আমানুল্লাহ কবীর
বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে, আর মাত্র এক বছর কয়েক মাস বাকি। নামে মহাজোট সরকার বলা হলেও কার্যত আওয়ামী লীগ সরকার। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সর্বপর্যায়ে যা ঘটছে, তার সবই ঘটছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নামে। সাধারণ মানুষও মহাজোট সরকার চেনে না, চেনে আওয়ামী লীগ সরকারকেই। কাজেই সরকারের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তারা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডেরই মূল্যায়ন করে থাকে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের যে মূল্যায়ন হবে, তা কেবল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই মূল্যায়ন হবে। ভালোমন্দসহ কাজের দায় আওয়ামী লীগের। সাফল্য- ব্যর্থতার দায়ও আওয়ামী লীগের। কেননা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিই এ সরকার বাস্তবায়ন করছে।
আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছাড়াও কয়েকটি প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ হাসিনা সরকার এসব স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এ ধরনেরই আরেকটি স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটে যায় সরকারের মেয়াদ এক মাস পূর্ণ হতে-না-হতেই, তা হচ্ছে, বিডিআর বিদ্রোহ। ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী বিডিআর বিদ্রোহ নবগঠিত সরকারের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ফলে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সাথে আরেকটি স্পর্শকাতর ইস্যু যোগ হয়। এসব প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচারের রায় বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদ্রোহীদের বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ ও ভারতের কাছে তাদের হস্তান্তর। অপ্রত্যাশিত বিডিআর বিদ্রোহ হাসিনা সরকারকে আরেকটা নতুন স্পর্শকাতর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। বিডিআর বিদ্রোহের বিচার কাজটিও সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই গ্রহণ করতে হয়। এসব স্পর্শকাতর ইস্যুর মধ্যে সর্বাগ্রে বাস্তবায়ন করা হয় শেখ মুজিব হত্যার রায়। ফাঁসির আসামি কর্নেল ফারুক ও তার সহযোগীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। যদিও বাকি তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিদেশে আত্মগোপন করে থাকা বা তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হওয়ায় এখনো তাদের শাস্তি কার্যকর করা যায়নি। অর্থাৎ শেখ মুজিব হত্যার রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আইনি কারণেই হোক আর আশ্রয়দাতা দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণেই হোক, সরকারের বাকি মেয়াদকালে তাদের দেশে এনে শাস্তি কার্যকর করার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে হয়। শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের সবাই সেনাবাহিনীর সদস্য। অবশ্য তাদের কেউ কেউ হত্যাকাণ্ডের আগেই সেনাবাহিনী থেকে অবসরগ্রহণ করেছিলেন বা তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। শেখ মুজিব হত্যার সাথে জড়িত সেনাবাহিনীর এসব সদস্যের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি কারা জুগিয়েছিল, তা ইতিহাসের অংশ হলেও তা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উচ্চবাচ্য নেই। তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তারই মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদ। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও এমপিদের নিয়ে তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। অর্থাৎ মুজিব হত্যার পেছনে রাজনৈতিক মদদ জুগিয়েছিল মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ, যারা এই নির্মম ঘটনার বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাভোগী হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। ঐতিহাসিক কারণেই তারা মুজিব হত্যার দায় এড়াতে পারেন না। শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীরা তাদের শেখ মুজিব হত্যার জন্য অভিযুক্ত করে ইতঃপূর্বে প্রকাশ্যে বহু বক্তৃতা বা বিবৃতি দিয়েছেন। খন্দকার মোশতাককে চিহ্নিত করা হয়েছিল সিআইএ এজেন্ট হিসেবে। কিন্তু তাদের কাউকেই মুজিব হত্যার আসামি করা হয়নি। কেবল তাই নয়, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতানেত্রীদের মুখে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতেও শোনা যায়নি। খন্দকার মোশতাক এখন বিস্মৃত ইতিহাসের নায়ক।
মনে হয়, আওয়ামী লীগ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই মোশতাক ও তার রাজনৈতিক সহযোগীদের দায়মুক্তি দিয়েছে। যারা কোনোভাবেই মুজিব হত্যার দায় এড়াতে পারেন না, এমন অনেক ব্যক্তিই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে পুনর্বাসিত হয়েছেন। তাদেরই একজন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতানেত্রীরা যাকে খুনি মোশতাক বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাকে ও তার সহযোগীদের আড়াল করার জন্য মুজিব হত্যাকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন বিএনপি ও তার প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ মুজিব নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী নেতৃত্বের এই রাজনৈতিক সংকীর্ণতা তার সেই ভাবমূর্তিকে ুণœ করেছে এবং আদালতের রায়ের পর বিতর্ক সৃষ্টি করে তার আত্মার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগীদের মুজিব হত্যার দায় থেকে মুক্তি দেয়ায় মুজিব হত্যার বিচার অসমাপ্ত থেকে গেলো কি না, ভবিষ্যতের ইতিহাসই তা নির্ধারণ করবে।
দ্বিতীয়ত গোপনে বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় গ্রহণকারী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের যে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রধানত উলফা নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযান, তাদের আটক ও ভারতের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ। উলফাপ্রধান পরেশ বড়–য়াসহ অনেক নেতাকর্মীকেই ইতোমধ্যে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আইনি জটিলতার কারণে কারারুদ্ধ অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের ব্যাপারটি বিলম্বিত হলেও সর্বশেষ তাকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। শিগগিরই এই হস্তান্তরপ্রক্রিয়া শেষ হবে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বর্তমান সরকার অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয়গ্রহণকারী উলফা বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ব্যক্তি নন। উলফা সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর বনাঞ্চলে আশ্রয়গ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশের মাটিতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা বিদ্রোহীদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। উলফা নেতাদের আটকের ফলে তাদের তৎপরতা সম্প্রতি কিছুটা হ্রাস পেলেও অন্যান্য বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলার জন্যই বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে আসছিল। ভারতের সাথে নবপর্যায়ে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে গিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পূর্ণ মাত্রায় তাকে সে সুবিধা দিয়েছে। এ জন্য নতুন কোনো চুক্তিও সই হয়নি। ভারত দ্রুত এই সুবিধা গ্রহণ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বেসামরিক সরবরাহের পাশাপাশি সামরিক সরঞ্জামও বহন করেছে। দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ দমনের জন্য সেখানে ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর যে কয়েক লাখ সদস্য মোতায়েন রয়েছে তাদের প্রয়োজনে এসব সামরিক সরঞ্জাম বহন করা হচ্ছে। এখানে দু’টি বিষয় লক্ষণীয়; এক. উত্তর- পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অভিযান এবং দুই. তাদের দমনের জন্য ভারতের সামরিক সরঞ্জামাদি বহনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে দেয়া। এ দু’টি ঘটনাই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে সামরিক সরঞ্জামাদি বহনকারী এসব ভারতীয় পরিবহনের ওপর যেকোনো সময় হামলা করতে পারে। তা ছাড়া যারা ভারতকে এই সুবিধা প্রদান করেছে তারা তাদের প্রতিশোধমূলক আচরণের শিকার হতে পারে। এটা ভাবা ঠিক নয় যে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে বা অদূরভবিষ্যতে শেষ হবে। বঞ্চনার শিকার এই অঞ্চলে কেন্দ্রীয় সামরিক বাহিনীর নির্যাতন যতই বাড়বে, এ আন্দোলন ততই তীব্র হবে। ফলে নিকটবর্তী প্রতিবেশী হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব পড়বে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি তা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। কারণ তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অভিযান জোরদার করা হলে তারা বাংলাদেশের সাথে বিদ্যমান দীর্ঘ সীমান্ত অতিক্রম করে গোপন আশ্রয় খুঁজবে বাংলাদেশে। প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে তারা সামরিক সরঞ্জামাদি বহনকারী ভারতীয় পরিবহনের ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালাতেও দ্বিধা করবে না, যার পরিণতিতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে উঠবে অনিবার্য। দিল্লির কর্মকর্তারা ভারতের অভ্যন্তরীণ অশান্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ইতোমধ্যেই বলা শুরু করেছে যে, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহই ভারতের নিরাপত্তার জন্য এখন বড় হুমকি।
এখানে স্মরণ করা দরকার যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জনসংহতি সমিতির সদস্যদের ভারত প্রকাশ্যেই তার (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য) ত্রিপুরায় আশ্রয় দিয়েছিল। কেবল তাই নয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিয়েছে ভারতই। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির এই বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা চলে দীর্ঘ দিন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে। জনসংহতি সমিতির সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত শান্তিচুক্তি হওয়ার পরেই কেবল ওই বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা বন্ধ হয় এবং চাকমা বিদ্রোহীরা ত্রিপুরা থেকে নিরাপদ পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে। ভারতের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছে। দিল্লি আজ যে সাধুবাদ নীতির কথা বলছে, প্রতিবেশী দেশগুলো অন্য দেশের বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিজেদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না প্রথমে ভারত নিজেই তা ভঙ্গ করেছে। বাংলাদেশের মাটিতে গোপনে অংশগ্রহণকারী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হস্তান্তরের বিষয়টি দিল্লির সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তিতে ফয়সালা হলে তা হতো বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিমুক্ত ও দূরদর্শিতার কাজ। তা না করে শেখ হাসিনা সরকার অতি উৎসাহী হয়ে ভারতের প্রতি যে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে, তার খেসারত একদিন বাংলাদেশকে দিতেই হবে।
তৃতীয়ত যুদ্ধাপরাধের বিচার। যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল চার দশক আগে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সব বর্বরতা নিয়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা করেছিল। যারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন তাদের বিচার হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাদের বিচার হয়নি। যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল মূলত পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী দ্বারা। আর এ দেশের যারা তাদের সহযোগিতা করেছিলেন তারা ছিলেন কোলাবরেটর বা সহযোগী শক্তি আলবদর ও রাজাকার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে এবং তাদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতের মাটিতে। ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল বলে একপর্যায়ে তা পাক-ভারত যুদ্ধের আকার গ্রহণ করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিমলা চুক্তির অধীনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্দিবিনিময় হয়। বন্দিবিনিময়ের সময় হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৯৩ জন সদস্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয় কিন্তু তাদেরও পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি না করে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ক্ষমা করে দেন। তবে বাংলাদেশের যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের কোলাবরেটর অ্যাক্টে বিচারের পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ বিচারপ্রক্রিয়ায় মাত্র তিনজন আলবদর সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আজ যাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা হচ্ছে তারা মূল যুদ্ধাপরাধীদের কেউ ননÑ তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন দু’জন বাদে অন্যরা জামায়াতে ইসলামীর নেতা। এসব জামায়াত নেতার মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ আরো কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। এ ছাড়া আরো কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ সরকারের আমলেই তাদের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আরো একটি বা দু’টি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল, যারা সংবিধান মেনে রাজনীতি করছে। ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তার অন্যতম শরিক দল ছিল জামায়াতে ইসলামী। পরবর্তী সময়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের শরিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীও তাতে অংশ নেয়। সে সময় জামায়াত নেতাদের সাথে শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতানেত্রীদের দহরমমহরম ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে নতুন করে আলোচনার দরকার নেই। সম্পর্ক এমনি ঘনিষ্ঠ ছিল যে, শেখ হাসিনা নিজে অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তখনকার পত্রিকা খুললেই সে খবর চোখে পড়বে। পরবর্তীকালে জামায়াত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-এর নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ওয়াদা ছিল না। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের ওয়াদা করে গত নির্বাচনে। এ থেকে এটাই মনে হয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যে ক্ষোভ আছে, এই ক্ষোভের প্রধান কারণ, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয়।
বর্তমানে দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। শোনা যায়, আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত দুই-তিনজনের বিচারকাজ শেষ হবে। তার পরও সাত-আটজনের বিচারপ্রক্রিয়া অসমাপ্ত থেকে যাবে। নতুন করে আরো কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনা হলে এই সংখ্যা বেড়ে যাবে। ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় যা-ই হোক না কেন, চূড়ান্ত রায়ের জন্য এসব মামলা সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তরিত হবে এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় সেখানেও দীর্ঘ সময় ব্যয় হবে। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদও প্রায় শেষ হয়ে আসবে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এই সময়ের মধ্যে সব অভিযুক্তের বিচার যে শেষ হবে না, তা সহজেই অনুমান করা যায়। অর্থাৎ এই সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের বিচার অসমাপ্তই থেকে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। সমাজের বিভিন্নপর্যায়েই তাদের সমর্থন রয়েছে। নেতৃত্বের অভাব ও কৌশলগত কারণে তারা এখন মাঠে নিষ্ক্রিয় থাকলেও কোনোভাবেই অসংগঠিত নয়। তারা এখনো বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক দল। সামনে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সে সুযোগ গ্রহণ করে ুব্ধ জামায়াত নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবেই সব শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে নামবে। আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সম্পর্ক হবে প্রতিশোধমূলক, যা দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য।
চতুর্থত বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহ ও পিলখানার হত্যাযজ্ঞ। বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানার হত্যাযজ্ঞ একটি অত্যন্ত বর্বর ও স্পর্শকাতর ঘটনা। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মাথায়ই এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা শুধু সদ্যগঠিত সরকারের ভিত্তিকেই নাড়া দেয়নি, দেশেও চরম অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক এ ঘটনায় চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে জাতি। বিশেষত এক-এগারোর ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের পর তেমনি আরেকটি দুঃস্বপ্নের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। বিডিআর বিদ্রোহের সময় পিলখানায় ৭৪ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। তাদের মধ্যে ৫৩ জনই সেনা অফিসার মেজর জেনারেল থেকে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত। বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানেরা এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। এ বিদ্রোহী জওয়ান সেনা অফিসারদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি, তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তারা দু’দিন ধরে এসব বর্বর ঘটনা ঘটায় নির্বিঘেœ কোনো প্রতিরোধ ছিল না। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও মন্ত্রী-এমপিদের চোখের সামনেই এই বর্বরতা চলে। টিভি চ্যানেলগুলো অব্যাহতভাবে এসব ঘটনা লাইভ প্রচার করে। বিদ্রোহী জওয়ানদের একটি প্রতিনিধিদলও প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে, যখন জেনারেল মইন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, এমপি মির্জা আজম পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নিজেদের চোখে পরিস্থিতি দেখেও আসেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কৌশলগত কারণ দেখিয়ে বিডিআর বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দান থেকে বিরত থাকেন। তার যুক্তি, তাহলে সংঘর্ষ দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তার এই যুক্তি কতটুকু দূরদর্শিতাপূর্ণ ছিল, তা এখনো বিতর্কের বিষয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের আগে বিডিআর প্রতিনিধিদল এমপি শেখ সেলিম ও এমপি ফজলে নূর তাপসের সাথে তাদের বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে দেখা করে। তারা দু’জনই প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সম্প্রতি আদালতে দু’জনই এ কথা স্বীকার করেছেন। বিডিআর বিদ্রোহ অবসানের পর প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যান সরকারের পদক্ষেপ ব্যাখ্যা ও বিুব্ধ সেনাকর্মকর্তাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে তিনি সেনাকর্মকর্তাদের প্রচণ্ড ক্ষোভের মুখে পড়েন। পরবর্তী সময়ে এসব বিুব্ধ সেনাকর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় বা বরখাস্ত করা হয়। বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাযজ্ঞের তদন্তের জন্য দু’টি কমিটি গঠিত হয়। এর একটি সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্ত কমিটি যার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। দ্বিতীয়টি গঠন করে সরকার, যার আংশিক রিপোর্ট প্রকাশিত হলে তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশের দাবি ওঠে। কিন্তু তা আর হয়নি। এ ছাড়া আরেকটি কমিটি গঠন করা হয় মামলার তদন্তের জন্য যার ভিত্তিতে বর্তমানে প্রচলিত বেসামরিক আইনে আদালতে মামলা চলছে। বিডিআর আইনের আওতায় গঠিত অপর একটি কোর্টেও বিদ্রোহের অভিযোগে বিচারকাজ চলছে। বেসামরিক আদালতে যে বিচার চলছে তাতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষ হয়নি। এই আদালতের রায়ের পর তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য স্বাভাবিকভাবে উচ্চ আদালতে স্থানান্তরিত হবে। সুতরাং এ বিচারপ্রক্রিয়া যে দীর্ঘ হবে তাতে সন্দেহ নেই। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হতে হতে বর্তমান সরকারের মেয়াদও শেষ হয়ে আসবে। ফলে সরকারের মেয়াদকালে বিচারপ্রক্রিয়া অসমাপ্ত থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
পিলখানার হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত স্পর্শকাতর, কেননা এর সাথে সেনাবাহিনীর আবেগ জড়িত। তা ধামাচাপা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুঃখজনক হচ্ছে, এই নির্মম ঘটনার পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল, কারা ইন্ধন জুগিয়েছিল তা কখনোই পরিষ্কার হয়নি। সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি এসব উপেক্ষা করেছে অথবা চাপা দিয়েছে। ফলে বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যাবে। এ প্রশ্নের জবাবের দায় থেকে আওয়ামী লীগও রেহাই পাবে না।
সুতরাং এসব স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ ইস্যুর প্রতিকূল প্রভাব মাথায় নিয়েই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে এবং ভবিষ্যতেও এর প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তি পাবে নাÑ যা আওয়ামী লীগের আকাশে কালো মেঘ ঘনীভূত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। আর তা সমাজে শুধু অস্থিরতাই সৃষ্টি করবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন