ক্ষমতার পালা বদলের আশঙ্কা স্কন্ধ ভূতের মতো প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে যত চেপে বসছে ততই আমরা লোক হাসানোর নানা ভাঁড়ামোপূর্ণ কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। আর কত তিনি লোক হাসাবেন। সাধারণ মানুষের হাসার ক্ষমতাও এখন আর নেই। দেশজুড়ে আজ লাশের মিছিল, চারদিকে লাশ আর লাশ। সরকারের হাতে গণতন্ত্রের লাশ। সরকারের হাতে মানবতার লাশ। আমরা সবাই পুড়ে অঙ্গার হতে চলেছি। তবে কি আমার মাতৃভূমি আবার পুড়ে ছারখার হতে চলেছে। জনগণের কাঁধে শত শত নিরীহ পোশাক শ্রমিকের লাশ। চট্টগ্রামবাসীর কাঁধে স্বপ্নের ফ্লাইওভারের লাশ। কয়েক হাজার টন ওজন সেই লাশের। মানুষ আর এই লাশের ওজন বইতে পারছে না। দেশজুড়ে কবর আর কবর। সোনার বাংলা কি তবে সোনার সরকারের জমানায় কবরস্থান হতে চলেছে। ছাত্রলীগের সোনার ক্যাডারদের হাতে সারাদেশের শিক্ষাঙ্গন এরই মধ্যে লাশের স্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে এখন তারা মরা লাশের ওপর নৃত্য করে উল্লাস করছে। আর এই শিক্ষাঙ্গনের লাশ-খাদকরা যখন চোরাগোপ্তা রহস্যময় হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে, তখন স্বয়ং সরকার ও সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাজশরমের মাথা খেয়ে সেই খুনেদের দেখতে গিয়ে প্রমাণ করছেন তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই সবকিছু হচ্ছে। একদিকে কবরস্থানে লাখো স্বজনের কান্না; অন্যদিকে দেশজুড়ে আগুন আর আগুন। আগুন নিভছেই না। দেশের ভবিষ্যত্ লেলীহান আগুনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্প এখন পুড়ে ছাই হওয়ার যোগাড় হয়েছে। কিন্তু তাতে কী! সরকারপ্রধানের রসময়তা তাতে দমবার নয়। তিনি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ গয়রহ সবকিছুতেই কেবল ষড়যন্ত্রের চালবাজি খুঁজছেন। তাদের ভাষায় নাশকতা। ভাবখানা এমন যে, নাশকতার বুলিবাজি করলেই জনগণের দরবারে সাতখুন মাফ। দেশবাসী যখন কাঁদছে, তখন সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়েই মত্ত উতোর চাপানের খেলাতে। সরকারি দল আর প্রধানমন্ত্রীর তো এক্ষেত্রে জবাব নেই। তিনি ক্ষমতায় আসতেই জাতি মর্মান্তিক উপহার হিসেবে পেয়েছিল পিলখানা ট্র্যাজেডি। প্রথম থেকেই তিনি, তার গুণধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আমলা, তার গুণধর সিপাহসালার সর্বকর্মবিশারদ নানক দিনভর মনিটর করলেন। আমরা তখন উপহার পেলাম বিদ্রোহ দমনের নামে নানা ছলছুতা, নানা নাটক প্রহসন, খুনে চক্রের প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সসম্মানে বিহার, সবকিছু সরকার ও তল্পিবাহকদের কন্ট্রোলে—এমন বাগাড়ম্বর-প্রতিশ্রুতি। আর তারপর লাশ আর লাশ। লাশের যেন শেষ নেই। জাতির সামনে তখন প্রশ্ন ছিল—কী তারা মনিটর করলেন? কী তারা শান্তি আলোচনা করলেন? প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কী সমঝোতা বৈঠক হলো? তাদের এমন মাহাত্ম্যপূর্ণ মনিটরিংয়ের পরও জাতি সেদিন সূর্যসৈনিকদের লাশ আর লাশ পেয়েছিল কেন? দেশের মানুষের সেই মুলতবি প্রশ্নের জবাব মেলেনি আজও। বরং তখনও উপহার পাওয়া গেছে ষড়যন্ত্র্ত্র তত্ত্ব। কে ষড়যন্ত্র করে? করে ওই বিরোধী দল। কে দায়ী? দায়ী ওই খালেদা জিয়া। এসব বলে বলে প্রধানমন্ত্রী দিব্যি তার এই সোনার জমানা পার করে দিলেন। তারপর আমরা বিডিআর বিদ্রোহ ও হত্যার বিচার হতে দেখছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বিচারে দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মোটেই হালে পানি পাচ্ছে না। হায় রে আমাদের দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রী!
এবার আসা যাক মহাজোট জমানার অন্তিম লাশ-মিছিল সাম্প্রতিক আশুলিয়া ট্র্যাজেডি নিয়ে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, এটাই যেন শেষ হয়। আর যেন তারা এমন শোকের মহা মিছিল উপহার না দেয়। আর লাশ বহনের ক্ষমতা নেই এই দুর্ভাগা জাতির। দেশ-জাতি এখন শোকে পাথর। আশুলিয়ার এই লাশ মিছিলের শোক ও কষ্ট দুর্বহ। এত কান্না, এত লাশ, এত মানুষের পুড়ে অঙ্গার দেহ দেশবাসী আর কখনও দেখেনি। আশুলিয়ার আকাশে-বাতাসে এখন কেবলই লাশের গন্ধ। কবরস্থানে লাখো মানুষের আহাজারি। মহাজোটের জমানায় এই কান্না আর থামবে বলে মনে হয় না। দেয়ালের ভাষা পড়ুন। মহাজোটের কপাল লিখন এর মধ্যেই জনগণ লাল অক্ষরে লিখে নিয়েছে রক্তাক্ত ক্ষুব্ধ হৃদয়ে। আগামী নির্বাচনে লোকজন কলাগাছে ভোট দিলেও আওয়ামী লীগকে আর নয়। একথা আমার নয়। একথা শুনেছি পোশাক শ্রমিকদের মুখে। প্রায় দেড়শ’ পুড়ে অঙ্গার লাশ। শনিবারের ঘটনা। সেদিনকার দৃশ্যপট দেখুন। আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেল। সারা ঢাকার ফায়ার সার্ভিস ছুটে গেল সেখানে। চলল উদ্ধার তত্পরতা। সবাই ছুটে গেলেন সেখানে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও অমাত্যবর্গ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীভুক্ত যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের নিয়ে গেছেন কিনা সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিত আসেনি। আমরা জানলাম প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই উদ্ধার অভিযান মনিটর করছেন। তিনি যখন অগ্নিদুর্গতদের পাশে, মানুষের তখন আশ্বস্ত না হয়ে উপায় কী! আমরা প্রধানমন্ত্রীর বরাতেও জানলাম তিনি নিজেই মনিটর করছেন। সে রাতে আগুন নেভানো হলো। আমরা জেনে আশ্বস্ত হলাম, তাহলে অল্পের ওপর দিয়েই এ যাত্রা রক্ষা। এক পর্যায়ে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি হলো। তারপরই ট্র্যাজেডির সূচনা। পরদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে খবর আসতে লাগল তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। প্রথমে কেউই তাদের চোখকে বিশ্বাস করেনি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ নিয়ে নানা রকম গল্প চালু বাজারে। সবাই ভেবেছে অমন কোনো বিভ্রাট হয়ে থাকবে। কিন্তু একযোগে সব টিভি মিডিয়া যখন একই তথ্য প্রচার শুরু করল তখন জাতির চোখে কান্না ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন—তারা কী মনিটরিং করলেন! যে মনিটরিংয়ের পর আমরা উপহার পাই লাশের মিছিল, জাতির কাঁধে তুলে দেয়া হয় দেড়শ’ পুড়ে প্রায় ছাই লাশের বেওয়ারিশ কফিন, এ কেমন দায়িত্ববোধ। প্রধানমন্ত্রী সপারিষদ কী মনিটরিং করলেন? পুরো ফায়ার সার্ভিস সেখানে পৌঁছে কী আগুন নেভাল? তারা কেউই কি টেরই পায়নি তাজরিন ফাশনের একটা ফ্লোরে লাশ আর লাশ। নাকি অত্যন্ত সুচতুর কৌশলে এই অগুনতি লাশ গোপন করার জন্য নিবিড় মনিটরিংয়ের নাটক করা হয়েছিল। যেমন নিষ্ঠুর নির্মম নাটক আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পিলখানা ট্র্যাজেডিতে। আশুলিয়ার হাজার হাজার শ্রমিক যদি কারখানা ঘেরাও করে না রাখত তবে জাতি হয়তো এই ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনার কথা জানতেই পারত না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট সদা জয়ন্ত বারাক ওবামার দায়িত্ববোধের ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। বিশ্ববাসী দেখেছে। তার নির্বাচনের ঠিক মাত্র কয়েকদিন আগে সেদেশে ঘটে যায় ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির নিষ্ঠুর তাণ্ডব। লণ্ডভণ্ড হয় নিউইয়র্ক। ওবামা কী করলেন! তিনি কি তার অপজিশন রমনিকে দায়ী করলেন? না, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানুষের সহায়তায়। দুগর্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। নির্বাচনী প্রচারের পালা মাথায় তুলে তিনি মানবতার ঝাণ্ডা তুলে ধরলেন। তার ফল পেয়েছেন হাতেনাতে। মার্কিনিরা তাকে বিজয় মুকুট পরিয়ে বরণ করে নিল। সারা দুনিয়া এই মানবতার বিজয়গাথা দেখল মুগ্ধ চোখে। বারাক ওবামার বিজয় নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যে মাতামাতি হয়েছে, বিজয়োল্লাস হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন।
আর আশুলিয়ায় মানবতার মৃত্যু নিয়ে নানা নাটকও দেখছে বিশ্ববাসী। আমেরিকায় বারাক ওবামার মনিটরিংয়ে লাখ লাখ মানুষ ফিরে পেয়েছিল জীবন, আর আমাদের দেশে নাটুকে নেতা-নেত্রী-মন্ত্রীদের মনিটরিংয়ে পাওয়া গেল লাশ আর লাশ। লাশের সঙ্গে আর কী উপহার পাচ্ছি আমরা ব্লেমগেম। পরস্পর দোষারোপ। সেই বস্তাপচা হুমকি। সেই বস্তাপচা অজুহাত। সেই নাশকতার গল্প। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী-অমাত্যরা এই ভয় দেখাতেও ছাড়ছে না—নাশকতার পেছনে যারা তাদের ছাড়া হবে না। এরকম হুমকি-ধমকি-বাগাড়ম্বর আমরা পিলখানা ট্র্যাজেডির সময় শুনেছি ও দেখেছি। মাথায় খালি একটাই চিন্তা—প্রতিপক্ষকে কেমনে ফাঁসানো যায়। কেমন করে জব্দ করা যায়। বিরোধী দল কী করছে! তারাও একই তালে আছে। তারাও আশুলিয়ার শোকক্ষুব্ধ মানুষের পাশে নেই। সরকার নেই, বিরোধী দল নেই—আশুলিয়ার এই অঙ্গার লাশের স্বজনরা কোন কবরস্থানে গিয়ে কাঁদবে।
ট্র্যাজেডির পর ২-৩ দিনও যায়নি। মানুষের পাশে না থাকলে কি হবে, প্রধানমন্ত্রী ঠিকই তার নির্বাচনী তালুকদারির রাজনীতির খেরোখাতা খুলে বসেছেন। ২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতবিনিময়ে বসলেন। কোথায় তিনি আশুলিয়ার দুর্গতদের পাশে থাকবেন তা নয়; তিনি আছেন ভোট নিয়ে। তিনি আছেন কীভাবে তার তথাকথিত বশংবদ সরকারের মাধ্যমে আবার মসনদে ফিরবেন তার ধান্দায়। ওইদিন তিনি বললেন—
পঁচাত্তরের পর একমাত্র ২০০১ সাল ছাড়া দেশে আর কখনও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। আওয়ামী লীগ থাকলেই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। মানুষ তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। কারণ, কারণ আওয়ামী লীগ জনগণের অধিকার ও ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। আগামীতেও জনগণের ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। জনগণ যাকে চাইবে তাকেই ভোট দেবে। আমরা সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। জনগণ যাকে খুশি ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে।
মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বললেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ছয় হাজারের অধিক বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। কোনো নির্বাচনেই কোনো সমস্যা হয়নি। এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণ হয়েছে। একই সঙ্গে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের আমলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। অথচ বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচন মানে ছিল হত্যা, মারামারি, ভোট চুরি ইত্যাদি। তিনি বলেন, টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) উপনির্বাচনে আমাদের প্রার্থী হেরেছেন। এর আগে হবিগঞ্জের উপনির্বাচনেও আমাদের প্রার্থী হেরেছেন। জনগণ ভোট দেয়নি, তাই তারা জিততে পারেননি।
এই হচ্ছে আমাদের রাজনীতি আর ওবামার রাজনীতির ফারাক। এখানে নিজের নাক কেটেও নেতারা ধান্দা খোঁজে—কীভাবে লুটপাটের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা যায়। তাই নির্বাচন বাদে তাদের মাথায় অন্য কোনো ইস্যুই নেই। মানুষের সেবার চিন্তা এখানে কোনো মূল্যই রাখে না। তারা কি আগডুম বাগডুম কেরদানি করছেন; কোথয় ভোটের নামে কোন ঘোড়ার ডিম দেখিয়েছেন—সেসবের জাবর ছাড়া আর কোনো খাবারও নেই তাদের জিহ্বায়। তাদের সে খবরও নেই মানুষ আর এখন তাদের থুথু দিয়েও বিশ্বাসও করে না। তারা যে গণতন্ত্র, নির্বাচনতন্ত্র, নিরপেক্ষতার কথা বলে—মানুষ তাতে ঘেন্নায় ধিক্কার জানানোও সময়ের অপচয় মনে করে। আর তারা আছে কিনা আত্মরতি ও অহমিকা নিয়ে। দেশ এখন এতবড় বাণিজ্যিক দুর্যোগের মুখে, তারা নির্বিকার।
মানুষ লাশ হচ্ছে—কী আসে যায় তাতে। পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে—কী আসে যায় তাতে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়-দায়িত্ব নেতাদের নয়। প্রধানমন্ত্রীর নয়। দেশের গার্মেন্ট শিল্প ধংস হচ্ছে। কী আসে যায় তাতে। কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আজ হুমকির মুখে। কী আসে যায় তাতে। বাংলাদেশ পোশাক পণ্যের বাজার হারাক, তাতে কুছ পরোয়া নেই এই বখরাজীবীদের। তাদের টার্গেট মসনদ। দেশ ধ্বংস হোক, মানুষ আবার শেখ মুজিব আমলের মতো দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, খাদ্যসঙ্কট, কর্মসঙ্কট ও ভয়ঙ্কর বেকারত্বের মুখে পড়ুক—তাতেও কিছুই তাদের যায় আসে না। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ, লাখো লাশ, কঙ্কালসার কোটি মানুষের মহাশ্মশানে ক্ষমতার দম্ভ আর লুটপাটের জয়োল্লাস করবেন—সে-ই তাদের শকুন-সুখ
।
এবার আসা যাক মহাজোট জমানার অন্তিম লাশ-মিছিল সাম্প্রতিক আশুলিয়া ট্র্যাজেডি নিয়ে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, এটাই যেন শেষ হয়। আর যেন তারা এমন শোকের মহা মিছিল উপহার না দেয়। আর লাশ বহনের ক্ষমতা নেই এই দুর্ভাগা জাতির। দেশ-জাতি এখন শোকে পাথর। আশুলিয়ার এই লাশ মিছিলের শোক ও কষ্ট দুর্বহ। এত কান্না, এত লাশ, এত মানুষের পুড়ে অঙ্গার দেহ দেশবাসী আর কখনও দেখেনি। আশুলিয়ার আকাশে-বাতাসে এখন কেবলই লাশের গন্ধ। কবরস্থানে লাখো মানুষের আহাজারি। মহাজোটের জমানায় এই কান্না আর থামবে বলে মনে হয় না। দেয়ালের ভাষা পড়ুন। মহাজোটের কপাল লিখন এর মধ্যেই জনগণ লাল অক্ষরে লিখে নিয়েছে রক্তাক্ত ক্ষুব্ধ হৃদয়ে। আগামী নির্বাচনে লোকজন কলাগাছে ভোট দিলেও আওয়ামী লীগকে আর নয়। একথা আমার নয়। একথা শুনেছি পোশাক শ্রমিকদের মুখে। প্রায় দেড়শ’ পুড়ে অঙ্গার লাশ। শনিবারের ঘটনা। সেদিনকার দৃশ্যপট দেখুন। আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেল। সারা ঢাকার ফায়ার সার্ভিস ছুটে গেল সেখানে। চলল উদ্ধার তত্পরতা। সবাই ছুটে গেলেন সেখানে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও অমাত্যবর্গ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীভুক্ত যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের নিয়ে গেছেন কিনা সংবাদ মাধ্যমে বিস্তারিত আসেনি। আমরা জানলাম প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই উদ্ধার অভিযান মনিটর করছেন। তিনি যখন অগ্নিদুর্গতদের পাশে, মানুষের তখন আশ্বস্ত না হয়ে উপায় কী! আমরা প্রধানমন্ত্রীর বরাতেও জানলাম তিনি নিজেই মনিটর করছেন। সে রাতে আগুন নেভানো হলো। আমরা জেনে আশ্বস্ত হলাম, তাহলে অল্পের ওপর দিয়েই এ যাত্রা রক্ষা। এক পর্যায়ে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি হলো। তারপরই ট্র্যাজেডির সূচনা। পরদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যে খবর আসতে লাগল তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। প্রথমে কেউই তাদের চোখকে বিশ্বাস করেনি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজ নিয়ে নানা রকম গল্প চালু বাজারে। সবাই ভেবেছে অমন কোনো বিভ্রাট হয়ে থাকবে। কিন্তু একযোগে সব টিভি মিডিয়া যখন একই তথ্য প্রচার শুরু করল তখন জাতির চোখে কান্না ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না।
তাহলে প্রশ্ন—তারা কী মনিটরিং করলেন! যে মনিটরিংয়ের পর আমরা উপহার পাই লাশের মিছিল, জাতির কাঁধে তুলে দেয়া হয় দেড়শ’ পুড়ে প্রায় ছাই লাশের বেওয়ারিশ কফিন, এ কেমন দায়িত্ববোধ। প্রধানমন্ত্রী সপারিষদ কী মনিটরিং করলেন? পুরো ফায়ার সার্ভিস সেখানে পৌঁছে কী আগুন নেভাল? তারা কেউই কি টেরই পায়নি তাজরিন ফাশনের একটা ফ্লোরে লাশ আর লাশ। নাকি অত্যন্ত সুচতুর কৌশলে এই অগুনতি লাশ গোপন করার জন্য নিবিড় মনিটরিংয়ের নাটক করা হয়েছিল। যেমন নিষ্ঠুর নির্মম নাটক আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পিলখানা ট্র্যাজেডিতে। আশুলিয়ার হাজার হাজার শ্রমিক যদি কারখানা ঘেরাও করে না রাখত তবে জাতি হয়তো এই ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ ঘটনার কথা জানতেই পারত না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট সদা জয়ন্ত বারাক ওবামার দায়িত্ববোধের ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। বিশ্ববাসী দেখেছে। তার নির্বাচনের ঠিক মাত্র কয়েকদিন আগে সেদেশে ঘটে যায় ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির নিষ্ঠুর তাণ্ডব। লণ্ডভণ্ড হয় নিউইয়র্ক। ওবামা কী করলেন! তিনি কি তার অপজিশন রমনিকে দায়ী করলেন? না, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন মানুষের সহায়তায়। দুগর্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। নির্বাচনী প্রচারের পালা মাথায় তুলে তিনি মানবতার ঝাণ্ডা তুলে ধরলেন। তার ফল পেয়েছেন হাতেনাতে। মার্কিনিরা তাকে বিজয় মুকুট পরিয়ে বরণ করে নিল। সারা দুনিয়া এই মানবতার বিজয়গাথা দেখল মুগ্ধ চোখে। বারাক ওবামার বিজয় নিয়ে দুনিয়াজুড়ে যে মাতামাতি হয়েছে, বিজয়োল্লাস হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন।
আর আশুলিয়ায় মানবতার মৃত্যু নিয়ে নানা নাটকও দেখছে বিশ্ববাসী। আমেরিকায় বারাক ওবামার মনিটরিংয়ে লাখ লাখ মানুষ ফিরে পেয়েছিল জীবন, আর আমাদের দেশে নাটুকে নেতা-নেত্রী-মন্ত্রীদের মনিটরিংয়ে পাওয়া গেল লাশ আর লাশ। লাশের সঙ্গে আর কী উপহার পাচ্ছি আমরা ব্লেমগেম। পরস্পর দোষারোপ। সেই বস্তাপচা হুমকি। সেই বস্তাপচা অজুহাত। সেই নাশকতার গল্প। প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী-অমাত্যরা এই ভয় দেখাতেও ছাড়ছে না—নাশকতার পেছনে যারা তাদের ছাড়া হবে না। এরকম হুমকি-ধমকি-বাগাড়ম্বর আমরা পিলখানা ট্র্যাজেডির সময় শুনেছি ও দেখেছি। মাথায় খালি একটাই চিন্তা—প্রতিপক্ষকে কেমনে ফাঁসানো যায়। কেমন করে জব্দ করা যায়। বিরোধী দল কী করছে! তারাও একই তালে আছে। তারাও আশুলিয়ার শোকক্ষুব্ধ মানুষের পাশে নেই। সরকার নেই, বিরোধী দল নেই—আশুলিয়ার এই অঙ্গার লাশের স্বজনরা কোন কবরস্থানে গিয়ে কাঁদবে।
ট্র্যাজেডির পর ২-৩ দিনও যায়নি। মানুষের পাশে না থাকলে কি হবে, প্রধানমন্ত্রী ঠিকই তার নির্বাচনী তালুকদারির রাজনীতির খেরোখাতা খুলে বসেছেন। ২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতবিনিময়ে বসলেন। কোথায় তিনি আশুলিয়ার দুর্গতদের পাশে থাকবেন তা নয়; তিনি আছেন ভোট নিয়ে। তিনি আছেন কীভাবে তার তথাকথিত বশংবদ সরকারের মাধ্যমে আবার মসনদে ফিরবেন তার ধান্দায়। ওইদিন তিনি বললেন—
পঁচাত্তরের পর একমাত্র ২০০১ সাল ছাড়া দেশে আর কখনও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। আওয়ামী লীগ থাকলেই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। মানুষ তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। কারণ, কারণ আওয়ামী লীগ জনগণের অধিকার ও ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে। আগামীতেও জনগণের ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতার পরিবর্তন হবে। জনগণ যাকে চাইবে তাকেই ভোট দেবে। আমরা সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। জনগণ যাকে খুশি ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে।
মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও বললেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ছয় হাজারের অধিক বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। কোনো নির্বাচনেই কোনো সমস্যা হয়নি। এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণ হয়েছে। একই সঙ্গে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের আমলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। অথচ বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচন মানে ছিল হত্যা, মারামারি, ভোট চুরি ইত্যাদি। তিনি বলেন, টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) উপনির্বাচনে আমাদের প্রার্থী হেরেছেন। এর আগে হবিগঞ্জের উপনির্বাচনেও আমাদের প্রার্থী হেরেছেন। জনগণ ভোট দেয়নি, তাই তারা জিততে পারেননি।
এই হচ্ছে আমাদের রাজনীতি আর ওবামার রাজনীতির ফারাক। এখানে নিজের নাক কেটেও নেতারা ধান্দা খোঁজে—কীভাবে লুটপাটের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা যায়। তাই নির্বাচন বাদে তাদের মাথায় অন্য কোনো ইস্যুই নেই। মানুষের সেবার চিন্তা এখানে কোনো মূল্যই রাখে না। তারা কি আগডুম বাগডুম কেরদানি করছেন; কোথয় ভোটের নামে কোন ঘোড়ার ডিম দেখিয়েছেন—সেসবের জাবর ছাড়া আর কোনো খাবারও নেই তাদের জিহ্বায়। তাদের সে খবরও নেই মানুষ আর এখন তাদের থুথু দিয়েও বিশ্বাসও করে না। তারা যে গণতন্ত্র, নির্বাচনতন্ত্র, নিরপেক্ষতার কথা বলে—মানুষ তাতে ঘেন্নায় ধিক্কার জানানোও সময়ের অপচয় মনে করে। আর তারা আছে কিনা আত্মরতি ও অহমিকা নিয়ে। দেশ এখন এতবড় বাণিজ্যিক দুর্যোগের মুখে, তারা নির্বিকার।
মানুষ লাশ হচ্ছে—কী আসে যায় তাতে। পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে—কী আসে যায় তাতে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়-দায়িত্ব নেতাদের নয়। প্রধানমন্ত্রীর নয়। দেশের গার্মেন্ট শিল্প ধংস হচ্ছে। কী আসে যায় তাতে। কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আজ হুমকির মুখে। কী আসে যায় তাতে। বাংলাদেশ পোশাক পণ্যের বাজার হারাক, তাতে কুছ পরোয়া নেই এই বখরাজীবীদের। তাদের টার্গেট মসনদ। দেশ ধ্বংস হোক, মানুষ আবার শেখ মুজিব আমলের মতো দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, খাদ্যসঙ্কট, কর্মসঙ্কট ও ভয়ঙ্কর বেকারত্বের মুখে পড়ুক—তাতেও কিছুই তাদের যায় আসে না। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ, লাখো লাশ, কঙ্কালসার কোটি মানুষের মহাশ্মশানে ক্ষমতার দম্ভ আর লুটপাটের জয়োল্লাস করবেন—সে-ই তাদের শকুন-সুখ
।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন