ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে গত ১১ নভেম্বর মাকে বুকে ও বোনকে পায়ে গুলি করে অপহরণ করা হয়েছিল শিশু পরাগকে। অপহরণের তিন দিন পর গত ১৩ নভেম্বর রাত ১২টায় ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা বাজারের সড়কের পাশ থেকে পরাগকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেছে তার পরিবার। এরপর স্বজন ও গোয়েন্দা পুলিশ ছয় বছরের শিশু পরাগকে রাজধানীর পান্থপথে স্কয়ার গাসপাতালে নিয়ে আসে। একজন বাবা হিসেবে পরাগের অপহরণের পর দারুণ অস্বস্তিতে ছিলাম। পরাগের স্কুলের বন্ধুরা যখন সতীর্থের জন্য মানববন্ধন করে তাকে মুক্ত করার আকুতি জানিয়েছে, অভিভাবকরা যখন বেদনা প্রকাশ করেছেন, তখন আমার অস্বস্তি বেড়েছে আরো বেশি।
আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যখন টেলিভিশন সাাৎকারে বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি দেখছেন তখনো অস্বস্তি কাটেনি। কেননা আমাদের সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরাসহ আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা বারবার আশ্বাস দেয়ার পরও শিশু মেঘের বাবা-মা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যার এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে পরাগের মুক্ত হওয়ার সংবাদ স্বস্তি দিলেও তার শারীরিক অসুস্থতার সংবাদ, ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ প্রদান এবং অপহরণকারীদের গ্রেফতার না হওয়ার বিষয়ের জন্য এখনো প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছি।
র্যাবের সূত্রে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ পাওয়ার পর অপহরণকারীরা শিশু পরাগকে রাস্তায় রেখে যায়। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, পরাগের বাবার সাথে অপহরণকারীদের টেলিফোন সংলাপ, ‘হ্যালো বিমল? তুই কি ঠিক করেছিস? শালা এখনো টাকা ম্যানেজ করতে পারিসনি? এত বড় ব্যবসায়ী। টাকা বড় নাকি তোর পোলার জীবন বড়?’ অপহরণকারীদের সাথে পরাগের বাবার কয়েক দফা টেলিফোন আলাপের পুরো রেকর্ড এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পরাগ মণ্ডলকে জীবিত অবস্থায় তার মা-বাবার কাছে ফেরত পাঠানো, তবে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেয়ার কোনো বস্তুনিষ্ঠ খবর আমাদের কাছে নেই।’ আবার মন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছেÑ সন্ত্রাসীরা যে শর্ত দিয়েছিল তা মানা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, অপহরণকারীদের কী শর্ত ছিল এবং তা মানা হয়েছে। যদিও পরাগের দাদী বলেছেন, টাকা গেছে দুঃখ নেই, নাতি তো ফিরে এসেছে। বিমল মণ্ডলের ভগ্নিপতি বলেছেন, ‘গোল্ড কিনতে গিয়েছি। ফ্রি তো গোল্ড পাওয়া যায় না।’
নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, পরাগ অপহরণের মূল হোতাকে গ্রেফতার না করা গেলেও অপহরণের সাথে জড়িত সাত-আটজনের মধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল হাসান বলেছেন, রাজধানীর এক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী এই অপহরণের সাথে জড়িত। কিছুদিন আগে সে জেল থেকে ছাড়া পায়। টাকার জন্য সে শিশুটিকে অপহরণ করে। ছয়-সাত অপহরণকারী শিশুটির বাবার কাছে প্রথমে দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে এটা কমিয়ে এক কোটি টাকা চায়, সব শেষ ৫০ লাখ টাকায় রফা হয়। র্যাবের এই বক্তব্য মন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে ভিন্নতা প্রমাণ করে। যদিও পরাগের বাবা জে কে ব্যাটারি কোম্পানির মালিক বিমল মণ্ডল আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। মুক্তিপণের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। শহরের শিশু স্কুলগুলোতে প্রতিদিন মায়েরা তাদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যান, বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এটি নৈমিত্তিক চিত্র। পরাগের অপহরণের ঘটনা যদি এসব মায়ের হৃদয়ে স্থায়ী আশঙ্কা সৃষ্টি করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমাদের দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, গুমের ঘটনা দেখে আমরা এত অভ্যস্ত যে, স্বস্তিকর সংবাদ আমাদের খুশি করে না। এখনো পর্যন্ত বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণের ঘটনার কোনো হদিস মেলেনি। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আকতারকে ঢাকায় সাদা মাইক্রোবাসে করে যে অপহরণ করা হলো তারও কোনো সংবাদ মেলেনি। শামীমের স্ত্রী ঝর্ণা আক্তার ও সন্তানদের চোখের পানি এখনো ঝরছে। শামীমের স্ত্রীর টেলিফোন কল আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ধরি না, কেননা শামীমের উদ্ধারবিষয়ক কোনো উত্তর আমার জানা নেই। পত্রিকা পড়ে জানলাম, আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর পেতে রাখা জালে পরাগ উদ্ধার হয়েছে।
মুক্তিপণের বিষয়টি বাদ দিলে পরাগ উদ্ধার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশংসা করতে হবে। কিন্তু তাদের পেতে রাখা জালে অপহরণকারীদের গ্রেফতার না হওয়াটি সুখসংবাদ নয়। মনে প্রচণ্ড অস্বস্তি বিরাজ করলেও আমি হতাশ নই, বিশ্বাস করি বাকি অপহরণকারীরা গ্রেফতার হবে। আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর যে সুনাম নানা ঘটনায় পিছিয়ে গেছে, সেটি পরাগ অপহরণকারীদের গ্রেফতার ও আইনে সোপর্দ করার ভেতর দিয়ে গৌরবের সাথে ফিরে আসবে। যদিও এই সরকারের আমলে গত ১৪ নভেম্বর সংসদে প্রদত্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ২১ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মা প্রাপ্তির সংবাদ পড়ে দারুণ অস্বস্তি ও মনঃকষ্টে আছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন