ভাসানী আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ৩৬ বছর হোল। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে, চিন পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ ধরেছে এবং পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে সকল দোষ আছে সেই সব বহন করবার পরেও অর্থনৈতিক সাফল্য বা বিপুল হারে ‘প্রবৃদ্ধি’ দেখিয়ে দুনিয়ায় তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এই সাফল্য রাজনৈতিকও বটে। এই অর্থে যে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে উৎখাত করে চিনের পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটে নি। কমিউনিস্ট পার্টি মতায় বহাল তবিয়তেই আছে। শুনতে স্ববিরোধী হলেও কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর বা লেনিনের ভাষায় বলা যায় শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের ‘দ্রুত ও ত্বরান্বিত’ বিকাশ ঘটেছে। যারা সরাসরি মার্কস বা লেনিন পড়েন নি, পুঁজিবাদকে যারা নৈতিক ভাবে সমালোচনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন, সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম কায়েম যাদের কাছে বিমূর্ত আদর্শ মাত্র ছিল, তাদের কাছে চিনের উদাহরণ বরাবরই কমিউনিস্টদের নীতিগত বিচ্যুতি বলে মনে হয়েছে। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় চিন যেভাবে নিজের জায়গা পোক্ত করে নিয়েছে সেই দিক থেকে বিচার করলে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাফল্য কিম্বা ব্যর্থতাকে নীতিবাদী সমালোচনা ছাড়াও আরও নানান দিক থেকে অনেক সতর্কতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। এ ধরণের ঘটনা যখন ঘটছে, তখন নানান দিক থেকে দাবি করা হয়েছিল সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম ইত্যাদির দিন শেষ। এই সব নিয়ে যেসব রক্তাক্ত পরীা-নিরীা হয়েছে সেসব ছিল নেহায়েতই দুঃস্বপ্ন। অনেকে কণ্ঠ চড়িয়ে বললেন, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এরপর মানুষের আর নতুন কোন ইতিহাস নাই। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাই মনুষ্য জাতির অন্তিম নিয়তি।
এই ধরণের ঘোষণার আওয়াজ শেষ হতে-না-হতেই দেখা গেল মানুষের ইতিহাসের ইতি যেখানে টানা হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করে হয়েছিল, তার দাগ অতিক্রম করে ‘ইসলাম’ নামক নতুন একটা ব্যাপারের আবির্ভাব ঘটছে। এই বিশ্বব্যবস্থা তার পছন্দ না, সে নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়তে চায়। তার ভাষায় সেটা হবে ইসলামি বিশ্বব্যবস্থা। এই ইসলাম মার্কস বা লেনিন বা মাও জে দং যেভাবে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ বুঝিয়েছেন আমাদের, তেমন করে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ বুঝলো না ঠিক, কিন্তু তার নিজের জায়গা থেকে দাবি করতে শুরু করলো তার লড়াইও সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। কমিউনিস্টরা যেখানে ‘সমাজতন্ত্র’ বা কমিউনিজম’ কায়েমের কথা বলতো, সেখানে তারা বলল ‘ইসলাম’ কায়েমের কথা। যারা এই কথা বলছিল তারা শুধু কথা বলে বা তাদের আদর্শের দাওয়াত দিয়ে ান্ত হয় নি, তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের সংগঠন গড়তে শুরু করল। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সামরিক নীতি ও কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও চ্যালেঞ্জ করবার জন্য নিজেদের সামরিক নীতি ও তৎপরতা চালাতে শুরু করল। অচিরেই তারা সন্ত্রাসবাদী হিশাবে চিহ্নিত হোল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তাদের সমূলে ধ্বংস করবার জন্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্তযুদ্ধের নীতি গৃহীত হোল। তার বাস্তবায়ন আমরা আফগানিস্তান, ইরাক, পাকিস্তানসহ দেশে দেশে দেখছি।
এতে অনেকে নড়েচড়ে বসলেন। ইতিহাস তাহলে শেষ গন্তব্যে পৌঁছায় নি, মানুষের জন্য আরও পরিণতি অপো করছে। কমিউনিজমের পতনের পর ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এই ধরণের ঝামেলা আর হবে না, কিন্তু নতুন ধরণের শত্রু মোকাবিলা করতে হবে পাশ্চাত্যে ডান বা বাম কোন পই তা চিন্তা করে নি, কল্পনাও করে নি। তারা এই ইসলামের নাম দিল ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, জাকাত দেন, হজে যান, তবলিগ করেন তারা সাম্রাজ্যবাদীদের চোখে ভাল মুসলমান। এদের ইমামদের প্রশিণের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা প্রচুর অর্থ খরচ করে, মসজিদ স্থাপনেও অর্থকড়ি দেয়। যে ইসলাম ছোবল মারে না, ফোঁসফাঁস করে না, দুধভাত খায়, জিকির-আজকার নিয়ে ব্যস্ত থাকে সাম্রাজ্যবাদীদের সেই ইসলাম খুবই পছন্দ।
অন্য দিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিশাবে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি ছিল, এটা স্থিতিশীল একটি ব্যবস্থা। কিন্তু কয়েক দশকের অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, কিছু কিছু দেশের অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ায় এটা পরিষ্কার হয়ে গেল সেটা সত্য নয়। আরব দেশগুলোতে তথাকথিত আরব বসন্তের তোড়ে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতন ঘটল। সেই সব দেশের গণ-আন্দোলনের ধরণ অনুকরণ করে ধনি দেশগুলোতে অকিউপাই ওয়াল স্ট্রিট জাতীয় আন্দোলন ও বিােভ শুরু হোল। বোঝা গেল পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা মানুষের ইতিহাসের শেষ গন্তব্যস্থল নয়। মার্কস, লেনিন ও মাও জে দংয়ের অনুসারীরা ইতিহাস থেকে শিা নিয়ে তাদের ভুল কাটিয়ে উঠবার চেষ্টা শুরু করলেন। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারাই লড়ছেন তাদের মাথার বদ্ধমূল হয়ে বাসা বেঁধে থাকা ছক দিয়ে নাকচ না করে সেই সব আন্দোলন বোঝার চেষ্টা জোরদার হতে শুরু করল।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে আমরা যদি বুঝতে চাই তাহলে নতুন বিশ্ববাস্তবতার পরিপ্রেেিতই বুঝতে হবে। তাঁর চলে যাবার ছত্রিশ বছর পরে তাকে নিছকই একজন বাংলাদেশের মজলুম কৃষক নেতা হিশাবে ভাবলে চলবে না। ইতিহাস আরও বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে। তাঁকে বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেেিত বুঝতে হবে। তাঁর মধ্যে দুটো অসাধারণ বিষয়ের সন্ধি ঘটেছিল, যার মর্মোদ্ধার বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠনের জন্য জরুরি। তিনি একই সঙ্গে ইসলামের কথা বলেছেন এবং একই ভাবে কমিউনিজমের কথা বলেছেন। তার ইসলামকে কমিউনিজম ছাড়া বোঝা অসম্ভব, ঠিক তেমনি তার কমিউনিজমকেও ইসলাম ছাড়া বোঝা অর্থহীন। অথচ মওলানা সারা জীবন এই দুইয়ের সন্ধিস্থলে নিজের স্থান শনাক্ত করবার চেষ্টা করে গিয়েছেন বলে তাঁকে স্ববিরোধী বিলে নিন্দিত হতে হয়েছে।
যারা নিজেদের বামপন্থী বা প্রগতিশীল ভাবেন তারা মওলানা ভাসানীর ‘ইসলাম’ পছন্দ করেন না, তাদের গা জ্বালা করে, অস্বস্তি বোধ করেন তারা। তারা ‘সবুজ’ মওলানা চান না, তাদের পছন্দ ‘লাল’ মওলানা। আর যারা ইসলামপন্থীÑ তাদের কাছে ‘লাল’ মওলানা দুশমন, কারণ মওলানা কমিউনিস্ট! নাউজুবিল্লাহ। এদের মধ্যে যারা তাঁর আশেকান তারাও মওলানার সারা জীবনের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস আড়াল করতে চান, যে লড়াইয়ের মৌলিক নীতি বা ধর্ম হচ্ছে জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বলপ্রয়োগ ন্যায়সঙ্গত। তাদের কাছে মওলানা ‘পীর’ আর তারা ‘মুরিদ’।
অথচ মওলানার মৌলিক শিা সারবস্তু কী? গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জালিম শাসক বা সরকার উৎখাত করার মাধ্যমে গণশক্তির উদ্বোধন ঘটানো এবং সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলয় ঘটিয়ে পুঁজির ইতিহাসকে মানুষের ইতিহাসে পরিণত করা। আর সেটাই দিব্যশক্তিসম্পন্ন মানুষের মুক্তির পথ। এই সেই ‘মানুষ’ যাকে সেজদা করতে আল্লাহ ফেরেশতাদের বাধ্য করেছেন, কারণ মানুষ জীবমাত্র নয়, সে আল্লার ‘খলিফা’। মানুষের জন্য জীবের জীবন অকাতরে ত্যাগ করে পরমার্থিক জীবন-আকাক্সা একমাত্র মানুষের পইে সম্ভব। জীব নিজের সংকল্পে মরতে জানে না, কিন্তু মানুষ তার সংকল্পের জন্য ‘শহীদ’ হতে জানে।
মওলানা ‘লাল’ও নয় কিম্বা ‘সবুজ’ও নয়। মওলানাকে নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন তারা সেই মওলানার লড়াকু রূপ আমাদের কাছ থেকে সবসময়ই আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করেন। মওলানার লড়াকু রূপ তাদের ভীত করে তোলে। মওলানা ভাসানীর তুলনা মওলানা ভাসানী নিজে। অন্য দিকে ভীতি ও সুবিধাবাদের কারণে তাকে মসৃণ ও মোলায়েম করবার জন্য ‘পীর’ বানিয়ে পূজা করবার ব্যবস্থা সহজে চালু করা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে চলেছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মওলানার নাম মুছে ফেলার কাজ। ইসলামকে ভাসানীর হাত থেকে রা করবার জন্য একই ভাবে ইসলামি রাজনীতির ধারা থেকেও তাঁকে খারিজ করে রাখার ভুয়া চেষ্টা চলে। আর কমিউনিস্টদের ধারণা বুড়া বয়সে মওলানার ভীমরতি ধরেছিল বলেই তিনি কমিউনিজম থুয়ে ইসলামের কথা বলতেন। তারা তাঁর ইসলামি সমাজতন্ত্রের ধারণাকেও বাঁকা চোখে দেখত।
মওলানার চিন্তা ঠিক নাকি বেঠিক সেটা বিচার করবার জন্য এই নিবন্ধটি নয়। ‘পথ প্রদর্শক’ বলে একটা কথা চালু আছে। মওলানা বিপ্লবী চিন্তার একটি গিঁটের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মতো করে তা সমাধানের একটা পদ্ধতি তিনি প্রদর্শন করেছেন। সেই গিঁটটি কোথায় আটকে আছে সেই দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করবার চেষ্টা করেছেন। শুধু পাশ্চাত্যচিন্তা থেকে বুদ্ধি হাওলাত নিয়ে বুঝলে আমরা মওলানা ভাসানীর শ্রেণিসংগ্রাম আর কমিউনিজম বুঝব না। ইসলাম তিনি আল্লাহর খলিফার মতোই পাঠ করেছেন, আল্লাহর খলিফার মতোই ব্যাখ্যা করেছেন। ধর্ম ও নীতিচ্যুত মোল্লা বা কমিউনিস্ট তাঁকে যেভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় তাদের মতো নয়। রাজতন্ত্র রার জন্য, কিম্বা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল হয়ে তিনি ইসলাম বা কমিউনিজম কোনটাই ব্যাখ্যা করেন নি। কিম্বা প্রগতিশীলতার নামে এটাও মানেন নি যে পাশ্চাত্য সভ্যতাই দিব্যশক্তিসম্পন্ন মানুষের একমাত্র নিয়তি। মানুষ সবসময়ই নতুনের সম্ভাবনায় ভরপুর। পাশ্চাত্যসভ্যতার শেষ পরিণতি নয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রচারণার অংশ হিশাবে স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে ইসলাম ও কমিউনিজমের মধ্যে অনতিক্রম্য ও অনিবার্য সংঘর্ষের যেসব কেচ্ছা রটনা করা হয়েছে, আজ সময় হয়েছে সেই সব বাজে প্রপাগান্ডা বা ওয়াজগুলো ছুড়ে ফেলার। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে জালিম শাসক বা সরকারকে উৎখাত করবার কাজ ফেলে যারা জনগণকে ক্রমাগত বিভক্ত করবার ও বিভক্ত রাখবার কুকাণ্ডগুলো চালু রেখেছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে ফেলার সময় এখন।
শুধু তা-ই নয়, এই পরিপ্রেেিত তাঁর ‘রবুবিয়াত’-সংক্রান্ত ধারণাও আমার কাছে অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। ‘জলের জল্লাদদের বিরুদ্ধে জলদেবতার যুদ্ধের ডাক’ শিরোনামের একটি লেখায় আমি এ সম্পর্কে এর আগে লিখেছি। জনগণকে নতুন ভাবে সমাজ ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও সংগঠিত হবার প্রেরণা হিশাবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রবুবিয়াতের রাজনীতির মর্ম উপলব্ধি করবার প্রয়োজনীয়তা আমি বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করি। সেই কথাগুলো আবার উল্লেখ করলে অন্যায় হবে না আশা করি।
পরিবেশ রা, প্রাণের হেফাজত ও প্রাণের প্রতিপালন রবুবিয়াতের মূল কথা। ভাসানী এর অনুবাদ করেছিলেন ‘পালনবাদ’। শব্দটি আরবি হবার কারণে একে মুসলমানি ধারণা গণ্য করবার কারণ নাই, তবে ইসলামের ভাবগত দিকের সঙ্গে এই পরিবেশবাদী চিন্তার মিল আছে অবশ্যই। ধরা যাক যদি আমরা নিজেদের নাস্তিক বলে দাবি করি, মাইকে সারা শহরে চিৎকার করে বলি, ‘আল্লাহ বলে কিছু নাই’ বা ‘সব নবী-রসূল, অলি-আউলিয়া সবাই ভুয়া’Ñ তাহলে সূর্যের আলো কি আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে? নদীর প্রবাহ মেঘের বৃষ্টি, কিংবা বাতাস কি আমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে? আমাদের রিজিক কি পরম শক্তিধর আল্লাহ ধ্বংস করে দেবেন? যিনি নাস্তিক তাঁর কাছে অবশ্য এই সব আদৌ কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। এতে তার কিছুই আসে-যায় না, কিন্তু যিনি সত্যি সত্যিই মোমিন তিনি তখন আল্লাহর এই ‘রব’ বা প্রতিপালক রূপে মুগ্ধ হন। তাঁর আশেকি বাড়ে এবং সৃষ্টির প্রতি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি আরো যতœবান হয়ে ওঠেন। আল্লাহকে মানা-না-মানা বা ইসলামপন্থী হওয়া-না-হওয়া এখানে মূল প্রশ্ন নয়। যে ভাবগত চর্চা আমাদের প্রাণ ও পরিবেশ রায় আগ্রহী করে তোলে, প্রাণের প্রতিরা ও হেফাজত করবার জন্য যে নীতি আমাদের ইহলৌকিক দুনিয়ায় কার্যতই আল্লাহর খলিফা হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী মানুষের মধ্যে সেই রূপচর্চার বা আল্লাহর এই বিশেষ গুণচর্চার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তার তুলনা মেলা ভার। এর জন্য তাঁকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে। নাস্তিকদের কাছে তিনি ছিলেন যেকোন মওলানা-মাশায়াখের মতোই পারলৌকিক অর্থে নিছকই একজন ইসলামপন্থী। তিনি ইসলামই কায়েম করতে চেয়েছিলেন। অন্য দিকে ইসলামপন্থীদের কাছে তিনি ছিলেন ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট। নাস্তিক। অতএব কাফের। অথচ যে দিব্য অনুভূতি, অভিজ্ঞতা এবং মানুষসহ সকল প্রাণের প্রতি প্রতিপালকের স্নেহ ও প্রেম ছাড়া কোন ধর্মই নিজেকে ধর্ম বলে দাবি করতে পারে না, মওলানা তারই দিকে আমাদের নজর ফেরাতে চেষ্টা করেছেন। অন্য দিকে কমিউনিজম তো দূরের কথা, কোন রাজনীতিই সেই দিব্য অনুভূতি ছাড়া নিজেকে মানুষের ইহলৌকিক স্বার্থ রা করছে বলে দাবি করতে পারে না। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তো সেই ধর্ম আর সেই কমিউনিজমই আমাদের শিখিয়েছেন। এই বিচারে উভয়ের মধ্যে যে আদতে কোন বিরোধ নাই এই শিা দিয়ে তিনি ধর্মের সম্ভাব্য বিপ্লবী চরিত্রকে যেমন খোলাসা করে দিয়েছেন, ঠিক তেমনি বিপ্লবী রাজনীতির দিব্যস্বভাব বা তার পেছনে জীবন্ত মানুষের শিরা-উপশিরার মতো লুকিয়ে থাকা রবুবিয়াতের স্পন্দনকেই শনাক্ত করে দিয়ে গেছেন। এখানে তিনি সম্পূর্ণ নতুন জিনিস দিয়ে গেছেন আগামী দিনের বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের জন্য যা দরকারি। যে ধর্ম বা কমিউনিজম বা প্রাণ ও পরিবেশ রার প্রাথমিক কর্তব্যকে এক নম্বর নীতি হিশাবে গ্রহণ করে না, তাকে যেমন কমিউনিজম বলা ভুল, ঠিক তেমনি যে ইসলাম কমিউনিজমকে শত্রু জ্ঞান করে এবং ইহলৌকিক জীবনে মানুষের জীবন, জীবিকা, প্রাণ ও পরিবেশের শর্ত রাকে তার ফরজ কাজ গণ্য করে না, তাকে আর যা-ই হোক ‘ইসলাম’ বলা যায় না।
অথচ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে তরুণ প্রজন্মের কয়জন জানে? বাংলাদেশের জনগণের শুধু নয়, সারা দুনিয়ার তিনি একজন অসামান্য নেতা। যার আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীনতা অর্জন করতে সম হোত না, সেই মানুষটি জাতির জনক হতে চান নি, সারা দুনিয়ার মানুষের পথপ্রদর্শক হতে চেয়েছেন।
ছত্রিশ বছর হোল তিনি নাইÑ কিন্তু ইসলামি কি কমিউনিস্ট-জালিমের বিরুদ্ধে ইনসাফ কায়েমের জন্য বা মওলানার ভাষায় ‘হক’ আদায়ের জন্য দেশে দেশে যারা লড়ছেন তারা জানেনÑ তিনি আছেন, থাকবেন এবং ‘খামোশ’ বলে তাদের কণ্ঠ ধারণ করেই জালিমের বিরুদ্ধে তিনি বারংবার হুঙ্কার দিয়ে উঠছেন।
তাঁর জয় হোক।
farhadmazhar@hotmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন