আমানুল্লাহ কবীর
বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক সপ্তাহের ব্যবধানে চীন ও ভারত সফর করেছেন। এ দু’টি দেশই অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে বিশ্বের উদীয়মান শক্তি। ভৌগোলিকভাবে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন প্রতিবেশী, চীন সীমান্তসংলগ্ন না হলেও নিকট প্রতিবেশী। আয়তনে ও জনসংখ্যায় এ দু’টি দেশই বিশাল। ুদ্র ও অনুন্নত বাংলাদেশের অবস্থান এ দু’টি দেশের মাঝখানে। আয়তনে ুদ্র হলেও ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের অবস্থান চীন ও ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি বাংলাদেশের কাছেও চীন ও ভারতের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা ভারতবিরোধী বলে পরিচিত খালেদা জিয়ার ভারত সফরকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার এবারের সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন প্রেক্ষাপটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের সময় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর ও বন্ধুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ক্ষমতার হাতবদল হলেও যেন এ ‘সুসম্পর্ক’ বজায় থাকে, এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ভারত তার কূটনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করেছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবেই খালেদা জিয়া ক্ষমতায় না থাকলেও তাকে দিল্লি সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণের সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। সব ঠিকঠাক থাকলে সংবিধান অনুসারে আগামী এক বছর পরই বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল ইতোমধ্যেই দিল্লিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
২৮ অক্টোবর থেকে সাত দিনের সফরের সময় খালেদা জিয়ার সাথে ভারতের শীর্ষপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সবার সাথেই বৈঠক হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন ও পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজের সাথে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে মনমোহন সিং খালেদা জিয়ার সম্মানে যে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন, সেখানে বিজেপি নেতা ও সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানিও উপস্থিত ছিলেন।
খালেদা জিয়ার ভারত সফরের আগে লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্বিমাসিক জার্নাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস-এর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় তার একটি লেখা ছাপা হয়। লেখাটির বাংলা অনুবাদ ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। লেখাটি ভারত সফরের প্রস্তুতি পর্বের অংশ বলে প্রতীয়মান হওয়ায় তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্ধৃতি যোগ করা এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন : ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়, এর রয়েছে জোরালো ঐতিহাসিক ভিত্তি। পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধাবোধের দিকটিতে গুরুত্ব দিলে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আরো জোরদার করার সুযোগ বিপুলভাবেই অবারিত। আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং যৌথ ইতিহাসই হওয়া উচিত আমাদের সম্পর্কের সূচক।… ‘আমি মনে করি, এই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হলে প্রথমেই আমাদের একসাথে বসতে হবে এবং যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে তুলে ধরতে হবে। খোলামেলা মুক্ত আলোচনা আর সমঝোতার মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্বে আলোড়ন তোলেÑ এমন ঘটনার মধ্যে রয়েছে যৌথ নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা এবং সীমান্ত সমস্যার মীমাংসা (যা আমরা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি)। একই সাথে সীমান্তের উভয় দিকেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও আমাদের আমলে আনতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে, কোনো পক্ষই পরস্পরের স্বার্থের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবে না। এসব জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করাই আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।… ‘আমাদের ঐতিহাসিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন কোনো কারণ কি আছে, যে জন্য ভারত ও বাংলাদেশ তাদের অভিন্ন লক্ষ্য হাসিল করতে পারে না? এ লক্ষ্যগুলো তখনই ভালোভাবে অর্জন করা যাবে যখন স্বচ্ছভাবে এবং পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে সম্পর্কের চর্চা হবে। স্থিতিশীলতার স্বার্থে জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কাজ করা জরুরি। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, এসব লক্ষ্য যাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশেই অর্জিত হয়, তা নিশ্চিত করা। যেসব সমস্যা গুরুতর ও উত্তপ্ত, সেসবকে জিইয়ে না রাখাই হলো পররাষ্ট্রনীতির গতিশীলতা যাচাইয়ের শর্ত।… ‘সবারই প্রয়োজন হলো সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করায় একসাথে কাজ করা এবং পরস্পরকে সহযোগিতা করা। আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন রকম কার্যক্রম রয়েছে, যার সুযোগ আমরা নিতে পারি।… ‘ভারতের জনগণের প্রতি আমার বার্তা হলো বন্ধুত্বের ও বোঝাপড়ার। নিকট প্রতিবেশী হওয়ার পাশাপাশি বসবাসই আমাদের নিয়তি এবং তা করতে হবে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে মাধ্যমে। পরস্পরের কোনো অমঙ্গল আমাদের চাওয়া হতে পারে না, নিজেদের মধ্যে শত্রুতাও আমরা বহন করতে পারব না।’
বেগম খালেদা জিয়ার এ লেখার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, তার দলের নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের সাথে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। এই পুনর্মূল্যায়িত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই তিনি দিল্লি সফরে গেছেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ দিল্লির নীতিনির্ধারকদের সাথে আলোচনা করেছেন। তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতকে পাশাপাশি বসবাস করতে হবে, এটাই নিয়তি। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি বলেছিলেন, আমাদের বন্ধু বাছাই করার সুযোগ রয়েছে, প্রতিবেশী বাছাইয়ের সুযোগ নেই। এটাই বাস্তবতা। তবে ুদ্র বাংলাদেশের মতো দেশের প্রতিবেশী যখন ভারতের মতো বিশাল দেশ হয়, তখন এ বাস্তবতা কঠিন ও নির্মম। এই কঠিন ও নির্মম বাস্তবতার অনেক উদাহরণই আমাদের সামনে রয়েছে। তারপরও দুই দেশকে প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে হবে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে। খালেদা জিয়া তার নিবন্ধে বলেছেন, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা ও দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতেই দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধান এবং টেকসই বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে পারে। গত বিএনপি সরকারের সময় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল। সেটা মাথায় রেখেই ভারত সরকার খালেদা জিয়াকে দিল্লি সফরে আমন্ত্রণ জানায়। চাণক্য কূটনীতির উত্তরাধিকারী দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা লাভালাভের অঙ্কটা ভালো বোঝেন। বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা সে অঙ্কে কতটুকু পাকা, তা সময়ই বলে দেবে। যা হোক, যে সমস্যা ও বিষয়গুলো দিল্লিতে খালেদা জিয়ার সাথে আলোচনা হয়েছে, তার কোনোটিই নতুন নয়। বরং দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো দীর্ঘ দিনের, যা বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই মোকাবেলা করে আসছে। এসব দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের কোনো হাত নেই, সম্পূর্ণভাবে তা নির্ভর করে ভারতের ওপর। এসব অনিষ্পন্ন দ্বিপক্ষীয় সমস্যার মধ্যে রয়েছে তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানিবণ্টন, সীমান্তে বিএসএফের নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্ত প্রটোকল চুক্তি বাস্তবায়ন ও তিনবিঘা করিডোর হস্তান্তর, ছিটমহল হস্তান্তর বা বিনিময়, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ (যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে), বাণিজ্য ঘাটতি প্রভৃতি। এসব সমস্যার শিকার এককভাবেই বাংলাদেশের জনগণ। এ ছাড়া ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দু’টি ইস্যু হচ্ছে : ভারতের বিুব্ধ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ও বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ দিল্লির নীতিনির্ধারকদের সাথে প্রায় সব বিষয়েই খালেদা জিয়ার আলোচনা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলো বিশেষত তিস্তার পানিবণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সমাধানের ব্যাপারে এরা বরাবরের মতো আশ্বস্ত করেছেন। তবে ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দু’টি বিষয়ে তারা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে ওয়াদা আদায় করেছেন। মনমোহন সিংয়ের সাথে বৈঠকে খালেদা জিয়া বলেছেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। কানেকটিভিটি (বা সংযোগব্যবস্থা বা ট্রানজিট সুবিধা) ইস্যুতে খালেদা জিয়া বলেছেন, এ সংযোগব্যবস্থা কেবল বাংলাদেশ নয়, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে হবে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল হলেও যাতে ভারতের জন্য এ দু’টি সুবিধা অব্যাহত থাকে, তা নিশ্চিত করাই ছিল দিল্লিতে খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণের প্রধান উদ্দেশ্য। এটা দিল্লির নতুন কূটনৈতিক কৌশল। তারা লক্ষ করেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই ক্ষমতার হাতবদল হয়। কাজেই আওয়ামী লীগ বিশ্বস্ত হলেও এককভাবে তার ওপর নির্ভর করলে প্রাপ্ত সুবিধা বিঘিœত হতে পারে। সুতরাং তারা বিএনপির সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি (যিনি বাঙালি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় এ উদ্যোগ নেন। তখন তিনি ঢাকা সফরে এলে খালেদা জিয়ার সাথেও সাক্ষাৎ করেন। সুতরাং রাষ্ট্রভবনে প্রণব মুখার্জি তাকে উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানাবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। দিল্লিতে বিরোধীদলীয় নেতা নয়, ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই খালেদা জিয়াকে সম্মান দেয়া হয়েছে। মনে হয়, দিল্লির মেহমানদারি খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গীদের অভিভূত করেছে। তারা এক সুরে এ সফরকে সফর বলে উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ট্রানজিটসহ ভারতকে নিঃশর্তভাবে যেসব সুবিধা দিয়েছে, তা জনসমর্থন অর্জন করতে পারেনি। এতে বরং সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারতের ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য পরাজয়ের যে আশঙ্কা করছে দিল্লি, তার অন্যতম প্রধান কারণ ভারতের সাথে হাসিনা সরকারের অসম বন্ধুত্ব। এ বন্ধুত্বের বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে তেমন কিছু দেয়নিÑ নিয়েছে। সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষা না করে ও আর্থিক সুবিধা ছাড়াই এ সরকার ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। সব দ্বিপক্ষীয় সমস্যাও অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। যে এক বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি হয়েছিল, তা-ও ভারত ছাড় দেয়নি। দিল্লি শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবে ঘটেনি। ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে ভুটান-বাংলাদেশ ও নেপাল-বাংলাদেশ বাণিজ্য হওয়ার কথা ছিল, ভারত সেই সুবিধা এখনো দেয়নি।
বেগম খালেদা জিয়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সাথে আলোচনায় বলেছেন, আমরা অতীত নয়, সামনের দিকে তাকাতে চাই। সামনের দিকে তাকিয়ে কতটুকু এগোতে পারবেন, তা প্রধানত নির্ভর করে দিল্লির ওপর। আগামী এক বছর পরই হাসিনা সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং তত দিনে উল্লিখিত সমস্যাগুলো নিষ্পন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে এসব সমস্যা সমাধানের দায়ভার পরবর্তী সরকারের ওপরই পড়বে, অর্থাৎ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরবর্তী সরকার গঠিত হলে তাকেই এ দায়ভার নিতে হবে। বিএনপির ভারতবিরোধী অতীত ভুলে গিয়ে ভারত তখন ‘বড় ভাই’সুলভ আচরণ পরিহার করে সহযোগিতার হাত কতটুকু প্রসারিত করবে, তার ওপর নির্ভর করেই সূচিত হবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন মোড়।
খালেদা জিয়ার দিল্লি সফর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতৃত্বকে উদ্বিগ্ন করেছে এবং তারা নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। খালেদা জিয়ার দিল্লি সফর শেষে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা দিল্লি গেছেন বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়ার জন্য। খোঁজখবর নেয়ার পরই হয়তো প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরের ব্যাপারে মুখ খুলবেন। আমাদের দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী প্রচারণায় ভারত একটা জোরালো ইস্যু এবং ভারতপ্রীতির জন্য আওয়ামী লীগকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এ দিক থেকে খালেদা জিয়ার দিল্লি সফর আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটাই শাপে বর হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতিও এখন আগের মতো পালে হাওয়া পাবে না। ভারতের জন্য অবশ্যই এটা একটা পাওয়া।
এবার খালেদা জিয়ার চীন সফর বিষয়ে আসা যাক। গত বিএনপি সরকারের সময় চীনের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল তাইওয়ানকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়ায়। খালেদা জিয়া প্রায় এক বছর আগেও চীন সফরে গিয়েছিলেন। তবে তার এবারের সফর ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। বেইজিং সফরের পরই তিনি দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন। ফলে বিশেষত আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বিশ্বের এই দুই উদীয়মান শক্তির মনোভাব কী, তার সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। বেইজিংয়ে আলোচনার অভিজ্ঞতা নিয়েই খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই দিল্লির সাথে আলোচনা করেছেন। চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত আবেগ জড়িত, কারণ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ই চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্যই তিনি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন, যে জন্য ভারত কখনো তাকে সুনজরে দেখেনি এবং তাকে ভারতবিরোধী মনে করত। বর্তমানে চীন ও ভারত প্রতিবেশী হিসেবে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার নীতি অবলম্বন করলেও এ অঞ্চলে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি বাংলাদেশকে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে দেখতে চায়। এমন স্পর্শকাতর বাস্তবতার মুখে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে তা নির্ধারণ করা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সাথে বৈরী সম্পর্ক রেখে যেমন এগোনো সম্ভব নয়, তেমনি চীনকে উপেক্ষা করেও সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে চীন দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করবে। এ বাস্তবতা সামনে রেখেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। নয়তো বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
বেইজিংয়ে খালেদা জিয়ার সাথে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, যিনি আগামী বছর প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে আশা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট শি বলেন, তার দেশ চট্টগ্রাম ও কুনমিংয়ের মধ্যে সড়ক ও রেলপথ নির্মাণে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। বঙ্গোপসাগরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও তিনি তার দেশের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ দু’টি বিষয়ই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিকে দিল্লিতে খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে শিবশঙ্কর মেননও সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারতের অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, চীন-ভারত মিলেই এ কাজ করতে পারে। চট্টগ্রাম-কুনমিং সড়ক ও রেল যোগাযোগ বাণিজ্য ছাড়াও বাংলাদেশের জন্য অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে তিন দিকেই ভারত ভূখণ্ড দিয়ে পরিবেষ্টিত, বঙ্গোপসাগর ছাড়া বের হওয়ার আর কোনো পথ নেই। চট্টগ্রাম-কুনমিং যোগাযোগ স্থাপন হলে বাংলাদেশ স্থলপথে বের হওয়ার সুযোগ পাবে। স্থলপথে এই সংযোগব্যবস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হলে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের দেশগুলো, বিশেষত চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অংশীদার হতে পারবে।
চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করা যত সহজ ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করা তত কঠিন ও জটিল। কারণ বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত সব সময় তার আধিপত্য বজায় রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে বৈঠকের পর খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, তার ভারত সফর সফল হয়েছে। অত্যন্ত আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। যে আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা ভারত দেখিয়েছে, তাতে আমি অভিভূত। তবে এটাও ঠিক যে, দিল্লির উদ্দেশ্যও সফল হয়েছে। দিল্লি এখন বিএনপিকে পর্যবেক্ষণে রাখবে এবং ভবিষ্যতে ফলাফল হিসাব-নিকাশ করে দেখবে তাদের ভাণ্ডে কী জমা পড়ল, যার ভিত্তিতেই নির্ধারণ করবে বিএনপি কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। এর পরও এটা বলা ভুল হবে না যে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই ভারতের একমাত্র পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত বন্ধু।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন