হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উদ্বেগ
বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশ একটি ট্রাইব্যুনালকে কেন্দ্র করে বর্তমানে গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের বিচারের জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর পর গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো মানেই পড়ে না। উপরন্তু বাংলাদেশের মতো সমস্যাজর্জরিত একটি দেশে এই ট্রাইব্যুনালের আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না, তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। ২০১০ সালের মার্চে গঠিত এই ট্রাইব্যুনালের একটি রায় নিয়ে সৃষ্ট দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে প্রায় ২০০ লোকের প্রাণহানি হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশু-বৃদ্ধ এমনকি মহিলাও রয়েছে। এদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গণহত্যার শিকার হয়ে প্রাণ হারায় বলে অভিযোগ। এ সময় হাজার হাজার লোক আহত হন এবং বিস্তর সম্পদ ধ্বংস হয়, যার কোনো হিসাব সরকারের কাছেও নেই। সহিংসতায় এক দিকে সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপব্যবহার করেছে, অন্য দিকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলও নিজেদের শক্তিমত্তা দেখিয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, যে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে এত ঘটনা, সেই ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ায় ন্যায়নীতির কিছু মৌলিক বিষয়কে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে খেয়ালখুশিমতো লোকদের অভিযুক্ত করে বিচার করা হচ্ছে। অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ট্রাইব্যুনাল ন্যায়নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মতো বিষয়কে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে শুধু সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ ট্রাইব্যুনাল গঠনপ্রক্রিয়া ও বিচারপদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করলে হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট কারো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে যাদের বিচার চলছে তাদের অভিযোগ তদন্তেও চলছে নানা ধরনের অনিয়ম। ফলে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত, বিচারপদ্ধতি ও রায় নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাজারো প্রশ্ন উঠেছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে কড়া নজরদারির কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যক্রম নিয়ে নির্মোহ, নিরপেক্ষ এবং বস্তু ও বিবেকনিষ্ঠভাবে খবর ও মতামত পরিবেশনের কোনো সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সংবাদমাধ্যম তোতাপাখির মতো নির্দেশিত বুলি আওড়ে যাচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পর্যবেক্ষণ অনুসারে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সরকার আগামী নির্বাচনে দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য এতখানি তৎপর যে, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যে সরকারের দায়িত্ব, তা সরকার আমলেই আনছে না। ফলে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হয়েছে এবং সামনেও ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা তিরোহিত হচ্ছে। এর ফলে পুরো জাতি এখন মানসিকভাবে দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠছে। দেশে আইনের শাসন ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। হয়তোবা রক্ত দিয়ে জাতিকে এর মূল্য দিতে হবে।
শুধু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নয়, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু দেশ চালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তারা যেন বিষয়টিকে আমলেই আনতে চান না। যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়কে কেন্দ্র্র করে সরকার ইতোমধ্যে এতটাই আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে যে বাংলাদেশ যেন বিশ্ব থেকে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। স্বাধীনতার পর গণহত্যা হিসেবে সমালোচিত হতে পারে আজকে এত বড় ঘটনা আর ঘটেনি। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশ যে চরম সঙ্ঘাত ও রক্তপাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে সরকারের অংশীদারেরাও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে। কিন্তু কিছুতেই যেন সরকার পক্ষের বোধোদয় হচ্ছে না। এখন নতুন করে পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ কমিটি করে সঙ্ঘাতকে আরো গভীর থেকে গভীরতর করার চেষ্টা হচ্ছে। কোনো বিবেকবান দেশপ্রেমিক মানুষ এই ধরনের পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারে না। কোনো সরকার যদি রাষ্ট্রবিধ্বংসী কোনো পথ অবলম্বন করে, সে ক্ষেত্রে সরকারকে সঠিক পথে আনতে জনগণ রাস্তায় নামতে পারে। সে নিয়মতান্ত্রিকতাকে আবার শক্তি দিয়ে নির্মূল করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশকে এক চরম ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
আমরা রাষ্ট্রচালকদের প্রতি আবেদন জানাতে চাই, গৃহযুদ্ধের বিধ্বংসী পথ থেকে দেশকে রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখুন। প্রয়োজনে যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুকে আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থাপন করুন। এ ঘটনার বিচারকে কেন্দ্র করে দেশকে রক্তপাত, হানাহানি ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হলে তা থেকে কেউই লাভবান হবেন না। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন