এদেশের বিবেকবান সচেতন মানুষ এটি ভেবে উদ্বিগ্ন যে, আওয়ামী লীগ দেশটিকে ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে চায়। আওয়ামী লীগ অতীতে গণতন্ত্রের কথা বলেছে, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনও করেছে। কিন্তু বিগত ৪ বছর ধরে, বিশেষ করে বিগত এক বছরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে তারা শাসনের নামে যে প্রচন্ড চন্ডনীতি গ্রহণ করেছে সেটি দেখে মানুষ ভয়ঙ্কর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান অপশাসনকে শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী বললে ভুল বলা হবে, তারা বরং তাদের শাসনকে কুখ্যাত হিটলারের একনায়কত্ববাদী দুঃশাসনকেও হার মানিয়ে চলেছে। সে জন্যই মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, আওয়ামী লীগ আসলে কি চায়? দেশটিকে তারা কোথায় নিয়ে যেতে চায়? এখন অনেক মানুষ মনে করছেন যে, সব কিছুর ঊর্ধ্বে সর্বাগ্রে এই বিষয়টির চূড়ান্ত নিত্তি হওয়া দরকার যে দেশটি কি গণতন্ত্রের পথে চলবে? নাকি কুখ্যাত একনায়ক স্পেনের ফ্রাঙ্কো, পর্তুগালের সালাজার, ইটালির মুসোলিনী, জার্মানির হিটলার অথবা সেই আগের যুগের মধ্য এশিয়ার চেঙ্গিস খান বা হালাকু খানের শাসনের মতো চলবে। কারণ এই বিষয়টির ফয়সালা না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি শুধু সাংঘর্ষিক নয়, এক রক্তক্ষয়ী পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে। গত বৃহস্পতিবার এক আলোচনা সভায় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা এমকে আনোয়ার কোনরূপ রাখঢাক না করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ যদি তার ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে, যদি তারা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতাকে রুদ্ধ করার প্রবণতা পরিহার না করে তাহলে দেশ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবে। কোনো দেশপ্রেমিক এমন একটি ভয়াবহ পরিণতি চান না। কিন্তু আওয়ামী সরকারকে মনে হচ্ছে যে, তারা যেন জোর করে দেশটিকে সেই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চান।
নেহায়েত রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে আমরা এসব কথা বলছি না। মাত্র একদিনের খবরের কাগজের পাতা উল্টান, তাহলে আমাদের এই কথার সত্যতা মিলবে। গত শুক্রবার ২৩ নবেম্বর ‘দৈনিক সংগ্রামের' প্রথম পৃষ্ঠার কয়েকটি খবরের শিরোনাম উদ্ধৃত করছি। শিরোনামগুলো হলো, ‘‘বগুড়া ফোকাস কোচিং সেন্টারে আগুন দিয়েছে ছাত্রলীগ’’, ‘‘হাত-পা ফুলে গেছে, ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না/মিয়া গোলাম পরওয়ারকে আরো পাঁচদিনের রিমান্ডে’’, ‘‘দলীয় কোন্দলে রাবি'র অস্ত্রধারী ক্যাডার আহত/রাজশাহীতে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও রেটিনা কোচিং সেন্টারে ছাত্রলীগের তান্ডব/ব্যাপক ভাংচুর অগ্নিসংযোগ’’, ‘‘রাবির অস্ত্রধারী ক্যাডার তাকিম/ কে এই তাকিম? আর কে আহত করলো তাকে?’’ শুক্রবার যখন এই কলাম লিখছি তখন অনলাইনে দেখলাম নরসিংদীর একটি খবর। খবরে বলা হয়েছে যে, নরসিংদীর জামায়াত অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ। ২৩ নবেম্বর আরো একটি শিরোনাম, ‘‘চার মামলার আসামী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধরতে গিয়ে মার খেল চার কর্মকর্তাসহ পাঁচ পুলিশ/ আতঙ্ক থানা জুড়ে’’, ‘‘নারায়ণগঞ্জ জেলা আমীরসহ ৫৬ নেতা-কর্মীর জামিন না মঞ্জুর’’, ‘‘কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের সমাবেশে দফায় দফায় ছাত্রলীগের হামলা/আহত ২৫’’, ‘‘জিয়া পরিষদের সভায় এম কে আনোয়ার/ দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে সরকার।
প্রিয় পাঠক, মাত্র একদিনে এতগুলো খবর। এখন ভাবুন, দেশের অবস্থা কি। এই মুহূর্তে সারা দেশ জুড়ে আওয়ামী ঘরানা তাদের অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে শোরগোল তুলেছে যে, রাজশাহীর ছাত্রলীগ নেতা তাকিমের পায়ের রগ কেটে দিয়েছে ছাত্রশিবির। এই সংবাদ প্রচার করে তারা সারা দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগারদেরকে এই কথা বলে তারা ক্ষেপিয়ে দিয়েছে এবং জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের ওপর শারীরিক হামলা চালানোর জন্য লেলিয়ে দিয়েছে। অথচ কারা ঐ তাকিমের রগ কেটেছে সেটি সঠিকভাবে খুঁজে বের করার কোনো উদ্যোগ নেই। নেই কোনো তদন্তের ব্যবস্থা। অথচ কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই তাকিমের রগ কাটা নিয়ে ছাত্রশিবির এবং জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য দেশব্যাপী উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে। যার জন্য এই শোরগোল তোলা হয়েছে সেই ব্যক্তিটি আসলে কে? কি তার পরিচয়? এই বিষয়টি তারা বেমালুম চেপে যাচ্ছে। আসুন, আমরা তাকিমের প্রকৃত পরিচয় উদঘাটন করি।
(দুই)
দৈনিক সংগ্রাম গত শুক্রবার তাকিমের ব্যাপারে থলের বিড়াল বের করে দিয়েছে। সংগ্রামের সম্মানিত পাঠকবৃন্দ অবশ্যই ঐ খবর পড়েছেন। তারপরেও লেখার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আমরা খবরটির অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরছি। তাকিমের আসল নাম আখেরুজ্জামান তাকিম। সংগ্রামের রিপোর্ট মোতাবেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হোসেন বিপুর ডান হাত হিসেবে আখেরুজ্জামান পরিচিত। ২০০৭/২০০৮ শিক্ষাবর্ষে সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়। ছাত্রলীগ করতে গিয়ে তাকিম ক্লাসে যে ন্যূনতম হাজিরা দিতে হয়, প্রথম বর্ষে পড়াকালে সে সেই ন্যূনতম হাজিরাও দেয় নেই। ফলে প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। একই কারণে পরের দুই বছরেও সে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেনি। তিন তিনবার প্রয়োজনীয় হাজিরা দিতে না পারায় এবং পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার ছাত্রত্ব প্রথম বর্ষেই বাতিল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হওয়া সত্ত্বেও সে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বিপুর ডান হাত হিসেবে পরিচিত হয়। বিপুর ডান হাত আখেরুজ্জামান, এই পরিচয়ে যে ক্যাম্পাসে অবাধে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। রিপোর্ট মোতাবেক গত বছরের শেষদিকে এক পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করে এবং অন্য এক পুলিশকে কান ধরে উঠবস করায় এই আখেরুজ্জামান। বিপুর ডান হাত হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রলীগ কর্মী সোহেলকে গুলী করে হত্যার অভিযোগে আখেরুজ্জামান তাকিমকে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। গত বুধবার রাতে তার ওপর হামলা হয় এবং রগ কেটে নেয়া হয়। এই হামলার আগের দিন মঙ্গলবার রাতে এসএম হল ছাত্রলীগের নেতা মামুনের সাথে তাকিমের কথা কাটাকাটি হয়। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই লোড শেডিংয়ের অন্ধকারে তার ওপর প্রতিপক্ষ হামলা করে বলে অন্যেরা আশঙ্কা করেন। যেখানে তার ওপর হামলা করা হয় সেখানে তাকিমের ব্যবহৃত একটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এই পিস্তলটি এখন থানায় জমা রয়েছে বলে জানা গেছে। ইতোপূর্বে বিরোধী দলের ওপর তাকিম আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার পিস্তল উঁচিয়ে ধরার ফটো একাধিক জাতীয় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। অবাক ব্যাপার এই যে, এখন তাকিমের ওপর হামলা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের একাংশ, একশ্রেণীর মিডিয়া এবং আওয়ামী ঘরানা সরগরম হয়েছে। কিন্তু তাকিম যে একজন ছাত্রলীগ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সে কথা সকলেই বেমালুম চেপে যাচ্ছে। মাত্র কিছুদিন আগে এই মাস্তান তাকিম যে নিজে পিস্তল উঁচিয়ে বিরোধীদলকে আঘাত করেছে এবং সেদিন যে সেই ছবি দেশের সমস্ত নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে সেটি এখন বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে। ওরা প্রশ্ন তুলছে না যে আখেরুজ্জামান তাকিম এই পিস্তলটি পেলো কোত্থেকে? এটি কোন লাইসেন্স করা পিস্তল নয়। তাহলে এটি রাখা এবং সেটি দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর গুলী ছোঁড়ার কারণে তাকে অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করা হয়নি কেন? গ্রেফতার করে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়নি কেন? এমন একজন অস্ত্রবাজ ক্রিমিনাল এমনিতেই পুলিশ ও র্যাবের হাতে আটক হওয়ার কথা। অথচ পুলিশ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অধস্তন কর্মচারীরা সেই দিকের ধারেপাশেও যাচ্ছেন না। এখন তারা এই মর্মে একটি ফ্রেঞ্জি সৃষ্টি করেছে যে, ছাত্রশিবির তার রগ কেটেছে। অতএব, ছাত্রশিবিরকে নির্মূল করতে হবে। সে জন্যই প্রশ্ন উঠছে যে, আওয়ামী সরকার আসলে কি চায়? তারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? তারা কি জোর করে সংঘাত বাধাতে চায়? সে জন্যই কি জামায়াত-শিবিরের ওপর এই বর্বর হামলা?
(তিন)
শুধুমাত্র হামলা চালিয়েই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না। তাদের হামলা যে সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে সেটিও এখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বুঝতে পারছেন। নিজেরাই অপকর্ম করে, নিজেরাই পায়ে পায়ে ঝগড়া বাধিয়ে অপবাদটি জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়াই তাদের আসল মতলব। এটা যেন সেই প্রবাদ বাক্যের মতো, Give the dog a bad name and hang it অর্থাৎ, কুকুরটির নামে অপবাদ ছড়াও এবং তাকে মেরে ফেল। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধেও একের পর এক অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে। হিটলারের প্রচার মন্ত্রী গোয়েবলসের তত্ত্ব মোতাবেক একটি মিথ্যা বার বার বললে সেটি সত্য বলে অনেকের কাছে প্রতিভাত হয়। তাই জামায়াতের বিরুদ্ধে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, খুনি, রগকাটা পার্টি এসব অপবাদ দিয়ে জনগণের কাছে প্রথম পর্যায়ে সেসব অপবাদ তারা বিশ্বাসযোগ্য করাতে চায়। এরপর ফাইনাল এ্যাকশন। সেটি হলো জামায়াত এবং শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। আইনমন্ত্রীতো বলেই দিয়েছেন যে, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না। জামায়াতের নিবন্ধন প্রত্যাহার করলে দলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সেই লাইনে এগিয়ে যাওয়ার তরিকাও তিনি নির্বাচন কমিশনকে বাতলিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন যে, জামায়াতের গঠনতন্ত্র নাকি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। যদি তাই হয় এবং জামায়াত যদি তাদের গঠনতন্ত্র না বদলায় তাহলে কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে।
৩৬ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে রাজনীতি করে আসছে। একাধিক নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছে। যেসব নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছিল তার প্রতিটি নির্বাচনে জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এই সংসদেও আছে। এই ৩৬ বছর ধরে জামায়াতে ইসলামী একটি গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে তার ভূমিকা রাখছে। '৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল এবং সেদিনও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু জামায়াত একটি অগণতান্ত্রিক এবং অনিয়মতান্ত্রিক দল, এমন কথা অতীতে কোনদিন ওঠেনি। '৯১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন। সেদিন জামায়াত অগণতান্ত্রিক ছিল না। পরবর্তীতে মাওলানা নিজামীসহ জামায়াতের নেতাদের সাথে শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য আওয়ামী নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেছেন। ঐসব বৈঠকের ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সেদিন জামায়াত জঙ্গি ছিল না। আজ কোন প্রমাণ নেই। তারপরেও জামায়াত জঙ্গি। আসল কথা হলো গায়ের জোর। কথায় বলে জোর যার মুল্লুক তার। হয়তো গায়ের জোরে আওয়ামী সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। জামায়াত তো তালেবান, আল কায়েদা বা হরকাতুল জিহাদ নয়। সরকার জামায়াতকে উস্কানি দিচ্ছে, যাতে তারা মরিয়া হয়ে এবং ধৈর্য হারা হয়ে কোন অগণতান্ত্রিক এবং অনিয়মতান্ত্রিক কাজ করে বসে। কিন্তু জামায়াত এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে বলে মনে হয় না। তারপরেও যদি জামায়াত এবং শিবিরকে গায়ের জোরে নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী, ইসলামী এবং জাতীয়তাবাদী মহল মেনে নেবেন না। এজন্য যদি দেশে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তার জন্য দায়ী হবে আওয়ামী সরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন