শুক্রবার, ৯ নভেম্বর, ২০১২

অং সান সু চির নৈতিক নেতৃত্ব!



ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ নুরাল হক্ পিএসসি
২০১২ সালের শেষপ্রান্তে এসে বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ খবরটি হলো, মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের বারবার অমানবিক নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি নির্যাতিত মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে নৈতিক নেতৃত্বের অপব্যবহার করতে চান না! কী অদ্ভুত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেত্রী সু চির নৈতিক নেতৃত্ব? জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দেশগুলো নিশ্চুপ। যারা নাকি নৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী সোচ্চার মানবাধিকারের একক ঠিকাদারের ভূমিকায় জীবনপাত করে চলেছে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইস্যুতে কী অদ্ভুত নৈতিকতার মানদণ্ড? মিয়ানমার কী রকমের একটি দেশ? সে দেশে কী ধরনের একজন বিরোধীদলীয় নেত্রী সু চি? যিনি তার দেশে বারবার নির্যাতিত একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর পক্ষ নিতে অক্ষম, অপারগ। হোক তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ। হোক তারা মুসলমান (অর্থাত্ ভিন্ন ধর্মের)। হোক তারা তথাকথিত অভিবাসী? তিনি নাকি আবার শান্তিতে নোবেল বিজয়ী? বিশ্ব বিখ্যাত নেত্রী? মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেত্রী?
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাস যুগের পর যুগ ধরে। এই জাতি-গোষ্ঠীর অপরাধ হলো, এরা মুসলমান। এরা হলো সংখ্যালঘিষ্ঠ। তাই এরা নাকি অভিবাসী। এ কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের দেশ মিয়ানমারে এই মুসলমানদের কোনো স্থান দেয়া যাবে না। যুগের পর যুগ ধরে এই মুসলমানরা মিয়ানমারে বসবাস করে এলেও মিয়ানমারে এখন তাদের থাকতে দেয়া যাবে না। অভিবাসী হওয়ায় কারণে এদের অত্যাচারিতই হতে হবে। ত্যাগ করতে হবে মিয়ানমার নামের দেশটির পবিত্র ভূখণ্ড। হঠাত্ করেই মিয়ানমারের নিরীহ ও নির্লিপ্ত বলে পরিচিত বৌদ্ধ গোষ্ঠীর এহেন মারদাঙ্গা জাগরণ কেন তা আঁচ করা খুবই মুশকিল। কিন্তু কেন? তা মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারও স্পষ্ট করে না বিশ্ববাসীর কাছে। আর মুসলমানরা নির্যাতিত বিধায় জাতিসংঘসহ বিশ্ব বিধাতারা প্রায় নিশ্চুপ। তাই নির্যাতিত মুসলমানদের মিয়ানমার ছেড়ে যেতেই হবে। কিন্তু, কোথায়? তার কোনো ঠিকানা নেই। একবিংশ শতাব্দীতে কি অদ্ভুত মানসিকতা মিয়ানমারের মতো একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের! মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় না হয় জাতি স্বার্থে নির্যাতন-নিপীড়নের পথ ধরেই হাঁটছে। কিন্তু এ কি ধরনের আবেশ মিয়ানমার সরকারের? আর বিশ্ব বিবেকের?
অথচ বাংলাদেশের রামুতে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের কেউই সু চির মতো দূরবীক্ষণ অথবা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বাছ-বিচারের অপেক্ষা করেনি। বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমার সরকারের মতো নির্লিপ্ত ভূমিকায় বসে থাকেনি এবং এখনও বসে নেই। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ সবাই রামুর ঘটনাকে অমানবিক অন্যায় বলে নিন্দার ঝড় তুলেছে। রামুর একজন বৌদ্ধও সীমান্ত অতিক্রম করে মিয়ানমার বা ভারতে যায়নি। অথচ, শত শত হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। অথবা প্রবেশের অপেক্ষায় আছে। নিরুপায় হয়ে বারবার প্রবেশের চেষ্টা করেই চলেছে। শুধু একটু আশ্রয়, একটু খাদ্য অথবা একটুখানি সহমর্মিতার আশায়। রামুর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত তথা সামগ্রিক মালামালের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার সঙ্গত কারণেই তাত্ক্ষণিকভাবে শতকোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে কোটি কোটি টাকা রামুর বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাত ঘুরে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করা হচ্ছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এমন কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বাংলাদেশে নাই যিনি রামুর বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের প্রতি সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন নাই, তাত্ক্ষণিকভাবে উখিয়া ও রামুবাসীর পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। এর বিপরীতে রাখাইন প্রদেশে কি ঘটছে? ওদিকের সম্পূর্ণ চিত্রটিই করুণভাবে ভেসে ওঠে যখন ভাসমান সর্বহারা রাখাইন মুসলমানদের পাওয়া যায় নৌকা অথবা ট্রলারের ওপর দিনের পর দিন রাতের পর রাত, কূলে উঠে একটু আশ্রয়ের আশায়, খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে উত্কণ্ঠিত অবস্থায়। রাখাইন প্রদেশে মুসলমান নিধনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার যখন নির্লিপ্ত-নির্বিকার, তখন ওআইসির মানবিক সাহায্যও মিয়ানমার সরকার প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। ওআইসির সামগ্রিক সাহায্য রাখাইন প্রদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওআইসির এমন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নির্যাতিত মুসলমানদের কোনো কাজেই আসেনি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসতে দেয়া হয়নি। কি অমানবিক আচরণ মিয়ানমার সরকারের! মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের!
রামুর ঘটনা নিয়ে বিটিভিসহ একাত্তর মঞ্চ থেকে মাই টিভি পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে আমার মনে হয় ডজন ডজন ঘণ্টার টকশো/আলাপ-আলোচনা হয়েছে। সবই রামু-উখিয়ার সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ জানাতে। সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্র্রদায়ের প্রতি সহমর্মিতা ও সমবেদনা প্রকাশের জন্য। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একটি দেশের মানুষের এই তো হওয়া উচিত সঙ্গত আচরণ। আমরা তো আমাদের সরকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রামুর ঘটনা নিয়ে দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে গবেষণারত হয়ে সময় ক্ষেপণ করতে দেখিনি? তাহলে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির ভয় কিসে? মিয়ানমারের পরবর্তী নির্বাচনে ভোট হারানোর ভয়? ক্ষমতা না পাওয়ার ভয়? প্রাপ্ত নোবেল হারানো অথবা দ্বিতীয় নোবেল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়? এ সমালোচনা শুধু আমার মতো দুর্মুখের নয়। এ সমালোচনা এখন বিশ্বের সব বিবেকমান মানুষের। জাগ্রত বিশ্ব সম্প্র্রদায়ের, যারা একটুখানি মনুষ্যত্বকে অন্তরে লালন-পালন করে তাদের সবার।
গত ৪ নভেম্বর ২০১২ এর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সু চিকে জড়িয়ে ‘নৈতিক নেতৃতের অপব্যবহারের’ খবরটি প্রচারের আগ পর্যন্ত অং সান সু চির যে ভাবমূর্তি ছিল তা আজ ভুলণ্ঠিত এবং নিঃসন্দেহে নিঃশেষিত। তাই পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়ে হলেও অং সান সু চিকে অযাচিতভাবেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ভারত বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার সেই মহান ব্যক্তিত্ব শেখ আহমেদ দিদাতের উক্তিটি। যেখানে বলা হয়েছে, ‘ওভ ুড়ঁ ফরংপত্রসরহধঃব ড়হ ষধহমঁধমব, পড়ষড়ঁত্, পধংঃব, পত্ববফ, ত্বষরমরড়হ ধহফ ত্রপযবং, ুড়ঁ ংযধষষ ঢ়বত্রংয, ঃযধঃ রং ঃযব ষধ িড়ভ হধঃঁত্ব।’ অর্থাত্, ‘যদি কেউ ভাষা, বর্ণ, জাতি, গোত্র, ধর্মমত এবং সম্পদকে বিবেচনায় এনে বৈষম্য প্রদর্শন করে, তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য। আর এটাই নিয়তির অমোঘ বিচার।’
লেখক : পেন্শনার
haquenoor@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads