রবিবার, ৩ মার্চ, ২০১৩

লক্ষ্যচ্যুত শাহবাগ আন্দোলনে এ কিসের প্রতিধ্বনি


শাহবাগ আন্দোলনের গতিপথটা কী? কোন মোহনায় মিশতে চায় এই আন্দোলনের ধারা? নাকি আন্দোলনের মূল ল্েযর চ্যুতি ঘটে তা এখন ভিন্ন আদর্শ বিকাশের এবং ল্য বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যে আদর্শের সৈনিকেরা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেও তাদের ল্য বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা না দেখে বিকল্প পথ ধরে ভিন্ন নৌকায় চেপে তাদের আদর্শের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় মতা কুগিত করতে সমর্থ হয়েছে। ধর্মচর্চায়, বিশেষত ইসলাম ধর্মের প্রতি তীব্র অনীহা ও অবহেলা অথবা ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন অনৈতিক আক্রমণ অথবা আক্রমণকারীদের লালন-পালন ও উৎসাহদান সেই আদর্শের অঘোষিত মূল্যবোধ। তারাই আজ শাহবাগ আন্দোলনের গতি-প্রকৃতিতে তাদের কুটিল মেধা এবং শাহবাগের তরুণদের উদ্যমকে কাজে লাগিয়ে কার্যত ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে দেশকে আশঙ্কাজনকভাবে সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের ভূমিকার প্রতি তীব্র নিন্দা এবং ওই সময়ে সংঘটিত অপরাধের জন্য দলটির কয়েকজন নেতার সর্বোচ্চ শাস্তির (যদিও বর্তমানে এসংক্রান্ত বিচারপ্রক্রিয়া চলছে এবং অভিযুক্ত দুইজনের বিরুদ্ধে রায়ও হয়েছে ; যার মধ্যে একটি রায়ে আন্দোলনকারীরা সন্তুষ্ট হতে পারেনি) দাবির আন্দোলন হঠাৎ করেই যেন ইসলাম এবং ইসলামপন্থীদের রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আর এই আন্দোলনের গতিপথ তখনই পাল্টাতে শুরু করে, যখন এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্লগারদের ব্লগে আল্লাহ, রাসূল সা:, কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলমানদের ঈমান-আকিদা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তীব্র ব্যঙ্গবিদ্রƒপ, কটূক্তি ও আপত্তিকর প্রচারণার বিষয়টি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। সাথে সাথে ফুঁসে ওঠেন দেশ এবং দেশের ওলামা-মাশায়েখগণ। তারা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এই অপরিণামদর্শী নাস্তিকদের শাস্তির দাবি করেছেনÑ যেটি প্রতিটি মুসলমানের ঈমানি দায়িত্বও বটে। ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অভাবে বৈষয়িক ও শারীরিক সমতায় তথাকথিত কিছু তরুণ আল্লাহ ও মানবতার মহান মুক্তিদূত রাসূল সা:-এর প্রতি যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তা মার অযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধের বিচার করা সময়ের সর্বোচ্চ দাবি এবং মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসনির্ভর প্রত্যাশা। এই ঔদ্ধত্য আর চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণকারী কিছু যুবক শুধু কি ইসলামবিদ্বেষী, নাকি যেকোনো ধর্মবিদ্বেষী, তা-ও সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শারীরিক শক্তির জোরে আজকে যারা নিজেদের সৃষ্টির রহস্য এবং সৃষ্টিকর্তাকেই অস্বীকার করে, তাদের কাছে দেশ-জাতির স্বার্থ নিরাপদ কি না, তা-ও সবাইকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। সমগ্র জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসে আঘাত করে হয়তো তথাকথিত কিছু জ্ঞানপাপীর প্রশংসা ও বাহবা কুড়ানো যেতে পারে; কিন্তু মানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া যায় না। নীতিবিবর্জিত অহেতুক উদ্যম জীবনাচারে অভ্যস্ত এসব নীতিহীন আদর্শবাদী ভিনদেশীয় সংস্কৃতির ছালবাকলা ধরে বাঁচতে চায়, নিজের দেশের সংস্কৃতি এবং মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়া তাদের কাছে নিতান্তই অর্থহীন। আর এ কারণেই ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে এসব অর্বাচীন তথাকথিত সেকুলারদের প থেকে যখন ইসলামি রাজনীতি বন্ধের জিগির তোলা হয়, তখন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। তারা কি শুধু ইসলামি রাজনীতি বন্ধ করতে চায়, নাকি আরো গভীর কোনো চক্রান্তের জাল বিছিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকেই জলাঞ্জলি দিতে চায়। ইসলাম যে কোনো আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং ইসলাম যে একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধানের ধর্ম ও রাজনীতি, যার ল্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার তারুণ্যে উদ্দীপ্ত এই তরুণেরা কি তা জানে? আইনের শাসন, ন্যায়ের শাসন, রাজনৈতিক মতার জনকল্যাণকর ব্যবহার এবং জবাবদিহিতার অনুপম আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় শাসনের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইসলাম স্থাপন করেছে, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণারে লিখিত রয়েছে। সমকালীন বিশ্বের জনকল্যাণকর শাসনের ধারক-বাহকদের কাছেও যা অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ তথাকথিত আধুনিক শিায় শিতি কিছু অবিবেচক তরুণ তাদের তারুণ্যের তাৎণিক অথচ য়িঞ্চু শক্তির বলে না জেনে, না বুঝে ইসলাম তথা আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, তাদের এই আত্মম্ভরিতার কারণ এবং উৎস কী? তারা কি কোনো কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীর ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে শাহবাগ আন্দোলনের শেষ পরিণতি হবে দুঃখজনক। কেননা বাংলাদেশের অতীত দৃষ্টান্ত বলে, ইসলামবিরোধী কোনো অপতৎপরতা বাংলাদেশের মানুষ শুধু যে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে তা-ই নয়, এদের হোতাদেরও গণমানুষ থেকে ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।
গণতন্ত্র সহনশীলতার শিা দেয়। পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা এবং অন্যের বিশ্বাসের প্রতি মর্যাদা দেয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই শিা। শাহবাগের আন্দোলনের তরুণেরা কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এই শিাও পাল্টে দিতে চায়? দেশের সব মত-পথের মানুষ ও মিডিয়াকে যেন তাদের স্তুতি গাইতে হবে। কেউ তাদের সমালোচনা করলেই শাহবাগের মঞ্চ থেকে তার বিরুদ্ধে স্লোগান এবং প্রতিরোধের হুমকি দেয়া হচ্ছে। আসিফ নজরুল থেকে পিয়াস করিম, এমনকি কাদের সিদ্দিকী থেকে মাহমুদুর রহমান কেউ বাদ যাচ্ছেন না। কাদের সিদ্দিকীর বঙ্গবীর খেতাব কেড়ে নেয়ার হুমকি এবং মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের আলটিমেটাম তখনই দেয়া হলো, যখন মতাসীনদের কর্তাব্যক্তিরাও তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার উগরে দিলেন। আর এ কারণেই মানুষ মনে করছেÑ এই আন্দোলন মতাসীনদের একটি অংশের হীন অভিলাষ পূরণেরই হাতিয়ার বৈ কিছু নয়। অরাজনৈতিক ও অহিংস আন্দোলনের বৃত্ত ভেঙে শাহবাগ আন্দোলন যে ক্রমেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক ল্য হাসিলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে, তাও স্পষ্ট হতে চলেছে। অহিংস জনপ্রিয় আন্দোলন যে কখনো কখনো নৈরাজ্যের ত্রে প্রস্তুত করে তারও ইঙ্গিত বহন করছে শাহবাগ আন্দোলন। সম্প্রতি হরতাল প্রতিরোধের নামে লাঠিমিছিল কিংবা উসকানিমূলক স্লোগানের মাধ্যমে সেই নৈরাজ্যের পথে খানিকটা অগ্রসরই হয়েছে শাহবাগ আন্দোলন। ২৫ ফেব্র“য়ারি মিরপুরের ১০ নম্বর গোল চত্বরে আয়োজিত এই আন্দোলনের এক জনসভায় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ডা: ইমরান এইচ সরকার নয়া দিগন্ত, আমার দেশ, দিগন্ত টিভি এবং আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে যে ভাষায় বক্তব্য দিলো এবং মাহমুদুর রহমানকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে হুঁসিয়ারি উচ্চারণ করল, তাতে নৈরাজ্যের অগ্রসরতা খানিকটা বেগবানই হয়েছে।
শাহবাগ আন্দোলনের তরুণদের উসকে দিয়ে যারা তাদের কায়েমি স্বার্থ উদ্ধার করতে চায় তাদের মনে রাখা দরকার যে, ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরাই সমগ্র দেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করে না। ১৬ কোটি মানুষের দেশে লাখোকোটি তরণের আশা-আকাক্সা ও বিশ্বাসের সাথে ওই আন্দোলনের তরুণদের শিা-সংস্কৃতি তথা জীবনাচারের সমন্বয়হীনতার বিষয়টি ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। এই আন্দোলনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও হঠাৎ করে শাহবাগ আন্দোলনের ইসলামবিদ্বেষী অবস্থানের বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে এবং আন্দোলনের ল্যচ্যুতিতে হতভম্ব হয়ে পড়েছে।
অন্যের মত-পথে বাধা সৃষ্টি না করে এবং অন্যের বিশ্বাসে আঘাত না দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কর্মসূচি দিলে গণমানুষ কর্তৃক প্রশংসিত হয়। গায়ের জোরে যদি কোনো মতবাদকে চেপে দেয়া হয়, তাহলে মানুষের যথার্থ সত্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকেÑ যেটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দার্শনিক জে এস মিল তার স্বাধীনতা তত্ত্বে উল্লেখ করেছেন। সব মানুষ, সব মিডিয়া শাহবাগের সুরে তাল মেলাবে আর সেটিই সমাজ-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হবেÑ এটি যারা ভাবছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ন্যায় ও সত্যই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যায় ও অসত্য ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিপ্তি হয়। ইসলাম হচ্ছে ন্যায়, সত্য, সুন্দর ও মানবতার সমার্থক। ইসলাম সম্পর্কে ব্যঙ্গবিদ্রƒপের পরিবর্তে এই বাস্তবতার যথার্থ উপলব্ধিই যেকোনো আন্দোলনের গতিপথকে সঠিক দিকে ধাবিত করতে পারে।
habib_umam@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads