সিরাজুর রহমান
আওয়ামী লীগ সরকারের জাসদ মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং শাসক দলের যুগ্মসম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের একটা বাক-বিনিময় যেন মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠে আবার অতলে তলিয়ে গেল। অনেকটা ফলিমাছ যেমন ভেসে উঠে ফুটুস কেটেই আবার ডুব দেয়। হানিফ বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সংশ্লেষ থাকতে পারে। জবাবে ইনু হানিফকে বলেছেন, সরকার যখন সঙ্কটে আছে তখন প্রকাশ্যে এসব পুরনো কাসুন্দি না ঘাঁটাই ভালো।
সহকর্মীদের মধ্যে বিরোধ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা না করাই উত্তম। হাসানুল হক ইনুর পরামর্শ তাই ভালোই বলতে হবে। কিন্তু ইতিহাসের প্রয়োজনে কোনো না কোনো দিন এ বিষয়টার ওপর আলোকপাত হতেই হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান সব সময়ই সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রাদর্শের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সে সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তিনি কখনো খুলে বলেননি। এবং এটাও পরিষ্কার যে, মুজিবের সমাজতন্ত্রে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কোনো স্থান ছিল না।
হাইকমান্ড গোড়া থেকেই একদলীয় পদ্ধতি চেয়েছিলেন। ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দেবো’ তিনি জাসদকে লক্ষ করেই বলেছিলেন। লাল ঘোড়াকে (জাসদ) দমনের কোনো চেষ্টারই ত্রুটি হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে রক্ষীবাহিনী যে কম-বেশি ৪০ হাজার লোককে হত্যা করেছিল তাদের প্রায় সবাই ছিল জাসদের কর্মী কিংবা সমর্থক। জাসদের প্রভাবমুক্ত একদলীয় সংসদ গঠনের উদ্দেশ্যেই ১৯৭৩ সালে সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন।
সে নির্বাচনে জাসদ অল্প কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকেরা সেটাকে বেয়াদবি বলেই তাকে বুঝিয়েছিল। বিবিসিতে আমার সহকর্মী (স্যার) মার্ক টালি তখন খবর দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ কর্মীরা সহিংসতা ও অসাধুতা দ্বারা অন্তত চারটি আসনে (জাসদের কাছ থেকে) বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। মনে রাখতে হবে সে সময় বাংলাদেশে জাসদ ছাড়া অন্য কোনো সুসংগঠিত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে জাসদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। হাসানুল হক ইনু একাত্তরে লন্ডনে আমার এক প্রেস ব্রিফিংয়েও উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জাসদ নেতা কর্নেল তাহেরের সামরিক বিচার ও প্রাণদণ্ডের ‘তদন্ত’ করেছে এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করেছে। হাসানুল হক ইনুর প্রথমে আওয়ামী লীগের মহাজোটে এবং পরে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় যোগদানে সেজন্যই কেউ বিস্মিত হয়নি। কিন্তু মনে রাখতে হবে সিরাজ শিকদারের হত্যার বিচার হয়নি, হত্যা সম্বন্ধে কোনো তদন্তও হয়নি। হাসানুল হক ইনু কর্নেল তাহেরের ‘হত্যার তদন্তে’ সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হত্যার তদন্ত নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য তিনি করেননি।
তাহেরের প্রাণদণ্ড কেন অনিবার্য ছিল
কর্নেল তাহেরের গোপন সামরিক বিচার ও প্রাণদণ্ডের সময় থেকে ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকের ঘটনাবলি বিবেচনা করলে জাসদের বিরুদ্ধে মাহবুব-উল আলম হানিফের অভিযোগের কিছু যৌক্তিকতা লক্ষ করা যাবে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর যে সিপাহিরা গৃহবন্দী অবস্থা থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এবং তাকে কাঁধে তুলে সেনা সদরদফতরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কর্নেল তাহের। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হতে পারে, জিয়ার উচিত ছিল তাহেরের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা। কিন্তু তিনি কৃতজ্ঞ হতে পারেননি কতকগুলো বিশেষ কারণে।
সাধারণ সৈনিকেরা তখন কর্নেল তাহেরের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সেদিন তারা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জিন্দাবাদ জানালেও গোটা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঘুরে ঘুরে ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল এবং জাসদের প্রচারপত্র বিলি করছিল। গণচীনের তখনকার (বর্তমানের নয়) স্বেচ্ছাসেবী সমাজতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর অনুকরণে বাংলাদেশেও চেন অব কমান্ড-বিহীন একটা সমাজতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গঠনই ছিল কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য। তাহেরের প্রভাবে তখনকার নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গে বহু ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ক্ষত্রেই চেন অব কমান্ড মেনে নিতে এবং অফিসারদের স্যালুট করতে সিপাহিরা অস্বীকার করেছিল। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে স্যালুট না করায় এক মেজর জনৈক সার্জেন্টের আঙুলে গুলি করেছিলেন। এ ঘটনার পরিণতি খুবই গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর তার অভ্যুত্থানের সময়। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সাধারণ সৈনিকেরা এই অভ্যুত্থান মেনে নিতে অস্বীকার করে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মোশাররফের সমর্থক কয়েকজন অফিসারকে তারা হত্যা করে। খালেদ মোশাররফ নিজে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সিপাহিরা তাকে ধরে ফেলে এবং হত্যা করে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান সনাতনী কায়দার মিলিটারি অফিসার ছিলেন। দেশে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে যেকোনো মূল্যে চেন অব কমান্ডকে বজায় রাখতে হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছিলেন, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সিপাহিদের আচরণ বরদাশত করা হলে এজাতীয় ঘটনা আরো বেড়ে যাবে। ফলে সেনাবাহিনী বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না এবং নতুন স্বাধীন দেশও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কর্নেল তাহের ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে সে জন্যই জিয়াকে বলিষ্ঠ ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যার পর বিবিসি থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনে স্যার মার্ক টালি বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান প্রাণ দিয়ে তার সেনাবাহিনীকে ভালোবাসতেন; হয়তো সে জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
কমিউনিজমের পতন ও বিপন্ন জাসদ
এই ঘটনাগুলো এক দিনে ঘটেনি। সিরাজ শিকদার ও কর্নেল তাহের স্বাধীনতার পর পরই তাদের তৎপরতা শুরু করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন নতুন রাষ্ট্র স্থিতিশীল হওয়ার আগেই এ রাষ্ট্রকে গণচীনের অনুকরণে গঠন করতে হবে। তাদের তৎপরতা জানতেন বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাসদকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। ‘লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দেওয়া’ এবং সিরাজ শিকদারের হত্যাকে সে আলোকেই দেখতে হবে। রক্ষীবাহিনীকে সে কারণেই জাসদের পেছনে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক হানিফ প্রশ্ন তুলেছেন, জাসদ মুজিবের হত্যার সাথে জড়িত ছিল কি না। মুজিবের হত্যাকারী বলে কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ প্রমুখ যাদের নাম জানি তারা জাসদের সদস্য কিংবা জাসদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন বলে জানি না। কিন্তু কর্নেল তাহের ও সিরাজ শিকদারেরা তাদের মতোই মুজিব সরকারের চরম বিরোধী ছিলেন। ঘাতকদের ওপর তাদের প্রভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক। অন্তত জাসদ ভাবাপন্নরা উসকানি দিয়ে ঘাতকদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে।
নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত কমিউনিস্ট সাম্রাজ্য ধসে পড়ার পর বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টরা ভয়ানক বেকায়দায় পড়ে যায়। বহু দেশে তারা এখনো ধকল সামলে উঠতে পারেনি। চীনেও মাও সে তুংয়ের আমলের কমিউনিজমের অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। তবে সেটা ধাপে ধাপে ঘটেছে বলে তাতে কোনো বিপর্যয় ঘটেনি। কিন্তু ভারত, নেপাল এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশের আরো কোনো কোনো দেশের মতো বাংলাদেশের মাওপন্থীদের অবস্থা হয়েছে পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ সন্তানের মতো।
চীনে এখন আর স্বেচ্ছাসেবী খণ্ডকালীন সেনাবাহিনী নেই। বরং বলা চলে সে দেশের সশস্ত্র বাহিনী জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভাবাদর্শ অনুযায়ী সুশৃঙ্খল চেন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেছে। হাসানুল হক ইনুদের এখন আর সিরাজ শিকদার কিংবা কর্নেল তাহেরের পথে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। বস্তুত ইনুরা জাসদ নামটা যে কী কারণে আঁকড়ে আছেন বুঝতে পারি না। মহাজোটে যোগ দিয়ে ইনু সাময়িক লাভবান হয়েছেন, মন্ত্রীও হয়েছেন। মুজিব হত্যার ব্যাপারে জাসদের ভূমিকা নিয়ে বেশি কথাবার্তা হলে এই অস্থায়ী মন্ত্রিত্বও আর থাকবে না। সেজন্যই বিষয়টি চাপা দিতে তিনি হানিফকে অনুরোধ করেছেন। হানিফও বুঝে গেছেন, সরকারের নড়বড়ে অবস্থায় জাসদকে ধাক্কা না দেয়াই ভালো হবে।
লন্ডন, ২৭.১১.১২
serajurrahman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন