মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

৭ নভেম্বরের চেতনা : আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়



শেখ শওকত হোসেন নিলু
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে চালু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতিমালাগুলো।
পটভূমি
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন এবং নিজে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ বিভক্ত হয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান তোলে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। কী লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মাত্র ২ মাসের মধ্যে এই সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিল সে সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা খুব কম সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকর্মীর আছে বলে আমার মনে হয়েছে।
এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আতাউ রহমান খান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ব্যারিস্টার কামরুল ইসলাম, সালাহউদ্দিনসহ মোট ৯ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আরও ১৫ থেকে ২০ জন বিরোধীদলীয় নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। খন্দকার মোশতাক আহমদের ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে হেলিকপ্টারে করে এনে বঙ্গভবনে বসে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ড. আলীমুল রাজী, এনায়েত উল্লাহ খান, মেজর (অব.) এমএ জলিলের মতো জনপ্রিয় নেতাদেরও ঘোষণার মাধ্যমে পরাজিত দেখানো হয়। এভাবেই শুরু হয় প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। গঠিত হয় জাতীয় রক্ষীবাহিনী। সে বাহিনীর মূল কাজের পরিধি নির্ধারণ করা হয় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্মম অমানবিক জুলুম-নির্যাতন। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় গুম-খুন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এমনকি জেলের মধ্যেও রাজনৈতিক নেতা হত্যা করা হয় এবং পরে মস্তকবিহীন লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় নদীর পাড়ে কিংবা মাঠে-ময়দানে। সরকারপ্রধান ও আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে দ্রুতগতিতে। এই রাজনৈতিক পটভূমিতে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে তারা অন্য সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে দেশের শত্রু বলে আখ্যায়িত করতে থাকে।
১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই শাসক দল বুঝতে পারল তাদের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকা তাদের পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। শেখ মুজিবের সরকার গৃহবন্দি করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে গ্রেফতার করা হয় তাকে। জননেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া, ভাষাসৈনিক অলি আহাদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) এমএ জলিল ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী আ.স.ম আবদুর রবসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন প্রখ্যাত জাতীয় নেতা কাজী জাফর আহমদ।
এইভাবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। আওয়ামী লীগের মধ্যেও বাকশালী শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। অনেকেই বাকশালী ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন, কিন্তু সংসদ থেকে পদত্যাগ করেননি।
অন্যদিকে বাকশালী ব্যবস্থার ঘোর সমর্থক অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মেদ, কমরেড মনিসিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জিরা হন চরমভাবে উপেক্ষিত। চাকরিরত সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও বাকশালে যোগ দিতে বলা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির আদলে ১৫ সদস্যের পলিটব্যুরো গঠন করা হয়। জাতীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয় শেখ ফজলুল হক মনি ও শেখ শহীদুল ইসলামকে। এরা দু’জনই শেখ মুজিবুর রহমানের নিকটাত্মীয়। এ থেকে দেশবাসী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আলামত দেখতে পায় এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এভাবেই গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একদলীয় ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার ফলে দেশে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়। কেড়ে নেয়া হয় মানুষের মৌলিক অধিকারের সব ব্যবস্থা। ৪টি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন ও শিশু রাসেলসহ নির্মম হত্যাযজ্ঞ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেষ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনিসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সবাইকেই হত্যা করা হয়। এসময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তত্কালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান একে খন্দকার সেই সরকারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আজকের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালী একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
জটিল ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ৮৩ দিন খন্দকার মোশতাকের শাসন পরিচালিত হয়। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ খন্দকার মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। ৪ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের মায়ের নেতৃত্বে ৩২ নং ধানমন্ডি অভিমুখে এক শোক মিছিলের আয়োজন করা হয়। এই থেকেই জনমনে প্রতীয়মান হয় খালেদ মোশাররফের সরকার শেখ মুজিবুর পন্থীদের সরকার।
এরই মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন কর্নেল তাহের, তার সঙ্গে ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও হাসানুল হক ইনুরা। তারা ভর করেন গৃহবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ওপর। অবশেষে ৭ নভেম্বর সূর্যোদয়ের আগেই ঢাকাসহ সারাদেশে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর সিপাহী-জনতা ভাই ভাই বাকশালীদের বিচার চাই—এই স্লোগান দিয়ে সেনা সদস্য ও জনগণ বঙ্গভবনসহ রাজপথ দখল করে নেন। নিহত হন খালেদ মোশাররফ। গৃহবন্দিত্ব দশা থেকে মুক্ত হন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এভাবেই ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে উপস্থিত হন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কালবিলম্ব না করে সেনা সদস্যদের চেইন অব কমান্ডের মধ্যে নিয়ে আসেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং উন্নয়নের রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৩ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তার এই শাসনকালের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবনে কতগুলো মৌলিক নীতিমালা পরিবর্তিত হয় : ১. জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। ২. বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। ৩. সংবাদ পরিবেশনের পূর্ণ স্বাধীনতা। ৪. বিভেদের রাজনীতি পরিহার ও পরিত্যাগ করে জাতীয় ঐক্য অর্থাত্ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ব্যক্তি উদ্যোগকে সহযোগিতা প্রদান, পররাষ্ট্রনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত না হওয়া, বিশেষ করে মুসলিম দেশ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সর্বোপরি রাজনীতি ও প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করা, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ৩৬৫ টাকা। তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সাভারে ৫ কাঠা জায়গার দলিল। এই সততা আজকে রাজনীতিতে বিরল।
সর্বত্র রাজনৈতিক মেরুকরণ, দুর্নীতি, লুটপাট বাংলাদেশকে আজ সার্বিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশটির ভাবমূর্তি নিম্নগামী।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে ৭ নভেম্বরের চেতনা, সত্ দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আসুন আমরা ৭ নভেম্বরের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হই।
লেখক : চেয়ারম্যান ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads