আবদুল হাই শিকদার
পেরিয়ে গেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কালের ধূলির নিচে চাপা পড়ে গেছে কত রাজ্য, রাজা, রাজধানী। বদলে গেছে মানচিত্র। পাল্টে গেছে মানুষ। তবুও মানব জাতির মহোত্তম উচ্চারণগুলোর অংশ হিসেবে আজও বিশ্বময় সমানভাবে আদৃত ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’। আমরা যাকে আরব্য রজনী বা আরব্যোপন্যাস হিসেবে জানি। হাজার এক রজনীর অনবদ্য সব গল্প দিয়ে গাঁথা এই গ্রন্থে নেই এমন জিনিস নেই।
তো এ গ্রন্থে দেখা যায়, মন্ত্রতন্ত্র আর জাদুর বলে মানুষ পরিণত হয় পশু-পাখিতে। শয়তান পরিণত হয় দরবেশে। রাজপুত্র হয়ে যায় পথের ফকির। ফকির হয়ে ওঠে রাজার পুত্র। উদ্ভট, অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর, রক্ত হিম করা কাহিনীর পাতায় পাতায় কল্পনার বিশাল বিস্তার। রূপকথা আর রূপকথা।
এসব কথা আর কাহিনীতে দেখা যায় সঙ্কটকালে গাধা, ছাগল, ঘোড়া, পাখি ইত্যাদি প্রাণীরও জবান খুলে যায়। তারা মানুষের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা লাভ করে।
কথা বলার এই যে অসীম ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা আবার লাভ করেছেন আমার সম্মানিত বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল আবদুল মুহিত। এর আগে বেফজুল কথা বলার জন্য তিনি তিরস্কৃত হয়েছিলেন সংসদে। টকশো ও পত্র-পত্রিকায় গালাগালের বন্যা বয়ে গেলে, প্রথমবারের মতো অনুধাবন করেছিলেন যে, তিনি সম্ভবত এদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। তারপর দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চেয়ে জীবনে আর কখনও বেল তলায় যাবেন না শপথ গ্রহণ করে বন্ধ করেছিলেন তার জবান। ফলে জাতি রেহাই পেয়েছিল জান ঝালাপালা হওয়ার হাত থেকে।
কিন্তু আল্লাহর লীলা বোঝা ভার। আল্লাহর অসীম কুদরতেই হোক আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃপালাভের জন্যই হোক, অতি অলৌকিকভাবে তিনি আবার তার আগের জবান ফিরে পেয়েছেন। জবান ফিরে পেয়েই তিনি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। এবার তার জবানপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি লাভ করেছেন অন্তর্দৃষ্টি। অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা যে কোনো ব্যক্তিকে খ্রিস্টানরা বলে সেন্ট, হিন্দুরা বলে স্বামী, বৌদ্ধরা বলে নির্বাণপ্রাপ্ত মহাথেরো। আর মুসলমানদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন আল্লাহর ওলি বা দরবেশ। তবে আমাদের মন্ত্রী মহোদয় কোন কাতারের দরবেশ বা তিনি কোন তরিকার ওলি, তা এখনও খোলাসা করে বলেননি। তবে ধারণা করা যায়, তিনি ‘মুজিবীয় তরিকার’ একজন জবরদস্ত কামেল।
এই অন্তর্দৃষ্টি লাভ এবং জবান খুলে যাওয়ার কারণেই তার কথার ধার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শব্দ দূষণ পরিমাপ যন্ত্রের হিসেবে তা কত ডেসিবল, বলতে পারব না। তবে তিনি যেসব ‘অমৃত বাণী’ জবান দ্বারা নির্গত করেছেন, তার সারাংশ হলো—বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দেশে বিদেশি বিনিয়োগে একমাত্র বাধা। আমাদের বিনিয়োগ যে তেমন বাড়েনি, সরাসরি বিনিয়োগও যে কমে গেছে তার জন্য একমাত্র দায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিদেশে তার মিথ্যা প্রচারণার কারণে দেশে বিনিয়োগ আসছে না। বিনিয়োগের অভাবে আমরা মরে যাচ্ছি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল যখন কথার মাধ্যমে এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত গু-গোবর উগড়াচ্ছিলেন, সে সময় সুদূর ভিয়েনার এক সেমিনারে স্পেনের রানী সোফিয়াকে পাশে নিয়ে, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, বিশ্বনন্দিত সোশ্যাল বিজনেস তত্ত্বের উদ্ভাবক ও প্রয়োগকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলছিলেন—সন্ত্রাস ও সংঘাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে শান্তির ঠিকানায় পরিণত করতে হলে অবশ্যই দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে হবে।
আমাদের দেশের এসব গলিত-দূষিত ‘মালামালের’ সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের পার্থক্য বোঝার জন্য মহাপণ্ডিত বা গবেষক হওয়ার দরকার নেই। দুটো বক্তৃতা পাশাপাশি রাখলেই হবে। বাংলাদেশের সীমা পার হয়ে তিনি যখন দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার জন্য চারণের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বময়, সেই সময় বাংলাদেশের ‘তুই চোর’গুলো নিজেদের পাপ ও ব্যর্থতার দায়ভার এই মানুষটির ওপর চাপিয়ে সাধু সাজার হাস্যকর কসরত করছেন। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। সূর্যের সঙ্গে শত্রুতা করে অন্ধকারের পেঁচা! এ যেন ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’।
আবুল মা’লকে ‘বাংলিশ’ ভাষা আবিষ্কারের জন্য এর আগে অভিনন্দিত করেছিলাম আমি। সেই সময় তার কবরের এফিটাফের একটা নমুনাও পেশ করেছিলাম। তিনি সে সময় যেসব বাণী ঝাড়তেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—‘আই অ্যাম একদম ফেড-আপ’, ‘ননসেন্স’, ‘শেয়ারবাজার ফটকাবাজার’, ‘লগ্নিকারীরা জুয়াড়ি’, হিলারি-ইউনূস ‘রাবিশ’, ‘চার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি এমন কিছুই নয়’ ইত্যাদি।
৩৩ লাখ লগ্নিকারীকে পথে বসিয়ে শেয়ারবাজারকে মতিঝিলে দাফন করেও তার খাসলত বদলায়নি। তিনি যদি সুস্থ ও স্বাভাবিক হতেন তাহলে তাকে প্রশ্ন করা যেত, যে বিনিয়োগের অভাবে মরছেন, তার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কাজটি করেছেন?
কোনো ব্যক্তি কি একটা সরকার বা রাষ্ট্রের চেয়েও ক্ষমতাধর হতে পারে? বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা কি সরকারের আদৌ ছিল? চুরি, লুটপাট, দুর্নীতি করে নিজেরাও ডুবেছে দেশকেও ডুবিয়েছে এই সরকার, দায়দায়িত্ব কার? দাতারা এই সরকারকে বিশ্বাস করে না। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে কার দোষে? নির্দিষ্ট সময়ে অনুমতি দেয়া, কারখানা স্থাপন ও উত্পাদনে যাওয়ার অনুকূল ব্যবস্থা কি দেশে এখন আছে? ঘুষ ছাড়া কি অন্য কোনো খাদ্য বর্তমান সরকার খায়? গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে বিনিয়োগ চাওয়া কোন জাতীয় রসিকতা? বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের দায়িত্ব কি ড. ইউনূসের? শেয়ারবাজার ধ্বংস করার নায়ক কে? সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারিও কি ড. ইউনূসের? প্রতিদিন গুম, খুন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি কি ড. ইউনূসের কাজ? পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি কার কীর্তি? বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি কাদের দ্বারা হচ্ছে? যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের আওতায় কোনো বৈঠক হচ্ছে না কেন? জনশক্তি খাতে যে বন্ধ্যত্ব সেটা কার দোষে? কোনো দেশের সঙ্গেই নতুন কোনো বাণিজ্য চুক্তি হচ্ছে না কেন? দাতাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে দেশকে ভারতমুখী করে বন্ধুহীন করা কার কাজ? বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী কেন্দ্রের নাম বদলিয়ে চীনের সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়েছে কে? বাংলাদেশ মৌলবাদী দেশ, জঙ্গিবাদী দেশ—এসব প্রচারণা বিশ্বময় কে করেছে? সব কাজ শিকায় তুলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মেতে থাকছে কারা? এলজিইডিকে দুর্নীতির খনি বানিয়েছে কারা? বস্তাভর্তি টাকাসহ ধরা পড়া কালো বিড়াল সুরঞ্জিতের বিচার কি হয়েছে? দীলিপ বড়ুয়ার এক ডজন প্লট কোত্থেকে এলো? লতিফ বিশ্বাসের ৭ তলা রংমহল কি ড. ইউনূস বানিয়ে দিয়েছেন? শিক্ষাঙ্গনকে ধ্বংস করছে কে?
দুর্নীতির পঞ্চপাণ্ডব আবুল হোসেন, ফারুক খান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মসিউর রহমান ও সৈয়দ মোদাচ্ছের কি ড. ইউনূসের সহচর? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কার সৃষ্টি? দীপু মনির কাজে-অকাজে ১০০টি বিদেশ সফর কেন? তিনি কি ড. ইউনূসের ‘ওয়ান্ডারফুল পাবলিসিটি মেশিনারি’র সঙ্গে পেরে উঠছেন না? নৌমন্ত্রী ও দিলীপ বড়ুয়ার অর্ধশত বার বিদেশ সফরও তাহলে ব্যর্থ? রেন্টাল-কুইক রেন্টাল খাতে লুটপাটের নায়ক কারা? চোরা আবুলকে ‘দেশপ্রেমিক’ বানিয়েছে কে? বিশ্বব্যাংককে বাপ-মা তুলে গালাগালি কে করেছে? এসব প্রশ্নের মতো হাজার প্রশ্ন সর্বত্র। বাংলাদেশকে দুর্নীতি ও কুশাসনের দেশ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত করিয়ে, নিজেদের হাড়-হাড্ডি আর চামড়া বাঁচানোর জন্য এখন ‘বলির পাঁঠা’ বানাতে চাচ্ছেন প্রফেসর ইউনূসকে? বড়ই মোটা দাগের জোকস এটা। নাচতে না জানলে যে উঠান বাঁকা হয়ে যায়, একথা সবাই জানে। তো সবকিছুই যদি ড. ইউনূসের কাজ তাহলে আপনাদের মতো ‘অপদার্থ’রা ক্ষমতা আগলে বসে আছেন কেন? এবার জাতির রক্ত-মাংস খাওয়ার বদলে দয়া করে ঘাড় থেকে নামুন। আমরা একটু দম নেই।
দুই.
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপস্থাপন করে যে ফায়দা বাংলাদেশ ঘরে তুলতে পারতো, তার উল্টো কাজই করেছে আমাদের সরকার। তারপর দিচ্ছে জঘন্য সব অপবাদ। এরই মধ্যে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রফেসর ইউনূসের ইমেজের বারোটা বাজানোর জন্য এই সরকার পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্বিচারে ব্যবহার করেছে। এই বিশ্বের তাবত্ দেশের কাছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বস্তা বস্তা পত্র প্রেরণ করে জানিয়েছে—লোকটি খুবই খারাপ। তিনি সুদখোর। গ্রামীণ ব্যাংকটা তিনি কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনার সরকার তার খপ্পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষা করেছে! তাছাড়া তাকে তো ঘরছাড়া করেছে আদালত! আর আমাদের আদালত তো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মশহুর! সে জন্য এই লোকটির সঙ্গে কোনো কাজ-কারবার করবেন না কেউ।
তারপরও এই মানুষটি দেশের জন্য আরও কিছু কাজ করতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ইউনূস সেন্টারের কথা শোনা যাক : “একজন নাগরিকের প্রভাব থাকলে তা খাটানোর কাজে সরকারের একটা ভূমিকা দরকার হয়। সরকারের রায় থেকে সেই নাগরিককে এই দায়িত্ব অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও দিতে হয়। দু’দিকের সরকারকে বুঝতে হবে যে, সেই নাগরিকের সঙ্গে কথা বললে তিনি সেকথা অন্য দিকের সরকারকে জানাতে পারবেন এবং তারা সেটা বিবেচনা করবেন; নাগরিক শুধু তার প্রভাব খাটিয়ে আলোচনাকে সহজ করে দিচ্ছেন মাত্র। তখন যে কোনো আলোচনা অগ্রসর হতে পারে। প্রফেসর ইউনূসের বর্তমান পরিস্থিতি সেরকম নয়। বর্তমান যুগের শক্তিশালী মিডিয়ার কারণে সব দেশের সরকার জেনে গেছে, প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনেকটা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। তাছাড়া সেটা তারা চাক্ষুষ দেখেনও। প্রফেসর ইউনূসের সম্মানে যখন কোনো একটি দেশে একটি অনুষ্ঠান হয় সেখানে সে দেশের মন্ত্রীরা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা আমন্ত্রিত হন; অনেকে আগ্রহ সহকারে উপস্থিত হন। কিন্তু একশ’ ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত থাকেন। সবাই জানতে চায়, যে দেশের একজন বিশিষ্ট মানুষের সম্মানে অনুষ্ঠান, সে দেশের রাষ্ট্রদূতের তো সেখানে গৌরবের সঙ্গে উপস্থিত থাকার কথা, অথচ তিনি অনুপস্থিত কেন? অবশ্য কারণ বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। তাদের ধারণাটি আরও বদ্ধমূল হয় যে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।
প্রফেসর ইউনূস একটা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিন বছর আগে। তার নাম গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বিভিন্ন দেশের কোম্পানি সরাসরি এর মাধ্যমে জনশক্তি আমদানির জন্য তার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কয়েকটি কোম্পানি অগ্রিম চাহিদাও দিয়ে রেখেছিল। সেসব দেশের সরকারও এই উদ্যোগে উত্সাহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের সরকারের কাছ থেকে এ কাজ শুরু করার অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই এই কোম্পানির কার্যক্রম কোনোদিন আর শুরু করা যায়নি। অটোমেকানিক, অটো-ইঞ্জিনয়ারিং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য জাপানি একটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ খোলার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে কিনা, এখনও বলা মুশকিল। প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার জন্য জার্মানির একটা বিখ্যাত কোম্পানি ২০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল, তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।
তিন বছর আগে সৌদি রাজপরিবারের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রিন্স তালাল বিন আবদুল আজিজ আল সাউদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লেখেন যে, তিনি তার প্রতিষ্ঠান ‘আরব গালফ ফান্ডের’ বাত্সরিক পুরস্কার বিতরণী সভাটি বাংলাদেশে করতে চান। তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর সংবাদ মাধ্যম উপস্থিত থাকবে। তিনি নিজে এবং আরব দেশগুলোর অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি এখানে উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করার জন্য তিনি আমন্ত্রণ করেন এবং অনুষ্ঠানের সামগ্রিক অনুষ্ঠানসূচি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেন। প্রিন্স তালাল প্রফেসর ইউনূসের দীর্ঘদিনের বন্ধু। আরব গালফ ফান্ডের মাধ্যমে তিনি আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে ‘মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যাংক’ স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ সরকার থেকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সানন্দে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, তবে তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী বক্তৃতা করতে পারবেন না। এই জবাবে প্রিন্স তালাল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি প্রফেসর ইউনূসকে জানান, প্রফেসর ইউনূসকে সম্মান জানানোর জন্যই এই সমগ্র অনুষ্ঠানটি তিনি বাংলাদেশে করতে চেয়েছিলেন। যদি প্রফেসর ইউনূস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে না পারেন তাহলে তিনি বাংলাদেশে এই অনুষ্ঠান করবেন না। তিনি এই অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে নিয়ে যান। পহেলা ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে প্রিন্স তালাল এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সব আতিথেয়তা দেখিয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অতিরিক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নাজিব প্রফেসর ইউনূসকে সম্মানিত করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিবের পরিবারের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের অনেক আগের সম্পর্ক। ১৯৯৪ সালে তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রফেসর ইউনূসকে ‘তুন আবদুর রাজ্জাক পুরস্কার’ দেয়া হয়েছিল। তার বাবার স্মৃতিতে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন যদি তার কোনো ভূমিকা দেশের কোনো সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে হবে তো।”—প্রফেসর ইউনূসকে কাজে লাগানোর লোক কি বর্তমান সরকারে আছে? কার ঘাড়ের ওপর কয়টি মাথা!
তিন.
ছোটবেলায় গান শুনতাম, ‘থাকিলে ডোবা নালা/হবে কচুরীপানা/স্বভাব তো কখনো যাবে না।’ সেই গানের মতোই প্রবাদ বাক্য কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। গ্রাম দেশে বলে চোরের মায়ের বড় গলা। চাষীদের কথা, যে গরু গু খাওয়া শিখে যায় তাকে আর ওই কর্ম থেকে বিরত রাখা যায় না। এজন্যই আগের দিনের মুরুব্বিরা বলতেন, কেউ যদি বলে হিমালয় পর্বত এক মাইল সরে গেছে, এটা বিশ্বাস করা যায়। কারণ বিষয়টি প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক। কিন্তু কেউ যদি দাবি করে আমার স্বভাব বদলে গেছে, তা বিশ্বাস করা উচিত নয়।
এই স্বভাব সংক্রান্ত আমার নিজের দেখা একটা গল্প বলছি। ছোট বেলাকার কথা। আমাদের গরুর পাল দেখাশোনার জন্য কয়েকজন রাখাল ছিল। এর মধ্যে একজন ছিল একটু বয়স্ক। চুপচাপ স্বভাবের কিন্তু কর্মঠ। একবার সব রাখাল ওর বিরুদ্ধে নালিশ করলো যে অমাবস্যার রাতে ও যেন কোথায় চলে যায়? লাগানো হলো গোয়েন্দা। দেখা গেল ও শুকনো বিলের মাঝখানে গিয়ে মাটি খুঁড়ছে। এভাবে ভোরের আজান পর্যন্ত। তারপর বাড়ি ফিরলো। সবাই ধরে ফেললো। অনেক জোরাজুরির পর বললো, যুবক বয়সে সে ছিল একজন সিঁধেল চোর। পরে পীরের নির্দেশে সে কর্ম ত্যাগ করে। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষে ওর ওই পুরনো অভ্যাসটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কী করা! আবার পীরের শরণাপন্ন। পীর বললো, ওমন হলে দূরে কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করো। তাতে একদিন হয়তো নেশাটাও যাবে, আর কায়িক পরিশ্রমের কারণে ঘুমও ভালো হবে। এছাড়া তওবা করবে সব সময়। এতে তার অনেক উপকার হয়েছে। সেজন্যই প্রতি অমাবস্যার রাতে সে এই কর্ম করে।
আওয়ামী লীগ এবং তাদের মন্ত্রীরা অনেক জ্বালিয়েছে শেখ মুজিবকে। রাগে-ক্ষোভে তিনি এদের চোরের দল, চাটার দল বলে গালমন্দ করতেন। এদের মানুষ করার জন্য খান আতাকে দিয়ে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবি বানিয়েছিলেন। তারপরও আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের স্বভাব বদলায়নি। বদলায়নি বলেই এরা ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতির তুফান ছুটিয়ে দেয়। আর এই দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়িয়ে ফেলে চোয়ালের জোর। চোয়ালবাজিতে এদের সঙ্গে পেরে ওঠার সাধ্য কারও নেই। এরা দুর্নীতিতেও চাম্পিয়ন, চোয়ালবাজিতেও এক নম্বর। চুরি করবে কিন্তু সাধু সেজে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেবে মঞ্চে। আর ব্যর্থতার সব দায় চাপাবে অন্যের ঘাড়ে। এবার তারা ঘাড় হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রফেসর ইউনূসকে।
চার.
আওরঙ্গজেব। দিল্লির সম্রাট নন। আমার বাঁধা রিকশাওয়ালা। এবার ঈদে সে আমাকে গরুর মাংস কাটার ফাঁকে ফাঁকে অনেক জ্ঞান দিয়েছে। বলে—ভাইজান, আপনি এলেমদার মানুষ। দুইডা কথা কইলে কি বেজার অইবেন?
বললাম, না।
আওরঙ্গজেব বললো, আমাগো গেরাম দেশে ঘোড়ার মুখে লাগাম পরানো অয়। লাগাম না দিলে ঘোড়ার পিঠে উঠতেই পারবেন না। গরুর জন্যও ব্যবস্থা আছে। গরুর পাল নিয়া আমরা যখন ধানের ক্ষেতের কিনার দিয়া যাই, গরু হালা ক্ষেতে মুখ দিবই। তো আমরা করি কি, যাওয়ার আগেই গরুর মুখে ‘মুখারী’ পরাইয়া নেই। মুখারী পরানো থাকলে হাজার ‘চুদুরবুদুর’ করলেও গরু আর ধান গাছ খাইতে পারে না।
বললাম, তা তুমি আমাকে কী বলতে চাচ্ছ?
আওরঙ্গজেব বললো, তেমন কিছু না ভাইজান। কথা অইলো, আগে গেরামে ছিলাম ভালোই আছিলাম। এখন শহরে থাকি। রেডিও-টেলিভিশন দেহি। ওই সব বাক্সে আমাগো দেশের নেতা, মন্ত্রী সাবরা যা সব কথা কয় হুইনা আমার শরীলডা জ্বইলা যায়?
বললাম, শরীর যদি জ্বলেও যায় তোমার তো কিছু করার নেই।
আওরঙ্গজেব নির্বিকার, না ভাইজান, আমাগো কিছু করণের নাই কথাডা ঠিক। তয় আপনাগো কিছু করণের আছে?
বললাম, কী করার আছে বল।
বললো, ভাইজান, আপনে মুখারী বেচার একটা দোকান খুলেন।
আমি অবাক, মুখারী বিক্রির দোকান খুলবো আমি? কেন?
আওরঙ্গজেব ঠাণ্ডা গলায় বললো, ভাইজান আমি আপনেরে লাগাম বেচার কথাই কইতাম। কিন্তু লাগাম পরানোর কামডা একটু কঠিন। প্রথমত লোহা লাগে। তারপর আবার নাক ছিদ্র করতে হয়, বহুত হাঙ্গামা। কিন্তু মুখারীতে কোনো হাঙ্গামা নাই। মুখারীতে খরচও কম। লাগে খালি বাঁশ আর দড়ি। পট কইরা মুখে বাইন্ধা দিলেই অয়। আমি কইতাছি ভাইজান, ভালো ব্যবসা অইব। মুখারী আমি দেশ থাইকা আইনা আইনা আপনারে দিমু। আপনি খালি বইয়া বইয়া বেচবেন। আপনেও একটা ভালা কাম পাইলেন, আমিও দুইডা পয়সা পামু।
বললাম, তা তোমার ওই মুখারী কে কিনবে?
আওরঙ্গজেবের গলায় প্রত্যয়, কি কন ভাইজান। কেনার জন্য দোকানের সামনে লাইন পড়বো। আমার কথাটা বিশ্বাস করেন, চারিদিকের অবস্থা দেইখা মানুষ খেইপা গনগনা চুলা অইয়া রইছে। দোকান খুললেই টের পাইবেন।
বললাম, সবই বুঝলাম। কিন্তু আমাকে বল, তোমার ওই মুখারী দিয়ে শহরের মানুষ করবে কী?
নতুন আবিষ্কারের আনন্দ আওরঙ্গজেবের চোখে-মুখে, বলেন কি ভাইজান। কি করবে মানে? আমাগো নেতারা এবং মন্ত্রী সাবরা যেসব আলতু-ফালতু কথাবার্তা কন, সেসব হুইনা সবাই রাইগা টং। কিন্তু কথা হইল তেনারা সম্মানিত মানুষ। তাগো তো নাক ছিদ্র কইরা লাগাম পরান যায় না। তাদের জন্য সহজ মুখারীর ব্যবস্থা। আদাব সালাম দিয়া আমরা বেবাগে মিলা তাগো মুখে মুখারী পরাইয়া দিমু। ব্যস। তাগো মুখ বন্ধ। লগে লগে না-হক কথাও বন্ধ। দেশের মানুষও বাঁচবো তাগোর কথার অত্যাচার থাইকা। বিদেশেও দেখবেন আমাগো নামডাক অইবো। আল্লায় যদি রহম করে, আফ্রিকা আর আরব দেশগুলোতেও আমরা মুখারী বেইচা ডলার কামাইতে পারমু। হা, হা, হা। ঠিক কই নাই ভাইজান?
আওরঙ্গজেবের চোখে খেলতে থাকে দুঃসাহসী নতুন স্বপ্নের ঢেউ। আর গুম হয়ে বসে রইলাম আমি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
a_hyesikder@yahoo.com
তো এ গ্রন্থে দেখা যায়, মন্ত্রতন্ত্র আর জাদুর বলে মানুষ পরিণত হয় পশু-পাখিতে। শয়তান পরিণত হয় দরবেশে। রাজপুত্র হয়ে যায় পথের ফকির। ফকির হয়ে ওঠে রাজার পুত্র। উদ্ভট, অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর, রক্ত হিম করা কাহিনীর পাতায় পাতায় কল্পনার বিশাল বিস্তার। রূপকথা আর রূপকথা।
এসব কথা আর কাহিনীতে দেখা যায় সঙ্কটকালে গাধা, ছাগল, ঘোড়া, পাখি ইত্যাদি প্রাণীরও জবান খুলে যায়। তারা মানুষের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা লাভ করে।
কথা বলার এই যে অসীম ক্ষমতা, সেই ক্ষমতা আবার লাভ করেছেন আমার সম্মানিত বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল আবদুল মুহিত। এর আগে বেফজুল কথা বলার জন্য তিনি তিরস্কৃত হয়েছিলেন সংসদে। টকশো ও পত্র-পত্রিকায় গালাগালের বন্যা বয়ে গেলে, প্রথমবারের মতো অনুধাবন করেছিলেন যে, তিনি সম্ভবত এদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। তারপর দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চেয়ে জীবনে আর কখনও বেল তলায় যাবেন না শপথ গ্রহণ করে বন্ধ করেছিলেন তার জবান। ফলে জাতি রেহাই পেয়েছিল জান ঝালাপালা হওয়ার হাত থেকে।
কিন্তু আল্লাহর লীলা বোঝা ভার। আল্লাহর অসীম কুদরতেই হোক আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃপালাভের জন্যই হোক, অতি অলৌকিকভাবে তিনি আবার তার আগের জবান ফিরে পেয়েছেন। জবান ফিরে পেয়েই তিনি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। এবার তার জবানপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি লাভ করেছেন অন্তর্দৃষ্টি। অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা যে কোনো ব্যক্তিকে খ্রিস্টানরা বলে সেন্ট, হিন্দুরা বলে স্বামী, বৌদ্ধরা বলে নির্বাণপ্রাপ্ত মহাথেরো। আর মুসলমানদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন আল্লাহর ওলি বা দরবেশ। তবে আমাদের মন্ত্রী মহোদয় কোন কাতারের দরবেশ বা তিনি কোন তরিকার ওলি, তা এখনও খোলাসা করে বলেননি। তবে ধারণা করা যায়, তিনি ‘মুজিবীয় তরিকার’ একজন জবরদস্ত কামেল।
এই অন্তর্দৃষ্টি লাভ এবং জবান খুলে যাওয়ার কারণেই তার কথার ধার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শব্দ দূষণ পরিমাপ যন্ত্রের হিসেবে তা কত ডেসিবল, বলতে পারব না। তবে তিনি যেসব ‘অমৃত বাণী’ জবান দ্বারা নির্গত করেছেন, তার সারাংশ হলো—বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দেশে বিদেশি বিনিয়োগে একমাত্র বাধা। আমাদের বিনিয়োগ যে তেমন বাড়েনি, সরাসরি বিনিয়োগও যে কমে গেছে তার জন্য একমাত্র দায়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিদেশে তার মিথ্যা প্রচারণার কারণে দেশে বিনিয়োগ আসছে না। বিনিয়োগের অভাবে আমরা মরে যাচ্ছি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল যখন কথার মাধ্যমে এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ঘৃণা ও বিদ্বেষপ্রসূত গু-গোবর উগড়াচ্ছিলেন, সে সময় সুদূর ভিয়েনার এক সেমিনারে স্পেনের রানী সোফিয়াকে পাশে নিয়ে, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, বিশ্বনন্দিত সোশ্যাল বিজনেস তত্ত্বের উদ্ভাবক ও প্রয়োগকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলছিলেন—সন্ত্রাস ও সংঘাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে শান্তির ঠিকানায় পরিণত করতে হলে অবশ্যই দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে হবে।
আমাদের দেশের এসব গলিত-দূষিত ‘মালামালের’ সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের পার্থক্য বোঝার জন্য মহাপণ্ডিত বা গবেষক হওয়ার দরকার নেই। দুটো বক্তৃতা পাশাপাশি রাখলেই হবে। বাংলাদেশের সীমা পার হয়ে তিনি যখন দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার জন্য চারণের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বময়, সেই সময় বাংলাদেশের ‘তুই চোর’গুলো নিজেদের পাপ ও ব্যর্থতার দায়ভার এই মানুষটির ওপর চাপিয়ে সাধু সাজার হাস্যকর কসরত করছেন। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। সূর্যের সঙ্গে শত্রুতা করে অন্ধকারের পেঁচা! এ যেন ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’।
আবুল মা’লকে ‘বাংলিশ’ ভাষা আবিষ্কারের জন্য এর আগে অভিনন্দিত করেছিলাম আমি। সেই সময় তার কবরের এফিটাফের একটা নমুনাও পেশ করেছিলাম। তিনি সে সময় যেসব বাণী ঝাড়তেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—‘আই অ্যাম একদম ফেড-আপ’, ‘ননসেন্স’, ‘শেয়ারবাজার ফটকাবাজার’, ‘লগ্নিকারীরা জুয়াড়ি’, হিলারি-ইউনূস ‘রাবিশ’, ‘চার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারি এমন কিছুই নয়’ ইত্যাদি।
৩৩ লাখ লগ্নিকারীকে পথে বসিয়ে শেয়ারবাজারকে মতিঝিলে দাফন করেও তার খাসলত বদলায়নি। তিনি যদি সুস্থ ও স্বাভাবিক হতেন তাহলে তাকে প্রশ্ন করা যেত, যে বিনিয়োগের অভাবে মরছেন, তার উন্নয়নে প্রয়োজনীয় কাজটি করেছেন?
কোনো ব্যক্তি কি একটা সরকার বা রাষ্ট্রের চেয়েও ক্ষমতাধর হতে পারে? বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা কি সরকারের আদৌ ছিল? চুরি, লুটপাট, দুর্নীতি করে নিজেরাও ডুবেছে দেশকেও ডুবিয়েছে এই সরকার, দায়দায়িত্ব কার? দাতারা এই সরকারকে বিশ্বাস করে না। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে কার দোষে? নির্দিষ্ট সময়ে অনুমতি দেয়া, কারখানা স্থাপন ও উত্পাদনে যাওয়ার অনুকূল ব্যবস্থা কি দেশে এখন আছে? ঘুষ ছাড়া কি অন্য কোনো খাদ্য বর্তমান সরকার খায়? গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে বিনিয়োগ চাওয়া কোন জাতীয় রসিকতা? বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের দায়িত্ব কি ড. ইউনূসের? শেয়ারবাজার ধ্বংস করার নায়ক কে? সোনালী ব্যাংক-হলমার্ক কেলেঙ্কারিও কি ড. ইউনূসের? প্রতিদিন গুম, খুন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি কি ড. ইউনূসের কাজ? পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি কার কীর্তি? বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি কাদের দ্বারা হচ্ছে? যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের আওতায় কোনো বৈঠক হচ্ছে না কেন? জনশক্তি খাতে যে বন্ধ্যত্ব সেটা কার দোষে? কোনো দেশের সঙ্গেই নতুন কোনো বাণিজ্য চুক্তি হচ্ছে না কেন? দাতাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে দেশকে ভারতমুখী করে বন্ধুহীন করা কার কাজ? বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী কেন্দ্রের নাম বদলিয়ে চীনের সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়েছে কে? বাংলাদেশ মৌলবাদী দেশ, জঙ্গিবাদী দেশ—এসব প্রচারণা বিশ্বময় কে করেছে? সব কাজ শিকায় তুলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মেতে থাকছে কারা? এলজিইডিকে দুর্নীতির খনি বানিয়েছে কারা? বস্তাভর্তি টাকাসহ ধরা পড়া কালো বিড়াল সুরঞ্জিতের বিচার কি হয়েছে? দীলিপ বড়ুয়ার এক ডজন প্লট কোত্থেকে এলো? লতিফ বিশ্বাসের ৭ তলা রংমহল কি ড. ইউনূস বানিয়ে দিয়েছেন? শিক্ষাঙ্গনকে ধ্বংস করছে কে?
দুর্নীতির পঞ্চপাণ্ডব আবুল হোসেন, ফারুক খান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মসিউর রহমান ও সৈয়দ মোদাচ্ছের কি ড. ইউনূসের সহচর? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কার সৃষ্টি? দীপু মনির কাজে-অকাজে ১০০টি বিদেশ সফর কেন? তিনি কি ড. ইউনূসের ‘ওয়ান্ডারফুল পাবলিসিটি মেশিনারি’র সঙ্গে পেরে উঠছেন না? নৌমন্ত্রী ও দিলীপ বড়ুয়ার অর্ধশত বার বিদেশ সফরও তাহলে ব্যর্থ? রেন্টাল-কুইক রেন্টাল খাতে লুটপাটের নায়ক কারা? চোরা আবুলকে ‘দেশপ্রেমিক’ বানিয়েছে কে? বিশ্বব্যাংককে বাপ-মা তুলে গালাগালি কে করেছে? এসব প্রশ্নের মতো হাজার প্রশ্ন সর্বত্র। বাংলাদেশকে দুর্নীতি ও কুশাসনের দেশ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত করিয়ে, নিজেদের হাড়-হাড্ডি আর চামড়া বাঁচানোর জন্য এখন ‘বলির পাঁঠা’ বানাতে চাচ্ছেন প্রফেসর ইউনূসকে? বড়ই মোটা দাগের জোকস এটা। নাচতে না জানলে যে উঠান বাঁকা হয়ে যায়, একথা সবাই জানে। তো সবকিছুই যদি ড. ইউনূসের কাজ তাহলে আপনাদের মতো ‘অপদার্থ’রা ক্ষমতা আগলে বসে আছেন কেন? এবার জাতির রক্ত-মাংস খাওয়ার বদলে দয়া করে ঘাড় থেকে নামুন। আমরা একটু দম নেই।
দুই.
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপস্থাপন করে যে ফায়দা বাংলাদেশ ঘরে তুলতে পারতো, তার উল্টো কাজই করেছে আমাদের সরকার। তারপর দিচ্ছে জঘন্য সব অপবাদ। এরই মধ্যে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রফেসর ইউনূসের ইমেজের বারোটা বাজানোর জন্য এই সরকার পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্বিচারে ব্যবহার করেছে। এই বিশ্বের তাবত্ দেশের কাছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বস্তা বস্তা পত্র প্রেরণ করে জানিয়েছে—লোকটি খুবই খারাপ। তিনি সুদখোর। গ্রামীণ ব্যাংকটা তিনি কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনার সরকার তার খপ্পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে রক্ষা করেছে! তাছাড়া তাকে তো ঘরছাড়া করেছে আদালত! আর আমাদের আদালত তো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মশহুর! সে জন্য এই লোকটির সঙ্গে কোনো কাজ-কারবার করবেন না কেউ।
তারপরও এই মানুষটি দেশের জন্য আরও কিছু কাজ করতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে ইউনূস সেন্টারের কথা শোনা যাক : “একজন নাগরিকের প্রভাব থাকলে তা খাটানোর কাজে সরকারের একটা ভূমিকা দরকার হয়। সরকারের রায় থেকে সেই নাগরিককে এই দায়িত্ব অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও দিতে হয়। দু’দিকের সরকারকে বুঝতে হবে যে, সেই নাগরিকের সঙ্গে কথা বললে তিনি সেকথা অন্য দিকের সরকারকে জানাতে পারবেন এবং তারা সেটা বিবেচনা করবেন; নাগরিক শুধু তার প্রভাব খাটিয়ে আলোচনাকে সহজ করে দিচ্ছেন মাত্র। তখন যে কোনো আলোচনা অগ্রসর হতে পারে। প্রফেসর ইউনূসের বর্তমান পরিস্থিতি সেরকম নয়। বর্তমান যুগের শক্তিশালী মিডিয়ার কারণে সব দেশের সরকার জেনে গেছে, প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনেকটা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। তাছাড়া সেটা তারা চাক্ষুষ দেখেনও। প্রফেসর ইউনূসের সম্মানে যখন কোনো একটি দেশে একটি অনুষ্ঠান হয় সেখানে সে দেশের মন্ত্রীরা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা আমন্ত্রিত হন; অনেকে আগ্রহ সহকারে উপস্থিত হন। কিন্তু একশ’ ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপস্থিত থাকেন। সবাই জানতে চায়, যে দেশের একজন বিশিষ্ট মানুষের সম্মানে অনুষ্ঠান, সে দেশের রাষ্ট্রদূতের তো সেখানে গৌরবের সঙ্গে উপস্থিত থাকার কথা, অথচ তিনি অনুপস্থিত কেন? অবশ্য কারণ বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। তাদের ধারণাটি আরও বদ্ধমূল হয় যে, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।
প্রফেসর ইউনূস একটা সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিন বছর আগে। তার নাম গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস। প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বিভিন্ন দেশের কোম্পানি সরাসরি এর মাধ্যমে জনশক্তি আমদানির জন্য তার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কয়েকটি কোম্পানি অগ্রিম চাহিদাও দিয়ে রেখেছিল। সেসব দেশের সরকারও এই উদ্যোগে উত্সাহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের সরকারের কাছ থেকে এ কাজ শুরু করার অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই এই কোম্পানির কার্যক্রম কোনোদিন আর শুরু করা যায়নি। অটোমেকানিক, অটো-ইঞ্জিনয়ারিং প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য জাপানি একটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ খোলার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। সে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে কিনা, এখনও বলা মুশকিল। প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার জন্য জার্মানির একটা বিখ্যাত কোম্পানি ২০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল, তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন।
তিন বছর আগে সৌদি রাজপরিবারের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য প্রিন্স তালাল বিন আবদুল আজিজ আল সাউদ বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লেখেন যে, তিনি তার প্রতিষ্ঠান ‘আরব গালফ ফান্ডের’ বাত্সরিক পুরস্কার বিতরণী সভাটি বাংলাদেশে করতে চান। তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর সংবাদ মাধ্যম উপস্থিত থাকবে। তিনি নিজে এবং আরব দেশগুলোর অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি এখানে উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করার জন্য তিনি আমন্ত্রণ করেন এবং অনুষ্ঠানের সামগ্রিক অনুষ্ঠানসূচি বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেন। প্রিন্স তালাল প্রফেসর ইউনূসের দীর্ঘদিনের বন্ধু। আরব গালফ ফান্ডের মাধ্যমে তিনি আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুকরণে ‘মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যাংক’ স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ সরকার থেকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সানন্দে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, তবে তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী বক্তৃতা করতে পারবেন না। এই জবাবে প্রিন্স তালাল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি প্রফেসর ইউনূসকে জানান, প্রফেসর ইউনূসকে সম্মান জানানোর জন্যই এই সমগ্র অনুষ্ঠানটি তিনি বাংলাদেশে করতে চেয়েছিলেন। যদি প্রফেসর ইউনূস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে না পারেন তাহলে তিনি বাংলাদেশে এই অনুষ্ঠান করবেন না। তিনি এই অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে নিয়ে যান। পহেলা ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখে প্রিন্স তালাল এবং আরব বিশ্বের অন্যান্য গণ্যমান্যদের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠান কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সব আতিথেয়তা দেখিয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অতিরিক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নাজিব প্রফেসর ইউনূসকে সম্মানিত করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিবের পরিবারের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের অনেক আগের সম্পর্ক। ১৯৯৪ সালে তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রফেসর ইউনূসকে ‘তুন আবদুর রাজ্জাক পুরস্কার’ দেয়া হয়েছিল। তার বাবার স্মৃতিতে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রফেসর ইউনূস নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন যদি তার কোনো ভূমিকা দেশের কোনো সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে হবে তো।”—প্রফেসর ইউনূসকে কাজে লাগানোর লোক কি বর্তমান সরকারে আছে? কার ঘাড়ের ওপর কয়টি মাথা!
তিন.
ছোটবেলায় গান শুনতাম, ‘থাকিলে ডোবা নালা/হবে কচুরীপানা/স্বভাব তো কখনো যাবে না।’ সেই গানের মতোই প্রবাদ বাক্য কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। গ্রাম দেশে বলে চোরের মায়ের বড় গলা। চাষীদের কথা, যে গরু গু খাওয়া শিখে যায় তাকে আর ওই কর্ম থেকে বিরত রাখা যায় না। এজন্যই আগের দিনের মুরুব্বিরা বলতেন, কেউ যদি বলে হিমালয় পর্বত এক মাইল সরে গেছে, এটা বিশ্বাস করা যায়। কারণ বিষয়টি প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক। কিন্তু কেউ যদি দাবি করে আমার স্বভাব বদলে গেছে, তা বিশ্বাস করা উচিত নয়।
এই স্বভাব সংক্রান্ত আমার নিজের দেখা একটা গল্প বলছি। ছোট বেলাকার কথা। আমাদের গরুর পাল দেখাশোনার জন্য কয়েকজন রাখাল ছিল। এর মধ্যে একজন ছিল একটু বয়স্ক। চুপচাপ স্বভাবের কিন্তু কর্মঠ। একবার সব রাখাল ওর বিরুদ্ধে নালিশ করলো যে অমাবস্যার রাতে ও যেন কোথায় চলে যায়? লাগানো হলো গোয়েন্দা। দেখা গেল ও শুকনো বিলের মাঝখানে গিয়ে মাটি খুঁড়ছে। এভাবে ভোরের আজান পর্যন্ত। তারপর বাড়ি ফিরলো। সবাই ধরে ফেললো। অনেক জোরাজুরির পর বললো, যুবক বয়সে সে ছিল একজন সিঁধেল চোর। পরে পীরের নির্দেশে সে কর্ম ত্যাগ করে। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষে ওর ওই পুরনো অভ্যাসটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কী করা! আবার পীরের শরণাপন্ন। পীর বললো, ওমন হলে দূরে কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করো। তাতে একদিন হয়তো নেশাটাও যাবে, আর কায়িক পরিশ্রমের কারণে ঘুমও ভালো হবে। এছাড়া তওবা করবে সব সময়। এতে তার অনেক উপকার হয়েছে। সেজন্যই প্রতি অমাবস্যার রাতে সে এই কর্ম করে।
আওয়ামী লীগ এবং তাদের মন্ত্রীরা অনেক জ্বালিয়েছে শেখ মুজিবকে। রাগে-ক্ষোভে তিনি এদের চোরের দল, চাটার দল বলে গালমন্দ করতেন। এদের মানুষ করার জন্য খান আতাকে দিয়ে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবি বানিয়েছিলেন। তারপরও আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের স্বভাব বদলায়নি। বদলায়নি বলেই এরা ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতির তুফান ছুটিয়ে দেয়। আর এই দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়িয়ে ফেলে চোয়ালের জোর। চোয়ালবাজিতে এদের সঙ্গে পেরে ওঠার সাধ্য কারও নেই। এরা দুর্নীতিতেও চাম্পিয়ন, চোয়ালবাজিতেও এক নম্বর। চুরি করবে কিন্তু সাধু সেজে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেবে মঞ্চে। আর ব্যর্থতার সব দায় চাপাবে অন্যের ঘাড়ে। এবার তারা ঘাড় হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রফেসর ইউনূসকে।
চার.
আওরঙ্গজেব। দিল্লির সম্রাট নন। আমার বাঁধা রিকশাওয়ালা। এবার ঈদে সে আমাকে গরুর মাংস কাটার ফাঁকে ফাঁকে অনেক জ্ঞান দিয়েছে। বলে—ভাইজান, আপনি এলেমদার মানুষ। দুইডা কথা কইলে কি বেজার অইবেন?
বললাম, না।
আওরঙ্গজেব বললো, আমাগো গেরাম দেশে ঘোড়ার মুখে লাগাম পরানো অয়। লাগাম না দিলে ঘোড়ার পিঠে উঠতেই পারবেন না। গরুর জন্যও ব্যবস্থা আছে। গরুর পাল নিয়া আমরা যখন ধানের ক্ষেতের কিনার দিয়া যাই, গরু হালা ক্ষেতে মুখ দিবই। তো আমরা করি কি, যাওয়ার আগেই গরুর মুখে ‘মুখারী’ পরাইয়া নেই। মুখারী পরানো থাকলে হাজার ‘চুদুরবুদুর’ করলেও গরু আর ধান গাছ খাইতে পারে না।
বললাম, তা তুমি আমাকে কী বলতে চাচ্ছ?
আওরঙ্গজেব বললো, তেমন কিছু না ভাইজান। কথা অইলো, আগে গেরামে ছিলাম ভালোই আছিলাম। এখন শহরে থাকি। রেডিও-টেলিভিশন দেহি। ওই সব বাক্সে আমাগো দেশের নেতা, মন্ত্রী সাবরা যা সব কথা কয় হুইনা আমার শরীলডা জ্বইলা যায়?
বললাম, শরীর যদি জ্বলেও যায় তোমার তো কিছু করার নেই।
আওরঙ্গজেব নির্বিকার, না ভাইজান, আমাগো কিছু করণের নাই কথাডা ঠিক। তয় আপনাগো কিছু করণের আছে?
বললাম, কী করার আছে বল।
বললো, ভাইজান, আপনে মুখারী বেচার একটা দোকান খুলেন।
আমি অবাক, মুখারী বিক্রির দোকান খুলবো আমি? কেন?
আওরঙ্গজেব ঠাণ্ডা গলায় বললো, ভাইজান আমি আপনেরে লাগাম বেচার কথাই কইতাম। কিন্তু লাগাম পরানোর কামডা একটু কঠিন। প্রথমত লোহা লাগে। তারপর আবার নাক ছিদ্র করতে হয়, বহুত হাঙ্গামা। কিন্তু মুখারীতে কোনো হাঙ্গামা নাই। মুখারীতে খরচও কম। লাগে খালি বাঁশ আর দড়ি। পট কইরা মুখে বাইন্ধা দিলেই অয়। আমি কইতাছি ভাইজান, ভালো ব্যবসা অইব। মুখারী আমি দেশ থাইকা আইনা আইনা আপনারে দিমু। আপনি খালি বইয়া বইয়া বেচবেন। আপনেও একটা ভালা কাম পাইলেন, আমিও দুইডা পয়সা পামু।
বললাম, তা তোমার ওই মুখারী কে কিনবে?
আওরঙ্গজেবের গলায় প্রত্যয়, কি কন ভাইজান। কেনার জন্য দোকানের সামনে লাইন পড়বো। আমার কথাটা বিশ্বাস করেন, চারিদিকের অবস্থা দেইখা মানুষ খেইপা গনগনা চুলা অইয়া রইছে। দোকান খুললেই টের পাইবেন।
বললাম, সবই বুঝলাম। কিন্তু আমাকে বল, তোমার ওই মুখারী দিয়ে শহরের মানুষ করবে কী?
নতুন আবিষ্কারের আনন্দ আওরঙ্গজেবের চোখে-মুখে, বলেন কি ভাইজান। কি করবে মানে? আমাগো নেতারা এবং মন্ত্রী সাবরা যেসব আলতু-ফালতু কথাবার্তা কন, সেসব হুইনা সবাই রাইগা টং। কিন্তু কথা হইল তেনারা সম্মানিত মানুষ। তাগো তো নাক ছিদ্র কইরা লাগাম পরান যায় না। তাদের জন্য সহজ মুখারীর ব্যবস্থা। আদাব সালাম দিয়া আমরা বেবাগে মিলা তাগো মুখে মুখারী পরাইয়া দিমু। ব্যস। তাগো মুখ বন্ধ। লগে লগে না-হক কথাও বন্ধ। দেশের মানুষও বাঁচবো তাগোর কথার অত্যাচার থাইকা। বিদেশেও দেখবেন আমাগো নামডাক অইবো। আল্লায় যদি রহম করে, আফ্রিকা আর আরব দেশগুলোতেও আমরা মুখারী বেইচা ডলার কামাইতে পারমু। হা, হা, হা। ঠিক কই নাই ভাইজান?
আওরঙ্গজেবের চোখে খেলতে থাকে দুঃসাহসী নতুন স্বপ্নের ঢেউ। আর গুম হয়ে বসে রইলাম আমি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
a_hyesikder@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন