সি রা জু র র হ মা ন
|
মঙ্গলগ্রহের কোনো পর্যটক বাংলাদেশে এলে ধরে নেবে জামায়াতে ইসলামী হচ্ছে এদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। তাদের দোষ দেয়া যাবে না, কেননা এ দলটির বিরুদ্ধে স্থূলমতি নির্যাতন চালাতে গিয়ে সরকার তাদের মধ্যে মরিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে দিয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের ওপর ক্রুদ্ধ সাধারণ মানুষের সহানুভূতি এখন জামায়াত আর শিবিরের দিকে চলে গেছে। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যেখানেই পুলিশের আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুণ্ডাদের সংঘর্ষ হচ্ছে দেখা যাচ্ছে যে স্থানীয় লোকেরাও তাদের সঙ্গে ভিড়ে যাচ্ছে। অন্যায়-অবিচারের ভুক্তভোগীদের প্রতি সাধারণ মানুষ সবসময় সহানুভূতিসম্পন্ন হয়।
স্বভাবতই বাংলাদেশের মিডিয়ায় এখন শাসক দলের চাইতেও বেশি মনোযোগ পাচ্ছে জামায়াত-শিবির। আমি এ কলাম লিখতে শুরু করেছি বুধবার ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যাবেলা। আজ খুলনায় জামায়াতে ইসলামী হরতাল পালন করেছে, কেননা আগের দিন পুলিশ জামায়াতের একজন নেতাকে গ্রেফতার করেছিল। ইন্টারনেটে দেখতে পাচ্ছি পুলিশের সঙ্গে জামায়াতের কর্মী ও তাদের স্থানীয় সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে, পুলিশ ৫০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
আগের দিন রাজধানীতে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ছিল বুধবারের পত্রিকার একটা শিরোনাম। মঙ্গলবারের অন্যান্য খবরের মধ্যে ছিল আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কনভয়ের ওপর অকস্মাত্ হামলা। সেদিনের আরেকটা ঘটনা ভিআইপি রোডে শিবিরের ঝটিকা মিছিল। এসব ঘটনায় অবশ্যই মনে হচ্ছে যে বহু স্থানীয় লোক এবং পথচারীও হামলায় অংশ নিয়েছিল।
বুধবারের আরও কিছু খবর। সংসদে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছেন : ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ এবং তারপর পেছনের দরোজা দিয়ে আবার মন্ত্রী হওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হাটহাজারীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বেআইনি ঘোষণা করা কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন। বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর অভিযোগ করেছেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির পেছনে কয়েকটি রাজনৈতিক দল আছে।
চোখে অস্ত্রোপচারের কারণে কয়েকদিন ইন্টারনেট পড়তে পারিনি। তারপর থেকে দেখছি রোজই দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশ এবং শাসক দলের গুণ্ডাদের সঙ্গে জামায়াত কিংবা শিবিরের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অকারণে অথবা যুদ্ধাপরাধের ভুয়া অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করে পুলিশ উস্কানি দেয়; জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ এবং শাসক দলের গুণ্ডারা তাদের ওপর চড়াও হয়। সাধারণত সংঘর্ষ বাধে এভাবে। মঙ্গলগ্রহের উপরোক্ত পর্যটক বাংলাদেশে কোনো সুশাসক সরকার, আইনশৃঙ্খলা কিংবা ন্যায়বিচার দেখতে পাবে না, তারা দেখবে হয় দেশব্যাপী ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে জামায়াত ও শিবির, না হয় সরকারের পুলিশ জামায়াত ও শিবিরকে নির্মূল করার জন্য নিদ্রা হারাম করে উঠেপড়ে লেগেছে।
তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণকালীন সাংবাদিকতা শরু করেছি ১৯৫০ সাল থেকে। ধর্মীয় রাজনীতি মুসলিম লীগ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবন শরু হয়েছে। আওয়ামী লীগও যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মের আলখাল্লা পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। অতএব আরেকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর উদ্ভব অস্বাভাবিক ছিল না। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের সব নির্বাচনই হয় চোখে দেখেছি, নয়তো দূরে থেকে লক্ষ্য করেছি। জামায়াত জয়ী হবে বলে বহু পূর্বাভাস সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনগুলোতে এ দলের আসন সংখ্যা হাতের এক কিংবা দুই আঙ্গুলেই গণনা করা গেছে।
জামায়াতকে নিয়ে হাসিনার পুতুল খেলা
জামায়াতে ইসলামীকে জাতীয় রাজনীতির গৌরব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, দলটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালুর দাবিতে শেখ হাসিনা আন্দোলন করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কাতারবন্দী হয়ে। মাওলানা নিজামীর পাশে বসে আওয়ামী লীগ নেত্রী বিএপি সরকারকে গরম গরম হুমকি দিয়েছেন, ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে অধ্যাপক গোলাম আজমের দোয়া নিয়ে তিনি নির্বাচন করেছিলেন। সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনে বৃহত্তম দল হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, জামায়াতের সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
হাসিনার ক্যাডার এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের পেশিশক্তি তখন বর্তমানের মতো শক্তিশালী ছিল না। জামায়াতের অপেক্ষাকৃত সুসংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনীকে আওয়ামী লীগ নেত্রীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর মনোনীত নারী আসনগুলো পাওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন আর হাসিনার প্রয়োজন ছিল না। ধর্মীয় রাজনীতি হঠাত্ করে তার কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে গেল। জামায়াতে ইসলামীকে তিনি আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলে দিলেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিশক্তি কিংবা ইতিহাস-জ্ঞান কোনোটাই নির্ভরযোগ্য নয়। জামায়াতে ইসলামীর কাছে ঋণ সুবিধাজনকভাবে ভুলে গেছেন তিনি। বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারতের নেতাদের তিনি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক মনে করেন। সারা বিশ্ব এখন জানে যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শের’ বদৌলতে। সে ভারতে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকার গঠন করেছে। হিন্দু রাজনৈতিক দলগুলো এখনও কোনো কোনো রাজ্যে শাসন করছে। সে দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে বছরখানেক পরে। হিন্দু ধর্মীয় দল বিজেপি আশা করছে তখন তারা আবারও সরকার গঠন করবে।
রাজনীতি মানুষের জন্য এবং মানুষেই রাজনীতি করে। মানুষগুলো ধর্মপ্রাণ হলে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব পড়বেই। মোট কথা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে সেকুলার প্রশাসনের কোনো বিরোধ নেই। এই বাংলাদেশেও ধর্মীয় রাজনৈতিক দল, এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রাদর্শ থাকা সত্ত্বেও সেক্যুলার প্রশাসন সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা যে এবারে ক্ষমতা পেয়ে উগ্র জামায়াত-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছেন তার কারণ বাহ্যিক। এই বিদ্বেষকেও তিনি ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক স্বার্থে ও প্রয়োজনে। ভারত সামরিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে ব্যবহার ও শোষণ করতে চায়। তাদের ভয় বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক শক্তি এ ব্যাপারে বাধা দেবে। ভারতের বিশেষ ভয় জামায়াতে ইসলামী সম্বন্ধে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং গত বছর জুলাই মাসে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী ভারত-বিরোধী এবং বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে।
এই ৪০ শতাংশ সমর্থনের কথাটা অবশ্যই ‘র’য়ের কোনো অনভিজ্ঞ চরের বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান এবং তারা ধর্মভীরু। তারা টুপি পরে, দাড়ি রাখে। মাওলানা, মৌলবি এবং ধর্মীয় আলেমদের তারা শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, তাদের সভা-সমাবেশে যেতে, তাদের বক্তব্য শুনতে তারা ভালোবাসে। এটা বর্তমানে যেমন সত্য, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকে সমানেই সত্য ছিল। কিন্তু অন্তত ১৯৫৪ সাল থেকে আমরা দেখেছি, এই টুপি-দাড়ি পরিহিত মানুষগুলো ভোট দেয়ার সময় ভুল করে না। তারা ভোট দেয় নিজেদের বিচারবুদ্ধি থেকে, কোনো মাওলানা-মৌলবির ফতোয়া শুনে নয়।
এই সহজ সত্যটি উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভারতকে খুশি করার আশায় জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করার কাজে হাত দিয়েছেন। একইসঙ্গে ‘ইসলামী সন্ত্রাসের‘ বিরুদ্ধে ‘সাফল্য’ দেখিয়ে ইসরাইলি-মার্কিনিদের মনোরঞ্জনও তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ইতিহাস থেকে যে শিক্ষাটা নিতে শেখ হাসিনা ব্যর্থ হয়েছেন সেটা এই যে, নির্যাতন-নিপীড়ন দিয়ে কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করা যায় না। বৃটিশরা তাদের সাম্রাজ্য কায়েম রাখার জন্য কম নির্যাতন করেনি। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের মতো তারাও পিটুনি শাস্তি দিয়েছে, গ্রাম ও চাক্লাভর্তি মানুষের বিরুদ্ধে পাইকারি মামলা করেছে। সন্ত্রাসের দায়ে যাদের তারা ফাঁসি দিয়েছে তারা প্রায় তাত্ক্ষণিকভাবেই সারা ভারতবর্ষে ‘হিরো‘ হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস নেতারা হাজারে হাজারে পুলিশের লাঠিপেটা ও টিয়ারগ্যাস খেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তারাই হয়েছিলেন মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী ও জননায়ক।
কারণ কী? কারণ এই যে, যাদের ওপর অবিচার করা হয়, অন্যায়ভাবে যাদের নির্যাতন ও নিপীড়ন করা হয়, সাধারণ মানুষের সহানুভূতি স্বভাবত তাদের দিকেই যায়। এটাই মানব ধর্ম। ইংরেজরা মহাত্মা গান্ধীকে যতই লাঠিপেটা করেছে, যত বেশি তাকে কারাদণ্ড দিয়েছে, তার অনুসারীদের মিছিল ততই দীর্ঘ হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশের মানুষের নীতিগত আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দুই বছরের ভেতর শেখ মুজিবুর রহমান সবচাইতে জঘন্য ১৯৩ যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানিদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, স্বদেশে তিনি স্বাধীনতার বিরোধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। অত্যন্ত অস্বাভাবিক একটা উত্তেজনার সময় উপমহাদেশে এবং স্বদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য সেসব ব্যবস্থা তিনি প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেছিলেন। নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তার সে ব্যবস্থাগুলোকে স্বাগত জানিয়েছিল। শফিক উদ্দিন আহমেদ ও শাহরিয়ার কবিররা তখন কোথায় ছিলেন?
চল্লিশ বছর পরে পুরনো ক্ষতকে চুলকিয়ে রক্তারক্তি করা, তার দ্বারা জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা এবং দেশকে ঘৃণা ও প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধ করার কোনো যুক্তি বাংলাদেশের মানুষ খুঁজে পায়নি। বিশেষ করে সবচাইতে জঘন্য যুদ্ধাপরাধ যারা করেছে তাদের যখন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া বিচারের নামে যা করা হচ্ছে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এবং সাধারণ মানুষ তাতে আস্থা স্থাপন করতে পারছে না। বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিদেশিরা বলছে এ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়। কোনো বিদেশি আইনজীবীকে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ সমর্থন করার জন্য আসতে দেয়নি এই সরকার। কেন? কী তারা লুকোতে চেয়েছে?
স্বাধীনতার পর নতুন সরকার কতজনকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করেছিল? আর যুদ্ধাপরাধী বলে কতজনকে গ্রেফতার করেছে এই সরকার? পাইকারি হারে গ্রেফতার করে সরকার এ ধারণা সৃষ্টি করেছে যে বিচার নয়, সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের জেলে পুরে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই হচ্ছে উদ্দেশ্য। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, এমন ব্যক্তিদের যুদ্ধাপরাধী বলে গ্রেফতার করা হচ্ছে কিংবা সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হচ্ছে একাত্তর সালে যাদের জন্ম হয়েছিল কি হয়নি।
জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষ কেন হয়
সরকার এবং শাসক দল এখন মাসুম বাচ্চা সাজার চেষ্টা করছে। তারা বলছে জামায়াত ও শিবির পুলিশের ওপর চড়াও হচ্ছে, পুলিশকে আক্রমণ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কী দেখেছে? আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রলীগ গুণ্ডারা শিবিরের সমর্থক ছাত্রকে খুন করেনি? তারপর থেকে কি চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে শিবিরের সমর্থক বলে ছাত্রহত্যা হয়নি?
অন্যায়-অত্যাচার বড়জোর দু’চারবার হজম করা যায়। তারপর মানুষ রুখে দাঁড়ায়। এটাই হচ্ছে স্বভাব। যতদূর জানি শেখ হাসিনার সরকারও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেনি। তাহলে জামায়াতি কিংবা শিবির সমর্থক বলে হাজার হাজার লোককে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে? পিটুনি খেয়ে খেয়ে পাল্টা যদি ওরা পেটাতে যায় তাহলে সেটাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিতে হবে। ‘বজ্র আঁটুনি ফস্্কা গেরো’ কথাটা বাংলা ভাষার। আমাদের কবিও লিখে গেছেন, ‘ওদের বাঁধন যতো শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে’।
বাংলাদেশের মানুষ এখন শেখ হাসিনার সরকার এবং আওয়ামী লীগের ওপর বীতশ্রদ্ধ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কারণগুলো লিখতে গেলে একটা কলামের কলেবর খুবই দীর্ঘ হয়ে যাবে। সরকারকে তারা আর সহ্য করতে পারছে না। সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে যারাই রুখে দাঁড়াবে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি তাদের দিকেই যাবে। জামায়াতে ইসলামী সেই স্বাভাবিক সহানুভূতি থেকেই লাভবান হচ্ছে।
আরেকটা ভুল সরকার ও পুলিশ করছে পাইকারিভাবে জামায়াত-শিবির কর্মী ও তাদের সমর্থকদের গ্রেফতার করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলমগীর মহীউদ্দীন সংসদে বলেছেন, কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ সংখ্যক লোক এখন কয়েদ আছে। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী প্রকৃত সংখ্যা তারচাইতেও বেশি। জামায়াতের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ সরকার যতই বিস্তার করবে, কর্মী ও সমর্থক মিলে বন্দীর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে। রাজনৈতিক বন্দীদের স্থান করার জন্য সরকার সাধারণ অপরাধীদের আর গ্রেফতার করছে না। দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২১ জনকেও ক্ষমা করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এমতাবস্থায় কারাগারেও সরকার শান্তি বজায় রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ।
আগেই বলেছি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি সবসময়ই ধাবিত হয় নির্যাতীত-নিপীড়িতের দিকে। জামায়াতে ইসলামীর বেলায়ও সেটাই হচ্ছে। সরকারের বর্তমান নীতি যদি বেশিদিন বজায় থাকে বাংলাদেশের আরও আরও বেশি মানুষেরও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ততই বৃদ্ধি পাবে। (লন্ডন, ১৭.১১.১২)
serajurrahman34@gmail.com
স্বভাবতই বাংলাদেশের মিডিয়ায় এখন শাসক দলের চাইতেও বেশি মনোযোগ পাচ্ছে জামায়াত-শিবির। আমি এ কলাম লিখতে শুরু করেছি বুধবার ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যাবেলা। আজ খুলনায় জামায়াতে ইসলামী হরতাল পালন করেছে, কেননা আগের দিন পুলিশ জামায়াতের একজন নেতাকে গ্রেফতার করেছিল। ইন্টারনেটে দেখতে পাচ্ছি পুলিশের সঙ্গে জামায়াতের কর্মী ও তাদের স্থানীয় সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে, পুলিশ ৫০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
আগের দিন রাজধানীতে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ছিল বুধবারের পত্রিকার একটা শিরোনাম। মঙ্গলবারের অন্যান্য খবরের মধ্যে ছিল আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কনভয়ের ওপর অকস্মাত্ হামলা। সেদিনের আরেকটা ঘটনা ভিআইপি রোডে শিবিরের ঝটিকা মিছিল। এসব ঘটনায় অবশ্যই মনে হচ্ছে যে বহু স্থানীয় লোক এবং পথচারীও হামলায় অংশ নিয়েছিল।
বুধবারের আরও কিছু খবর। সংসদে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছেন : ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ এবং তারপর পেছনের দরোজা দিয়ে আবার মন্ত্রী হওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হাটহাজারীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বেআইনি ঘোষণা করা কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন। বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর অভিযোগ করেছেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির পেছনে কয়েকটি রাজনৈতিক দল আছে।
চোখে অস্ত্রোপচারের কারণে কয়েকদিন ইন্টারনেট পড়তে পারিনি। তারপর থেকে দেখছি রোজই দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশ এবং শাসক দলের গুণ্ডাদের সঙ্গে জামায়াত কিংবা শিবিরের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অকারণে অথবা যুদ্ধাপরাধের ভুয়া অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করে পুলিশ উস্কানি দেয়; জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ এবং শাসক দলের গুণ্ডারা তাদের ওপর চড়াও হয়। সাধারণত সংঘর্ষ বাধে এভাবে। মঙ্গলগ্রহের উপরোক্ত পর্যটক বাংলাদেশে কোনো সুশাসক সরকার, আইনশৃঙ্খলা কিংবা ন্যায়বিচার দেখতে পাবে না, তারা দেখবে হয় দেশব্যাপী ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে জামায়াত ও শিবির, না হয় সরকারের পুলিশ জামায়াত ও শিবিরকে নির্মূল করার জন্য নিদ্রা হারাম করে উঠেপড়ে লেগেছে।
তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণকালীন সাংবাদিকতা শরু করেছি ১৯৫০ সাল থেকে। ধর্মীয় রাজনীতি মুসলিম লীগ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবন শরু হয়েছে। আওয়ামী লীগও যাত্রা শুরু করেছিল ধর্মের আলখাল্লা পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। অতএব আরেকটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর উদ্ভব অস্বাভাবিক ছিল না। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাংলাদেশের সব নির্বাচনই হয় চোখে দেখেছি, নয়তো দূরে থেকে লক্ষ্য করেছি। জামায়াত জয়ী হবে বলে বহু পূর্বাভাস সত্ত্বেও জাতীয় নির্বাচনগুলোতে এ দলের আসন সংখ্যা হাতের এক কিংবা দুই আঙ্গুলেই গণনা করা গেছে।
জামায়াতকে নিয়ে হাসিনার পুতুল খেলা
জামায়াতে ইসলামীকে জাতীয় রাজনীতির গৌরব দিয়েছে আওয়ামী লীগ, দলটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালুর দাবিতে শেখ হাসিনা আন্দোলন করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কাতারবন্দী হয়ে। মাওলানা নিজামীর পাশে বসে আওয়ামী লীগ নেত্রী বিএপি সরকারকে গরম গরম হুমকি দিয়েছেন, ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে অধ্যাপক গোলাম আজমের দোয়া নিয়ে তিনি নির্বাচন করেছিলেন। সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনে বৃহত্তম দল হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, জামায়াতের সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
হাসিনার ক্যাডার এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের পেশিশক্তি তখন বর্তমানের মতো শক্তিশালী ছিল না। জামায়াতের অপেক্ষাকৃত সুসংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনীকে আওয়ামী লীগ নেত্রীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর মনোনীত নারী আসনগুলো পাওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন আর হাসিনার প্রয়োজন ছিল না। ধর্মীয় রাজনীতি হঠাত্ করে তার কাছে অপাঙক্তেয় হয়ে গেল। জামায়াতে ইসলামীকে তিনি আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলে দিলেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিশক্তি কিংবা ইতিহাস-জ্ঞান কোনোটাই নির্ভরযোগ্য নয়। জামায়াতে ইসলামীর কাছে ঋণ সুবিধাজনকভাবে ভুলে গেছেন তিনি। বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারতের নেতাদের তিনি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক মনে করেন। সারা বিশ্ব এখন জানে যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন ভারতের ‘বস্তা বস্তা টাকা আর পরামর্শের’ বদৌলতে। সে ভারতে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকার গঠন করেছে। হিন্দু রাজনৈতিক দলগুলো এখনও কোনো কোনো রাজ্যে শাসন করছে। সে দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে বছরখানেক পরে। হিন্দু ধর্মীয় দল বিজেপি আশা করছে তখন তারা আবারও সরকার গঠন করবে।
রাজনীতি মানুষের জন্য এবং মানুষেই রাজনীতি করে। মানুষগুলো ধর্মপ্রাণ হলে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব পড়বেই। মোট কথা ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে সেকুলার প্রশাসনের কোনো বিরোধ নেই। এই বাংলাদেশেও ধর্মীয় রাজনৈতিক দল, এমনকি ইসলামী রাষ্ট্রাদর্শ থাকা সত্ত্বেও সেক্যুলার প্রশাসন সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা যে এবারে ক্ষমতা পেয়ে উগ্র জামায়াত-বিদ্বেষী হয়ে উঠেছেন তার কারণ বাহ্যিক। এই বিদ্বেষকেও তিনি ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক স্বার্থে ও প্রয়োজনে। ভারত সামরিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে ব্যবহার ও শোষণ করতে চায়। তাদের ভয় বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক শক্তি এ ব্যাপারে বাধা দেবে। ভারতের বিশেষ ভয় জামায়াতে ইসলামী সম্বন্ধে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং গত বছর জুলাই মাসে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী ভারত-বিরোধী এবং বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে।
এই ৪০ শতাংশ সমর্থনের কথাটা অবশ্যই ‘র’য়ের কোনো অনভিজ্ঞ চরের বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান এবং তারা ধর্মভীরু। তারা টুপি পরে, দাড়ি রাখে। মাওলানা, মৌলবি এবং ধর্মীয় আলেমদের তারা শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, তাদের সভা-সমাবেশে যেতে, তাদের বক্তব্য শুনতে তারা ভালোবাসে। এটা বর্তমানে যেমন সত্য, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় থেকে সমানেই সত্য ছিল। কিন্তু অন্তত ১৯৫৪ সাল থেকে আমরা দেখেছি, এই টুপি-দাড়ি পরিহিত মানুষগুলো ভোট দেয়ার সময় ভুল করে না। তারা ভোট দেয় নিজেদের বিচারবুদ্ধি থেকে, কোনো মাওলানা-মৌলবির ফতোয়া শুনে নয়।
এই সহজ সত্যটি উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভারতকে খুশি করার আশায় জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করার কাজে হাত দিয়েছেন। একইসঙ্গে ‘ইসলামী সন্ত্রাসের‘ বিরুদ্ধে ‘সাফল্য’ দেখিয়ে ইসরাইলি-মার্কিনিদের মনোরঞ্জনও তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ইতিহাস থেকে যে শিক্ষাটা নিতে শেখ হাসিনা ব্যর্থ হয়েছেন সেটা এই যে, নির্যাতন-নিপীড়ন দিয়ে কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করা যায় না। বৃটিশরা তাদের সাম্রাজ্য কায়েম রাখার জন্য কম নির্যাতন করেনি। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের মতো তারাও পিটুনি শাস্তি দিয়েছে, গ্রাম ও চাক্লাভর্তি মানুষের বিরুদ্ধে পাইকারি মামলা করেছে। সন্ত্রাসের দায়ে যাদের তারা ফাঁসি দিয়েছে তারা প্রায় তাত্ক্ষণিকভাবেই সারা ভারতবর্ষে ‘হিরো‘ হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস নেতারা হাজারে হাজারে পুলিশের লাঠিপেটা ও টিয়ারগ্যাস খেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তারাই হয়েছিলেন মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী ও জননায়ক।
কারণ কী? কারণ এই যে, যাদের ওপর অবিচার করা হয়, অন্যায়ভাবে যাদের নির্যাতন ও নিপীড়ন করা হয়, সাধারণ মানুষের সহানুভূতি স্বভাবত তাদের দিকেই যায়। এটাই মানব ধর্ম। ইংরেজরা মহাত্মা গান্ধীকে যতই লাঠিপেটা করেছে, যত বেশি তাকে কারাদণ্ড দিয়েছে, তার অনুসারীদের মিছিল ততই দীর্ঘ হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশের মানুষের নীতিগত আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের দুই বছরের ভেতর শেখ মুজিবুর রহমান সবচাইতে জঘন্য ১৯৩ যুদ্ধাপরাধীকে পাকিস্তানিদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, স্বদেশে তিনি স্বাধীনতার বিরোধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। অত্যন্ত অস্বাভাবিক একটা উত্তেজনার সময় উপমহাদেশে এবং স্বদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য সেসব ব্যবস্থা তিনি প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেছিলেন। নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তার সে ব্যবস্থাগুলোকে স্বাগত জানিয়েছিল। শফিক উদ্দিন আহমেদ ও শাহরিয়ার কবিররা তখন কোথায় ছিলেন?
চল্লিশ বছর পরে পুরনো ক্ষতকে চুলকিয়ে রক্তারক্তি করা, তার দ্বারা জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা এবং দেশকে ঘৃণা ও প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধ করার কোনো যুক্তি বাংলাদেশের মানুষ খুঁজে পায়নি। বিশেষ করে সবচাইতে জঘন্য যুদ্ধাপরাধ যারা করেছে তাদের যখন ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া বিচারের নামে যা করা হচ্ছে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এবং সাধারণ মানুষ তাতে আস্থা স্থাপন করতে পারছে না। বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিদেশিরা বলছে এ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়। কোনো বিদেশি আইনজীবীকে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ সমর্থন করার জন্য আসতে দেয়নি এই সরকার। কেন? কী তারা লুকোতে চেয়েছে?
স্বাধীনতার পর নতুন সরকার কতজনকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করেছিল? আর যুদ্ধাপরাধী বলে কতজনকে গ্রেফতার করেছে এই সরকার? পাইকারি হারে গ্রেফতার করে সরকার এ ধারণা সৃষ্টি করেছে যে বিচার নয়, সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের জেলে পুরে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই হচ্ছে উদ্দেশ্য। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, এমন ব্যক্তিদের যুদ্ধাপরাধী বলে গ্রেফতার করা হচ্ছে কিংবা সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হচ্ছে একাত্তর সালে যাদের জন্ম হয়েছিল কি হয়নি।
জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষ কেন হয়
সরকার এবং শাসক দল এখন মাসুম বাচ্চা সাজার চেষ্টা করছে। তারা বলছে জামায়াত ও শিবির পুলিশের ওপর চড়াও হচ্ছে, পুলিশকে আক্রমণ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কী দেখেছে? আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্রলীগ গুণ্ডারা শিবিরের সমর্থক ছাত্রকে খুন করেনি? তারপর থেকে কি চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে শিবিরের সমর্থক বলে ছাত্রহত্যা হয়নি?
অন্যায়-অত্যাচার বড়জোর দু’চারবার হজম করা যায়। তারপর মানুষ রুখে দাঁড়ায়। এটাই হচ্ছে স্বভাব। যতদূর জানি শেখ হাসিনার সরকারও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেনি। তাহলে জামায়াতি কিংবা শিবির সমর্থক বলে হাজার হাজার লোককে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে? পিটুনি খেয়ে খেয়ে পাল্টা যদি ওরা পেটাতে যায় তাহলে সেটাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিতে হবে। ‘বজ্র আঁটুনি ফস্্কা গেরো’ কথাটা বাংলা ভাষার। আমাদের কবিও লিখে গেছেন, ‘ওদের বাঁধন যতো শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে’।
বাংলাদেশের মানুষ এখন শেখ হাসিনার সরকার এবং আওয়ামী লীগের ওপর বীতশ্রদ্ধ ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কারণগুলো লিখতে গেলে একটা কলামের কলেবর খুবই দীর্ঘ হয়ে যাবে। সরকারকে তারা আর সহ্য করতে পারছে না। সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে যারাই রুখে দাঁড়াবে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি তাদের দিকেই যাবে। জামায়াতে ইসলামী সেই স্বাভাবিক সহানুভূতি থেকেই লাভবান হচ্ছে।
আরেকটা ভুল সরকার ও পুলিশ করছে পাইকারিভাবে জামায়াত-শিবির কর্মী ও তাদের সমর্থকদের গ্রেফতার করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলমগীর মহীউদ্দীন সংসদে বলেছেন, কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ সংখ্যক লোক এখন কয়েদ আছে। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী প্রকৃত সংখ্যা তারচাইতেও বেশি। জামায়াতের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ সরকার যতই বিস্তার করবে, কর্মী ও সমর্থক মিলে বন্দীর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে। রাজনৈতিক বন্দীদের স্থান করার জন্য সরকার সাধারণ অপরাধীদের আর গ্রেফতার করছে না। দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এমনকি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২১ জনকেও ক্ষমা করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এমতাবস্থায় কারাগারেও সরকার শান্তি বজায় রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ।
আগেই বলেছি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি সবসময়ই ধাবিত হয় নির্যাতীত-নিপীড়িতের দিকে। জামায়াতে ইসলামীর বেলায়ও সেটাই হচ্ছে। সরকারের বর্তমান নীতি যদি বেশিদিন বজায় থাকে বাংলাদেশের আরও আরও বেশি মানুষেরও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ততই বৃদ্ধি পাবে। (লন্ডন, ১৭.১১.১২)
serajurrahman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন