ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
সরকারের সব কর্তা এখন একই রা করতে শুরু করেছে। আর তা হলোÑ প্রতিহত করা হবে। এই প্রতিহত করার কাজে তারা কখনোই জনগণের শক্তির ওপর ভরসা করতে পারেনি। এ কাজে তারা ব্যবহার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় মাস্তানদের। এ ব্যাপারে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই। প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের মাস্তানরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে লাঠি, রামদা আর পিস্তল নিয়ে এই ‘প্রতিহত’ করার কাজে অংশ নিচ্ছে। সরকার এটা উপলব্ধি করতে পারছে না যে, কারো জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী নয়। একসময় না একসময় এ সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে যেতেই হবে। সেটি নির্বাচন হতে পারে, সিজারিয়ানের মাধ্যমে হতে পারে, হতে পারে অন্য কোনো পথেও। কিন্তু এক ‘আঁতাতে’র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়ে সরকার ধরাকে একেবারে সরাজ্ঞান করতে শুরু করেছে। তারা এখন অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের পরোয়া করছে না। বরং তাদের দলীয় মাস্তানদের দায়মুক্তির আশ্বাস দিয়ে একেবারে বেপরোয়া করে তুলেছে। আর দায়মুক্তি যে তারা দেন, তার প্রমাণও ভূরিভূরি। হত্যা মামলায় দণ্ডিত ফাঁসির জন্য অপেক্ষমাণ আসামিদের এই সরকার রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় জেল থেকে বের করে এনে সার্কিট হাউজে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। তার অর্থ দাঁড়াল, যাও বিরোধী পক্ষের লোকদের নির্বিচারে হত্যা করো। তোমাদের কোনো বিচার হবে না। তারা করছেও তাই।
কিন্তু বিচার একদিন হবেই। সে বিচার মানুষের আদালতেও হতে পারে, প্রকৃতিও তার বিচার করে দিতে পারে। তার ওপর মহান আল্লাহ তায়ালার আদালত তো আছেই। এসব বিষয়ে ভাববার অবকাশ এই সরকারের নেই। পৃথিবীর সব স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী সরকারেরই এমন হয়। নির্বাচনে বিজয়ের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণ শুনলাম। সে ভাষণে তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে হবে। এর উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তার জন্য কাজ করে যেতে হবে সবাইকে। এই যে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিÑ এটা একটা জাতির প্রাণশক্তির উৎস। একে ভুলে গেলে সে জাতির বিনাশ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সরকার সে বিনাশ আরো ত্বরান্বিত করে তুলেছে। মিথ্যা দিয়ে সব ইতিহাস মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় ঐক্যের বদলে দেশে অবিরাম বিভেদ রচনা করছে ও বিভেদের বীজ রোপণ করে যাচ্ছে। সম্ভবত এ সরকারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে এখন প্রতিহত করার সময় এসে গেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ধর-মার-কাট নীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের লোকদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের পিটিয়ে লাশ বানাতে হবে। জাসদের হাসানুল হক ইনু এখন বড় বড় কথা বলছেন। তাকে কখনো কখনো প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যাচার-নির্যাতন যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখন তিনি কী করেছিলেন? এই নির্যাতন প্রতিহত করার জন্য তারা গণবাহিনী গঠন করেছিলেন। আর দেশের সাধারণ মানুষ এই গণবাহিনীকে আশ্রয় দিয়ে গরু-ছাগল জবাই করে খাইয়ে সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিল। গণবাহিনী তখন দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। কোনো গ্রামে গণবাহিনী আছে শুনলে রক্ষীবাহিনী পর্যন্ত সে গ্রামে যেতে দশবার চিন্তা করত। কেন এমন হয়েছিল আশা করি সেটা ইনু সাহেবকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।
ইনু সাহেবের বোধ করি জানা আছে, যারা রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছিল তাদের বহু লোক রাজাকারি পরিত্যাগ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। সে ছিল এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। আর মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের সাদর সম্ভাষণে গ্রহণ করেছিলেন। অন্তত আরেকটি অস্ত্র তো পাওয়া গেল। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। সেটা অত্যন্ত বিজ্ঞজনোচিত সিদ্ধান্ত ছিল। তখন যদি তিনি লোম বাছতে বসতেন, তাহলে কম্বল উজাড় হয়ে যেত। বিপ্লব-পরবর্তী পৃথিবীর সব সরকারের মতো তিনিও একত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার লড়াইয়ে শরিক হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখন যে ‘বিচার’ চলছে তার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাচেতনার কোনো সাযুজ্য নেই। অথচ মুখে ফেনা তুলে বর্তমান সরকার ‘শেখ মুজিবের বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নের কথা বলছে। অধ্যাপক গোলাম আযম বলি, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলি, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের কথা বলি, কামারুজ্জামান কিংবা আবদুল কাদের মোল্লার কথা বলি কিংবা বলি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কথা। তাদের কাউকে সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান সরকার অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করেনি। যে লক্ষাধিক লোককে তৎকালে ‘দালাল’ বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল সে তালিকায়ও এদের কারো নাম ছিল না।
তাহলে এদের দোষ কী? এরা রাজাকার। রাজাকারদের তো শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমাই করে দিয়েছিলেন। আর আওয়ামী লীগেও হাজার হাজার রাজাকার আছে। এমনকি এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বাবাও ভয়াবহ রাজাকার ছিলেন। যদি রাজাকারদেরই বিচার হবে তাহলে আওয়ামী লীগার রাজাকারদের বিচার হবে না কেন? বিএনপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এখন আটক আছেন। এ এক মহাধন্ধ। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দোষ সম্ভবত এই যে, তিনি অকপটে কোদালকে কোদাল বলেন, কোদালকে গোলাপফুল বলেন না। তারও বিচার করা হচ্ছে। বিচারে যে কী হবে, ট্রাইব্যুনাল যা-ই বলুক, সাধারণ মানুষের কাছে তা যেন অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাক্ষীরা জানাচ্ছেন, তাদের ওপর সরকারি দলের লোক ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা বল প্রয়োগ করছেন এবং নানা কথা বলতে বাধ্য করছেন। সরকার পক্ষের সাক্ষী বিরোধীপক্ষের সাক্ষী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এবং জামায়াত নেতাদের আইনজীবীর গাড়ি থেকে সেই সাক্ষীকে সরকার অপহরণ করে নিয়ে গেছে। আর কী আশ্চর্য দেশ যে, সরকার তাদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে বসেছে।
এখন খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে সরকার যে বিচারকার্য পরিচালনা করছে তা ভয়াবহ এক রাজনৈতিক খেলা। জামায়াতে ইসলামী একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ দলকে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। তা যদি না-ই করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যে পৈশাচিক নির্যাতন চলছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধু তাই নয়, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোথায় জামায়াত-শিবির আছে তা পুলিশ ও ছাত্রলীগ দিয়ে শনাক্ত করে শিবিরের শিক্ষার্থীদের মেসে মেসে হামলা চালানো হয়েছে। শয়ে শয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে টেলিভিশনে বলতে শুনলাম, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তারা যেখানে জামায়াত-শিবির পায় গ্রেফতার করে যেন পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ এক ভয়াবহ বক্তব্য। টেলিভিশনে তার মুখ থেকে এ বক্তব্য না শুনলে একজন অভিজ্ঞ আমলা থেকে মন্ত্রী হয়ে এ ধরনের ভয়াবহ কথা কেউ বলতে পারেন তা বিশ্বাস করা মুশকিল হতো। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথায় অথবা আইনের কোন ধারায় একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অন্য দলের কর্মীদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারবেন কি? এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দেশকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চান? হ্যাঁ, আমি ইসলামী মতাদর্শে বিশ্বাস করি। ইসলামের আদর্শ আমার আদর্শ, ইসলামের শিক্ষা আমার শিক্ষা। এর মধ্যে অপরাধ কোথায় সেটা বোঝা দুষ্কর। এখন এমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন ইসলাম মানেই জঙ্গিবাদ। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে সরকারের এই ভয়াবহ সন্ত্রাস কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরের মিছিলে পুলিশ ও আওয়ামী মাস্তানরা অবিরাম হামলা চালাচ্ছে। সে হামলায় কী নৃশংসভাবে সর্বশক্তি দিয়ে একেকজন শিবিরকর্মীকে পেটানো হচ্ছে তা চোখে দেখা যায় না। টেলিভিশনের ফুটেজে আর পত্রিকার পাতায় সে দৃশ্য দেখি। পাকিস্তান আমল ও শেখ মুজিবের আমলেও আমরা কখনো দেখিনি যে, পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষের ওপর গুলি করছে। এখন দেখি পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ অবৈধ অস্ত্রে ম্যাগাজিন লোড করছে। ছাত্রলীগ আর পুলিশ একাকার হয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। প্রতি মাঘ মাসে কঠোর শীত পড়ে। সে শীত সামনে। কিন্তু এক মাঘে যে শীত যায় না সেটা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কেউই উপলব্ধি করতে পারছে না। শেখ হাসিনা তো ঘোষণাই করে দিয়েছেন, তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ তায়ালা তত দিন তাকে জীবিত রাখুন।
কিন্তু জীবন-মৃত্যু আমাদের হাতে নেই। কোনো কোনো শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মাতৃগর্ভে মারা যায়। কোনো কোনো শিশু মারা যায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, কেউ কেউ কয়েক দিনের মধ্যেই। কোনো কোনো তরুণ-যুবা একেবারেই প্রারম্ভ যৌবনে মৃত্যুবরণ করে। যে মৃত্যুর জন্য কেউ প্রস্তুত থাকে না। যেমন মহিউদ্দীন খান আলমগীর ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের ছেলে। তাদের জন্য আমার গভীর সমবেদনা আছে। আমার সন্তানসন্ততিরা তাদের চেয়েও হয়ত বয়সে বড়। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু আমাকে যদি আমার কোনো সন্তানের লাশ কাঁধে নিতে হয় তাহলে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দীন খান আলমগীর বা জাহাঙ্গীর কবির নানকের যে কষ্ট হয়েছে, সে কষ্ট আমারও হতো। আল্লাহ তায়ালা কখন যে কাকে নিয়ে যাবেন সেটা তিনিই জানেন। এমনকি আমাদের এই দেশেও কেউ শতাধিক বছর বাঁচে, কেউ বিশ বছরও বাঁচে না। এটা নিয়তি কিংবা প্রকৃতি। শেখ হাসিনা সম্ভবত এসব বিষয়ে অবহিত নন।
কিন্তু জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও তাদের ওপর সরকার এখন যে নিষ্ঠুর নির্যাতন অভিযান পরিচালনা করছে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। শুধু জামায়াত-শিবির বলি কেন, কোনো বিরোধী দল দেশে কোনো দাবি আদায়ের জন্য মিটিং-মিছিল করতে পারবে নাÑ এই হয়েছে সরকারের নীতি। বিএনপির মহাসমাবেশ বানচাল করার জন্য এমন কোনো অপকর্ম নেই যা সরকার করেনি এবং এখনো বিএনপির মিটিং-মিছিল দমন করার জন্য সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে তা কোনোভাবেই গণতন্ত্রসম্মত নয়। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।
দেশের মিডিয়া এমন চিত্রও প্রচার করেছে, পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ পিস্তলে গুলি লোড করছে, প্রচারিত হয়েছে সমস্ত শারীরিক শক্তি দিয়ে পুলিশের লাঠি নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা বিরোধী দলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। পুলিশবাহিনীর সদস্যদেরও এ কথা মনে রাখতে হবে, তাদের চাকরিজীবনে এ সরকারই শেষ সরকার নয় এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কোনোভাবেই ২০২১ সাল পর্যন্ত এই মহাদুর্নীতিবাজ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। সরকার অস্থায়ী। তাদের চাকরি স্থায়ী। সুতরাং সাবধান হওয়াই ভালো।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন