সা লে হ নো মা ন
‘রোহিঙ্গাদের জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে জাতিসংঘের শরণার্থী ক্যাম্প অথবা তৃতীয় কোনো দেশ।’ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন কোনো রকম রাখঢাক না করে রোহিঙ্গা সম্পর্কে এই কথাটি বলেছেন স্বয়ং জাতিসংঘবিষয়ক শরণার্থী হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে। একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন তার দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রকাশ্যে এই বক্তব্য দেন, তখন সেই দেশের সেনাবাহিনী, পুলিশসহ অন্য সংস্থাগুলো এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কী আচরণ করবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আন্তর্জাতিক মূলধারার মিডিয়াতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খবরাখবর প্রকাশিত হলেও তাতে প্রকৃত অবস্থার চিত্র সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। অন্তত এমনটাই দাবি করছে রোহিঙ্গাদের ব্লগগুলো। গত আগস্টে টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা উঠে এসেছে। ‘মাস গ্রেইভ ফর মিয়ানমার’স রোহিঙ্গা’ শিরোনামে আল-জাজিরার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের অবস্থা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি নাজুক। রাখাইনের রাজধানী সিটুইয়া শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে একসময় রোহিঙ্গাদেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। অথচ এখন এই শহরটিতে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর মানুষ খুব একটা চোখে পড়ছে না। একই নৃগোষ্ঠীর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সেখানে বৌদ্ধদের হামলা এড়াতে মাথায় বিশেষ কাপড় পেঁচিয়ে রাখে।
সিটুইয়া শহরের হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখন পার্শ্ববর্তী ভুমেয় গ্রাম ও আশপাশের ছয়টি অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করছে। এখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার নামে ঘিরে রেখেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাইলেও নিরাপত্তার অজুহাতে সরকারি বাহিনী তাদের সেখানে যেতে দিচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাড়িঘরে গিয়ে লাভ হবে না, সেখানে তোমাদের কোনো চিহ্ন নেই। অনেক রোহিঙ্গা নিজ নিজ বাড়িঘরে গিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আবার চালুর উদ্যোগ নিলেও কর্তৃপক্ষ সেগুলো বন্ধ করে দেয় একই অজুহাতে।
মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্লগ সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের সংশ্রবে না আসার ব্যাপারে সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সিটুইয়া শহরের বড় বড় বাজার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যেতে দেয়া হয় না। রোহিঙ্গাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গারা খাদ্য এবং ওষুধ সংগ্রহ করতে পারছে না, সেইসঙ্গে চলাচল এবং যোগাযোগের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
এটা ছিল গত জুনের দাঙ্গার পরবর্তী পরিস্থিতি।
গত ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গার পর এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে রাজধানী সিটুয়ে এবং মারকু-ত এলাকায়। গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় মারকু-তে রোহিঙ্গাদের ৪৩০টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিলো মাত্র সাতটি ঘর। এই সময় নিহত হওয়া ৬৮ রোহিঙ্গাকে তাদের পরিবার-পরিজন কোনো রকমে কবরস্থ করেছে।
দাঙ্গাকবলিত ক্যায়াক প্রুয়ে এলাকা থেকে চারটি ট্রলারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মংডুতে অবতরণ করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের অনুমতি দেয়নি। খাদ্য ও পানীয়বিহীন এসব রোহিঙ্গা দু’দিন ধরে এই নৌকাগুলোতে অবস্থান করার পর মংডুতে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর চাপে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মংডুর উত্তরাঞ্চলে তুয়াগ্নব্রুতে ক্যাম্প স্থাপনে রাজি হয়। নাসাকার পাহারায় নাফ নদী দিয়ে ট্রলারভর্তি রোহিঙ্গাদের খুবই অমানবিকভাবে তুয়াগ্নব্রুতে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে দাঙ্গাকবলিত এলাকাগুলো থেকে পালিয়ে আসা ১২টি নৌকাভর্তি রোহিঙ্গাদের সিটুইয়াতে অবতরণ করতে দেয়নি। চরম খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি সঙ্কটে পতিত হয়ে এসব রোহিঙ্গা কূলে উঠতে চাইলে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়। হিউম্যান রাইট ওয়াচও ক্যায়াক পুয়ের ধ্বংসযজ্ঞের উপগ্রহের ছবি প্রচার করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই শহরটিতে আটশ’র মতো ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা ব্লগের খবর অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরে, মংডু ও সংলগ্ন সেন্টমার্টিন উপকূলে বেশকিছু মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব মৃতদেহ বোটে করে আসা রোহিঙ্গাদের, যারা দাঙ্গাকবলিত এলাকা থেকে এসে মংডুতে আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বাহিনী আশ্রয় নিতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, যেসব বোট বাধা সত্ত্বেও উপকূলে ভিড়তে চেয়েছিল, সেসব বোট গুলি করে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগ বসবাস করছে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিটুইয়া ও এর আশপাশের ছয়টি ক্যাম্পে। এছাড়া নাফ নদীর তীরবর্তী মংডু শহরেও বাস্তুহারা রোহিঙ্গারা কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বসবাস করছে।
বাংলাদেশে অনেকের ধারণা, রোহিঙ্গারা যে কোনোভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করার জন্য অজুহাত খোঁজে। যে কোনো একটা কিছু হলেই তাদের দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত জুনে দাঙ্গার পর রোহিঙ্গাদের দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকেও সেই রকম কিছু বলে মনে হয়েছিল। তবে অক্টোবরের দাঙ্গার পর আবারও প্রমাণ হয়েছে, তারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। আর রাখাইন প্রদেশের অবস্থা যে ভযাবহ, তা প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে আল-জাজিরায় দেয়া একটি সাক্ষাত্কারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দায়-দায়িত্ব মিয়ানমারের। গত জুনে সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশে দাঙ্গার পর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছিলেন, আল-জাজিরার সাক্ষাত্কারেও তিনি একই কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ না নেয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাস্তবসম্মত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ না দেয়ার নীতিও দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই নীতির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর অপবাদ দেয়াটা বড় বেশি অমানবিক। জাতীয় সংসদ এবং বিভিন্ন ফোরামে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের আশ্রয় না দেয়ার পেছনে এটাকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে সরকারের নীতি থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাদের অপবাদ দেয়াটা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাদের গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীরাও দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে রোহিঙ্গাদের নানা অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে।
নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে নেয়া না হলেও বর্তমানে কক্সবাজারে দুটি ক্যাম্পে ৩০ হাজার শরণার্থী বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গা জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে আছে। মিয়ানমার সরকার সহযোগিতা না করায় এসব শরণার্থী নিজ দেশে ফেরত যেতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকারও চাইলে তাদের ফেরত পাঠাতে পারবে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশে ফেরত যেতে না পারার জন্য কেউ যদি দায়ী থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না।
অথচ আমাদের সরকার ও একটি বিশেষ মহলের যাবতীয় আক্রোশ যেন রোহিঙ্গাদের উপর। তাদের সন্ত্রাসী জঙ্গি আখ্যা দিয়ে যেমন হেয় করা হচ্ছে, তেমনি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার পরিবর্তে তাদের শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া তিনটি সাহায্য সংস্থার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঈদুল আজহার সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোরবানির মাংস বিলি করার অভিযোগে তুরস্কের এক সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন বিদেশি সাহায্য কর্মীকে কক্সবাজার থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
অথচ অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কোস্টগার্ড এবং স্থানীয় প্রশাসন যেভাবে খাদ্য ও চিকিত্সাসেবা দিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক অনেক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় না পেলেও রোহিঙ্গারা এই সেবা কার্যক্রমের কারণে সন্তুষ্ট ছিল।
বিদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তেমনি আবার এই নিয়ন্ত্রণ যাতে নির্যাতনের পর্যায়ে না যায়, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। গত জুনের দাঙ্গার পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অর্জন আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে।
একসময়ের সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা এখন কালচক্রে পৃথিবীর সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে। তাই মিয়ানমার সরকার তাদের ওপর সম্ভাব্য সব ধরনের নির্যাতনই চালাচ্ছে। মনে হয়, মানবাধিকারের কোনো বিধিবিধানই রোহিঙ্গাদের জন্য কার্যকর নয়, কারণ রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত মিয়ানমারের কাছে যতটা না মানুষ, তার চেয়েও বেশি পরিচিত বিদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে।
মিয়ানমারের আরাকান বর্তমান রাখাইন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক বিষয়। এর অন্যতম কারণ যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি অভিন্ন কৃষ্টি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধজনিত। একসময় গোটা চট্টগ্রাম এলাকাই ছিল অভিন্ন আরাকান রাজ্য। শুধু রোহিঙ্গারা কেন, নাফ নদীর দুই পাড়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদেরও আসা-যাওয়া ছিল। তবে একসময় এই যাতায়াতটি অবাধ হলেও পরিস্থিতির কারণে এখন কিছুটা রাখঢাক করে তা হচ্ছে। তবে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আটক করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো রাখাইনকে অবাধে আসা-যাওয়ার জন্য আটকের খবর পাওয়া যায়নি। একই এলাকায় একই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য রোহিঙ্গা এবং রাখাইনদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী অং সান সুচি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাত্কারে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে অস্বকৃতি জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন সামরিক সরকারের কারাগারে থেকে গণতন্ত্র এবং মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হওয়া এই নেত্রী যখন একটি জানগোষ্ঠীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মূলের পক্ষে অবস্থান নেন, তখন ভাবতে হয়, ‘রোহিঙ্গারা কি আসলে মানুষ না অন্য কোনো জীব।’
লেখক : সাংবাদিক ও ব্লগার
salehnoman@gmail.com
আন্তর্জাতিক মূলধারার মিডিয়াতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খবরাখবর প্রকাশিত হলেও তাতে প্রকৃত অবস্থার চিত্র সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। অন্তত এমনটাই দাবি করছে রোহিঙ্গাদের ব্লগগুলো। গত আগস্টে টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা উঠে এসেছে। ‘মাস গ্রেইভ ফর মিয়ানমার’স রোহিঙ্গা’ শিরোনামে আল-জাজিরার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের অবস্থা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি নাজুক। রাখাইনের রাজধানী সিটুইয়া শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে একসময় রোহিঙ্গাদেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। অথচ এখন এই শহরটিতে রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর মানুষ খুব একটা চোখে পড়ছে না। একই নৃগোষ্ঠীর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সেখানে বৌদ্ধদের হামলা এড়াতে মাথায় বিশেষ কাপড় পেঁচিয়ে রাখে।
সিটুইয়া শহরের হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখন পার্শ্ববর্তী ভুমেয় গ্রাম ও আশপাশের ছয়টি অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করছে। এখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার নামে ঘিরে রেখেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে চাইলেও নিরাপত্তার অজুহাতে সরকারি বাহিনী তাদের সেখানে যেতে দিচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাড়িঘরে গিয়ে লাভ হবে না, সেখানে তোমাদের কোনো চিহ্ন নেই। অনেক রোহিঙ্গা নিজ নিজ বাড়িঘরে গিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আবার চালুর উদ্যোগ নিলেও কর্তৃপক্ষ সেগুলো বন্ধ করে দেয় একই অজুহাতে।
মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্লগ সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের সংশ্রবে না আসার ব্যাপারে সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সিটুইয়া শহরের বড় বড় বাজার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যেতে দেয়া হয় না। রোহিঙ্গাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গারা খাদ্য এবং ওষুধ সংগ্রহ করতে পারছে না, সেইসঙ্গে চলাচল এবং যোগাযোগের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
এটা ছিল গত জুনের দাঙ্গার পরবর্তী পরিস্থিতি।
গত ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গার পর এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে রাজধানী সিটুয়ে এবং মারকু-ত এলাকায়। গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় মারকু-তে রোহিঙ্গাদের ৪৩০টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিলো মাত্র সাতটি ঘর। এই সময় নিহত হওয়া ৬৮ রোহিঙ্গাকে তাদের পরিবার-পরিজন কোনো রকমে কবরস্থ করেছে।
দাঙ্গাকবলিত ক্যায়াক প্রুয়ে এলাকা থেকে চারটি ট্রলারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মংডুতে অবতরণ করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ তাদের অনুমতি দেয়নি। খাদ্য ও পানীয়বিহীন এসব রোহিঙ্গা দু’দিন ধরে এই নৌকাগুলোতে অবস্থান করার পর মংডুতে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর চাপে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মংডুর উত্তরাঞ্চলে তুয়াগ্নব্রুতে ক্যাম্প স্থাপনে রাজি হয়। নাসাকার পাহারায় নাফ নদী দিয়ে ট্রলারভর্তি রোহিঙ্গাদের খুবই অমানবিকভাবে তুয়াগ্নব্রুতে নিয়ে যাওয়া হয়। একইভাবে দাঙ্গাকবলিত এলাকাগুলো থেকে পালিয়ে আসা ১২টি নৌকাভর্তি রোহিঙ্গাদের সিটুইয়াতে অবতরণ করতে দেয়নি। চরম খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানি সঙ্কটে পতিত হয়ে এসব রোহিঙ্গা কূলে উঠতে চাইলে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়। হিউম্যান রাইট ওয়াচও ক্যায়াক পুয়ের ধ্বংসযজ্ঞের উপগ্রহের ছবি প্রচার করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই শহরটিতে আটশ’র মতো ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
রোহিঙ্গা ব্লগের খবর অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরে, মংডু ও সংলগ্ন সেন্টমার্টিন উপকূলে বেশকিছু মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব মৃতদেহ বোটে করে আসা রোহিঙ্গাদের, যারা দাঙ্গাকবলিত এলাকা থেকে এসে মংডুতে আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বাহিনী আশ্রয় নিতে দেয়নি। শুধু তাই নয়, যেসব বোট বাধা সত্ত্বেও উপকূলে ভিড়তে চেয়েছিল, সেসব বোট গুলি করে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগ বসবাস করছে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিটুইয়া ও এর আশপাশের ছয়টি ক্যাম্পে। এছাড়া নাফ নদীর তীরবর্তী মংডু শহরেও বাস্তুহারা রোহিঙ্গারা কোনো রকম সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া বসবাস করছে।
বাংলাদেশে অনেকের ধারণা, রোহিঙ্গারা যে কোনোভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করার জন্য অজুহাত খোঁজে। যে কোনো একটা কিছু হলেই তাদের দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত জুনে দাঙ্গার পর রোহিঙ্গাদের দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টাকেও সেই রকম কিছু বলে মনে হয়েছিল। তবে অক্টোবরের দাঙ্গার পর আবারও প্রমাণ হয়েছে, তারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। আর রাখাইন প্রদেশের অবস্থা যে ভযাবহ, তা প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে আল-জাজিরায় দেয়া একটি সাক্ষাত্কারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দায়-দায়িত্ব মিয়ানমারের। গত জুনে সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশে দাঙ্গার পর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছিলেন, আল-জাজিরার সাক্ষাত্কারেও তিনি একই কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ না নেয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাস্তবসম্মত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ না দেয়ার নীতিও দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই নীতির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর অপবাদ দেয়াটা বড় বেশি অমানবিক। জাতীয় সংসদ এবং বিভিন্ন ফোরামে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের আশ্রয় না দেয়ার পেছনে এটাকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে সরকারের নীতি থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাদের অপবাদ দেয়াটা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাদের গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীরাও দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে রোহিঙ্গাদের নানা অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে।
নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসেবে নেয়া না হলেও বর্তমানে কক্সবাজারে দুটি ক্যাম্পে ৩০ হাজার শরণার্থী বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গা জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে আছে। মিয়ানমার সরকার সহযোগিতা না করায় এসব শরণার্থী নিজ দেশে ফেরত যেতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকারও চাইলে তাদের ফেরত পাঠাতে পারবে না। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশে ফেরত যেতে না পারার জন্য কেউ যদি দায়ী থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে মিয়ানমার সরকার। এজন্য রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না।
অথচ আমাদের সরকার ও একটি বিশেষ মহলের যাবতীয় আক্রোশ যেন রোহিঙ্গাদের উপর। তাদের সন্ত্রাসী জঙ্গি আখ্যা দিয়ে যেমন হেয় করা হচ্ছে, তেমনি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার পরিবর্তে তাদের শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া তিনটি সাহায্য সংস্থার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঈদুল আজহার সময় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোরবানির মাংস বিলি করার অভিযোগে তুরস্কের এক সংসদ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন বিদেশি সাহায্য কর্মীকে কক্সবাজার থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
অথচ অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কোস্টগার্ড এবং স্থানীয় প্রশাসন যেভাবে খাদ্য ও চিকিত্সাসেবা দিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক অনেক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় না পেলেও রোহিঙ্গারা এই সেবা কার্যক্রমের কারণে সন্তুষ্ট ছিল।
বিদেশি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচল যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তেমনি আবার এই নিয়ন্ত্রণ যাতে নির্যাতনের পর্যায়ে না যায়, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। গত জুনের দাঙ্গার পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অর্জন আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে।
একসময়ের সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা এখন কালচক্রে পৃথিবীর সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে। তাই মিয়ানমার সরকার তাদের ওপর সম্ভাব্য সব ধরনের নির্যাতনই চালাচ্ছে। মনে হয়, মানবাধিকারের কোনো বিধিবিধানই রোহিঙ্গাদের জন্য কার্যকর নয়, কারণ রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত মিয়ানমারের কাছে যতটা না মানুষ, তার চেয়েও বেশি পরিচিত বিদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে।
মিয়ানমারের আরাকান বর্তমান রাখাইন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক বিষয়। এর অন্যতম কারণ যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি অভিন্ন কৃষ্টি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধজনিত। একসময় গোটা চট্টগ্রাম এলাকাই ছিল অভিন্ন আরাকান রাজ্য। শুধু রোহিঙ্গারা কেন, নাফ নদীর দুই পাড়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদেরও আসা-যাওয়া ছিল। তবে একসময় এই যাতায়াতটি অবাধ হলেও পরিস্থিতির কারণে এখন কিছুটা রাখঢাক করে তা হচ্ছে। তবে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আটক করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো রাখাইনকে অবাধে আসা-যাওয়ার জন্য আটকের খবর পাওয়া যায়নি। একই এলাকায় একই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য রোহিঙ্গা এবং রাখাইনদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী অং সান সুচি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাত্কারে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে অস্বকৃতি জানিয়েছেন। দীর্ঘদিন সামরিক সরকারের কারাগারে থেকে গণতন্ত্র এবং মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হওয়া এই নেত্রী যখন একটি জানগোষ্ঠীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মূলের পক্ষে অবস্থান নেন, তখন ভাবতে হয়, ‘রোহিঙ্গারা কি আসলে মানুষ না অন্য কোনো জীব।’
লেখক : সাংবাদিক ও ব্লগার
salehnoman@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন