‘জগতটা বাণীময় রে, তার যেদিকটাতে শোনা বন্ধ করবি, সেই দিক থেকে মৃত্যুবাণ আসবে।’ রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের এই সংলাপটি ছিল খবর চেপে রাখার বিপরীত উচ্চারণ। কবি-প্রাবন্ধিক শঙ্খ ঘোষের কথা হলো, (কান-ঢাকা টুপি শীর্ষক নিবন্ধে) এক পক্ষের কান ঢেকে দিয়ে, আর অন্য পক্ষকে বুলি শিখিয়ে দিয়ে ‘মুক্তধারা’ নাটকে সেই মৃত্যুবাণেরই আয়োজন চলছিল চারদিক থেকে। সাধারণ মানুষকে কিছু জানতে না দেয়া, কিংবা ততটুকুই জানতে দেয়া যতটুক ক্ষমতাবানদের পক্ষে ভালো, রাষ্ট্রশাসক বা যে কোনো শাসনের জন্যই একটা ফলপ্রদ পদ্ধতি।
হঠাত্ করেই শঙ্খ ঘোষের ‘মুক্তধারা’ মূল্যায়নের প্রসঙ্গটি এলো কেন, সে ব্যাখ্যা জরুরি। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সংসদে প্রদত্ত তথ্যের জন্যই অমন স্মরণ। দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতন যখন তথ্য অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বর্বরভাবে বিদীর্ণ করছে, সে মুহূর্তে তথ্যমন্ত্রী বললেন যে, সাংবাদিক নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বর্তমান সরকারের আমলে। আর ১৬ জন নয়, ৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এই মেয়াদে। ১৬ জন নিহতের পরিসংখ্যানটি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৯ জন সাংবাদিকের প্রাণহানি ঘটেছে।
আমরা প্রতিবাদ করি তথ্যমন্ত্রীর এই নির্জলা অসত্য বিবৃতির। দীর্ঘকাল রাজনৈতিক কমজোরির দরুন পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট সিঙ্গেল কলামের এই নেতা তথ্যের মন্ত্রিত্ব পেয়ে এত দ্রুত দিশাবিহীন হয়ে পড়বেন বা ‘কান-ঢাকা টুপি’ পরবেন, ভাবিনি। হাসানুল হক ইনুর ওই মিথ্যার নিন্দা করি এই সাহসে যে, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক পীড়নের বিরুদ্ধে আজ বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ। সাংবাদিকদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী ইতিহাস আমাদের নিরন্তন সাহস জোগায়। আজ ২৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। ১৯৯০ সালের এই দিনে আমরা সাংবাদিক ইউনিয়ন এরশাদশাহীর পতনের ঘণ্টা বাজিয়েছিলাম। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে সাংবাদিকরা পত্রিকা বের করবেন না বলে সাংবাদিক সমাজ একমত হয়েছিল সেদিন। ডা. মিলন হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ইমার্জেন্সি জারি হওয়া মাত্র আমরা ধর্মঘটে চলে যাব। জরুরি অবস্থা জারি হতে যাচ্ছে এই মর্মে আমি আগেই খবর পেয়েছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদানীন্তন অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) আলোকিত আমলা আবদুল হামিদ চৌধুরীর কাছ থেকে। এ দিনই সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল ধিকৃত স্বৈরাচারী এরশাদ। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোথাও পত্রিকা বেরোয়নি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণতন্ত্র স্কোয়ারে ঘটেছিল ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। এরশাদের দোসররা এখনও আফসোস করেন, পত্রিকা বন্ধের ওই সিদ্ধান্ত না হলে তাদের অবৈধ সরকার অত সহজে পড়ত না।
আমরা জানি না, এখন আরেকটি ইমার্জেন্সি দরজায় কড়া নাড়ছে কিনা। সরকারের ভাবগতিকে তেমনই মনে হচ্ছে। সরকারের উদগ্র আস্ফাালন রাজনীতি, সমাজনীতি বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা নীতি, মানবাধিকার নীতির চরম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। ২০১২-এর ২৭ নভেম্বর মূলত ‘সাংবাদিকদের ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ’ দিবসে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি বহুল প্রচলিত, কিন্তু ব্যাখ্যাটি সব সময় জানা থাকে না। রাজাদের সামনে রাজদণ্ড নিয়ে একজন বাহক যেত। প্রাচীন রোমে কনসালদের সামনে একজন বাহকের হাতে থাকত এক বান্ডিল ডান্ডা ও বান্ডিলের মধ্যে একটা কুড়াল। তাকেই বলা হতো Fasces, তার থেকে নিষ্পন্ন fascismo বা ফ্যাসিবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর ইতালিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কট দেখা দিলে বেনিতো মুসোলিনি নামে এক সোশ্যালিস্ট fascio di conflation বা ‘সংগ্রামের জন্য সংহতি’ নামে এক বাহিনী গঠন করেন গুণ্ডা বদমাশদের দিয়ে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাজা মুসোলিনিকে সরকার গঠন করতে বললেন। তার নীতি ছিল অগণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সামাজিক পরিবর্তন সাধন। ফ্যাসিস্ট বলতে তাদেরকে বোঝায় যারা বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করবে, শোষকদের কায়েমি স্বত্ব বজায় রেখে শোষিতদের ভাত-কাপড় জোগানোর কথা বলবে। এর রাজনৈতিক দিকটা হলো, সংবিধান লঙ্ঘন, নির্বাচন বন্ধ বা পিছিয়ে দেয়া, নাগরিকদের সব অধিকার হরণ, একদল ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের তত্পরতা দমন, সাংবাদিক-লেখকদের স্বাধীনতা বিলোপ, সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যাচার, তথ্যের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে মিথ্যাকে তথ্য বানানো, বইপত্রের ওপর সেন্সরশিপ প্রভৃতি। এর স্বীকৃত সংজ্ঞা হলো—'A mass movement that combines different classes but is prevalently of the middle classes, which sees itself as having a mission of national regeneration, is in a state of war with its adversaries and seeks a monopoly of power by using terror, Parliamentary tactics and compromise to create a new regime destroying democracy. এক-এগারোর বর্বরতাসহ গত ৬ বছরে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন বাকশালী অপশাসনকে অতিক্রম করে ফেলেছে বললে ভুল হবে না। খোদ প্রধানমন্ত্রী হত্যার বদলে হত্যার কথা বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘নির্মূল’ করার ঘোষণা দিয়ে তার দলের লোকদের আইন ভেঙে ঘরে ঘরে হামলার উস্কানি দিচ্ছেন, বিরোধী দল ও মতকে সরকার চরম ক্রুরতায় বাধা দিচ্ছে, জেলে পুরছে। অপমানে অপমানে বিরোধী দলকে সংসদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগ, আইন-প্রণয়ন এবং নির্বাহী বিভাগের পর সংবাদপত্র যদি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়, তবে বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম তিন স্তম্ভ চতুর্থটির ওপর একযোগে হামলে পড়েছে। মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার নামে এখতিয়ারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান, সম্পাদকদের কোর্টে দাঁড় করানো, সাংবাদিকদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন, মরহুম হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি অনুযায়ী সংশোধনের জন্য আদালতের নির্দেশ, সংসদে লাগাতার সংবাদপত্রবিরোধী বিষোদগার, সম্পাদককে রাস্তায় চলতে না দেয়ার হুমকি এবং নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের সম্পাদক গ্রেফতারের হুমকি, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে না দেয়ার মতো সাংবাদিক পীড়ন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অফিস থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গ্রেফতার, রিমান্ডে নির্যাতন, ‘আমার দেশ’, চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি বন্ধ করে দেয়া, আরও চ্যানেল বন্ধের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রীর ঘোষণা, টকশো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কটু মন্তব্য—এসব ঘটনা সরকারের ফ্যাসিবাদী মনোভাবেরই প্রকাশ।
এ সরকারের সময় সাংবাদিক নির্যাতন হয়নি বলে তথ্যমন্ত্রীর দম্ভের জবাবে বলতে চাই, গত চার বছরে দুই হাজারেরও বেশি সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট, অধিকার ও আইন সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্টগুলো কি এতদিন মিথ্যে বলেছে? আরএসএফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও এসবের পুনরুল্লেখ রয়েছে। লক্ষ্মীপুরে এ মুহুর্তে ৪ জন সাংবাদিক খুনির হুমকিতে ঘরছাড়া এবং ‘প্রথম আলো’র সংবাদদাতা প্রহৃত, পটুয়াখালীতে সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্যের তাণ্ডবে ৭ জন সাংবাদিককে ঢাকায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল। ময়মনসিংহে বিপ্লব ও সুপ্রিয় ধর, যশোরের শার্শায় মনিরুল ইসলাম, ফরিদপুরে আরিফকে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী জিজ্ঞেস করতে পারেন, কী নির্যাতন হয়েছে। মনিরের শরীর হাতুড়ির আঘাতে থেঁতলে দেয়া হয়েছিল। কুমিল্লা, নরসিংদী ও কক্সবাজারে গিয়ে খোঁজ করে আসুন প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত কমিটিগুলোকে কারা উচ্ছেদ করেছে? ঢাকার রাজপথে ফটোসাংবাদিকরা হামেশাই পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। কুড়িগ্রামে ভিত্তিহীন অভিযোগে দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগের তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ নিরীহ নির্বোধ ছিলেন, কিন্তু কখনও বলেননি যে সাংবাদিক নির্যাতন হয়নি। কিন্তু হাসানুল হক ইনুকে কেন অস্বীকৃতি জানাতে হয়? তার মন্ত্রী হওয়ার প্রথম যোগ্যতা, তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার দুঃসাহস দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন জয় করেছেন। তার যোগ্যতা তিনি ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঐতিহাসিক উত্থানের বিরুদ্ধে বানানো কথা বলতে পারেন। সে সময় গণবাহিনীর পক্ষে উল্টো তিনি সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত করেছিলেন। শুধু এই চক্রান্তের যোগ্যতা কেন, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এবং ’৭৫-এ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে অপহরণের চক্রান্ত প্রভৃতির চিন্তাগুরু ছিলেন। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে জনাব ইনু আন্দোলন করেছেন। সেদিনের গণঅভ্যুত্থানে দেখেছি, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। কিন্তু আজ একসঙ্গে রাজনৈতিক ঘর করছেন, পার্লামেন্টে বসছেন।
মূলত বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা চিরায়ত করতে যেভাবে জনমত দাবিয়ে ফ্যাসিবাদে মত্ত হয়ে উঠেছে, জনাব ইনুর ওইসব অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা তাতে খাপে খাপ মিলে যায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরেরও। ২০২১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে হবে—এ ঘোষণা তিনি বহুবার দিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী হয়েই বলেছিলেন—অসত্ এবং বিভ্রান্তিকর সাংবাদিকতা রুখবেন। ভালো কথা, বাংলাদেশ হলুদ-সাংবাদিকতামুক্ত গণতন্ত্র নয়। কিন্তু ক’জন করে এসব? খাস দিলে দমন করুন, আমরা সমর্থন দেব। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যক সাংবাদিকের নির্বিঘ্নে পেশাগত দায়িত্ব পালন, তথ্য চাওয়া এবং সেসব তথ্যের বাধামুক্ত প্রকাশের চেষ্টাকে সমর্থন দেয়াই তো তথ্যমন্ত্রীর প্রধান কর্তব্য। সে ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন তিনি?
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে বৃহত্তর জাসদে নানা রকম কথা আছে, অভিযোগ বিস্তর। বিবেচ্য বিষয় সেটা নয়। কথা হলো, এখনও তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে আছেন কিনা। আরও বিশদে বললে কার্ল মার্কসের ওপর তার আস্থা অটুট কিনা। পার্লামেন্ট হচ্ছে শুয়োরের খোঁয়াড়—মার্কসের এই মন্তব্যে এখনও ইনু সহমত কিনা জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু কাল মার্কসের দুর্বার মুক্ত গণমাধ্যমপ্রিয়তা সম্পর্কে তাকে দুটি কথা না শোনালেই নয়।
মার্কস ছিলেন শুরু থেকেই একজন নির্যাতিত সাংবাদিক। জার্মানির ড্রেসডেন শহর থেকে প্রকাশিত Deuteche Jahrbucher ছিল প্রুশিয়ার রাজতন্ত্র আরোপিত সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে। মার্কসের এক লেখার কারণে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কোলনের Rheinische Zeitung পত্রিকায় যোগ দেন। ১৮৪২-এর মে মাসে তার সেন্সরশিপ বিরোধী এক লেখার জন্য পার্লামেন্ট ধরে বসল। মার্কস সংসদ সদস্যদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিরোধী মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করে বললেন, 'Freedom of the Press also has its beauty, which one must have loved in order to defend it.' এই পত্রিকার সম্পাদক হয়ে মার্কস এমনই লেখালেখি শুরু করলেন যে রাশিয়ার রাজা জার নিকোলাস এক-এর অনুরোধে প্রুশিয়ার রাজা ১৮৪৩-এ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। পত্রিকার সাংবাদিকদের গ্রেফতার এবং মার্কসের দেশত্যাগের আদেশ আসে। চলে যান লন্ডন। মার্কসের কথা একটাই, সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করা যাবে না। এরপর তার পরিচয় হয় ‘নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’ পত্রিকার সাংবাদিক চার্লস ডানার সঙ্গে। মার্কস নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে লিখতে শুরু করেন। তার তথ্য ও ইতিহাস বিশ্লেষণী ক্ষমতায় মার্কিনিরা মুগ্ধ হয়ে যেত। কিন্তু বেতন কম পাওয়ায় তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে নবনির্বাচিত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আমেরিকান নিউজ পেপার পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন যে, নিউইয়র্ক ট্রিবিউনের লন্ডন সংবাদদাতা কার্ল মার্কস প্রতি লেখার জন্য আরও ৫ ডলার করে বেশি চেয়েছিলেন। কারণ সংসার চালানো তার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু ভাতা বাড়ানো হয়নি। তখন তিনি এটা ছেড়ে অন্যত্র কাজ নেন এবং রাজনৈতিক লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। কেনেডির সর্বশেষ কথা হলো, পুঁজিবাদী নিউইয়র্ক ট্রিবিউন পত্রিকা যদি মার্কসের বেতন বৃদ্ধির আবেদন সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করত এবং তিনি যদি বিদেশি সংবাদদাতা থেকে যেতেন, তবে আজকে ইতিহাস হতো অন্য রকম। রুশ বিপ্লব, স্টালিনবাদ, স্নায়ুযুদ্ধ হতো না।
মার্কসের সংগ্রামী ও পীড়িত সাংবাদিক জীবন থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথ্যমন্ত্রী শিক্ষা নেবেন বলে মনে হয় না। নির্যাতিত সাংবাদিকদের কান্না তাকে স্পর্শ করবে না। বাণীময় জগতে সেদিকটা তিনি শুনতে চান না। বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে ঘৃণা বাড়িয়ে দেয়ার কাজটাই যেন এখন তথ্যমন্ত্রীর কাজ। তিনি টিআইবি’র জরিপকে নাস্তানুবাদ করার জন্য যারপরনাই ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী ও কয়েক মন্ত্রী সজ্ঞানে হিংসার রটনা করছেন, বিদ্বেষটাকে তীব্র করে তুলছেন। এতে আখেরে কোনো লাভ হবে না। গণতন্ত্রের নামে যেন স্রেফ একটা রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে। আইন করেই একটি পরিবারের সদস্যদের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরোক্ষ রাজতন্ত্র? প্রাচীনকালে রাজাদের আমলে জিজ্ঞেসই করা যেত না—রাজ্যের এ হাল কেন। এসব জিজ্ঞাসা ছিল বেআইনি। হিন্দু শাস্ত্র মতে, ‘অগ্নিবত্ রাজানম আশ্রয়েত্’, অগ্নি যেমন সর্বপাপঘ্ন, রাজাও তাই। কাজেই তুমি একান্তভাবে চরণাশ্রিত হও, কিছু জানতে চেয়ো না। দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিও নাকো। তোমাদের কল্যাণ তিনি সাধন করবেনই। এই যেমন কয়েকদিন আগে স্কাউটদের অনুষ্ঠানে বলা হলো, বাংলাদেশ নাকি দক্ষিণ এশিয়ায় উদার গণতন্ত্রের রোল মডেল হবে। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন—ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে? বিশ্বাস হয় এ কথা?
অতিষ্ঠ প্রজারা জিজ্ঞেস করছে—কর্তা, তোমার কি এখনও ছাড়ার সময় হয় নাই? রাজা বললেন, ওরে আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই। তোরা ছাড়ালেই আমি ছাড়া।
হঠাত্ করেই শঙ্খ ঘোষের ‘মুক্তধারা’ মূল্যায়নের প্রসঙ্গটি এলো কেন, সে ব্যাখ্যা জরুরি। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সংসদে প্রদত্ত তথ্যের জন্যই অমন স্মরণ। দেশব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতন যখন তথ্য অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বর্বরভাবে বিদীর্ণ করছে, সে মুহূর্তে তথ্যমন্ত্রী বললেন যে, সাংবাদিক নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বর্তমান সরকারের আমলে। আর ১৬ জন নয়, ৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এই মেয়াদে। ১৬ জন নিহতের পরিসংখ্যানটি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৯ জন সাংবাদিকের প্রাণহানি ঘটেছে।
আমরা প্রতিবাদ করি তথ্যমন্ত্রীর এই নির্জলা অসত্য বিবৃতির। দীর্ঘকাল রাজনৈতিক কমজোরির দরুন পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট সিঙ্গেল কলামের এই নেতা তথ্যের মন্ত্রিত্ব পেয়ে এত দ্রুত দিশাবিহীন হয়ে পড়বেন বা ‘কান-ঢাকা টুপি’ পরবেন, ভাবিনি। হাসানুল হক ইনুর ওই মিথ্যার নিন্দা করি এই সাহসে যে, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক পীড়নের বিরুদ্ধে আজ বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ। সাংবাদিকদের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী ইতিহাস আমাদের নিরন্তন সাহস জোগায়। আজ ২৭ নভেম্বর সাংবাদিকদের ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। ১৯৯০ সালের এই দিনে আমরা সাংবাদিক ইউনিয়ন এরশাদশাহীর পতনের ঘণ্টা বাজিয়েছিলাম। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে সাংবাদিকরা পত্রিকা বের করবেন না বলে সাংবাদিক সমাজ একমত হয়েছিল সেদিন। ডা. মিলন হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ইমার্জেন্সি জারি হওয়া মাত্র আমরা ধর্মঘটে চলে যাব। জরুরি অবস্থা জারি হতে যাচ্ছে এই মর্মে আমি আগেই খবর পেয়েছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদানীন্তন অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) আলোকিত আমলা আবদুল হামিদ চৌধুরীর কাছ থেকে। এ দিনই সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল ধিকৃত স্বৈরাচারী এরশাদ। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোথাও পত্রিকা বেরোয়নি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গণতন্ত্র স্কোয়ারে ঘটেছিল ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। এরশাদের দোসররা এখনও আফসোস করেন, পত্রিকা বন্ধের ওই সিদ্ধান্ত না হলে তাদের অবৈধ সরকার অত সহজে পড়ত না।
আমরা জানি না, এখন আরেকটি ইমার্জেন্সি দরজায় কড়া নাড়ছে কিনা। সরকারের ভাবগতিকে তেমনই মনে হচ্ছে। সরকারের উদগ্র আস্ফাালন রাজনীতি, সমাজনীতি বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা নীতি, মানবাধিকার নীতির চরম বিপর্যয় ঘটিয়েছে। ২০১২-এর ২৭ নভেম্বর মূলত ‘সাংবাদিকদের ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ’ দিবসে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি বহুল প্রচলিত, কিন্তু ব্যাখ্যাটি সব সময় জানা থাকে না। রাজাদের সামনে রাজদণ্ড নিয়ে একজন বাহক যেত। প্রাচীন রোমে কনসালদের সামনে একজন বাহকের হাতে থাকত এক বান্ডিল ডান্ডা ও বান্ডিলের মধ্যে একটা কুড়াল। তাকেই বলা হতো Fasces, তার থেকে নিষ্পন্ন fascismo বা ফ্যাসিবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর ইতালিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কট দেখা দিলে বেনিতো মুসোলিনি নামে এক সোশ্যালিস্ট fascio di conflation বা ‘সংগ্রামের জন্য সংহতি’ নামে এক বাহিনী গঠন করেন গুণ্ডা বদমাশদের দিয়ে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে রাজা মুসোলিনিকে সরকার গঠন করতে বললেন। তার নীতি ছিল অগণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সামাজিক পরিবর্তন সাধন। ফ্যাসিস্ট বলতে তাদেরকে বোঝায় যারা বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করবে, শোষকদের কায়েমি স্বত্ব বজায় রেখে শোষিতদের ভাত-কাপড় জোগানোর কথা বলবে। এর রাজনৈতিক দিকটা হলো, সংবিধান লঙ্ঘন, নির্বাচন বন্ধ বা পিছিয়ে দেয়া, নাগরিকদের সব অধিকার হরণ, একদল ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলের তত্পরতা দমন, সাংবাদিক-লেখকদের স্বাধীনতা বিলোপ, সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যাচার, তথ্যের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে মিথ্যাকে তথ্য বানানো, বইপত্রের ওপর সেন্সরশিপ প্রভৃতি। এর স্বীকৃত সংজ্ঞা হলো—'A mass movement that combines different classes but is prevalently of the middle classes, which sees itself as having a mission of national regeneration, is in a state of war with its adversaries and seeks a monopoly of power by using terror, Parliamentary tactics and compromise to create a new regime destroying democracy. এক-এগারোর বর্বরতাসহ গত ৬ বছরে আওয়ামী লীগের দুঃশাসন বাকশালী অপশাসনকে অতিক্রম করে ফেলেছে বললে ভুল হবে না। খোদ প্রধানমন্ত্রী হত্যার বদলে হত্যার কথা বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘নির্মূল’ করার ঘোষণা দিয়ে তার দলের লোকদের আইন ভেঙে ঘরে ঘরে হামলার উস্কানি দিচ্ছেন, বিরোধী দল ও মতকে সরকার চরম ক্রুরতায় বাধা দিচ্ছে, জেলে পুরছে। অপমানে অপমানে বিরোধী দলকে সংসদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগ, আইন-প্রণয়ন এবং নির্বাহী বিভাগের পর সংবাদপত্র যদি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়, তবে বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম তিন স্তম্ভ চতুর্থটির ওপর একযোগে হামলে পড়েছে। মাহমুদুর রহমানকে আদালত অবমাননার নামে এখতিয়ারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান, সম্পাদকদের কোর্টে দাঁড় করানো, সাংবাদিকদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন, মরহুম হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসকে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি অনুযায়ী সংশোধনের জন্য আদালতের নির্দেশ, সংসদে লাগাতার সংবাদপত্রবিরোধী বিষোদগার, সম্পাদককে রাস্তায় চলতে না দেয়ার হুমকি এবং নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের সম্পাদক গ্রেফতারের হুমকি, প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান কভার করতে না দেয়ার মতো সাংবাদিক পীড়ন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অফিস থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গ্রেফতার, রিমান্ডে নির্যাতন, ‘আমার দেশ’, চ্যানেল ওয়ান ও যমুনা টিভি বন্ধ করে দেয়া, আরও চ্যানেল বন্ধের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রীর ঘোষণা, টকশো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কটু মন্তব্য—এসব ঘটনা সরকারের ফ্যাসিবাদী মনোভাবেরই প্রকাশ।
এ সরকারের সময় সাংবাদিক নির্যাতন হয়নি বলে তথ্যমন্ত্রীর দম্ভের জবাবে বলতে চাই, গত চার বছরে দুই হাজারেরও বেশি সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট, অধিকার ও আইন সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্টগুলো কি এতদিন মিথ্যে বলেছে? আরএসএফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও এসবের পুনরুল্লেখ রয়েছে। লক্ষ্মীপুরে এ মুহুর্তে ৪ জন সাংবাদিক খুনির হুমকিতে ঘরছাড়া এবং ‘প্রথম আলো’র সংবাদদাতা প্রহৃত, পটুয়াখালীতে সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্যের তাণ্ডবে ৭ জন সাংবাদিককে ঢাকায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল। ময়মনসিংহে বিপ্লব ও সুপ্রিয় ধর, যশোরের শার্শায় মনিরুল ইসলাম, ফরিদপুরে আরিফকে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী জিজ্ঞেস করতে পারেন, কী নির্যাতন হয়েছে। মনিরের শরীর হাতুড়ির আঘাতে থেঁতলে দেয়া হয়েছিল। কুমিল্লা, নরসিংদী ও কক্সবাজারে গিয়ে খোঁজ করে আসুন প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত কমিটিগুলোকে কারা উচ্ছেদ করেছে? ঢাকার রাজপথে ফটোসাংবাদিকরা হামেশাই পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। কুড়িগ্রামে ভিত্তিহীন অভিযোগে দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগের তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ নিরীহ নির্বোধ ছিলেন, কিন্তু কখনও বলেননি যে সাংবাদিক নির্যাতন হয়নি। কিন্তু হাসানুল হক ইনুকে কেন অস্বীকৃতি জানাতে হয়? তার মন্ত্রী হওয়ার প্রথম যোগ্যতা, তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার দুঃসাহস দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন জয় করেছেন। তার যোগ্যতা তিনি ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঐতিহাসিক উত্থানের বিরুদ্ধে বানানো কথা বলতে পারেন। সে সময় গণবাহিনীর পক্ষে উল্টো তিনি সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টির চক্রান্ত করেছিলেন। শুধু এই চক্রান্তের যোগ্যতা কেন, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এবং ’৭৫-এ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে অপহরণের চক্রান্ত প্রভৃতির চিন্তাগুরু ছিলেন। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে জনাব ইনু আন্দোলন করেছেন। সেদিনের গণঅভ্যুত্থানে দেখেছি, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। কিন্তু আজ একসঙ্গে রাজনৈতিক ঘর করছেন, পার্লামেন্টে বসছেন।
মূলত বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা চিরায়ত করতে যেভাবে জনমত দাবিয়ে ফ্যাসিবাদে মত্ত হয়ে উঠেছে, জনাব ইনুর ওইসব অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা তাতে খাপে খাপ মিলে যায় এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরেরও। ২০২১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতে হবে—এ ঘোষণা তিনি বহুবার দিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী হয়েই বলেছিলেন—অসত্ এবং বিভ্রান্তিকর সাংবাদিকতা রুখবেন। ভালো কথা, বাংলাদেশ হলুদ-সাংবাদিকতামুক্ত গণতন্ত্র নয়। কিন্তু ক’জন করে এসব? খাস দিলে দমন করুন, আমরা সমর্থন দেব। কিন্তু ব্যাপক সংখ্যক সাংবাদিকের নির্বিঘ্নে পেশাগত দায়িত্ব পালন, তথ্য চাওয়া এবং সেসব তথ্যের বাধামুক্ত প্রকাশের চেষ্টাকে সমর্থন দেয়াই তো তথ্যমন্ত্রীর প্রধান কর্তব্য। সে ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন তিনি?
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে বৃহত্তর জাসদে নানা রকম কথা আছে, অভিযোগ বিস্তর। বিবেচ্য বিষয় সেটা নয়। কথা হলো, এখনও তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে আছেন কিনা। আরও বিশদে বললে কার্ল মার্কসের ওপর তার আস্থা অটুট কিনা। পার্লামেন্ট হচ্ছে শুয়োরের খোঁয়াড়—মার্কসের এই মন্তব্যে এখনও ইনু সহমত কিনা জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু কাল মার্কসের দুর্বার মুক্ত গণমাধ্যমপ্রিয়তা সম্পর্কে তাকে দুটি কথা না শোনালেই নয়।
মার্কস ছিলেন শুরু থেকেই একজন নির্যাতিত সাংবাদিক। জার্মানির ড্রেসডেন শহর থেকে প্রকাশিত Deuteche Jahrbucher ছিল প্রুশিয়ার রাজতন্ত্র আরোপিত সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে। মার্কসের এক লেখার কারণে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কোলনের Rheinische Zeitung পত্রিকায় যোগ দেন। ১৮৪২-এর মে মাসে তার সেন্সরশিপ বিরোধী এক লেখার জন্য পার্লামেন্ট ধরে বসল। মার্কস সংসদ সদস্যদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিরোধী মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করে বললেন, 'Freedom of the Press also has its beauty, which one must have loved in order to defend it.' এই পত্রিকার সম্পাদক হয়ে মার্কস এমনই লেখালেখি শুরু করলেন যে রাশিয়ার রাজা জার নিকোলাস এক-এর অনুরোধে প্রুশিয়ার রাজা ১৮৪৩-এ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। পত্রিকার সাংবাদিকদের গ্রেফতার এবং মার্কসের দেশত্যাগের আদেশ আসে। চলে যান লন্ডন। মার্কসের কথা একটাই, সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করা যাবে না। এরপর তার পরিচয় হয় ‘নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’ পত্রিকার সাংবাদিক চার্লস ডানার সঙ্গে। মার্কস নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে লিখতে শুরু করেন। তার তথ্য ও ইতিহাস বিশ্লেষণী ক্ষমতায় মার্কিনিরা মুগ্ধ হয়ে যেত। কিন্তু বেতন কম পাওয়ায় তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে নবনির্বাচিত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আমেরিকান নিউজ পেপার পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন যে, নিউইয়র্ক ট্রিবিউনের লন্ডন সংবাদদাতা কার্ল মার্কস প্রতি লেখার জন্য আরও ৫ ডলার করে বেশি চেয়েছিলেন। কারণ সংসার চালানো তার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু ভাতা বাড়ানো হয়নি। তখন তিনি এটা ছেড়ে অন্যত্র কাজ নেন এবং রাজনৈতিক লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। কেনেডির সর্বশেষ কথা হলো, পুঁজিবাদী নিউইয়র্ক ট্রিবিউন পত্রিকা যদি মার্কসের বেতন বৃদ্ধির আবেদন সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করত এবং তিনি যদি বিদেশি সংবাদদাতা থেকে যেতেন, তবে আজকে ইতিহাস হতো অন্য রকম। রুশ বিপ্লব, স্টালিনবাদ, স্নায়ুযুদ্ধ হতো না।
মার্কসের সংগ্রামী ও পীড়িত সাংবাদিক জীবন থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী তথ্যমন্ত্রী শিক্ষা নেবেন বলে মনে হয় না। নির্যাতিত সাংবাদিকদের কান্না তাকে স্পর্শ করবে না। বাণীময় জগতে সেদিকটা তিনি শুনতে চান না। বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে ঘৃণা বাড়িয়ে দেয়ার কাজটাই যেন এখন তথ্যমন্ত্রীর কাজ। তিনি টিআইবি’র জরিপকে নাস্তানুবাদ করার জন্য যারপরনাই ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী ও কয়েক মন্ত্রী সজ্ঞানে হিংসার রটনা করছেন, বিদ্বেষটাকে তীব্র করে তুলছেন। এতে আখেরে কোনো লাভ হবে না। গণতন্ত্রের নামে যেন স্রেফ একটা রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে। আইন করেই একটি পরিবারের সদস্যদের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরোক্ষ রাজতন্ত্র? প্রাচীনকালে রাজাদের আমলে জিজ্ঞেসই করা যেত না—রাজ্যের এ হাল কেন। এসব জিজ্ঞাসা ছিল বেআইনি। হিন্দু শাস্ত্র মতে, ‘অগ্নিবত্ রাজানম আশ্রয়েত্’, অগ্নি যেমন সর্বপাপঘ্ন, রাজাও তাই। কাজেই তুমি একান্তভাবে চরণাশ্রিত হও, কিছু জানতে চেয়ো না। দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিও নাকো। তোমাদের কল্যাণ তিনি সাধন করবেনই। এই যেমন কয়েকদিন আগে স্কাউটদের অনুষ্ঠানে বলা হলো, বাংলাদেশ নাকি দক্ষিণ এশিয়ায় উদার গণতন্ত্রের রোল মডেল হবে। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন—ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে? বিশ্বাস হয় এ কথা?
অতিষ্ঠ প্রজারা জিজ্ঞেস করছে—কর্তা, তোমার কি এখনও ছাড়ার সময় হয় নাই? রাজা বললেন, ওরে আমার ধরাও নেই, ছাড়াও নেই। তোরা ছাড়ালেই আমি ছাড়া।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন