বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল গণতন্ত্র হত্যার শামিল



ড. কে এম এম শাহাদত হোসেন মণ্ডল
 
স্বাধীনতার দীর্ঘ একচল্লিশ বছর পর দেশ আজ চরম সঙ্কটে আবর্তিত এবং রাজনৈতিক সংঘাতের মুখোমুখি। হুমকির মুখে দেশের গণতন্ত্র, জান-মালের নিরাপত্তাহীনতায় দেশের মানুষ এবং সর্বোপরি বিপন্নপ্রায় দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। আর দেশের অর্থনীতি? সে তো অনেক আগেই ধ্বংস হয়েছে—ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করা হয়েছে। দুর্নীতির অতল গভীরে নিমজ্জিত আমাদের তথাকথিত সোনার বাংলাদেশ। দেশের মানুষ আজ দেশ, জান-মালের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। ভবিষ্যতের এক অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত দেশের মানুষ। সবকিছুর মূলেই রয়েছে আওয়ামী সরকার কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলকরণ। উল্লেখ্য, গত ৩০ জুন ২০১১ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে আপাতত সক্ষম হয়। দেশের সব পেশার মানুষের মতামত, বিএনপিসহ সব গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলের দাবি ও মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বরং বলা যায় পদদলিত করে শুধু সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা করে ও দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলো। উদ্দেশ্য, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত করা—যাতে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে।
‘সুপ্রিমকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলকরণ বাধ্যতামূলক’—সরকারপ্রধানের এ ধরনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তব্য হচ্ছে, ‘সুপ্রিমকোর্ট এ বিষয়ে যে রায় দিয়েছে, তার দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমাংশে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। সে কারণে তা বহাল রাখাটা অবৈধ। রায়ের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, তা সত্ত্বেও আগামী দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বিচার বিভাগের কোনোরূপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্তি রাখা যাবে না। সংসদকেই এ বিষয়ে পথ বের করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাই কি সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই-এর নমুনা? বাংগালকে আর কত ‘হাইকোর্ট দেখানো হবে’। তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে, তার প্রথম ধারণাগত উদ্ভাবনের সময় (১৯৯০ সালে) একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থারূপে ভাবা হয়নি। নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে তিন মেয়াদের জন্য এটা বহাল করার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটাকে স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ এটাকে তারই কৃতিত্ব বলে দাবি করতে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি শেখ হাসিনার ব্রেইন চাইল্ড এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য একটি আদর্শ মডেল বলেও প্রচারণা চালানো হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ এর উপযোগিতা, অপরিহার্যতা ও গণতান্ত্রিক মর্মবাণীর কথা ঢালাওভাবে প্রচার করেছে। এখন তারা বলছে, ‘সংসদীয় ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো স্থান থাকতে পারে না। ... ব্রিটেন, ভারত প্রভৃতি দেশে যেভাবে নির্বাচনকালে সরকার চলে, সেভাবেই আমাদের চলতে হবে।’ প্রশ্ন করতে চাই, যদি ১৯৯৫-৯৬ সালের কথাগুলোই আপনাদের সুচিন্তিত যুক্তির কথা হয়ে থাকে, তবে এখন একেবারে বিপরীত যুক্তি দিচ্ছেন কেন? ‘যুক্তি’ বিষয়টিকেও কি দলীয় সুবিধা অনুযায়ী যখন যেমন দরকার তেমনভাবে এদিক-সেদিক করে ব্যবহার করার মতো একটি খেলার সামগ্রীতে পরিণত না করে আপনারা ছাড়বেন না?’ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, ৬ জুন, ২০১১)।
এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া। আবার এবার সেই তত্ত্বাবধাযক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে ফের ক্ষমতায় থাকা। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেই তত্কালীন বিরোধীদলগুলোর দাবি ও আন্দোলনের মুখে দেশ ও জাতির স্বার্থে দেশের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের ২৫ মার্চের রাতের অধিবেশনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল সর্বসম্মতিক্রমে পাস করে এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতির পর এ বিল আইনে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে (ত্রয়োদশ সংশোধনী) একীভূত হয়। ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু হওয়ায় রাজনীতিবিদরা যখন হার-জিতের হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত, তখন দেশের জনগণ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে আন্দোলনের নামে লাগাতার হরতাল ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ায়। কারণ তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের লাগাতার ২২ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির কারণে দেশের সাধারণ মানুষ—যারা দিন আনে দিন খায়, তারা কর্মের অভাবে অর্থ-অন্ন সঙ্কটে স্ত্রী-ছেলে-মেয়েসহ অনাহারে ও অর্ধাহারে মরণযন্ত্রণা ভোগ করেছিল। অনেকেই যে অনাহারে মারা যায়নি, তা হলফ করে বলা যাবে না। তাছাড়া ওই লাগাতার অসহযোগ কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পোশাক শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত ও সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ থাকে একটানা ২২ দিন। সত্যি বলতে কি, আওয়ামী লীগের সে অসহযোগ আন্দোলনের কারণে ওই সময় দেশবাসী একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যত্ এবং ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিল। তবে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দল বিএনপি কর্তৃক সাংবিধানিক পন্থায় সুষ্ঠুভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দূর হয়। জনজীবনে ফিরে আসে স্বস্তি ও স্বাভাবিকতা।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের অধিকাংশ মানুষই বুঝতে পেরেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ফের ক্ষমতায় টিকে থাকার বা আসার জন্যই আদালতের আংশিক রায় (যেটুকু তাদের জন্য সুবিধাজনক) গ্রহণ করে সে অংশের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। কারণ সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই জনসমর্থন প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ানোর উপক্রম। দেশের মানুষসহ খোদ সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাই আজ মন্ত্রীদের, সরকারের কার্যকলাপ ও ব্যর্থতার জন্য ভীষণ ক্ষুব্ধ এবং সমালোচনায় সোচ্চার। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ ও তিস্তাচুক্তি সম্পাদনে সরকারের ব্যর্থতা, বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশী নিরীহ নাগরিককে পাখির মতো গুলি করে হত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থতা, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক ও ডেসটিনি কর্তৃক হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্ ও অর্থ পাচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জানমালের নিরাপত্তা প্রদানের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক হত্যা, গুম, হামলা, মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতাসহ সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে বর্তমান মহাজোট সরকারের জনসমর্থন আজ শূন্যের কোঠায়। এসব কারণেই জনগণ এ সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি নিশ্চিত জেনেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের লক্ষ্যে তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো। কারণ জনগণের ওপর আওয়ামী লীগের আর আস্থা নেই। জনগণ যে তাদের আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না, সেটা তারা বুঝতে পেরেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে। কিন্তু বিরোধী দল কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিরোধী দল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন ও কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার পাশাপাশি দলীয় সরকারের অধীনে নীল নকশার নির্বাচন বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে বাধ্য করা হবে। প্রয়োজন হলে লাগাতার হরতালের মতো কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি ১০০ দিন হরতাল ও অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে থাকে, এখন বিএনপির নেতৃত্বে বৃহত্তর ঐক্যজোট সে ব্যবস্থা বহাল রাখতে সে রকমই কঠোর কর্মসূচি যে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আর দেয়াটাই অতিস্বাভাবিক। এতে দেশের মানুষের সমর্থনও রয়েছে। তার প্রমাণ, বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে রোডমার্চ, লংমার্চ, জনসভা, পথসভা ও ঢাকা চলো প্রোগ্রামসহ দিনাজপুর ও হবিগঞ্জের জনসভায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা। যদিও আন্দোলনের কারণে দেশের সম্পদ নষ্ট হবে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মানুষের কষ্ট বাড়বে, সর্বোপরি দেশে যে রাজনৈতিক সংঘাতের সৃষ্টি হবে না, তা কে বলতে পারে? দেশে হয়তো নেমে আসবে ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ মতো আরেকটি অগণতান্ত্রিক শক্তি, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আর যদি সেটা হয়, তাহলে তা হবে রাজনৈতিক সংঘাতের কারণেই এবং এর দায়-দায়িত্ব সরকার ও সরকারি দলের ওপরই বর্তাবে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ যে, রায় প্রকাশের দীর্ঘ ১৬ মাস পর ১৩ সেপ্টেম্বর ১০১২ বিচারপতি খায়রুল হক পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক, তাং-১৪/০৯/২০১২)। তত্ত্বাবধাযক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর গত ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে তা প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। আন্দোলন চলবে। তার ভাষায়, সাবেক প্রধান বিচারপতির দেয়া এ রায় রাজনৈতিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতদুষ্ট, বাতিলযোগ্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার ও পরস্পরবিরোধী এ রায় জনগণ কখনও গ্রহণ করবে না এবং এর ভিত্তিতে আয়োজিত কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না। জনগণ তা প্রতিহত করবে। নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির এ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়ের কারণে চলমান আন্দোলনকে কেউ দুর্বল করতে পারবে না। সরকার যদি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস না করে তাহলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।’
বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আপিল বিভাগের দেয়া রায়ে পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা মনে করি, নৈতিকতাবিরোধী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ রায় যৌক্তিক কারণেই অকার্যকর। এ রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর, কয়েক দিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচরণ। আমরা তার এ আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সংসদে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া আরও বলেন, বর্তমান সরকারকে তাদের অনৈতিক ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে নতুন করে লেখা এ রায় উপহার দেয়া হলো। একই সঙ্গে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও এ রায়ে অবৈধ ফখরুদ্দীন সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়েছে—যা এ রায়কে রাজনীতিকীকরণের আর একটি দৃষ্টান্ত।
বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কখনও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেনি। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ সম্পর্কে কোনো কথা ছিল না। এমনকি সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে গঠিত সংসদীয় কমিটিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করেছিল। একইভাবে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণীপেশার সংগঠন, সংবিধানবিশেষজ্ঞরাও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু সরকার অবধারিত পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে মত পাল্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা শুরু করে। অন্যদিকে সে সময় নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক হঠাত্ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে বহু আগের একটি রিট মামলা উদ্ভূত আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিষয়টি সাংবিধানকিভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আদালতের বন্ধু হিসেবে যে আট জন সিনিয়র আইনজীবীকে মতামত দিতে ডাকা হয়েছিল, তাদের ৭ জনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং এ ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মত দেন। তা সত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক গত বছর ১৭ মে অবসরে যাওয়ার মাত্র এ সপ্তাহ আগে, ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন এবং এটি ছিল একটি বিভক্ত রায়।
বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায়, বিচারকরা পক্ষপাতহীন থেকে সুবিচার করার যে শপথ গ্রহণ করেন, অবসরে যাওয়ার পর তারা সে শপথের অধীন থাকেন না। আর সে কারণেই অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি আদালতে বসতে পারেন না, শুনানি করতে পারেন না এবং একই কারণে কোনো মামলার রায়ও লিখতে কিংবা তাতে দরখাস্ত করতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক তা-ই করেছেন। এতে এই রায় যৌক্তিক কারণেই পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য। এছাড়া সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সঙ্গে স্পষ্টই অসঙ্গতিপূর্ণ। প্রধান বিচারপতির এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ একটি মারাত্মক বিচারিক অসদাচরণ। এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
উল্লেখ্য, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া সাবেক প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে ১০ মে, ২০১১ তারিখে ঘোষিত রায়ের অসঙ্গতির কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আলাদা মত দিয়েছেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিচারপতি আ. ওয়াহহাব মিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেছেন। একই সঙ্গে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিকভাবে অপরিহার্য এবং সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলেও মত দিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া আরও বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, তিনি ২৯ মার্চ ২০১২ তারিখে তার লেখা রায় সই করে জমা দিয়েছেন। কিন্তু গত রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, জমাকৃত রায়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের জন্য তিনি সেই রায় ফেরত নিয়ে কয়েকমাস পরে আবার জমা দিয়েছেন। অর্থাত্ একই রায় তিনি ২ বার লিখেছেন এবং ২ বার দরখাস্ত করেছেন। সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী লেখার জন্যই যে তিনি নিজের লেখা রায় ফিরিয়ে এনে ফের লিখেছেন, তা সুস্পষ্ট হয়েছে নতুন রায়ে সরকারি অবস্থানের পক্ষে লেখা বিভিন্ন প্রস্তাবে। এ পরিবর্তন ও পরিমার্জনের বিষয়টি প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের ভাষায় ভুল ও অসদাচরণ এবং বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে এটি সরাসরি প্রতারণা।
কী পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, তা দেশবাসীর অজানা নয়। আওয়ামী লীগই আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে তত্কালীন বিএনপি সরকারকে বাধ্য করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে। সংবিধানে এ ব্যবস্থা সংযোজিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ তখন গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে বলে দেশজুড়ে ঢোল পিটিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ বলেছিল, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগণের আন্দোলন বিজয়ী হয়েছে। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কেয়ারটেকার সরকারের দাবি আদায়ের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।’ আবার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তাদের সে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আর এ ইতিহাস আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।’ এ বিষয়ে বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ মাসুদ মোস্তফার বক্তব্য, ‘যা আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়, তা-ই ঐতিহাসিক। হিন্দু ধর্মে একটা কথা আছে, দেবতা করলে হয় লীলা খেলা, আর পাপ হয় মোদের বেলা।’ মূলত আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও রাজনীতিতে নিজেদেরকে দেবতাতুল্যই মনে করে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য যখন তারা আন্দোলন করে তা হয় ঐতিহাসিক, আবার আওয়ামী লীগ তা বাতিল করলেও হয় ঐতিহাসিক। সাংবিধানিক ও বৈধ সরকারকে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতাচ্যুত করলে তা যদি আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়, তাহলেও তা ঐতািসিক (সূত্র : দৈনিক দিনকাল, তাং-১৪/১০/১২)।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেদনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ভালো ছিল, আজ এত খারাপ হলো কেন? সত্য হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আবার আওয়ামী লীগের পক্ষে জয়লাভ করা এবং ক্ষমতায় যাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিচারপতি খায়রুল হককে যে কারণে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল, বিরোধী দল তাকে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে না নেয়, তাহলে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ। তাই এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরকার অবস্থান নিয়েছে। প্রায়ই আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। তাদের দাবি, বর্তমান সরকারের অধীনে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের কয়েকটি উপ-নির্বাচন সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে। কিন্তু এটা সত্য যে, আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফের আসীন হওয়া। সেক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের কয়েকটি উপ-নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন গুরুত্বহীন। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যার মাধ্যম্যেই একমাত্র সম্ভব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়া। তাই এসব বক্তব্য দ্বারা দেশবাসীকে ধোঁকা দেয়া যাবে না; কারণ দেশের মানুষ জানে, সরকার গঠন কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষে আনা চাই এবং সেটা আনতে যা যা করা দরকার, তা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবে না আওয়ামী লীগ। তাই দেশের মানুষ ও বিরোধী দল সরকারের কোনো মিষ্টি কথায় ভুলছে না এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেবে না। এ কথা আজ অস্বীকার করার কোনোই কারণ নেই যে, আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলকরণ দেশের মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। দেশের মানুষ চায় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে—যেখানে ভোটারদের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে এবং ফলাফল সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশে গণ্ডগোল, আন্দোলন, হরতাল, অবরোধসহ সংঘাতের সৃষ্টি হোক, তা দেশের মানুষ চায় না। মানুষ শান্তি চায়। বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করবে, এটাই স্বাভাবিক। ফলে রাজপথে আন্দোলন হবে, হরতাল হবে। জনগণের কষ্ট হবে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুখের মতো অনেক নেতাকর্মীর দেহ থেকে আরও হয়তো রক্ত ঝরবে। রাজপথ রক্তাক্ত হবে। হামলা-মামলা হবে। গ্রেফতার হবে রাজনৈতিক অনেক নেতাকর্মী। রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। রাজনীতিবিদদের মনে রাখা প্রয়োজন, ‘জোর করে ক্ষণিকের জন্য ক্ষমতায় থাকা বা আসা যায়, কিন্তু জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থন পাওয়া যায় না।’ গণআন্দোলনের স্রোতে একদিন না একদিন স্বৈরাচারকে বিদায় নিতে হয়। সেটি কোনো সময়ই কারও জন্য সুখকর হয় না; মঙ্গলজনকও হয় না দেশ ও জাতির জন্য। এর জ্বলন্ত উদাহরণ নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া তিউনিশিয়া, মিসর ও লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন। সিরিয়ার বর্তমান অবস্থাও এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
পরিশেষে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, দয়া করে জনগণের মতামতকে সম্মান জানিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আগামী সংসদ অধিবেশনে পুনর্বহাল করে দেশকে সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা করুন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ভূমিকা রাখুন। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিন। দেশের মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিন। পাশাপাশি দেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক ও রাজনৈতিক দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে বর্তমান সরকারকে রাজি বা বাধ্য করাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে—আজকে দেশের ক্রান্তিকালে দেশবাসীর এই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
mondalsh52@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads