ওয়াশিংটন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের দেওয়ানি বিচারব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ। গত বুধবার প্রকাশিত ‘আইনের শাসন সূচক ২০১২’ শিরোনামের এই বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেওয়ানি বিচারব্যবস্থাসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রভাব রাখতে পারে এমন আটটি েেত্রর বেশিরভাগেই বাংলাদেশের অবস্থান খারাপ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সরকারের প্রভাব সীমাবদ্ধ রাখার েেত্র ৮৭তম, দুর্নীতি অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে ৮৯তম, আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৭২তম, মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষায় ৮৭তম, সরকারের স্বচ্ছতায় ৮৯তম, আইনের প্রয়োগে ৯০তম, দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় ৯৭তম ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় ৮৩তম স্থানে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগা ও বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতিই দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় বাংলাদেশ সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকার জন্য দায়ী। এখানকার সরকারের জবাবদিহিতার অবস্থা খুবই খারাপ। বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থা ও আদালত চরম অদ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পুলিশি হয়রানিও বাংলাদেশের একটি সমস্যা।
বাংলাদেশে আইনের শাসনের পরিস্থিতি সম্পর্কিত এই প্রতিবেদনে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা এক কথায় উদ্বেগজনক। ঘুষ দুর্নীতি প্রশাসনিক অব্যবস্থাÑ এসব বাংলাদেশের নিত্য চিত্রের অংশ। কিন্তু তুলনীয় দেশগুলোর মধ্যে যে অবস্থানে বাংলাদেশ রয়েছে তা কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিম্নতম অবস্থানে বোঝা যায় দেশের মানুষ জায়গা-জমি নিয়ে কী ধরনের ভোগান্তিতে রয়েছেন। অনেক সময় দেওয়ানি মামলা দায়েরের পর ১০-২০ বছরেও তা নিষ্পত্তি হতে দেখা যায় না। দুর্নীতি এতটা গভীরে পৌঁছে গেছে, জমিসংক্রান্ত বিরোধে রায় পেতে কোর্ট ম্যানেজ করতে হয় বলে একটি কথা আদালতপাড়ায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত। অর্থাৎ বিচারকদের ঘুষ দিতে পারলে অন্যের জমির রায় নিজের নামে পাওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। এ অবস্থার অবসানে এক দিকে দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় সংস্কার এনে মামলা নিষ্পত্তিতে সময়সীমা বেঁধে দেয়ার বিধান করতে হবে। অন্য দিকে জমিবিরোধ নিষ্পত্তিতে দুর্নীতির বিস্তার রোধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। দেওয়ানি মামলা ছাড়া অন্য সূচকগুলোতেও বাংলাদেশের অবস্থান উদ্বেগজনক। সরকারের প্রভাব যেন ক্রমেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থা মাত্র ১০টি দেশের। এটি কোনোভাবেই সম্মানজনক চিত্র নয়। সূচকে আরো খারাপ অবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ততায় । এর সাথে সমান্তরালভাবে নিম্নঅবস্থান সরকারের স্বচ্ছতায়। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৭২টি দেশের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। এ ছাড়া যেন সান্ত্বনার আর কোনো চিত্র নেই। মৌলিক অধিকার রক্ষা আর আইনের প্রয়োগে যে দুরবস্থা তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা আর পুলিশের সাথে সরকার সমর্থক সন্ত্রাসীদের গলাগলি অবস্থা থেকে অনুমান করা যায়। আমরা মনে করি, যে অবস্থা দেশে এখন বিরাজ করছে সেটি চলতে দেয়া যায় না। আইনের শাসনের উন্নতি করতেই হবে। বিচারব্যবস্থায় গতি আনতে হবে। নিয়োগ-পদোন্নতিতে দুর্নীতি ও দলীয় বিবেচনা বাদ দিতে হবে। প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে। এ জন্য অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব বেশি। এ ক্ষেত্রে জনগণের দায়িত্বও রয়েছে। দেশের মানুষকে এ বাপারে পদক্ষেপ নিতে এক দিকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে অন্য দিকে অন্যায় অসাধুতার ব্যাপারে নৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের সামনে যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে সেটি মরীচিকার মতো হারিয়ে যাবে। আর আমাদের স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে আগামী প্রজন্মকে হাতাশার অতল গহ্বরে ঠেলে দেবে। এ অবস্থার কথা আমরা ভাবতে চাই না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন