ড. মা হ্ বু ব উ ল্লা হ
|
গত ১৯ নভেম্বর সোমবার বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বরিশালে অত্যন্ত সফল জনসভা করেছেন। প্রায় দু’বছর পর তিনি বরিশালের মাটিতে জনসভা করলেন। স্বাভাবিকভাবেই এই জনসভা নিয়ে বরিশালবাসীর মনে প্রবল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিন রিপোর্ট করেছে—‘সমাবেশকে ঘিরে প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত অসামান্য সৌন্দর্যের নগরী বরিশাল সকাল থেকে মিছিল-স্লোগান ও ঢাক-ঢোলকের বাদ্য-বাজনায় মুখর হয়ে ওঠে। স্রোতের মতো মিছিলের ঢল নামতে থাকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র বেলস পার্ক ময়দানমুখী। ... দুপুরের আগেই ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ দৃশ্যপট রচিত হয় ময়দানজুড়ে। বেগম খালেদা জিয়া যখন মঞ্চে আরোহণ করেন তখন মাঠ ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার পথঘাট লোকারণ্য হয়ে ওঠে। দেড়শতাধিক মাইকের আওয়াজ বেষ্টন করেছিল নগরীর এক বিরাট অংশ। মানুষ এসেছে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে। গতকাল বাস, ট্রাক, লঞ্চ ও টেম্পোযোগে যারা শহরে প্রবেশ করেছেন, প্রায় সবাই ছিলেন সমাবেশমুখী। ধান নদী খাল এই তিনে বরিশাল দৃশ্যত পুরোমাত্রায় উত্সবের নগরীতে টইটম্বুর ছিল। ... রবিবার মধ্যরাতে বেগম জিয়া যখন বরিশাল শহরে প্রবেশ করেন তখন মোড়ে মোড়ে বাজছিল দলীয় সঙ্গীত ... প্রথম বাংলাদেশ আমার ...।’
গত দুই বছরে বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই গেছেন, যে কর্মসূচিই পালন করেছেন, তা জনসভা হোক কিংবা রোড মার্চ—সর্বত্রই মানুষের ঢল নেমেছে। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছিল। এই ভরাডুবি ছিল অংশত আরোপিত এবং অংশত জনপ্রিয়তার পারদ নেমে যাওয়ার ফল। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা অনেকেই ভেবেছিলেন বিএনপির পক্ষে আগেকার শক্তি-সামর্থ্য এবং ঔজ্জ্বল্য নিয়ে রাজনীতির মাঠে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ দিন বদলের স্লোগান দিয়ে তরুণ ভোটারদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল বলে অনেকেই মনে করেন। আবার অনেকের ধারণা, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় চমক যোগ করতে পারার ফলেই সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়। শাসন ক্ষমতার বাইরে থেকে মুখরোচক, জনতুষ্টিবাদী (Populist) স্লোগান দিয়ে ভোট পাওয়া এক কথা, আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো পূরণ করা আরেক কথা। আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, উঁচু থেকে নিচ পর্যায় পর্যন্ত তাদের লোকদের কর্মকাণ্ডে মানুষ এতই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যে তাদের বর্তমান শাসনামলের প্রথম দু’বছরের মধ্যেই জনগণ তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এর প্রতিফলন আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে এবং সর্বশেষ ঘাটাইলের উপনির্বাচনে। ঘাটাইলে বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত মহাজোটের অঙ্গদলগুলোর মধ্যে। এমন একটি উত্তাপবিহীন নির্বাচনে ভোটারদের উত্সাহেও ঘাটতি ছিল। নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে অপ্রতুল। ঘাটাইলের জনগণ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীকে পরাজিত করে দেখিয়ে দিয়েছে তারা আওয়ামী লীগ অনুমোদিত প্রার্থী চায় না। নৌকার প্রতি তাদের বিষম বিতৃষ্ণার প্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন প্রভৃতির ফলাফল পরিবর্তনে শাসক দল কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি দাবি করে আওয়ামী লীগ নেত্রী-নেতৃবৃন্দ বলতে চান, তারা যেহেতু নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার মতো কোনো অবাঞ্ছিত কাজের সঙ্গে যুক্ত নন, সেহেতু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বর্ণিত ব্যবস্থা অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু তাদের এই দাবির প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। উপনির্বাচন কিংবা পৌরসভা নির্বাচনে শাসক দলের সংসদে ব্রুট মেজরিটি থাকা অবস্থায় সরকার পরিবর্তন হয় না। গত ৪ বছরে আওয়ামী লীগের আমলনামায় যতরকম নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের পাহাড় জমেছে, তারপর আর মনে হয় না আগামীতে একটি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সংবাদপত্রগুলোতেও একই সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কোনোক্রমেই একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে চায় না। তারা প্রমাদ গুনছে আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি নিয়ে। তারা এ কথাও ভাবতে পারেনি, ফিনিক্স পাখির মতো বিএনপির পুনরুত্থান ঘটবে। সেটাও তাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে একেবারেই রাজি নয়। অথচ জনগণ সন্দেহাতীতভাবে মনে করে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটা সম্ভব নয়।
বরিশালের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ উক্তি হলো—‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে দেশকে রক্ষা করতে হবে। তাই আরেকবার আমাকে সমর্থন ও সুযোগ দিন। দুর্নীতিমুক্ত, জঙ্গিবাদের অবসান, সন্ত্রাসমুক্ত করে দেশের চেহারা পাল্টে দেব। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়ন করব। ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দিয়ে বেকারত্ব দূর করব। যদি দেশের চেহারা পাল্টে দিতে না পারি, তাহলে আপনারা যে শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেব।’ এই উদ্ধৃতিটি ছিল দৈনিক যুগান্তর থেকে। দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, ক্ষমতায় গেলে ব্যাপক উন্নয়ন করে দেশের চেহারা পাল্টে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যদি সুযোগ দেন, আমি যদি বাংলাদেশের এ চেহারা পরিবর্তন করতে না পারি তাহলে যে শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।’
বড় কঠিন সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। রেকর্ড পরিমাণ দুর্নীতি, অপশাসন, প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বাংলাদেশের প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মতো অবস্থার পর আবার দেশে উন্নয়ন, উত্পাদন ও সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের জোয়ার আনা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড আর্থিক খাতে যে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তারপর এই খাতের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনে এই খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে পুনর্গঠিত করা অত্যন্ত দুরূহ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা অর্থনীতির গতি মন্থর করে ফেলেছে। সরকারি খাত ও বেসরকারি খাত উভয় খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত স্থবির। সেবা খাতগুলোর অদক্ষতা চরমে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় দেশের চেহারা পাল্টে দেয়ার প্রত্যয় অসম্ভবকে সম্ভব করার এক সুকঠিন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলকে সুনিপুণ হোমওয়ার্ক করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, পরিবহন, পরিবেশ, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এবং পররাষ্ট্রনীতিসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সব খাতের ওপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণভিত্তিক স্ট্র্যাটেজি তথা কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ হতে পারে এশিয়ার পরবর্তী ব্যাঘ্র। এই সম্ভাবনা একদিকে যেমন আশাজাগানিয়া, অন্যদিকে তেমনি এই সাফল্য অর্জন সর্বাত্মক সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভরশীল। সুশাসন নিশ্চিত করার মূল চেতনা হবে দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন তার সামর্থ্য, মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে দেশকে তার যা কিছু দেয় তা দিতে পারে। এজন্য দলীয় বৃত্তের বাইরে আসতে হবে। প্রয়োজনে শাসন কাঠামোর মধ্যে দলবহির্ভূত যোগ্য লোকদের ঠাঁই করে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বাগ্রে সব উন্নয়ন কাজে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এমন একটি দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে যে মন্ত্রিসভার প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়নে সততা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে অনিষ্পন্ন সব সমস্যার সমাধানে জাতীয় স্বার্থের নীতিতে অবিচল থেকে যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
কোন উপলব্ধি থেকে বেগম খালেদা জিয়া বরিশালের জনসভায় এমন দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন, সেটাও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। যদি শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এরকম একটি নির্বাচন করতে শাসক দলকে বাধ্য করতে পারে, তাহলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়াই হবেন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আল্লাহ তায়ালা তাকে এই সুযোগ দেবেন—এটাই আমাদের প্রার্থনা। তবে একথাও ঠিক, তার যা বয়স হয়েছে তার ফলে এটাই হয়তো হবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ টার্ম। সেজন্য তিনিও হয়তো কায়মনোবাক্যে চাইছেন জীবনের শেশপ্রান্তে এসে দেশের জন্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। আপসহীন নেত্রী হিসেবে তার যে সুখ্যাতি সেটাকে যদি তিনি এই সুযোগ পাওয়ার পর দুর্নীতিবাজ মতলববাজ সুযোগসন্ধানী অযোগ্য ও অথর্বদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারেন, যদি দেশের ভাবমূর্তিকে ম্লান থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলতে পারেন, যদি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে পারেন, যদি নতজানু অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে উন্নতশির করতে পারেন—তাহলে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। ইতিহাস বলবে, দেশপ্রেমিক শহীদ জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়া তার প্রয়াত স্বামীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com
গত দুই বছরে বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই গেছেন, যে কর্মসূচিই পালন করেছেন, তা জনসভা হোক কিংবা রোড মার্চ—সর্বত্রই মানুষের ঢল নেমেছে। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছিল। এই ভরাডুবি ছিল অংশত আরোপিত এবং অংশত জনপ্রিয়তার পারদ নেমে যাওয়ার ফল। রাজনৈতিক পণ্ডিতরা অনেকেই ভেবেছিলেন বিএনপির পক্ষে আগেকার শক্তি-সামর্থ্য এবং ঔজ্জ্বল্য নিয়ে রাজনীতির মাঠে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ দিন বদলের স্লোগান দিয়ে তরুণ ভোটারদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল বলে অনেকেই মনে করেন। আবার অনেকের ধারণা, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় চমক যোগ করতে পারার ফলেই সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়। শাসন ক্ষমতার বাইরে থেকে মুখরোচক, জনতুষ্টিবাদী (Populist) স্লোগান দিয়ে ভোট পাওয়া এক কথা, আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো পূরণ করা আরেক কথা। আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, উঁচু থেকে নিচ পর্যায় পর্যন্ত তাদের লোকদের কর্মকাণ্ডে মানুষ এতই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যে তাদের বর্তমান শাসনামলের প্রথম দু’বছরের মধ্যেই জনগণ তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এর প্রতিফলন আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে এবং সর্বশেষ ঘাটাইলের উপনির্বাচনে। ঘাটাইলে বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী ছিল না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত মহাজোটের অঙ্গদলগুলোর মধ্যে। এমন একটি উত্তাপবিহীন নির্বাচনে ভোটারদের উত্সাহেও ঘাটতি ছিল। নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে অপ্রতুল। ঘাটাইলের জনগণ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীকে পরাজিত করে দেখিয়ে দিয়েছে তারা আওয়ামী লীগ অনুমোদিত প্রার্থী চায় না। নৌকার প্রতি তাদের বিষম বিতৃষ্ণার প্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন প্রভৃতির ফলাফল পরিবর্তনে শাসক দল কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি দাবি করে আওয়ামী লীগ নেত্রী-নেতৃবৃন্দ বলতে চান, তারা যেহেতু নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেয়ার মতো কোনো অবাঞ্ছিত কাজের সঙ্গে যুক্ত নন, সেহেতু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বর্ণিত ব্যবস্থা অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু তাদের এই দাবির প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। উপনির্বাচন কিংবা পৌরসভা নির্বাচনে শাসক দলের সংসদে ব্রুট মেজরিটি থাকা অবস্থায় সরকার পরিবর্তন হয় না। গত ৪ বছরে আওয়ামী লীগের আমলনামায় যতরকম নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের পাহাড় জমেছে, তারপর আর মনে হয় না আগামীতে একটি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সংবাদপত্রগুলোতেও একই সম্ভাবনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কোনোক্রমেই একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে চায় না। তারা প্রমাদ গুনছে আগামী নির্বাচনে ভরাডুবি নিয়ে। তারা এ কথাও ভাবতে পারেনি, ফিনিক্স পাখির মতো বিএনপির পুনরুত্থান ঘটবে। সেটাও তাদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে একেবারেই রাজি নয়। অথচ জনগণ সন্দেহাতীতভাবে মনে করে, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটা সম্ভব নয়।
বরিশালের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ উক্তি হলো—‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে দেশকে রক্ষা করতে হবে। তাই আরেকবার আমাকে সমর্থন ও সুযোগ দিন। দুর্নীতিমুক্ত, জঙ্গিবাদের অবসান, সন্ত্রাসমুক্ত করে দেশের চেহারা পাল্টে দেব। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়ন করব। ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দিয়ে বেকারত্ব দূর করব। যদি দেশের চেহারা পাল্টে দিতে না পারি, তাহলে আপনারা যে শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেব।’ এই উদ্ধৃতিটি ছিল দৈনিক যুগান্তর থেকে। দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, ক্ষমতায় গেলে ব্যাপক উন্নয়ন করে দেশের চেহারা পাল্টে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা যদি সুযোগ দেন, আমি যদি বাংলাদেশের এ চেহারা পরিবর্তন করতে না পারি তাহলে যে শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।’
বড় কঠিন সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। রেকর্ড পরিমাণ দুর্নীতি, অপশাসন, প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বাংলাদেশের প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মতো অবস্থার পর আবার দেশে উন্নয়ন, উত্পাদন ও সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের জোয়ার আনা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড আর্থিক খাতে যে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তারপর এই খাতের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনে এই খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে পুনর্গঠিত করা অত্যন্ত দুরূহ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা অর্থনীতির গতি মন্থর করে ফেলেছে। সরকারি খাত ও বেসরকারি খাত উভয় খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত স্থবির। সেবা খাতগুলোর অদক্ষতা চরমে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় দেশের চেহারা পাল্টে দেয়ার প্রত্যয় অসম্ভবকে সম্ভব করার এক সুকঠিন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলকে সুনিপুণ হোমওয়ার্ক করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, পরিবহন, পরিবেশ, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এবং পররাষ্ট্রনীতিসহ রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সব খাতের ওপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণভিত্তিক স্ট্র্যাটেজি তথা কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ হতে পারে এশিয়ার পরবর্তী ব্যাঘ্র। এই সম্ভাবনা একদিকে যেমন আশাজাগানিয়া, অন্যদিকে তেমনি এই সাফল্য অর্জন সর্বাত্মক সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভরশীল। সুশাসন নিশ্চিত করার মূল চেতনা হবে দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন তার সামর্থ্য, মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে দেশকে তার যা কিছু দেয় তা দিতে পারে। এজন্য দলীয় বৃত্তের বাইরে আসতে হবে। প্রয়োজনে শাসন কাঠামোর মধ্যে দলবহির্ভূত যোগ্য লোকদের ঠাঁই করে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বাগ্রে সব উন্নয়ন কাজে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এমন একটি দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে যে মন্ত্রিসভার প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়নে সততা ও যোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে অনিষ্পন্ন সব সমস্যার সমাধানে জাতীয় স্বার্থের নীতিতে অবিচল থেকে যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
কোন উপলব্ধি থেকে বেগম খালেদা জিয়া বরিশালের জনসভায় এমন দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন, সেটাও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। যদি শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট এরকম একটি নির্বাচন করতে শাসক দলকে বাধ্য করতে পারে, তাহলে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়াই হবেন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আল্লাহ তায়ালা তাকে এই সুযোগ দেবেন—এটাই আমাদের প্রার্থনা। তবে একথাও ঠিক, তার যা বয়স হয়েছে তার ফলে এটাই হয়তো হবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ টার্ম। সেজন্য তিনিও হয়তো কায়মনোবাক্যে চাইছেন জীবনের শেশপ্রান্তে এসে দেশের জন্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। আপসহীন নেত্রী হিসেবে তার যে সুখ্যাতি সেটাকে যদি তিনি এই সুযোগ পাওয়ার পর দুর্নীতিবাজ মতলববাজ সুযোগসন্ধানী অযোগ্য ও অথর্বদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারেন, যদি দেশের ভাবমূর্তিকে ম্লান থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলতে পারেন, যদি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে পারেন, যদি নতজানু অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে উন্নতশির করতে পারেন—তাহলে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। ইতিহাস বলবে, দেশপ্রেমিক শহীদ জিয়ার সহধর্মিণী খালেদা জিয়া তার প্রয়াত স্বামীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ
mahbub.ullah@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন