জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করতে যুবলীগের প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ফরমান জারি করেছেন, তাত্ক্ষণিকভাবে তা নাকচ করেছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান। তিনি প্রকাশ্য সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, এটা যুবলীগের কাজ নয়। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও যুবলীগ চেয়ারম্যানের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র মতবিরোধ। এতে সরকার তথা সরকারি দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কমবেশি বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে বলা যায়। কিন্তু বাক্য হচ্ছে ব্রহ্মাস্ত্র। মুখ থেকে বেরিয়ে গেলেই তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। তাই হচ্ছে। দেশবাসী ভেবে পাচ্ছেন না একটি গণতান্ত্রিক দেশে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দেখামাত্র প্রতিহত করার ঘোষণা দিতে পারেন সে দেশেরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই অপকৃষ্ট চরম উস্কানিমূলক বক্তব্যই দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যুবলীগের সমাবেশে। তিনি জামায়াত-শিবিরকে শুধু প্রতিহত নয়, খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন যুবলীগকে। এহেন দায়িত্বহীন উক্তির বিপরীতে জনগণের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আগেই মোক্ষম জবাব দিয়েছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। তিনি মন্ত্রীর বচন ফিরিয়ে দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন এবং জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুদ্ধংদেহী ফ্যাসিস্ট মনোভাবে দেশবাসী শুধু হতবাক হননি, হতাশও হয়েছেন। কারণ, প্রতিহিংসার এমন নগ্ন প্রকাশ এদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। শান্তি-শৃঙ্খলার নাভিমূল থেকে যদি এ ধরনের ধ্বংসাত্মক গর্জন বের হয় তাহলে স্বভাবতই সংশয় জাগে—কোনো অদৃশ্য খুঁটির জোরে এ ধরনের মাস্তানসুলভ বাক্য উচ্চারণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাও আবার নিজ দলীয় অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে? এ ব্যাপারে সরকার তথা দলের পক্ষ থেকে কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তা-ই এখন দেখার বিষয়। ৯ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আয়োজিত সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর যুবলীগ কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘যেখানেই জামায়াত-শিবির দেখবেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির অপতত্পরতা দেখবেন, সেখানেই তাদের প্রতিহত করবেন।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘প্রতিহত’ শব্দটি এখানে আলাদা ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে। অর্থাত্ দেখামাত্র ধরো-মারো, পিটাও-ঠ্যাঙ্গাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা যদি দলীয় লোকদের এভাবে শক্তি প্রদর্শনের জন্য প্ররোচিত করেন, তাহলে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে তিনি প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার প্রশ্নে আর কী সব নৈরাজ্যকর পন্থা অনুসরণ করছেন বা করবেন। মন্ত্রীর এসব কথার জবাব প্রতিপক্ষের তরফ থেকেই আসার কথা ছিল। কিন্তু সে সুযোগ দেননি যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বানকে তীব্র ভাষায় নাকচ করেছেন তিনি। বলেছেন, অফিসে ঢুকে জামায়াত খুঁজে পান না, আর এখানে বলছেন জনগণকে জামায়াত-শিবির খুঁজতে হবে। যুবলীগ কেন তাদের খুঁজবে? এটা তাদের কাজ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অগণতান্ত্রিক নির্দেশনায় উত্তেজিত যুবলীগ চেয়ারম্যান তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, আমি কী ডিবিতে চাকরি করি নাকি। আমি তো রাজনীতি করি। জামায়াত-শিবির খোঁজা আমার কাজ নয়। আমার কাজ হচ্ছে জনমত সৃষ্টি করা। আপনার কাজ আপনি করেন, জামায়াত-শিবির আপনি খোঁজেন। যদি না পারেন তাহলে ওই আইজি, ডিআইজি, এসপিকে ধরব। লাঠিপেটা করব। এরপর আর কথা থাকে না—যেমনি বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল। এবার নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—তিনি বাক্যসিদ্ধ কোনো মুনিঋষি নন, তার দায়িত্বহীন নৈরাজ্যকর হুকুম তামিল করার জন্য সবাই ঘাড় কাত করে অপেক্ষায় নেই। এ কাজে বরং তিনিই সফল মানুষ। আজকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রিত্ব সেই সাফল্যের একটি ধাপ! তল্পিবহন, তোষামদবৃত্তির ঢের পরিচয় তিনি এর আগেও রেখেছেন। তার দাম যে কমবেশি শোধ করতে হয়নি তাও নয়। কিন্তু কথায় আছে, স্বভাব যায় না ম’লে। ১৯৯৬ সালে এই তিনিই সচিবালয় ছেড়ে দলেবলে জনতার মঞ্চে যোগ দিয়েছিলেন। একমাত্র যুদ্ধাবস্থায়ই এ ধরনের প্রতিবাদ সম্ভব। কার্যত তিনি বাংলাদেশের আইনের শাসন, জনপ্রশাসন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি সবকিছুকে তছনছ করে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করে দৃশ্যত সফলও হয়েছিলেন। এখনও সাফল্যের সেই ধারাবাহিকতাকেই আঁকড়ে আছেন। মাঝে মধ্যে শব্দবোমা ছেড়ে অতীত গৌরবের (?) প্রমাণ রাখছেন, যাতে করে উপরে চড়ার মইটি সরে না যায়। শব্দবোমা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চমত্কার সবক শুনিয়েছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান—‘শব্দবোমা নিক্ষেপ করার রাজনীতি করতে চাই না। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা আমাকে যুবলীগের দায়িত্ব দিয়েছেন জনমত সৃষ্টি করার জন্য। জনমত সৃষ্টির দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্যও উত্তম। কেননা তিনি রাজনীতি করেন। রাজনীতিবিদ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় শক্তিনির্ভর হলে তার পরিণতি সম্পর্কেও তার মতো বিদগ্ধ ব্যক্তির অজানা থাকার কথা নয়। অথচ তিনিই জনগণের ভাষা, গণতন্ত্রের ভাষা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে ঝগড়াটে মাস্তানি ভাষায় কথা বলছেন। তাছাড়া জামায়াত তো কোনো নিষিদ্ধ দলও নয়। সংসদেও রয়েছে তাদের প্রতিনিধিত্ব। এহেন একটি দলের বিরুদ্ধে রণহুংকার কেন? কাউকে তুষ্ট করার জন্য কিংবা কোনো মহলের সুদৃষ্টি পেতে কী এত বাজে বকতে হয়? একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি আক্রমণাত্মক ভাষায় কথা বলেন, ক্ষমতার জোরে অধীনস্থ বাহিনী ও নিজ দলের সমর্থকদের উত্তেজিত করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন, তাহলে নৈরাজ্যের বাকি থাকে কী? তিনি কি চান একটি গণতান্ত্রিক দেশ হানাহানি-মারামারির বলয়ে প্রবেশ করুক আর তিনি ও তার মদতদাতা নেপথ্য শক্তি মিলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করুন? যুবলীগ চেয়ারম্যানের কথায় এসব প্রশ্নর জবাব ফুটে উঠেছে। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই এবং তার বক্তব্যের প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করি।
শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১২
জামায়াত-শিবির ঠেকাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুকুম : যুবলীগের ‘না’
Posted on ১২:৫৫ PM by Abul Bashar Manik
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন