শা হ আ হ ম দ রে জা
ক্ষমতাসীনদের সর্বাত্মক চেষ্টা ও প্রচারণা সত্ত্বেও রামু, উখিয়া, পটিয়া ও টেকনাফসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত সহিংসতার দায়ভার বিএনপিসহ দেশপ্রেমিক শক্তির ওপর চাপানো সম্ভব হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার ছোবল এলে কারা মেরেছিল সে কথা যেমন জানাজানি হয়েছে তেমনি জানা গেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রশংসিত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়াই ছিল অন্তরালে সক্রিয় বিশেষ গোষ্ঠীর প্রকৃত উদ্দেশ্য। জনগণের প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে পিছিয়ে গেলেও একই গোষ্ঠী যে থেমে নেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে অন্য কিছু ঘটনায়। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রথমে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রধান নায়ক ও দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা অলি আহাদের প্রতি দেখানো অসম্মানের কথা উল্লেখ করতেই হবে। গত ২০ অক্টোবর এই নেতা ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। পাকিস্তান যুগের প্রাথমিক দিনগুলো থেকে জীবনের শেষ পর্যন্তও তিনি এ দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন এবং ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সম্মানজনক অবস্থানে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন। মন্ত্রিত্ব কিংবা রাজনৈতিক কোনো সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চিন্তা পর্যন্ত করেননি কখনো। তিনি বরং শিখিয়ে গেছেন, ক্ষমতায় না গিয়েও কীভাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে ভূমিকা পালন করা যায়। অমন একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতাকে নিয়ে কিন্তু বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ টিভি চ্যানেলগুলোকে সামান্য উচ্চবাচ্য করতেও দেখা যায়নি। কোনো কোনো চ্যানেলে ‘জাতীয়’ খবর হিসেবে প্রচার করা হলেও খবরটি এসেছিল পাঁচ থেকে আট-দশ নম্বরের দিকে। ক্ষমতাসীনদের কেউই হাসপাতালে তাকে দেখতে যাননি, তার জানাজায়ও কোনো মন্ত্রী গিয়ে অংশ নেননি। এমনকি শোকও প্রকাশ করেননি ক্ষমতাসীনরা।
বলাবাহুল্য, সবকিছুর পেছনে একটি মাত্র কারণই ছিল—মরহুম অলি আহাদ আওয়ামী লীগ করতেন না। তার দেশপ্রেমিক ভূমিকা বরং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের অঘোষিত আইন হলো, কাউকে সম্মান পেতে হলে আওয়ামী লীগ তো করতেই হবে, ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতাকে’ নিয়েও মাতামাতি না করলে চলবে না। কথা শুধু এটুকু হলেও হয়তো আপত্তি উঠত না। অন্যদিকে সরকারের সেবাদাস ও আওয়ামী চাটুকাররা সৌজন্যের সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করেছেন। যেমন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অলি আহাদের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেছেন, এর ফলে ‘অসাম্প্রদায়িক মিলনস্থল’ শহীদ মিনারের ‘পবিত্রতা’ নাকি নষ্ট হয়েছে এবং এভাবে জানাজা পড়ানো নাকি ‘জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী’! সরকারের আরেক সেবাদাস নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, শহীদ মিনারে জানাজার আয়োজনের মধ্য দিয়ে নাকি ‘সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ’ ঘটেছে!
কথাগুলোকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়া যায় না। কারণ, একদিকে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আর অন্যদিকে বলেছেন এদেশের সাংস্কৃতিক জগতের আওয়ামী ‘দিকপাল’ (!)। তিনিও এসেছেন ‘জাতীয় মূল্যবোধ’ এবং ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে জনগণকে জ্ঞান দিতে! পাঠকরা বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, মহান যে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই শহীদ মিনার, মরহুম অলি আহাদ ছিলেন সে আন্দোলনের প্রধান নেতা। বাচ্চু এবং আরেফিন সিদ্দিকদের ‘পূজনীয়’ নেতার মতো ফরিদপুরের জেলখানায় বসে তিনি ‘চিরকুট’ পাঠিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অসত্য দাবি জানিয়ে বসেননি। সুতরাং শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাজা অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না। তথাকথিত ‘পবিত্রতা’ এবং ‘জাতীয় মূল্যবোধের’ কথাও অচল হয়ে পড়ে। কারণ, একমাত্র শহীদ দিবস তথা একুশে ফেব্রুয়ারির উপলক্ষ ছাড়া ড্রাগ ও মদ ইত্যাদি খাওয়া থেকে রাতের অন্ধকারে এটা-ওটা করা পর্যন্ত সারা বছর ধরে শহীদ মিনারে যা কিছু চলছে সে সবের কোনোটি আরেফিন ও বাচ্চু সাহেবদের কথিত ‘পবিত্রতা’ এবং ‘জাতীয় মূল্যবোধের’ সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এ ব্যাপারে সচিত্র বিভিন্ন তথ্য হাজির করা হলে কিন্তু তাদের লা-জবাব হতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওনারা কবির চৌধুরীর মতো ঘোষিত নাস্তিককে নিয়ে শহীদ মিনারে শুইয়ে রাখলে দোষ হবে না। কিন্তু অলি আহাদের মতো ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাজা পড়ানো হলে সেটাই ‘মহা অপরাধ’ হয়ে যাবে!
নিবন্ধের শুরুতেই কেন এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হচ্ছে তার কারণ জানতে হলে অন্যকিছু তথ্যও স্মরণ করতে হবে। এরকম প্রথম তথ্যটি হলো, জাতীয় নেতা অলি আহাদের ইন্তেকালের দু’দিন পর ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় মারা গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার ‘নামকরা’ সাহিত্যিক ছিলেন তিনি। সুতরাং তার মৃত্যু জানানোর মতো একটি খবর ছিল বটে। কিন্তু সে খবরটিকে নিয়েও সীমা ছাড়ানো বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ২৩ অক্টোবর সকাল থেকে সব টিভি চ্যানেলেই বারবার দেখানো হচ্ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর। দেশপ্রেমিকদের ধাক্কা খেতে হয়েছে বিশেষ কারণে। প্রায় সব চ্যানেলেই খবরটি দেখানো হচ্ছিল ‘জাতীয়’ খবর হিসেবে। অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশের লোক ছিলেন না। ছিলেন ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক। সে কারণে তার মৃত্যু অবশ্যই ‘জাতীয়’ খবর হিসেবে প্রচারিত হতে পারে না। সেটাই করে ছেড়েছে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো। এমনকি সরকার সমর্থক নয় এবং ইসলামী ধারার বলে নিজেদের যারা জাহির করে তারাও। সেটা তারা করতেই পারে, কিন্তু আপত্তির কারণ হলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে পবিত্র হজের খবরকেও কোনো কোনো টিভি চ্যানেল কম গুরুত্বপূর্ণ করে ছেড়েছে। ঘটনাক্রমে হজের দিনটিতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কলকাতার ক্যাওড়াতলা শ্মশানঘাটে। দু’একটি টিভি চ্যানেল আগুনে লাশ পোড়ানোর সে দৃশ্যকেও দেখিয়ে ছেড়েছে। একেই সম্ভবত ‘অতি ভক্তি’ বলা হয়!
শুধু এটুকু জানানোর জন্যই এত কথা বলা হচ্ছে না। আরও কিছু কারণও রয়েছে। পাঠকরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, এবার হিন্দুদের দুর্গাপূজাও পড়েছিল পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে। কয়েকদিন ধরে চলা এই পূজার নানা আনুষ্ঠানিকতা দেখানোর ব্যাপারেও আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো ‘অতি ভক্তি’ই দেখিয়েছে। বাড়াবাড়ি করেছে। ২৩ অক্টোবর হিন্দুদের উদযাপিত নবমীর কথাই বলা যাক। ওই রাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গেছেন রাজধানীর বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে। সঙ্গে গেছেন অন্য মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও। এদের মধ্যে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের কথা উল্লেখ করতে হবে এজন্য যে, তিনি যখন পূজা মণ্ডপগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখনও প্রতারিত শতাধিক হজযাত্রী সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে ফারুক খানের তখন প্রধান দায়িত্ব ছিল ওই হজযাত্রীদের পাঠানোর জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু মন্ত্রী গিয়েছিলেন হিন্দুদের মা দুর্গাকে দর্শন করতে। এতটাই ভক্তি ছিল তার!
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জবরই শুনিয়েছেন। ভক্তির আতিসহ্যে তিনি বলে বসেছেন, ‘দেবী দুর্গা’ এবার ফিরে যাবেন নৌকায় চড়ে। ফলে দেশ ফসলে ভরে যাবে—অর্থাত্ প্রচুর ফসল হবে এবার! খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ‘হিন্দুদের’ কিংবা হিন্দুদের উদ্দেশে বলার সময় ‘আপনাদের দেবী দুর্গা’ বলেননি। ‘দেবী দুর্গা’ কথাটা এমনভাবে বলেছেন যা শুনে মনে হবে যেন হিন্দুদের ‘দেবী দুর্গা’ শেখ হাসিনারও ‘দেবী’! কথা শুধু এটুকুই নয়। ‘দেবী দুর্গা’ নৌকায় চড়ে বিদায় নিলেই দেশ ফসলে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে এমন কথা প্রধানমন্ত্রীকে কে বলেছে? নৌকার সঙ্গে ফসলের সম্পর্কটাই বা কোথায়? আর ‘দেবী দুর্গা’র মূর্তিও তো দেশে একটি মাত্র বানানো হয়নি, হয়েছিল হাজার হাজার। এসব মূর্তির মধ্যকার কোনটি কোন নদী বা খাল দিয়ে কোন অচিন দেশে পাড়ি জমাবে তা-ই বা জানা রয়েছে কার? ‘দেবী দুর্গা’র ঠিকানাই বা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রশ্নের ধারেকাছে যাননি। তিনি সোজা বলে বসেছেন, ‘দেবী দুর্গা’ নৌকায় চড়ে যাবেন বলেই দেশ ফসলে ভরে যাবে। লক্ষণীয় যে, প্রধানমন্ত্রী শুধু নিজেদের দলীয় মার্কা নৌকার ব্যাপারেই জোর দিয়েছেন। ভেবে দেখেননি যে, দেশ সত্যিই যদি ফসলে ভরে ওঠে এবং সে ফসল যদি সত্যিই নৌকায় করে আনতে হয় তাহলে তো সব নৌকা বিএনপির ‘ধানের শীষে’ই ভরে যাবে! তখন আর নৌকার গুরুত্ব থাকে কোথায়? গুরুত্ব তো পাবে ‘ধানের শীষ’ই! শেখ হাসিনার ‘দেবী দুর্গা’ কি তাহলে বিএনপির বিজয় বার্তাই দিয়ে গেছে?
এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানির দিকটি লক্ষ্য করা দরকার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা অলি আহাদের জানাজাকে ঘিরে অসভ্য প্রতিক্রিয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকেও বিবেচনায় রাখা দরকার। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্য একটি ঘটনাও। পবিত্র ঈদুল আজহার ঠিক একদিন পর পালিত হয়েছে বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমা। এ উপলক্ষে একই শহীদ মিনারে জ্বালানো হয়েছে কয়েক হাজার মোমবাতি, সঙ্গে ছিল প্রদীপ। এগুলোকে হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। এবার কিন্তু কোনো ‘বাচ্চু’ বা আরেফিন সিদ্দিককে শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্টের বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার অভিযোগ করতে শোনা যায়নি। কথাগুলো বলার কারণ অবশ্যই কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলেই ৯০ ভাগের বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কেউ কখনও আপত্তি করেননি। করেনও না। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাজা নিয়ে আপত্তি জানানোর এবং শোরগোল তোলার পর পর একই শহীদ মিনারে রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমার উত্সব করা হবে, সেখানে মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালানো হবে—এ কেমন ন্যায়বিচার? একেই কি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা হিসেবে মাথায় তুলে নৃত্য করতে হবে? বলা দরকার, ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে স্বাধীনতার পর থেকেই কিন্তু এমন অনেক কর্ম-অপকর্ম করা হয়েছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে হলেও মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি হিসেবে কাজ করেছে। যেমন ঢাকা ভার্সিটির ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ ‘মুসলিম’ হলের নাম থেকে বেছে বেছে শুধু ‘মুসলিম’ শব্দটিকেই বাদ দিয়েছিল প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার। একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর ‘মুসলিম’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকেও বাদ দেয়া হয়েছিল ‘মুসলিম’ শব্দটিকেই। অথচ যে দেশটির সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এসব করা সে ভারতেই কিন্তু আলীগড় ‘মুসলিম’ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে যাদবপুর ‘হিন্দু’ বিশ্ববিদ্যালয়ও! আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ পণ্ডিত নেতারা এটুকুও জানতেন না!
এদিকে প্রমাণিত বিভিন্ন সত্যও কিন্তু আওয়ামী লীগকে অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা বা স্বীকৃতি দেয় না। কারণ, প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, কথিত ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর হামলা ও নির্যাতন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও পুরোদমেই চলছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি, ভাংচুর চালানো হচ্ছে তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে। বিগত মাত্র কিছুদিনের মধ্যে দিনাজপুরে ৩৫টি ‘সংখ্যালঘু’ পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জে চারটি মন্দিরে ভাংচুর চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। চট্টগ্রামে ১২টি মন্দির ভাংচুর করার পাশাপাশি বেশকিছু ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ আরও অনেক এলাকাতেই ‘সংখ্যালঘুরা’ হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অসহায় শিকার হচ্ছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বলেই জাতীয় হিন্দু মহাজোট গভীর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু মহাজোটের নেতারা অভিযোগ করেছেন, সরকারের ‘প্রত্যক্ষ মদতেই’ দেশব্যাপী ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এই অভিযোগ শুধু কঠিন সত্য ও গুরুতর নয়, যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণও। কথিত ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর আসলেও আওয়ামী লীগের লোকজন সর্বাত্মক নির্যাতন চালাচ্ছে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকাবাহী এ দলটি সব সময়ই সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছে, বিশেষ করে যখন ক্ষমতায় থেকেছে তখন তো বটেই। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, পাকিস্তান যুগে নয়, ‘সংখ্যালঘুদের’ বিপদ বেড়েছিল স্বাধীনতার পর। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারই সর্বতোভাবে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিয়েছিল। ওই সরকারের সময় রাতের অন্ধকারে রমনার কালী মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সে সময় শোনা গেছে, হুকুম নাকি এসেছিল ধানমন্ডির বিখ্যাত একটি সড়কে বসবাসকারী আরও বিখ্যাত কোনো একজনের কাছ থেকে! কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, তাদের এমনকি চিহ্নিত করার চেষ্টাও চালায়নি সরকার। এটা একটি ঘটনা মাত্র। ওদিকে দেশজুড়ে সে সময় অর্পিত সম্পত্তি দখলের মহাধুম পড়ে গিয়েছিল। এসব সম্পত্তি ছিল হিন্দুদের। পাকিস্তান আমলে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিতগুলো তো বটেই, যুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে আসা হিন্দুদের সম্পত্তিও দখল করেছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের সে কর্মকাণ্ড বর্তমান সরকারের আমলেও অপ্রতিহতভাবেই চলছে। কোনো ‘সংখ্যালঘু’ এমনকি প্রতিকার বা ন্যায়বিচার চাওয়ার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না। ফলে দুর্নাম বাড়ছে বাংলাদেশের।
ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, শুধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা জুড়ে দিলেই সাম্প্রদায়িক কোনো দল ও সে দলের সরকার রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায় না। ওদিকে যে দেশটিকে খুশি করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার ‘কার্ড’ ব্যবহার করা হচ্ছে সে ভারতেও মুসলমানসহ ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর চলছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। তাদের শরীরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারার রেকর্ডও ভারতেই তৈরি হয়েছে! অমন কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশীদের জীবন উল্টো বিপন্নই হয়ে পড়বে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই সারাদেশে ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর চলমান নির্যাতনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অনুধাবন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। হিন্দু মহাজোটের নেতারা বলেছেন বলে শুধু নয়, ঘটনাপ্রবাহেও বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার এবং দিল্লির আশীর্বাদ নিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার পুরনো ‘কার্ড’টিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীনদের ভয়ঙ্কর এ খেলাকে প্রতিহত না করা গেলে দেশের সর্বনাশ ঘটবে। এমনকি স্বাধীনতাও বিপন্ন হতে পারে। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, জনপ্রিয়তা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি এসে পড়ায় এবং আবারও ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন হোঁচট খাওয়ায় ক্ষমতাসীনরা দিশা তো হারিয়েছেনই, ক্ষিপ্তও হয়ে পড়েছেন। এজন্যই তারা সাম্প্রদায়িকতার ‘কার্ড’ খেলে একদিকে ভারতকে খুশি করতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের বোঝাতে চাচ্ছেন, আওয়ামী লীগই তাদের রক্ষা করতে পারে। অতি শঠতাপূর্ণ এই কৌশল অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা যে বুঝতে পেরেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে হিন্দু মহাজোটের বক্তব্যে। সে কারণে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ক্ষমতাসীনরাও বাংলাদেশের জন্য পূর্বদিকে অবস্থিত সব রাষ্ট্রের দরজা বন্ধ করার ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছেন, বাংলাদেশকে যাতে ভারতের অধীনস্থ অবস্থায় থাকতে হয়। আমরা অবশ্য মনে করি না যে, ক্ষমতাসীনদের চাওয়াটাই যথেষ্ট সব হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com
বলাবাহুল্য, সবকিছুর পেছনে একটি মাত্র কারণই ছিল—মরহুম অলি আহাদ আওয়ামী লীগ করতেন না। তার দেশপ্রেমিক ভূমিকা বরং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের অঘোষিত আইন হলো, কাউকে সম্মান পেতে হলে আওয়ামী লীগ তো করতেই হবে, ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতাকে’ নিয়েও মাতামাতি না করলে চলবে না। কথা শুধু এটুকু হলেও হয়তো আপত্তি উঠত না। অন্যদিকে সরকারের সেবাদাস ও আওয়ামী চাটুকাররা সৌজন্যের সীমা পর্যন্ত অতিক্রম করেছেন। যেমন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অলি আহাদের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেছেন, এর ফলে ‘অসাম্প্রদায়িক মিলনস্থল’ শহীদ মিনারের ‘পবিত্রতা’ নাকি নষ্ট হয়েছে এবং এভাবে জানাজা পড়ানো নাকি ‘জাতীয় মূল্যবোধ বিরোধী’! সরকারের আরেক সেবাদাস নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছেন, শহীদ মিনারে জানাজার আয়োজনের মধ্য দিয়ে নাকি ‘সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ’ ঘটেছে!
কথাগুলোকে অবশ্যই হাল্কাভাবে নেয়া যায় না। কারণ, একদিকে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আর অন্যদিকে বলেছেন এদেশের সাংস্কৃতিক জগতের আওয়ামী ‘দিকপাল’ (!)। তিনিও এসেছেন ‘জাতীয় মূল্যবোধ’ এবং ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ সম্পর্কে জনগণকে জ্ঞান দিতে! পাঠকরা বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে পারেন। কারণ, মহান যে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই শহীদ মিনার, মরহুম অলি আহাদ ছিলেন সে আন্দোলনের প্রধান নেতা। বাচ্চু এবং আরেফিন সিদ্দিকদের ‘পূজনীয়’ নেতার মতো ফরিদপুরের জেলখানায় বসে তিনি ‘চিরকুট’ পাঠিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অসত্য দাবি জানিয়ে বসেননি। সুতরাং শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাজা অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘দোষের’ কিছু থাকতে পারে না। তথাকথিত ‘পবিত্রতা’ এবং ‘জাতীয় মূল্যবোধের’ কথাও অচল হয়ে পড়ে। কারণ, একমাত্র শহীদ দিবস তথা একুশে ফেব্রুয়ারির উপলক্ষ ছাড়া ড্রাগ ও মদ ইত্যাদি খাওয়া থেকে রাতের অন্ধকারে এটা-ওটা করা পর্যন্ত সারা বছর ধরে শহীদ মিনারে যা কিছু চলছে সে সবের কোনোটি আরেফিন ও বাচ্চু সাহেবদের কথিত ‘পবিত্রতা’ এবং ‘জাতীয় মূল্যবোধের’ সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এ ব্যাপারে সচিত্র বিভিন্ন তথ্য হাজির করা হলে কিন্তু তাদের লা-জবাব হতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওনারা কবির চৌধুরীর মতো ঘোষিত নাস্তিককে নিয়ে শহীদ মিনারে শুইয়ে রাখলে দোষ হবে না। কিন্তু অলি আহাদের মতো ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাজা পড়ানো হলে সেটাই ‘মহা অপরাধ’ হয়ে যাবে!
নিবন্ধের শুরুতেই কেন এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হচ্ছে তার কারণ জানতে হলে অন্যকিছু তথ্যও স্মরণ করতে হবে। এরকম প্রথম তথ্যটি হলো, জাতীয় নেতা অলি আহাদের ইন্তেকালের দু’দিন পর ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় মারা গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার ‘নামকরা’ সাহিত্যিক ছিলেন তিনি। সুতরাং তার মৃত্যু জানানোর মতো একটি খবর ছিল বটে। কিন্তু সে খবরটিকে নিয়েও সীমা ছাড়ানো বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ২৩ অক্টোবর সকাল থেকে সব টিভি চ্যানেলেই বারবার দেখানো হচ্ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর। দেশপ্রেমিকদের ধাক্কা খেতে হয়েছে বিশেষ কারণে। প্রায় সব চ্যানেলেই খবরটি দেখানো হচ্ছিল ‘জাতীয়’ খবর হিসেবে। অথচ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশের লোক ছিলেন না। ছিলেন ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক। সে কারণে তার মৃত্যু অবশ্যই ‘জাতীয়’ খবর হিসেবে প্রচারিত হতে পারে না। সেটাই করে ছেড়েছে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো। এমনকি সরকার সমর্থক নয় এবং ইসলামী ধারার বলে নিজেদের যারা জাহির করে তারাও। সেটা তারা করতেই পারে, কিন্তু আপত্তির কারণ হলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে পবিত্র হজের খবরকেও কোনো কোনো টিভি চ্যানেল কম গুরুত্বপূর্ণ করে ছেড়েছে। ঘটনাক্রমে হজের দিনটিতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হয়েছে কলকাতার ক্যাওড়াতলা শ্মশানঘাটে। দু’একটি টিভি চ্যানেল আগুনে লাশ পোড়ানোর সে দৃশ্যকেও দেখিয়ে ছেড়েছে। একেই সম্ভবত ‘অতি ভক্তি’ বলা হয়!
শুধু এটুকু জানানোর জন্যই এত কথা বলা হচ্ছে না। আরও কিছু কারণও রয়েছে। পাঠকরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, এবার হিন্দুদের দুর্গাপূজাও পড়েছিল পবিত্র ঈদুল আজহার প্রাক্কালে। কয়েকদিন ধরে চলা এই পূজার নানা আনুষ্ঠানিকতা দেখানোর ব্যাপারেও আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো ‘অতি ভক্তি’ই দেখিয়েছে। বাড়াবাড়ি করেছে। ২৩ অক্টোবর হিন্দুদের উদযাপিত নবমীর কথাই বলা যাক। ওই রাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছুটে গেছেন রাজধানীর বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে। সঙ্গে গেছেন অন্য মন্ত্রী-উপদেষ্টারাও। এদের মধ্যে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানের কথা উল্লেখ করতে হবে এজন্য যে, তিনি যখন পূজা মণ্ডপগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখনও প্রতারিত শতাধিক হজযাত্রী সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে ফারুক খানের তখন প্রধান দায়িত্ব ছিল ওই হজযাত্রীদের পাঠানোর জন্য চেষ্টা করা। কিন্তু মন্ত্রী গিয়েছিলেন হিন্দুদের মা দুর্গাকে দর্শন করতে। এতটাই ভক্তি ছিল তার!
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জবরই শুনিয়েছেন। ভক্তির আতিসহ্যে তিনি বলে বসেছেন, ‘দেবী দুর্গা’ এবার ফিরে যাবেন নৌকায় চড়ে। ফলে দেশ ফসলে ভরে যাবে—অর্থাত্ প্রচুর ফসল হবে এবার! খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ‘হিন্দুদের’ কিংবা হিন্দুদের উদ্দেশে বলার সময় ‘আপনাদের দেবী দুর্গা’ বলেননি। ‘দেবী দুর্গা’ কথাটা এমনভাবে বলেছেন যা শুনে মনে হবে যেন হিন্দুদের ‘দেবী দুর্গা’ শেখ হাসিনারও ‘দেবী’! কথা শুধু এটুকুই নয়। ‘দেবী দুর্গা’ নৌকায় চড়ে বিদায় নিলেই দেশ ফসলে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে এমন কথা প্রধানমন্ত্রীকে কে বলেছে? নৌকার সঙ্গে ফসলের সম্পর্কটাই বা কোথায়? আর ‘দেবী দুর্গা’র মূর্তিও তো দেশে একটি মাত্র বানানো হয়নি, হয়েছিল হাজার হাজার। এসব মূর্তির মধ্যকার কোনটি কোন নদী বা খাল দিয়ে কোন অচিন দেশে পাড়ি জমাবে তা-ই বা জানা রয়েছে কার? ‘দেবী দুর্গা’র ঠিকানাই বা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রশ্নের ধারেকাছে যাননি। তিনি সোজা বলে বসেছেন, ‘দেবী দুর্গা’ নৌকায় চড়ে যাবেন বলেই দেশ ফসলে ভরে যাবে। লক্ষণীয় যে, প্রধানমন্ত্রী শুধু নিজেদের দলীয় মার্কা নৌকার ব্যাপারেই জোর দিয়েছেন। ভেবে দেখেননি যে, দেশ সত্যিই যদি ফসলে ভরে ওঠে এবং সে ফসল যদি সত্যিই নৌকায় করে আনতে হয় তাহলে তো সব নৌকা বিএনপির ‘ধানের শীষে’ই ভরে যাবে! তখন আর নৌকার গুরুত্ব থাকে কোথায়? গুরুত্ব তো পাবে ‘ধানের শীষ’ই! শেখ হাসিনার ‘দেবী দুর্গা’ কি তাহলে বিএনপির বিজয় বার্তাই দিয়ে গেছে?
এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে এখানে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানির দিকটি লক্ষ্য করা দরকার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতা অলি আহাদের জানাজাকে ঘিরে অসভ্য প্রতিক্রিয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকেও বিবেচনায় রাখা দরকার। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্য একটি ঘটনাও। পবিত্র ঈদুল আজহার ঠিক একদিন পর পালিত হয়েছে বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমা। এ উপলক্ষে একই শহীদ মিনারে জ্বালানো হয়েছে কয়েক হাজার মোমবাতি, সঙ্গে ছিল প্রদীপ। এগুলোকে হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। এবার কিন্তু কোনো ‘বাচ্চু’ বা আরেফিন সিদ্দিককে শহীদ মিনারের পবিত্রতা নষ্টের বা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার অভিযোগ করতে শোনা যায়নি। কথাগুলো বলার কারণ অবশ্যই কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলেই ৯০ ভাগের বেশি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কেউ কখনও আপত্তি করেননি। করেনও না। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রধান নেতার জানাজা নিয়ে আপত্তি জানানোর এবং শোরগোল তোলার পর পর একই শহীদ মিনারে রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমার উত্সব করা হবে, সেখানে মোমবাতি ও প্রদীপ জ্বালানো হবে—এ কেমন ন্যায়বিচার? একেই কি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা হিসেবে মাথায় তুলে নৃত্য করতে হবে? বলা দরকার, ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে স্বাধীনতার পর থেকেই কিন্তু এমন অনেক কর্ম-অপকর্ম করা হয়েছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে হলেও মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি হিসেবে কাজ করেছে। যেমন ঢাকা ভার্সিটির ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ ‘মুসলিম’ হলের নাম থেকে বেছে বেছে শুধু ‘মুসলিম’ শব্দটিকেই বাদ দিয়েছিল প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার। একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর ‘মুসলিম’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকেও বাদ দেয়া হয়েছিল ‘মুসলিম’ শব্দটিকেই। অথচ যে দেশটির সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এসব করা সে ভারতেই কিন্তু আলীগড় ‘মুসলিম’ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে যাদবপুর ‘হিন্দু’ বিশ্ববিদ্যালয়ও! আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ পণ্ডিত নেতারা এটুকুও জানতেন না!
এদিকে প্রমাণিত বিভিন্ন সত্যও কিন্তু আওয়ামী লীগকে অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা বা স্বীকৃতি দেয় না। কারণ, প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, কথিত ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর হামলা ও নির্যাতন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও পুরোদমেই চলছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি, ভাংচুর চালানো হচ্ছে তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে। বিগত মাত্র কিছুদিনের মধ্যে দিনাজপুরে ৩৫টি ‘সংখ্যালঘু’ পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর এলাকা গোপালগঞ্জে চারটি মন্দিরে ভাংচুর চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। চট্টগ্রামে ১২টি মন্দির ভাংচুর করার পাশাপাশি বেশকিছু ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করেছে তারা। বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ আরও অনেক এলাকাতেই ‘সংখ্যালঘুরা’ হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অসহায় শিকার হচ্ছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বলেই জাতীয় হিন্দু মহাজোট গভীর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু মহাজোটের নেতারা অভিযোগ করেছেন, সরকারের ‘প্রত্যক্ষ মদতেই’ দেশব্যাপী ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এই অভিযোগ শুধু কঠিন সত্য ও গুরুতর নয়, যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণও। কথিত ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর আসলেও আওয়ামী লীগের লোকজন সর্বাত্মক নির্যাতন চালাচ্ছে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকাবাহী এ দলটি সব সময়ই সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসেছে, বিশেষ করে যখন ক্ষমতায় থেকেছে তখন তো বটেই। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, পাকিস্তান যুগে নয়, ‘সংখ্যালঘুদের’ বিপদ বেড়েছিল স্বাধীনতার পর। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারই সর্বতোভাবে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিয়েছিল। ওই সরকারের সময় রাতের অন্ধকারে রমনার কালী মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সে সময় শোনা গেছে, হুকুম নাকি এসেছিল ধানমন্ডির বিখ্যাত একটি সড়কে বসবাসকারী আরও বিখ্যাত কোনো একজনের কাছ থেকে! কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, তাদের এমনকি চিহ্নিত করার চেষ্টাও চালায়নি সরকার। এটা একটি ঘটনা মাত্র। ওদিকে দেশজুড়ে সে সময় অর্পিত সম্পত্তি দখলের মহাধুম পড়ে গিয়েছিল। এসব সম্পত্তি ছিল হিন্দুদের। পাকিস্তান আমলে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিতগুলো তো বটেই, যুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে আসা হিন্দুদের সম্পত্তিও দখল করেছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের সে কর্মকাণ্ড বর্তমান সরকারের আমলেও অপ্রতিহতভাবেই চলছে। কোনো ‘সংখ্যালঘু’ এমনকি প্রতিকার বা ন্যায়বিচার চাওয়ার সাহস পর্যন্ত দেখাতে পারছেন না। ফলে দুর্নাম বাড়ছে বাংলাদেশের।
ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, শুধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা জুড়ে দিলেই সাম্প্রদায়িক কোনো দল ও সে দলের সরকার রাতারাতি ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায় না। ওদিকে যে দেশটিকে খুশি করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার ‘কার্ড’ ব্যবহার করা হচ্ছে সে ভারতেও মুসলমানসহ ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর চলছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। তাদের শরীরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারার রেকর্ডও ভারতেই তৈরি হয়েছে! অমন কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশীদের জীবন উল্টো বিপন্নই হয়ে পড়বে। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই সারাদেশে ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর চলমান নির্যাতনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অনুধাবন করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। হিন্দু মহাজোটের নেতারা বলেছেন বলে শুধু নয়, ঘটনাপ্রবাহেও বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার এবং দিল্লির আশীর্বাদ নিয়ে আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার পুরনো ‘কার্ড’টিকে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীনদের ভয়ঙ্কর এ খেলাকে প্রতিহত না করা গেলে দেশের সর্বনাশ ঘটবে। এমনকি স্বাধীনতাও বিপন্ন হতে পারে। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, জনপ্রিয়তা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি এসে পড়ায় এবং আবারও ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন হোঁচট খাওয়ায় ক্ষমতাসীনরা দিশা তো হারিয়েছেনই, ক্ষিপ্তও হয়ে পড়েছেন। এজন্যই তারা সাম্প্রদায়িকতার ‘কার্ড’ খেলে একদিকে ভারতকে খুশি করতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের বোঝাতে চাচ্ছেন, আওয়ামী লীগই তাদের রক্ষা করতে পারে। অতি শঠতাপূর্ণ এই কৌশল অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা যে বুঝতে পেরেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে হিন্দু মহাজোটের বক্তব্যে। সে কারণে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ক্ষমতাসীনরাও বাংলাদেশের জন্য পূর্বদিকে অবস্থিত সব রাষ্ট্রের দরজা বন্ধ করার ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছেন, বাংলাদেশকে যাতে ভারতের অধীনস্থ অবস্থায় থাকতে হয়। আমরা অবশ্য মনে করি না যে, ক্ষমতাসীনদের চাওয়াটাই যথেষ্ট সব হতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন