এম. আবদুল হাফিজ
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশে বঙ্গবন্ধুর সংগৃহীত বিদেশী সাহায্য অনুদানের অনেক অপব্যবহার করেছিল নাকি আওয়ামী লীগ। ‘পা চাটার’ সক্রিয় দলকে সামলানো নাকি কষ্টকর হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে সদ্যফেরত বিজয়ী বীরের জন্য। একটি জনযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে অস্তিত্বে আনতে পারলেও দুর্নীতির দানবকে তিনি বশে আনতে পারছিলেন না। সেই গ্লানিবোধ থেকেই সম্ভবত উৎপত্তি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বহুল উচ্চারিত উক্তিটির : চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। তার সহকর্মীরা যেভাবে ত্যাগ-তিতিক্ষার সাথে তার নির্দেশ মেনে চলেছে, কিন্তু তবুও প্রতিকূলতার সাথে আপস করেনি, তাদের সাথে একজন সংবেদনশীল বঙ্গবন্ধু এর চেয়ে কঠোর হতে পারেননি। বরং কারোর দুর্নীতি সম্বন্ধে কোনো নালিশ এলে তিনি দুঃখ পেতেন। দুর্নীতির ব্যাপারে কাউকে শাস্তির প্রশ্নে তিনি বলতেনÑ স্বাধীনতার জন্য ওরা অনেক কষ্ট করেছে, কেউবা সর্বস্ব খুইয়েছে।
এতদসত্ত্বেও এ কথা বলা যাবে না যে, এ দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির অঙ্কুরোদ্গামের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই নমনীয়তা এককভাবে দায়ী। সমাজে বিরাজমান অনেক নেতিবাচক উপসর্গের সমাহারেই এমন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হতে পারে। তাই বলে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ দুর্নীতির উৎপত্তিতে দায়মুক্তি পেতে পারে না। দুর্নীতি একটি বিশ্বজনীন ব্যাধি। কিন্তু শুরুতেই এর টুঁটি চেপে ধরতে পারলে হয়তো দুর্নীতির আজকের কদর্যরূপ দেখতে হতো না।
বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কার সাথে সঙ্গতি রেখেই তার সাঙ্গোপাঙ্গরাই ‘ধর্মের কাহিনী’ শুনতে বিমুখ ছিল। অতঃপর লোভলালসার বশবর্তী হয়ে ক্ষমতার বর্মে আবৃত হয়ে যখন সরকারের রাঘব বোয়ালেরাই এতে জড়িয়ে পড়তে থাকল স্বতঃসিদ্ধভাবেই সরকার ও দলের চুনোপুঁটিরাও অবধারিতভাবে এতে সৃষ্ট মহামারীর শিকার না হয়ে পারেনি। লোভ ও লালসার আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে এটাই স্বাভাবিক যে, কীটপতঙ্গরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেই যেকোনো ঝুঁকি উপেক্ষা করেই।
বৈধতার বিভিন্ন মুখোশ পরিয়ে যখন সরকার বা দল তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় অনুগ্রহভাজনদের পুরস্কৃত করতে কুইক রেন্টালের ঠিকাদারি বা হাজারো কিসিমের ‘বাণিজ্যে’র সাথে সম্পৃক্ত কাজ করে অথবা আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচনের ‘লাঠিয়াল’দের প্রস্তুত করতে প্রবৃত্ত হয়, তখন আসলেই নীতি ও দুর্নীতির ভেদাভেদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিবেকহীনতার বিচ্ছিন্নতার নিñিদ্র অন্ধকারে তখন ‘ফ্রি’ ফর অল-এর সূচনা হয়। আমরা এখন দুর্নীতির সেই পর্যায়েই আছি। যথাযথ মহল থেকে যথাযথ আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে কেউ কি ভাবতে পারে যে, তানভীর নামে কোনো ভূঁইফোঁড় ব্যবসায়ী নামধারী ব্যক্তি ভুয়া দলিলপত্রের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ঋণ হাতিয়ে নিতে পারে। বলাবাহুল্য তার এই ‘অসম্ভব’ প্রাপ্তির নেপথ্যে যে ব্যক্তি বা মহল সক্রিয় ছিল, তার কিছু কিছু তথ্য ইতোমধ্যে বেরিয়ে এসেছে। মনে রাখতে হবে যে, ছিঁচকে চোরও যদি আশকারা পেয়ে বিনা বাধায় সামান্যও এগোতে পারে, তার সাহস বেড়ে যায় এবং সে তানভীরের মতো দম্ভোক্তি করতে পারে যে, ‘যা নিয়েছি তার ২০ গুণ সম্পদ আমার আছে এবং গৃহীত ঋণ শোধে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দেখার বিষয় যে, চালচুলোহীন কেদা মুদির দোকানের মালিকের কাছে সেই ২০ গুণ সম্পদই বা এলো কী করে?
আরো বিচিত্র দুর্নীতি সহযোগী বা সাহায্যকারীদেরও উত্থান। বিচিত্র এ জন্য যে, কী দ্রুত গতিতে বদলে যায় তাদের জীবনশৈলী (lifestyle)। সামান্য স্কুলশিক্ষিকা অর্ধকোটি টাকা মূল্যের গাড়ির মালিক হন। অবশ্য হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাথে সংশ্লিষ্টতার অপবাদ নিয়ে তিনি এখন রিকশা আরোহী। একটি চীনা প্রবাদ অনুযায়ীÑ একটি মাছের পচন ধরে তার ওপরের অংশ থেকে। সমাজ, রাষ্ট্র বা যেকোনো সম্মিলিত সংগঠন সম্বন্ধেও এ কথা সত্য।
যখন মন্ত্রীরা দুর্নীতি করে বা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন, এ দেশে যখন সুরঞ্জিত বাবুরা বুক ফুলিয়ে চলেন, বড় বড় কথা বলেন এবং দুর্নীতি দমনের কর্তাব্যক্তিরাও তাতে সায় দেন, তখন ব্যাংকের একজন সামান্য কর্মকর্তা বা তানভীরের নৈতিকতার কথা বলা কি অধিকার থাকতে পারে? ডাকসাইটে আমলাদের বিরুদ্ধে যখন পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে সন্দেহের তীর নিক্ষিপ্ত হয় তখন আমজনতার সর্বোত্তম পথ (Bestbet) দুর্নীতির সাথে আপস করে নির্ঝঞ্ঝাট হওয়া।
স্বয়ং রাজনীতিকেরা, যারা পালাক্রমে দেশ শাসন করেন, দেশের নৈতিকতার মান নির্ধারণ করেন তারাও কি ধোয়া তুলসীপাতা। রাজনৈতিক সরকার নিজেদের নৈতিক দুর্বলতার জন্য না পারলেও এক-এগারোর সরকার তো শীর্ষ নেতৃত্বের বেশির ভাগকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করেছিল। তাদের দলের কোষাগারের উৎস কী? তারাও নাকি মনোনয়ন বাণিজ্য করে অঢেল অর্থ পান। সেই অর্থ দিয়েই চলে তাদের অপরাজনীতি। কিন্তু সে কথা কি তারা কখনো স্বীকার করবেন?
আফটার অল দুর্নীতিই বা আসলে কী? এটা কি শুধুই অবৈধ অর্থের লেনদেন? না তারও বাইরে কিছু? অর্থের অবৈধ লেনদেন, অবৈধ দখলদারিত্ব, অসৎ উদ্দেশ্য, হত্যা, গুম, ছিনতাইÑ এগুলোও তো দুর্নীতি। এমনকি একজনের অভিপ্রায় বা মনোষ্কামনাও তো দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আমরা এ সব কিছুতেই এমনভাবে জড়িয়ে আছি যে, একটি সুদীর্ঘ ব্যাপক আত্মবিশোধন প্রক্রিয়া ছাড়া এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ‘আমরা টপ টু বটম’ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছি। পরিহাসই বটে, আমরা একটি মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হতে পারি, কিন্তু দুর্নীতি দমনের যুদ্ধে পারি না। ফলে সমগ্র দেশ, জাতি, সমাজ, শ্রেণী-পেশা আজ এক দুষ্টগ্রহের বলয়ে আবদ্ধÑ যেখান থেকে নিষ্ক্রক্রমনের পথ খুঁজে পাইনি আমরা। লোভলালসার দাসত্ব করতে করতে আমরা আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোকে ভোঁতা করে ফেলেছি। তাই আর বিশুদ্ধতার কোনো ঘ্রাণ আমরা গ্রহণ করতে পারি না। বুদ্ধি ও মেধার দুর্নীতি তো আরো মারাত্মক। সেটা যখন ঘটে, জাতি তখন বিুব্ধ সমুদ্রে তার বাধার শেষ নোঙরটিও হারিয়ে ফেলে। বলা বাহুল্য, সেটাও আজ অনিবার্যভাবে জাতিতে এক অনির্বচনীয় অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন