শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৩

সরকারের পেছনে সরকার এবং বাকশালের প্রেতাত্মা


আহমদ আশিকুল হামিদ 
২০১০ সালের মে মাসে সৌদি আরবে গিয়েছিলাম ওমরাহ করতে। যাওয়ার সময় হজরত শাহ জালাল (রহঃ) বিমানবন্দরে ঢোকার পর থেকেই একের পর এক ধাক্কা খেতে হয়েছিল। এক নাম ছাড়া বিমানবন্দরের আর কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়নি। যাত্রীদের, বিশেষ করে বিদেশ থেকে আগত বাংলাদেশীদের হেনস্তা করার দৌরাত্ম্য যথারীতি চলছিল পুরোদমেই। বড় ধাক্কাটুকু খেয়েছিলাম ইমিগ্রেশনের কর্তব্য পালনরত অফিসারদের সামনে যাওয়ার পর। প্রত্যেক অফিসারের কম্পিউটারের পাশেই ছিল কয়েকটি করে ছবির ফটোকপি। এসব ছবি কথিত যুদ্ধাপরাধীদের। কিছুটা আলো-অাঁধারী ছিল বলে সবাইকে চিনতে পারিনি, তার প্রয়োজনও ছিল না। তবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ছবি চিনতে অসুবিধা হয়নি। লজ্জা লাগছিল এই ভেবে যে, এদের প্রত্যেকে বাংলাদেশের বিশিষ্টজন। সংবিধানসম্মত রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা। দু'জন তো সেদিন পর্যন্তও দেশের মন্ত্রী ছিলেন। অমন বিশিষ্টজনদের ছবিই ইমিগ্রেশনে এমনভাবে রাখা হয়েছিল যেন তারা পালিয়ে যাওয়ার মতো ফালতু লোকজন কিংবা কোনো মামলার পলাতক আসামী বা ওয়ান্টেড পারসনস! চরম অসভ্যের মতো যারা এই ব্যবস্থা করেছিলেন সে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে কিন্তু সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশীরা মোটেও আহামরি ধরনের কোনো কথা বলেননি। বাংলাদেশী অধ্যুষিত হোটেলে এবং গাড়িতে বরং মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ শুনেছি। ফজরের নামাযের পর পাঁচ তারকা হোটেলে পর্যন্ত দেখেছি, ম্যানেজারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য বাংলাদেশী। তাদের সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ শুনছেন। কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তখনও তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিন্তু গ্রেফতার করা হতে পারে শোনার পর যে প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশীদের মধ্যে দেখেছিলাম তা অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের জন্য সুখকর হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা টের পাবেন বলে আমার ধারণা।
এভাবে শুরু করার কারণ সম্পর্কে জানাতে হলে শাহবাগের দিকে দৃষ্টি ফেরানো দরকার। ‘নির্দলীয়' এবং ‘অবুঝ' তরুণদের আন্দোলন হিসেবে ধারণা দেয়ার চেষ্টা চালানো হলেও ‘জয় বাংলা' থেকে ‘তোমার আমার ঠিকানা' পর্যন্ত আওয়ামী স্লোগানগুলোর মধ্য দিয়ে প্রথম দিনটিতেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল, অন্তরালে আসলে কারা রয়েছে। হাসান ইমাম, রামেন্দু মজুমদার, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মুনতাসির মামুন, শ্যামল দত্ত ও অঞ্জন রায় প্রমুখের পর ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির পর্যন্ত চিহ্নিতজনদের প্রত্যেকেই এসেছেন পালাক্রমে। নির্লজ্জের মতো এসে ‘তরুণ প্রজন্মের' পেছনে দাঁড়িয়েছেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের নেতারা- যাদের মধ্যে ছিলেন সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ‘কাপুরুষ' হিসেবে বর্ণিত জেনারেল শফিউল্লাহও। তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জোরেশোরেই জানান দেয়া হয়েছিল। সেটা তারা দিতেই পারে। কিন্তু আপত্তি উঠেছে কিছু বিশেষ কারণে। দাবি জানানোর নামে প্রকাশ্যে আদালত অবমাননা এরকম একটি কারণ। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায় প্রত্যাখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বন্দি সব নেতাকে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দেয়ার জন্য রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে তারা। অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিদের কাছ থেকে তারা গায়ের জোরে রায় আদায় করার চেষ্টা চালিয়েছে। এখনো চালাচ্ছে। অথচ তথ্য-প্রমাণ, সাক্ষ্য, জেরা প্রভৃতির ভিত্তিতে যে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার অধিকার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের। শুধু ফাঁসিই কেন, বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড যেমন দিতে পারেন, তেমনি অভিযোগ প্রমাণিত না হলে কাউকে মুক্তি দেয়ারও অধিকার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের। অন্যদিকে ‘তরুণ প্রজন্ম'কে দিয়ে এমনভাবেই দাবি উত্থাপন করা হয়েছে যাতে এক ফাঁসি ছাড়া অন্য কোনো সাজা দেয়ার কথা মাননীয় বিচারপতিরা বিবেচনাও না করতে পারেন। বলা বাহুল্য, এর ফলে মাননীয় বিচারপতিদের ওপর শুধু প্রচন্ড মানসিক চাপেরই সৃষ্টি হচ্ছে না, দেশের বিচার ব্যবস্থাও একেবারে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এজন্যই কথা উঠেছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে।  একথা বলার অবশ্য সময় আসেনি যে, রায়টি দেয়া হয়েছে শাহবাগীদের চাপের মুখে।
‘তরুণ প্রজন্মের' দাবিগুলোও লক্ষ্য করা দরকার। গত ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদের কাছে তারা যে ছয় দফা দাবি পেশ করেছে, তার কোনো একটিকেই অরাজনৈতিক বা নির্দলীয় কোনো সাধারণ গোষ্ঠীর দাবি বলা যায় না। ছয় দফায় কথিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যেককে ‘সর্বোচ্চ' শাস্তি অর্থাৎ ফাঁসি দেয়ার দাবি তো ছিলই, একই সঙ্গে ছিল আইন পরিবর্তন করার দাবিও। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার জন্যও দাবি জানিয়েছিল ‘তরুণ প্রজন্ম'। বলেছিল, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও নিষিদ্ধ করতে হবে, যেগুলোর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ধরনের দাবি কোনো অরাজনৈতিক গোষ্ঠীর হতে পারে না। মাননীয় স্পিকারও জনগণকে স্তম্ভিত করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদে কোনো গোষ্ঠী চাইলেই তাদের কাছ থেকে দাবির ফিরিস্তি গ্রহণ যায় না। তাছাড়া শাহবাগ চত্বর থেকে যারা গিয়েছিল তারা জনগণের তো নয়ই, এমনকি কথিত ঐ ‘তরুণ প্রজন্মের'ও প্রকাশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না। অন্যদিকে অমন একটি গ্রুপের কাছ থেকেই স্মারকলিপি নিয়েছিলেন মাননীয় স্পিকার। ওদিকে সংসদের ভেতরে ঝড় তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘তরুণ প্রজন্ম' নামধারীরা যেদিন স্মারকলিপি পেশ করেছিল সেদিনই অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারিই জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘দৃষ্টি আকর্ষণ করে' প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তাদের (অর্থাৎ মাননীয় বিচারপতিদের) অনুরোধ করবো, মানুষের আকাঙ্ক্ষা তারা যেন বিবেচনায় নেন। অর্থাৎ তারা যেন ‘সর্বোচ্চ' শাস্তিই দেন! প্রধানমন্ত্রী শুধু ‘অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত' স্মারকলিপির প্রতিটি বাক্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেননি, সেগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রতিও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, টেলিভিশনে তরুণদের দেখে এই ‘বৃদ্ধ বয়সে' তারও নাকি শাহবাগে ‘ছুটে যাওয়ার' এবং গিয়ে তরুণদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর ইচ্ছা জেগেছে! প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, এতদিনে তার পথচলা নাকি ‘সার্থক' হয়েছে! এখন তিনি নাকি খুব ‘স্বস্তিতে, শান্তিতে ও নিশ্চিন্তে' মরতে পারবেন! প্রধানমন্ত্রী তার কথাও রেখেছেন। শাহবাগে ‘ছুটে' না গেলেও প্রজন্মওয়ালাদের দাবি অনুযায়ী মানবতাবিরোধী বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তার নির্দেশে মাত্র দু'দিনের মধ্যে আইনমন্ত্রী সংসদে বিল পেশ করেছেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একদিনের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাস করার জন্য ফেরৎ পাঠিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের অধিকার রেখে সংশোধিত আইনটি ১৭ ফেব্রুয়ারি পাসও হয়ে গেছে। পাস করার সময় লাফিয়ে এসেছিলেন বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন। তার দাবি অনুযায়ী ব্যক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বিচারের বিষয়টিকেও আইনে যুক্ত করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর তোড়জোরও শুরু হয়ে গেছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বলা দরকার, এটাও নিরীহ ‘তরুণ প্রজন্মের'ই দাবি ছিল!
‘তরুণ প্রজন্ম' নামধারীদের ফ্যাসিস্টসুলভ বক্তব্য এসেছে আপত্তির অন্য এক কারণ হিসেবে। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে তো বটেই, শাহবাগের সমাবেশ থেকে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও ফ্যাসিস্ট সুরে ভয়ঙ্কর হুমকি উচ্চারিত হয়েছে। শেষ কয়েকদিনে মনেই হয়নি, শাহবাগ নাটকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কথিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আদায়ের দাবি জানানো। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এরকম এক ঘোষণায় তরুণ প্রজন্মের নেতারা বলেছে, শাহবাগের নাটক সম্পর্কে আর একটা ‘উল্টাপাল্টা কথা' লিখলে দৈনিক আমার দেশের সম্পাদককে ‘খতম' করা হবে। টিভি টকশোর জনপ্রিয় দুই আলোচক অধ্যাপক পিয়াস করিম ও ড. আসিফ নজরুলের ‘পিঠের চামড়া' তুলে নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে তারা। সাবধান করতে গিয়ে বলেছে, ‘কুলাঙ্গার' দু'জন শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে ‘উল্টাপাল্টা কথা' বললে তাদেরকেও ‘নির্মূল' করা হবে, ‘পিঠের চামড়া' তো থাকবেই না। আমার দেশ-এর পাশাপাশি দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম এবং দিগন্ত টিভির বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বক্তারা। বর্জনের আহবান তো জানিয়েছেই, এসব গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের ‘প্রতিহত' করার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, শাহবাগের ঐ সমাবেশ থেকে হুমকি ও ঘোষণা এসেছিল সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে। এ ধরনের হুমকি এখনও উচ্চারণ করে চলেছে তারা।
হুমকির ধারাবাহিকতায় শাহবাগের নতুন প্রজন্ম তাদের দাবির মধ্যেও পরিবর্তন এনেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টিকে অনেকাংশে শিকেয় তুলে সিরিয়ালের এক নম্বরে তারা মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে এসেছে। সবকিছু ফেলে তাদের আগে দরকার মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করানো! এজন্য প্রথমে তারা ২৪ ঘণ্টার ‘আল্টিমেটাম' দিয়েছে। তারপর বলেছে ‘অবিলম্বে' গ্রেফতার করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারও এ ব্যাপারে জবরই দেখিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ প্রহরায় রীতিমতো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল দিয়ে নতুন প্রজন্মের স্বঘোষিত নেতাদের সচিবালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে তাদের কাছ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু স্মারকলিপি গ্রহণ গ্রহণ করেননি, মাহমুদুর রহমান এবং তার সক্রিয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে ‘এখনই' ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। বুঝতে বাকি থাকেনি, তরুণ প্রজন্ম নামধারীরা আসলেও সরকারকে ‘উদ্ধার' করার জন্যই ময়দানে নেমেছে।  কারণ, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সর্বশেষ পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও দুর্নামের পরিণতিতে সরকার এক মারাত্মক পরিস্থিতির মুখে এসে গিয়েছিল। নিন্দিত হচ্ছিল দেশে-বিদেশে। এদিকে আবার মেয়াদের শেষ বছরের দিন গণনা শুরু হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীনরা তাই অতি কূটিল কৌশল অবলম্বন করেছেন। শাহবাগের তরুণ প্রজন্মও সেবাদাসের ভূমিকাই পালন করে চলেছে।
তরুণ প্রজন্ম নামধারীরা হঠাৎ কেন মাহমুদুর রহমানকে প্রধান টার্গেট বানিয়েছে এবার সেদিকে লক্ষ্য করা দরকার। উত্তর জানার জন্য ইসলাম ও মুসলিম বিরোধিতার উল্লেখ করতেই হবে। এ ব্যাপারেও অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছে শাহবাগ মঞ্চের কুশীলবরাই। তরুণ প্রজন্ম নামের আড়ালে তারা আসলে এমন একটি গোষ্ঠী যারা বহুদিন ধরে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। মহান আল্লাহ, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং পবিত্র আল-কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত অসভ্য ভাষায় মন্তব্য করার ও কুৎসা রটানোর মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম নামধারী এই ব্লগাররা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুচিন্তিতভাবে বিষোদগার করে চলেছে। চালাচ্ছে বিরামহীন সাইবার ওয়ার। যে ধরনের ভাষা ও শব্দ তারা ব্যবহার করেছে সে সবের কোনো একটিও ধর্মপরায়ণ কোনো মুসলমানের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। ঐ ব্লগাররা কিন্তু শুধু ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী কটূক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের আইন ও আদালতের প্রতিও তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। গত বছরের মার্চে দেয়া একটি রায়ে হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা চিহ্নিত ইসলামবিরোধী ব্লগগুলো বন্ধ করাসহ ব্লগারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। গোয়েন্দারা একজন ব্লগারকে গ্রেফতার করার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাকে ছেড়ে শুধু ছেড়েই দিতে হয়নি, গ্রেফতারকারী গোয়েন্দাদের উল্টো ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল।
ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারগোষ্ঠীও সরকারের এ মনোভাবের সুযোগ নিতে ভুল করেনি। প্রচারণা বন্ধ করার কিংবা সংযত হওয়ার পরিবর্তে ব্লগাররা বরং নিজেদের কর্মকান্ডকে আরো জোরদার করেছে। তারা একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের প্রতিও প্রকাশ্যে অবজ্ঞা দেখিয়েছে। যেমন গত বছরের ২১ মার্চ রায় ঘোষিত হওয়ার পর আসিফ নামের একজন ব্লগার ‘সম্পূর্ণ সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে' যুক্তিহীন ধর্মীয় অনুভূতির রক্ষক আদালত অবমাননার ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালত সম্পর্কে কুৎসিত ভাষা ও শব্দেও অনেক মন্তব্য করেছে ব্লগাররা। অন্যদিকে ব্লগারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ধারে কাছে যাওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মারমুখী হয়ে ওঠেছে, যারা ঐ ব্লগারদের ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেছিলেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুময়ার নামাযের আগে ও পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ মুসল্লিদের ওপর যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হামলা চালিয়েছে সে সম্পর্কে মাথা ঠান্ডা রেখে বর্ণনা দেয়াটা কঠিনই বটে। তরুণ প্রজন্ম নামের আড়ালে একটি নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী বহুদিন ধরে মহান আল্লাহ, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং পবিত্র আল-কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কে অত্যন্ত অসভ্য ভাষায় যে ভয়ঙ্কর অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ১২টি ইসলামী ও সমমনা দল জুময়ার নামাযের পর প্রতিবাদ মিছিল করতে চেয়েছিল। এই কর্মসূচির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ছিল না। অন্যদিকে সরকার নিয়েছিল প্রচন্ড মারমুখী অবস্থান। পুলিশ মুসল্লিদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে ঢুকতেই দিতে চায়নি। গেটগুলোতে তারা তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। কোনোভাবে নামায আদায় করলেও বেরিয়ে আসা মাত্র মুসল্লিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুলিশ। পুলিশ বায়তুল মুকাররম মসজিদের ভেতরে গুলী পর্যন্ত চালিয়েছে। বায়তুল মুকাররম থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব হয়ে মৎস্য ভবন পর্যন্ত পুরো এলাকা জুড়ে চলেছে এই তান্ডব। অনেক মুসল্লিকেই পুলিশের লাথি খেতে হয়েছে। পুলিশ লাথি মেরেছে এমনকি পিতার বয়সীদেরকেও। রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় পুলিশ একই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মুসল্লিদের লাঠিপেটা করেছে। টিয়ার গ্যাস তো ছুঁড়েছেই, কয়েকশ রাউন্ড গুলীও করেছে। এসব গুলীতে মুসল্লিরা শুধু নন, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষও আহত হয়েছেন। একই উদ্দেশ্য থেকে পুলিশ মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে হত্যা করেছে চারজনকে। ঘটনাপ্রবাহের ঐ পর্যায়ে মাত্র ১১ দিনে পুলিশ ১৭ জনের লাশ ফেলেছে। এরপর এসেছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা-উত্তর পরিস্থিতি। ১ মার্চ দুপুরে এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে কম করে হলেও ৬০ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছে পুলিশ। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে। নাহলে পুলিশের পক্ষে এতটা নিষ্ঠুরতা দেখানো সম্ভব হওয়ার কথা নয়।
এভাবে হত্যাসহ নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও তার ‘সক্রিয়' সহযোগীদের বিরুদ্ধে ‘এখনই' ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েও পরিস্থিতিকে অত্যন্ত বিপজ্জনক করে তুলেছে সরকার। অথচ গণতন্ত্রের পাশাপাশি ৯০ ভাগ অধিবাসী মুসলমানদের ধর্মের ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত ছিল প্রথমে ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। কারণ, সর্বাত্মক উস্কানি তারাই দিয়েছে। ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের অনুভুতিতে চরমভাবে আঘাত করার মধ্য দিয়ে সাইবার ওয়ারের সূচনাও তারাই করেছে। অন্যদিকে মন্ত্রীরা কিন্তু তাদের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরং নতুন প্রজন্মকে অনুসরণীয় হিসেবে সাবাশী দিয়েছেন, তাদের ঘাড়েও তুলেছেন। ওদিকে অনেকাংশে অনুগ্রহ দেখানোর ঢঙে মাঝখানে তথ্যমন্ত্রী একদিন জানিয়েছেন, ইসলামবিদ্বেষী কয়েকটি ব্লগ বন্ধ করে দেয়ার জন্য তিনি নাকি বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যি তিনি তেমন কোনো নির্দেশ দিয়েছেন কি না এবং দিলেও বিটিআরসি সত্যি কোনো ব্লগ বন্ধ করেছে কি না সে বিষয়ে জানার কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাছাড়া ইসলামবিদ্বেষীরা এতটাই বাড়াবাড়ি করে চলেছে যে, কয়েকটি মাত্র ব্লগ বন্ধ করলেই তাদের প্রচারণা বন্ধ হয়ে যাবে না। তারা বরং নিত্য নতুন ব্লগের মাধ্যমে উস্কানি আরো বাড়িয়ে চলবে। এজন্যই শুধু বন্ধ করার আশ্বাস দিলে চলবে না, সত্যিই বন্ধ যে করা হয়েছে তারও প্রমাণ দেয়া দরকার। একযোগে ব্যবস্থা নেয়া দরকার বিশেষ করে এরই মধ্যে যারা ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। না হলে জনগণ যেমন মোটেই বিশ্বাস করবে না, তেমনি শান্ত করা যাবে না সামাজিক অস্থিরতাও- যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্রমাগত জোরদার হয়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্যে।
উদ্বেগের কারণ হলো, তরুণ প্রজন্ম নামধারী ব্লগাররা কিন্তু গণতন্ত্রসম্মত সমালোচনা বা শালীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হুমকিও তারাই বেশি দিচ্ছে। কিন্তু এদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। তাদের প্রতি উল্টো উদারতাই দেখানো হচ্ছে। অথচ ব্লগাররা শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধেই সাইবার ওয়ার চালাচ্ছে না, দেশের উচ্চ আদালতকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সব জেনে-বুঝেই একটি নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারগোষ্ঠীকে সমর্থন-সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে শুধু নয়, তাদের দিয়ে শাহবাগ নাটক সাজানোর মাধ্যমেও ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইসলামবিরোধী উদ্দেশ্যের ন্যক্কারজনক প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। সরকার পুলিশকে দিয়ে ধর্মপরায়ণ মুসলমানদেরও হত্যা করাচ্ছে। এমন নীতি ও কর্মকান্ড কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এই সত্য ভুলে যাওয়ার পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে যে, বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ শুধু মুসলমান নন, ধর্মপরায়ণ, অসাম্প্রদায়িক ও সংগ্রামী মানুষও। নিজেদের অধিকার রক্ষা ও আদায় করার জন্য যুগে যুগে তারা সংগ্রাম করে এসেছেন। সংগ্রাম যে চালিয়ে যাবেনই, তারও প্রমাণ দিচ্ছেন তারা।
এমন নিশ্চিত সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে উচিত যখন ছিল নীতি-সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ডে পরিবর্তন আনা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখানো আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা তখন উল্টো পথে এগিয়ে চলেছেন। তাদের মাধ্যমে আরো একবার জনগণকে বাকশালের প্রেতাত্মাও দেখতে হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তরুণ প্রজন্মের আড়ালে জাতির ওপর একই সঙ্গে চাপানো হচ্ছে দ্বৈত শাসন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন এমনকি সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এডভোকেট জয়নাল আবেদীন না বলে পারেননি যে, দেশে এখন দুটি সরকারের শাসন চলছে- একটি চালাচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার, শাহবাগে বসে অন্যটির নেতৃত্ব দিচ্ছে ইমরান সরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের কর্মকান্ডের পরিণতি ধ্বংসাত্মক হতে বাধ্য। আমরা জানি না, ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন ঘটবে কি না। বর্তমান পর্যায়ে শুধু এটুকু জানিয়ে রাখা দরকার, তিনিও যদি শাহবাগীদের কথায় নৃত্য করতে থাকেন তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে তাকে এমনকি নেতৃত্ব পর্যন্ত হারাতে হতে পারে। কারণ, শাহবাগে তৎপর মস্কোপন্থীরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছে। বড় কথা, তারা সেই মনি সিং-মোজাফফরদের উত্তরসূরি, বন্ধুত্বের ছদ্মাবরণে যারা প্রধানমন্ত্রীর পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকেও ডুবিয়ে ছেড়েছিলেন।



0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads