের মন্ত্রীবাহাদুররাও অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে দেশ শাসন না করার শপথ নিয়েছিলেন। অথচ বর্তমান সময়ে সরকার ও পুলিশের আচরণে অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়টি প্রকট হয়ে উঠেছে। এভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করে সরকার জনগণকে ফেলে দিয়েছে দুঃশাসনের আবর্তে। পুলিশ এখন শুধু বিরোধী দল দমনে লাঠি ও টিয়ারশেল ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, সরাসরি গুলী করে মানুষ হত্যা করছে। থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে মানুষের সাথে আইনি আচরণের বদলে গুলীর ভাষায় কথা বলছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, হরতালে পিকেটার সন্দেহে আটকের পরে থানায় নিয়ে নির্যাতন ও গুলী করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি হাত-পা বেঁধে থানার ভেতর নিয়ে পায়ে গুলী করে পঙ্গু করে দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এভাবে অন্তত ৭ জনকে পুলিশ গুলী করেছে। এতে দু’জন ইতিমধ্যে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গেছে। তাদের শরীর থেকে পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এমন পুলিশকে কি জনগণের পুলিশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়? শুধু পুলিশ নয়, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এখন দাঁড় করানো হয়েছে বিজিবিকেও। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিজিবি এখন সীমান্ত ছেড়ে নেমে পড়েছে দেশের জনগণকে শায়েস্তা করতে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, জামায়াত-শিবিরের আন্দোলন দমানোর নামে নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্বিচারে গুলী চালাচ্ছে বিজিবি। গত কয়েকদিনে বিজিবি’র গুলীতে সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সীমান্ত ছেড়ে অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের নামে সারা দেশের জেলা-উপজেলায় কত সংখ্যক বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে তার প্রকৃত পরিসংখ্যান তাৎক্ষণিকভাবে সংস্থার সদর দফতরে পাওয়া যায়নি। তবে রাজধানীসহ সারাদেশেই বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। অস্ত্র হাতে টহল দিচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে তাদের উপস্থিতি বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, তাদের কাজ বাংলাদেশের সীমান্ত সুুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী-শিশু এবং মাদক পাচার ও আমদানি প্রতিরোধ করা। পাশাপাশি প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করা। কিন্তু বিজিবি এখন কি করছে? তাদের নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রক্তঝরা সীমান্তে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানে ভারতীয় বিএসএফ নির্বিচারে গুলী চালিয়ে নিরস্ত্র বাঙালীদের গুলী করছে। পিটিয়ে, পানিতে চুবিয়ে, পাথর ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েও বাংলাদেশীদের হত্যা করছে বিএসএফ। বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রবেশ করে নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার মত অপরাধও ঘটাচ্ছে তারা। দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী বিএসএফের কর্মকা- প্রতিরোধে বিজিবি পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে না পারলেও দেশের জনগণকে বেপরোয়াভাবে গুলী করে হত্যা করার ব্যাপারে বেশ সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছে। সাবেক বিডিআর বর্তমানের বিজিবি বীরত্ব ও ঐতিহ্যম-িত এক সুশৃংখল আধা সামরিক বাহিনী। প্রায় ২২০ বছরের ঐতিহ্য তাদের। স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রসেনানী ছিল এই বাহিনী। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বাহিনীর ৮১৭ জন জোয়ান শহীদ হয়েছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ অর্জন করেছেন এই বাহিনীর দুই সদস্য। এমন ঐতিহ্য ও গৌরবম-িত বাহিনীকে আজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে বর্তমান সরকার। এর চাইতে অর্বাচীন সিদ্ধান্ত আর কি হতে পারে?
দেশের জনগণ যখন সরকারের নানা ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কৌশলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছে তখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা। সরকারী মহল এসব বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার জন্য বিরোধীদলের ওপর দোষ চাপাবার চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে গত সোমবার এক বিবৃতিতে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনের মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয়ে হামলা ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। তিনি আরো বলেন, এদেশের মানুষ ধার্মিক কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান ধর্মের মানুষ আবহমান কাল থেকে শান্তিতে পাশাপাশি বসবাস করে আসছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় গণবিচ্ছিন্ন শাসকরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে জনগণের আন্দোলনকে বিপথগামী করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। স্বৈরশাসকদের এমন ঘৃণ্য তৎপরতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে অতীতে আমরা জনগণের আন্দোলনকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছি। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না ইনশাআল্লাহ। এদিকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও অমুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছেন, বর্তমান সরকার একদিকে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়ে জনগণের শান্তিপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ-আন্দোলনকে দমনের অপচেষ্টা করছে, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয়ে হামলা চালিয়ে জামায়াতের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। জামায়াত সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয়ে হামলা চালানোর সকল ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, দোষীদের শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে। আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এদেশে কখনো-কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার পেছনে সক্রিয় থাকে হীন রাজনৈতিক কৌশল। সাম্প্রদায়িকতাকে দেশের জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে, তাই ঐসব হীন রাজনৈতিক কৌশল হালে পানি পাবে না। অবশেষে জয় হয় সত্যের। বর্তমান সময়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকার কাঙ্খিত ভূমিকা পালন করছে না। বরং সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে সৃষ্টি করা হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতা। হিংসা বিদ্বেষসহ জাতিকে বিভক্ত করার নানা তৎপরতা চলছে দেশে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ক্ষমতা কোনো দলের জন্য চিরস্থায়ী বিষয় নয়। এ সত্যটি সরকার উপলব্ধি করলে শাহবাগ মঞ্চ তৈরি করে নির্বাচন-বৈতরণী পার হওয়ার মন্দ কৌশল গ্রহণ করতো না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিজিবিকেও জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হতো না। ইতোমধ্যে অনেকগুলো জীবন ঝরে গেছে। রক্তাক্ত এ পথ পরিহার করে এখন সরকারের উচিৎ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ রচনা করা। এতেই দেশ ও জনগণের কল্যাণ। সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে এ পথ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তবে সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads