শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১২

দুই নেত্রীর ২৮ নবেম্বরের ভাষণ



গত ২৮ নবেম্বর একই দিনে দুটি জনসমাবেশ হয়ে গেলো। একটি রাজধানীর পল্টন এলাকায়, অন্যটি টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলায়। ১৮ দলের আহবানে প্রথমটি পরিণত হয়েছিল মহাসমাবেশে, অন্যদিকে ধনবাড়ির জনসভা প্রকৃতপক্ষে ছিল সরকারি খরচে আয়োজিত আওয়ামী লীগের দলীয় সমাবেশ। উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে আলাদা হলেও এই উপলক্ষে বহুদিন পর দুই নেত্রীকে সামনে থেকে দেখার এবং সরাসরি তাদের বক্তব্য শোনার সুযোগ পেয়েছিল সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী বুলেটপ্রুফ নিরাপত্তা খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ে দূরত্বের সৃষ্টি করলেও বেগম খালেদা জিয়া মহাসমাবেশে আগত লাখ লাখ মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য বিষয হলো, দুই নেত্রীর ভাষণে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। দু'জনই আক্রমণাত্মক বক্তব্য রেখেছেন, একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে সমালোচনায় সোচ্চার থেকেছেন। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যথারীতি ছিলেন অতুলনীয় অবস্থানে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও শেখ হাসিনা পুরনো ধারাতেই আক্রমণ শানিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে কষেই এক হাত নিয়েছেন তিনি। অন্য কিছু প্রসঙ্গের মধ্যে বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন, তারা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের পথে এগিয়ে চলেছেন বেগম জিয়া তখন নাকি সে বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর এবং দেশকে হানাহানির দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রী তার স্বরে ঘোষণা করেছেন, খালেদা জিয়া যতো চেষ্টাই করুন না কেন, ‘বাংলার মাটিতে' (বাংলাদেশের নয়!) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ‘হবেই হবে'।
বলা দরকার, যথেষ্ট চিৎকার করলেও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে গুণগত কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পুরনো ধারাতেই আক্রমণ শানিয়েছেন শেখ হাসিনা। পুরো ভাষণে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তুলোধুনো করেছেন, তাকে ‘চোরের মা' পর্যন্ত আখ্যা দিয়েছেন এবং চার দলীয় জোট সরকারের দুর্নীতি ও লুটপাটের কল্পিত কাহিনী শুনিয়েছেন- প্রকৃতপক্ষে পুনরাবৃত্তি করেছেন। মূলত মারমুখী বক্তব্যের কারণে জনমনে আস্থাই তৈরি করতে পারেননি শেখ হাসিনা। মানুষ আসলে প্রধানমন্ত্রীর মুখে তার সরকারের কল্যাণ ও উন্নয়নমুখী কর্মকান্ডের কথা শুনতে চেয়েছিল। অন্যদিকে ক্ষমতায় আসার দীর্ঘ চার বছর পরও কেবলই বেগম খালেদা জিয়া এবং চারদলীয় জোট সরকারের সমালোচনা করার পাশাপাশি কথিত যুদ্ধারাধীদের বিচার ‘হবেই হবে' ধরনের বাগাড়ম্বর শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি, জনগণের সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী আদৌ সফল হতে পারছেন না। পারলে নিজেদের কৃতিত্বের কথাই বেশি বলতেন তিনি। তিনি অবশ্য বিদ্যুৎ খাতের মতো কোনো কোনো বিষয়ে পরিসংখ্যানসহ বানোয়াট সাফল্যের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। কিন্তু সেগুলো মানুষ বিশ্বাস করেনি। সংক্ষেপে বলা যায়, জনগণ যখন আশার কথা শুনতে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী তখনও বিরোধী দলের নেত্রীর মতো আক্রমণাত্মক ভাষণ শুনিয়ে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার ভাষণে যথারীতি এসেছে জঙ্গি প্রসঙ্গ। জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেয়ার জন্য জোট সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতেও ভুল হয়নি তার। গল্পের রাখাল বালকের মতো ‘বাঘ এলো, বাঘ এলো' বলে চিৎকার প্রধানমন্ত্রী ধনবাড়িতেই প্রথম দেননি। অন্তরালে বিশেষ পরিকল্পনা থাকায় জঙ্গিদের বিষয়টিকে তিনি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করেছেন। অন্যদিকে সত্য হলো, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই বাংলাদেশে। বস্তুত, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চারদলীয় জোট সরকার কঠোর ভূমিকা নেয়ায় ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মতো আর কোনো ঘটনা দেশে ঘটেনি। ক্ষমতাসীনদের কারো কারো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ জঙ্গি নেতাদের জোট সরকারই গ্রেফতার করেছিল। বিচারও শুরু করেছিল একই সরকার। জোট সরকারের এই কঠোর ভূমিকার কারণে এখন আর কোথাও সুসংগঠিত সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর পাওয়া যায় না। ক্ষমতাসীনরা তবু ‘জঙ্গি জঙ্গি' বলে পাড়া মাতিয়ে চলেছেন। কথাটা স্পষ্ট করেছেন বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া। একই দিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে তিনি বলেছেন, দেশে কোনো জঙ্গি নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও জঙ্গি জঙ্গি বলে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ধোঁয়া তুলে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে সরকার দেশে ইমার্জেন্সি ঘোষণার পাঁয়তারা করছে।
এভাবেই ধনবাড়ির জনসভায় প্রতিটি সমস্যার জন্য প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণরূপে চারদলীয় জোট সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে সমালোচনায় মুখর থেকেছেন। কোনো কোনো বিষয়ে ‘কিছুটা' সময় দেয়ার এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন তিনি। সব মিলিয়েই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জনগণকে উদ্দীপিত করতে পারেনি। পরিষ্কার হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও এখনো বুঝতে চাচ্ছেন না যে, দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব তার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের। দীর্ঘ চার-চারটি বছর পেরিয়ে আসার পর বর্তমান পর্যায়ে উচিত যেখানে ছিল নমনীয় ও সংযমী হওয়া, প্রধানমন্ত্রী সেখানে শুধু আক্রমণই শানিয়েছেন। ফলে মনেই হয়নি যে, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি মানার মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এবং গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানোর ব্যাপারে তার সরকারের তেমন আগ্রহ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরং এমন এক দৌড়ই শুরু করেছেন যার লক্ষণ মোটেও শুভ নয়। এখানে লক্ষণের কথাটা বলার বিশেষ কারণ রয়েছে। ইতিহাসের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যর্থতার পাহাড় তৈরি হওয়ার পর স্বৈরশাসকরা সাধারণত দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাদের কান্ডজ্ঞানও লোপ পায়। এসময়ই তারা আবোল-তাবোল বকতে থাকেন, মূলত আত্মরক্ষার উদ্দেশ্য থেকে একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নেন যেগুলো তাদের অশুভ পরিণতিকে অনিবার্য করে তোলে। পাকিস্তান যুগে ‘লৌহমানব' আইউব খানের উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রের নামে উদ্ভট শাসন ব্যবস্থার আড়ালে মোটামুটি ভালোই চালাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু এরপরই রাজনীতির ‘ভূত' চেপেছিল তার ঘাড়ে। কোনো কথা নেই, বার্তা নেই- ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে এসে হঠাৎ করে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে পুরো পূর্ব পাকিস্তানকে ক্ষেপিয়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে মামলায় এমন এক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করা হয়েছিল, যিনি ১৯৬৬ সালের মে মাস থেকে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে কারাগারে আটক ছিলেন। পদক্ষেপটি প্রেসিডেন্ট আইউব খানের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছিল। শুধু পাকিস্তানের কথাই বা বলা কেন, বাংলাদেশেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ রয়েছে। সে উদাহরণ বাকশালের নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের, যার উদ্যোক্তা ও প্রধান নেতা ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সামান্য সফলতার প্রমাণ রাখতে পারেননি তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে পড়তে না হলেও নিজের তৈরি ব্যর্থতার পাহাড় তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। তিনিও আইউব খানের মতো দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারও কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। এজন্যই সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য চিৎকার করে আসার পর হঠাৎ করে তিনি প্রথমে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর বাকশাল গঠন করে এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানোর মাধ্যমে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটাই তার জন্য ‘কাল' হয়েছিল।
ইতিহাস অকারণে টেনে আনা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে লক্ষ্য করে দেখুন। তিনিও একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন যেগুলোকে সুস্থ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত বলার উপায় নেই। সর্বশেষ একটি উদাহরণ হিসেবে কথিত যুদ্ধারাধীদের বিচারের কথাই ধরা যাক। বিস্তারিত উল্লেখের পরিবর্তে বলা দরকার, নিজের পিতা যে বিষয়টির মীমাংসা করে গেছেন মূলত ভারতের ইঙ্গিতে, শেখ হাসিনা সে বিষয়টিকে নিয়েই মাতামাতি শুরু করেছেন। করেছেনও এমনভাবে যা দেখে মনে হতে পারে, দেশের এবং জনগণের আর কোনো সমস্যা নেই! যেন কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্যই জনগণ তাকে ‘ডিজিটাল' নির্বাচনে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিল! দেশের হালহকিকতের দিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। যে কেউ রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষেত্রগুলোকে একটি একটি করে পর্যালোচনা করে দেখতে পারেন। কোনো ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার সরকার জনগণের আশা-আকাক্মখা পূরণ করার ধারে-কাছে যেতে পারেনি। এর কারণ, নির্বাচনের আগে ভাষণে ও মেনিফেস্টোতে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তেমন সদিচ্ছা বা উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না। ভেতরে ভেতরে ভারতের স্বার্থোদ্ধার করাসহ তারা অন্য কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছিলেন। এসব উদ্দেশ্যের মধ্যে আর যাই থাকুক, গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চিন্তা বা সদিচ্ছা অন্তত ছিল না।  এখনো সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা। কারণ, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারের বেআইনী পদক্ষেপ এবং র‌্যাব-পুলিশ ও ক্যাডারদের হামলার ফলে বিরোধী কোনো দল মিছিল-সমাবেশ পর্যন্ত করতে পারছে না। গ্রেফতার, শ্যোন অ্যারেস্ট, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি বাড়ছে মিথ্যা মামলার সংখ্যা। ওদিকে গণতন্ত্রের প্রধান কেন্দ্র জাতীয় সংসদকে পঙ্গু করা হয়েছে প্রথম অধিবেশন থেকে। সুচিন্তিত কৌশলের ভিত্তিতে বিরোধী দলের এমপিদের বাইরে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে সংসদকে অকার্যকর করেছেন ক্ষমতাসীনরা। সরকারী দলের এমপিরাও অধিবেশনে ঠিকমতো হাজির থাকছেন না। ফলে সংসদ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সে সংসদকে দিয়েই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়েছে, জাতীয় সংসদের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ নেই ক্ষমতাসীনদের। গণতন্ত্রকে তারা নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। সংসদকে শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনের অন্যসব ক্ষেত্রকেও একেবারে তছনছ করে ফেলেছে শেখ হাসিনার সরকার। জনপ্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রই দলীয়করণ নীতির অসহায় শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ তথা আইন-আদালতকে ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছে সরকার। সরকারের ইচ্ছার কাছে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকার মানুষের সর্বশেষ ভরসার স্থল হিসেবেও কোনো প্রতিষ্ঠানকে থাকতে দিচ্ছে না। এভাবেই চূড়ান্ত স্বৈরশাসনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে চাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
সেটা তিনি চাইতেই পারেন, কিন্তু রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ সব সময় প্রধানমন্ত্রীর একার ইচ্ছাতেই চলবে- এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। কথাটা বলার কারণ, দিকভ্রান্ত প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হুমকির পর হুমকি উচ্চারণ করেছেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন গণঅভ্যুত্থান ও সরকারের পতন ঘটানোর আহবান নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। ২৮ নবেম্বরের মহাসমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া জনগণের প্রতি সরকারের পতন ঘটানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার এই আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে হলে শেখ হাসিনার সরকারকে বিদায় করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের জন্যও পথের নির্দেশনা রয়েছে তার ভাষণে। তিনি বলেছেন, অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। সে নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। খালেদা জিয়ার কথাগুলো জনগণকে উদ্দীপিত করেছে। কারণ, বিভিন্ন সময়ের সফল হরতাল, রোডমার্চ এবং সর্বশেষ মহাসমাবেশের মধ্য দিয়েও প্রমাণিত হয়েছে, জনগণের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বিএনপি ও জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে। তারা চাইলে দিনের পর দিন ধরে হরতাল করতে পারে, চাইলে ভাংচুর ও সহিংসতার মাধ্যমেও সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারে। কিন্তু খালেদা জিয়া শেখ হাসিনা নন, বিএনপিও আওয়ামী লীগের মতো গণতন্ত্র ও জনস্বার্থবিরোধী ফ্যাসিস্ট কোনো দল নয়। এজন্যই এখনও পর্যন্ত খালেদা জিয়া নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে এগিয়ে চলেছেন। আন্দোলনকে তিনি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন।
খালেদা জিয়ার ভাষণের বিশেষ কিছু দিক গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করা দরকার। যেমন তিনি বলেছেন, জেনারেল মইন উ এবং ফখরুদ্দিনদের সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল। ওই সরকার যে আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল' ছিল এবং দলের জনাকয়েক নেতা নির্যাতিত হলেও শেখ হাসিনা যে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের এজেন্ডাই এখনও বাস্তবায়ন করে চলেছেন সে কথাও বলেছেন খালেদা জিয়া। সুতরাং ওই সরকারকে অজুহাত বানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানে খালেদা জিয়ার মূলকথার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ নেই। কারণ, নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল' অবৈধ সে সরকারের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সুচিন্তিতভাবে একাকার করে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সম্ভবত ভেবে বসে আছেন, বাংলাদেশের জনগণ মাত্র সেদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতাও ভুলে যাবে। অথচ এতদিনে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জেনে গেছে, কেন ১/১১-এর নামে অবৈধ অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছিল। সুতরাং ‘দোষ'টা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার নয়। অসৎ উদ্দেশ্যে মইন উ'র মতো যারা এর অপব্যবহার করেছেন দায়ী করতে হবে তাদেরকে।
সংসদকে অকার্যকর করা থেকে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পর্যন্ত পদক্ষেপগুলোর পর্যালোচনায় দেখা যাবে, শেখ হাসিনার সরকার দেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। একই কারণে দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় করার ডাক দিয়েছেন। বলা হচ্ছে, বুদ্ধি একেবারে খুইয়ে না ফেলে থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত দমন-নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার চিন্তা ছেড়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা। কারণ, গণঅভ্যুত্থানের আঘাতে ভেসে যাওয়ার পরিণতি শুভ হয় না। তাছাড়া খালেদা জিয়া শুধু গণঅভ্যুত্থানের আহবান জানাননি, একই সঙ্গে আলোচনার দরজাও খোলা রেখেছেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করাসহ সুনির্দিষ্ট কিছু পূর্বশর্তের উল্লেখ করেছেন। গণতন্ত্রের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে সম্মত হওয়া এবং পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বেগম জিয়ার পরামর্শ শোনার ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার ধারেকাছে পর্যন্ত  যাওয়ার নাম করছেন না। তিনি বরং ইমার্জেন্সি ডেকে আনার চেষ্টা চালানোর জন্য উল্টো খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। বলেছেন, ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থার মধ্যে বিএনপিই নাকি ভালো থাকে এবং সেজন্যই বেগম জিয়া নাকি রাজপথে সংঘাতের পাশাপাশি সহিংসতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ইমার্জেন্সি জারি করানোর মতো পরিবেশ তৈরি করতে চাচ্ছেন! পর্যবেক্ষকরা কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই যুক্তিকে নিতান্ত রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। কারণ, ক্ষমতায় যেখানে শেখ হাসিনা রয়েছেন সেখানে রাজপথের নেত্রী বেগম জিয়া বা অন্য কারো পক্ষে ইমার্জেন্সি জারি করানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি করার কথা কল্পনা করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ব্যর্থতা এবং দেশ ও জাতিবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের অশুভ পরিণামের কবলে যাতে পড়তে না হয় সে উদ্দেশ্যে চেষ্টা আসলে ক্ষমতাসীনরাই চালাচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়ার মতো অত্যন্ত দায়িত্বশীল নেত্রী নিশ্চয়ই প্রমাণ ছাড়া গুরুতর অভিযোগটি তোলেননি। অনুমাননির্ভর কোনো বিতর্কে যাওয়ার পরিবর্তে বর্তমান পর্যায়ে আমরা মনে করি, ইমার্জেন্সি জারি করানোর মতো চরম অগণতান্ত্রিক কোনো পন্থায় এগোতে চাইলে সর্বোতভাবে বিপদ বাড়বে ক্ষমতাসীনদেরই। এ সম্পর্কিত উদাহরণও ইতিহাসে অনেকই রয়েছে। জানতে চাইলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নিজের পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে পারেন। সে অভিজ্ঞতা বলাবাহুল্য মোটেও মধুর নয়। এজন্যই বলা দরকার, বেগম খালেদা জিয়ার তথা ১৮ দলীয় জোটের দাবি পূরণের মধ্যেই দেশ ও জাতির জন্য তো বটেই, ক্ষমতাসীনদের জন্যও মঙ্গল নিহিত রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads