বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

রাষ্ট্র যখন খুনীদের রক্ষক



সংসদীয় পদ্ধতির সরকারে দলীয় এমপিদের ভোটে তাদের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ করা হয়। তবে নির্বাচিত হবার পর রাষ্ট্রপতি কোন দল বা বিশেষ রাজনীতির কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না। রাষ্ট্রপতি কেবল নিজের বিবেক-সংবিধানের কাছেই দায়বদ্ধ থাকেন। রাষ্ট্রপতি এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর মতো কোন রাজনীতি তাড়িত ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে আইনের সুরক্ষা ও বিবেকের স্বীকৃতি থাকে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণের সময় কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি সমানাচরণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, তাকে সংসদ সদস্য হতে হবে। তিনি একটা দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
কারাগারে বন্দি কোনো কয়েদির যে কোনো মেয়াদের দন্ড মওকুফের বিষয়ে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এখতিয়ার দিয়েছেন। আদালতের রায়ে খুনীদের ফাঁসির রায় হওয়ার পর সাধারণভাবে আইনের শাসনে বিশ্বাসীদের এই প্রত্যাশা থাকে যে, রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সরকার সংক্ষুব্ধ-ভিকটিম পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন এবং আইনের শাসনের সুরক্ষায় রাষ্ট্র ও সরকার তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে তিনি ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করার ক্ষমতা রাখেন। অতীতেও রাষ্ট্রপতিরা তাদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের দন্ড মওকুফ করে দিয়েছেন, এমন নজির রয়েছে। বরং অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিদের এমন সিদ্ধান্তকে মানবিক বিবেচনায় অভিনন্দিত করা হয়েছে। তবে অতীতের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোন রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচারে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত একাধিক আসামীকে নির্বিচারে সাধারণ ক্ষমা দিয়ে তাদের দন্ড মওকুফ করে দিয়েছেন, এমন নজির বাংলাদেশে নেই। সম্ভবত বিশ্বের অন্য কোন দেশেও এর দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর একাধিক হত্যা মামলার আসামীদের ক্ষমা করে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির এই সিদ্ধান্ত আইনের শাসন এবং হত্যাকান্ডের বিচারিক রায় কার্যকর করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যারা ফাঁসির দন্ড থেকে মুক্তি পেলেন, তারা সবাই শাসক-আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মী এবং আসামী পক্ষ যারা বিচারিক রায়ের সর্বোচ্চ দন্ড বাস্তবায়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হলেন, তারা হতভাগ্য বিরোধী দল-তথা বিএনপি'র কর্মী। সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে নানাভাবেই এটা প্রতিফলিত হয়েছে যে, সরকারি দলের লোকদের জন্য আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ একরকম, আর বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জন্য অন্যরকম। একদিকে বিরোধী দলীয় নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা-জুলুম-নির্যাতনের স্টীম রোলার চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা হত্যাকান্ডসহ বড়ো বড়ো অপরাধ করে আইনের হাত ও বিচারের দন্ড থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাচ্ছেন।
ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ধাপেই মামলা প্রত্যাহারের হিড়িক : নরসিংদীর পৌর কমিশনার মানিক হত্যা মামলার প্রধান আসামি একই পৌরসভার চেয়ারম্যান (মেয়র) লোকমান হোসেনকে (তিনিও সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন) খালাস দিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রথম হাসিনা সরকারের সময়ে দায়ের করা ৪টি মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য সুপারিশ করেন ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক।
রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু তার সুপারিশে মামলা বাতিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন। নজরুল ইসলাম হিরু লিখেছেন, মামলাগুলো মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা। এগুলো বাতিলের সুপারিশ করছি। আবেদনের ওপর সুপারিশ করার বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরু বলেন, আমি সাধারণত নৈতিক ও আইনগত বিষয়গুলো দেখে শুনেই কাউকে সুপারিশ করে থাকি। যাকে-তাকে সুপারিশ কখনই করি না। লোকমান হোসেনের মামলার কাগজপত্রগুলো আমি বেশ ভালোভাবে খতিয়ে দেখে নিজে সন্তুষ্ট হয়েই সুপারিশ করেছি। মামলাগুলো যে রাজনৈতিক ও মিথ্যা সেটা লোকমান হোসেন তার রক্ষিত তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আদালতেও প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন। তাছাড়া টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীও বুঝে-শুনেই সুপারিশ করেছেন।  (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২০ জুলাই ২০০৯)
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি লোকমান হোসেন পৌর কমিশনার মানিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ওইদিনই লোকমান হোসেনের বিরুদ্ধে নরসিংদী থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়। দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা উল্লেখ করে দায়ের করা এ মামলাটি চাঞ্চল্যকর ও বহুল আলোচিত মামলা হিসেবে ঢাকার দ্রুত বিচার-১ আদালতের কার্যতালিকার ১৩/০৭নং মামলা হিসেবে বিচারাধীন ছিল। এই মামলার পাশাপাশি লোকমান হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ১৯৯৯ সালে দায়ের করা আরও ৩টি মামলা নরসিংদীর বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন ছিল। লোকমান হোসেনের বিরুদ্ধে ওই সময়ের সরকারই মামলাগুলো দায়ের করেছে। এ মামলাগুলোর বিবরণ উল্লেখ করে এগুলো বাতিলের প্রার্থনা জানিয়ে লোকমান হোসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন পেশ করেন। আবেদনে তিনি আওয়ামী লীগের সময়ে দায়ের করা মামলাগুলোর ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৯৮ সালে নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছেন তিনি। বিএনপি ক্ষমতায় এসে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে মতিয়া চৌধুরী এবং রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী লে. কর্নেল নজরুল ইসলাম হিরুর বিজয়ের পেছনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন।
বিচারাধীন হত্যা মামলা বাতিলে মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশ বেআইনি। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী একজন মন্ত্রী ওই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলা বাতিলের আবেদনে সুপারিশ করতে পারেন না। এই সুপারিশ বেআইনি।
আলোচিত একটি হত্যা মামলায় চার্জশিট ও চার্জ গঠন সম্পন্ন হয়েছে, বিচার নিত্তির অপেক্ষায়, এই অবস্থায় মামলা প্রত্যাহারের কোনো আইনগত এখতিয়ার সরকারের নেই। বিধান অনুযায়ী মন্ত্রী ও এমপিরা মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত আবেদনে সুপারিশও করতে পারেন না। মামলাটি সঠিক নাকি মিথ্যা এটি আদালতেই প্রমাণিত হওয়া উচিত ছিল।
আমাদের দেশে কিছু লোক সবসময় আইনের ঊর্ধ্বে বসবাস করতে চায়। আর বাকিরা বসবাস করে আইনের নিচে। একটি চাঞ্চল্যকর ও বহুল আলোচিত বিচারাধীন মামলা বাতিলের জন্য একজন মন্ত্রী কীভাবে সুপারিশ করেছিলেন তা আমি বুঝতে পারছি না।
২২ মে ২০১১ রাজনৈতিক মামলার অজুহাতে গুরুতর জখম করে হত্যার চেষ্টা ও বাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ থেকে একযোগে মুক্তি পেলেন ৩৬ আসামি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে নাটোরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তারা মুক্তি পান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত চৌদ্দতম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিংড়া থানার ২৭ (২৫/১১/২০০২) নম্বর মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন করেন নাটোরের পিপি আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম। তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় দরখাস্ত দিয়ে মামলাটি প্রত্যাহার চান। তিনি আদালতকে বলেন, আসামিদের রাজনৈতিক কারণে এই মামলার আসামি করা হয়েছে। এ কারণে সরকার মামলাটির প্রত্যাহার চাচ্ছে। তবে বাদী ও আসামিরা কে কোন রাজনীতি করেন বা তারা কে কোন রাজনীতি করেন বা তারা কে কোন পদে রয়েছেন তা উল্লেখ করেননি। এ অবস্থায় সরকার পক্ষের আবেদনের বিরোধিতা করে বাদীপক্ষের আইনজীবী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, এই মামলার ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মামলার বাদী ও আসামিরা কেউই রাজনৈতিক নেতা নন। তারা রাজনৈতিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। পারিবারিক জমিজমার বিরোধের জের ধরে আসামিরা বাদী ও সাক্ষীদের গুরুতর জখম করেছে এবং হত্যার চেষ্টা করেছে। আসামিরা বাদীর বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে এবং মালামাল লুট করে বিরোধীয় জমি দখল করে নিয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক অজুহাতে মামলাটি প্রত্যাহার করা হলে বাদী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. লিয়াকত আলী মোল্লা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন। এতে ৩৬ আসামির সবাই মামলা থেকে মুক্ত হন।
খুনী বিপ্লবের যত অপরাধ : লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে হত্যাকারী পৌর চেয়ারম্যান আবু তাহের পুত্র এএইচএম বিপ্লবের মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফের ঘটনা গোটা দেশে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। নুরুল ইসলামকে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০১ রাত সাড়ে ১১টায় বাসভবন থেকে অপহরণ করার পর ওই রাতেই হত্যা করা হয়।  অপহৃত নুরুল ইসলামকে অপহরণের পর স্থানীয় মজু চৌধুরী হাটের কাছে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে সুইস গেটের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহরণকারী দলের নেতৃত্বে ছিল তাহেরের ছেলে বিপ্লব ও পালিত ছেলে রিংকু। অপহরণের দুই ঘণ্টা পরেই তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে বস্তাবন্দি অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর হত্যাকারীরা ঘণ্টা তিনেক ঘটনাস্থলে ছিল। ভোর চারটার দিকে তারা শহরে প্রবেশ করলে স্থানীয় পিটিআই কলেজের সামনে টহলরত একজন পুলিশ হাবিলদার তাদের দেখে ফেলে। এত রাতে তাদের শহরে ঘোরা ফেরার বিষয়ে হাবিলদার জিজ্ঞাসা করলে তারা তাকে কেন জবাবদিহি করতে হবে বলে দ্রুত সটকে পড়ে। বিস্তারিত বিষয়াদি রিংকু বাঙ্গাখা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম হাসুকে ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টার দিকে জানায়। হাসু তখন জেলা বারের একজন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন যে, নুরুল ইসলামকে জীবিত ফেরত পাওয়ার আশা কম। পদস্থ ওই আইনজীবী সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অবহিত করেন। এর আগে পর্যন্ত হাসু চেয়ারম্যান অপহৃত আইনজীবীকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও বেলা দুইটার আগে পর্যন্ত হত্যার বিষয়ে জানতেন না। ঘটনা জানার পর পরই পুলিশ হাসু চেয়ারম্যান ও রিংকুর রায়পুর উপজেলার গ্রামে হানা দেয়। কিন্তু সেখানে তখন তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
প্রশাসনের সঙ্গে ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা পর্যন্ত খোদ অপহরণকারীরা নানা নাটক করতে থাকে। ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় তাহেরের স্ত্রী জেলা প্রশাসকের অফিসে আসেন। তিনি জেলা প্রশাসককে বলেন, নুরুল ইসলাম উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ওই অফিসে তিনি অবস্থান করবেন। ঘণ্টা দুয়েক তিনি এভাবে বসে থাকার পর জেলা প্রশাসক তাকে এক গাড়ি দিয়ে অনুরোধ করেন এ বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। তখন গাড়িতে করে পৌর চেয়ারম্যানের স্ত্রী নিজের বাসায় চলে যান। এ সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিপ্লব ও হাসু চেয়ারম্যান একাধিকবার ফোনে অপহৃত নুরুল ইসলামকে ফেরত দেয়ার আশ্বাস দেয়।
সাড়ে বারোটার দিকে বিপ্লব ও হাসু চেয়ারম্যান জেলা প্রশাসকের কক্ষে আসে। এ সময় পুলিশ সুপার ইরফান আলী খান এবং জেলা বারের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। ডিসি এবং এসপি অপহৃত নুরুল ইসলামকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ করলে বিপ্লব সম্মত হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেয় যে এ ব্যাপারে কোনো মামলা দেয়া চলবে না। ডিসি এবং এসপি তাকে বলেন, ঠিক আছে এবং উপস্থিত আইনজীবীদের ৫০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করতেও বলেন। এরপর বিপ্লব চলে যেতে চাইলে তার সঙ্গে তিনজন আইনজীবীকেও দেয়া হয়। প্রশাসন বিপ্লবকে জানায়, এই তিনজন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজান, অ্যাডভোকেট নূর এবং অ্যাডভোকেট নয়নের সঙ্গে যেন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে ফেরত দেয়া হয়। বিপ্লব আইনজীবীদের সঙ্গে করে নিজ বাসভবনে গিয়ে জানিয়ে দেয়, অপহরণের বিষয়ে সে কিছুই জানে না। সুতরাং অপহৃত নুরুল ইসলামকে ফেরত দেয়ার প্রশ্ন নেই। আইনজীবীরা নিরুপায় হয়ে ফিরে আসেন। এই ঘটনার পরপরই মধ্যস্থতাকারী হাসু চেয়ারম্যান চাপ দিলে দুপুর ২টার দিকে রিংকু তাকে জানায় যে, অপহৃত নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে।
খবরটি হাসু চেয়ারম্যান জেলা বারের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুনিরকে জানায়। মুনিরের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারও ঘটনা জানতে পারেন। এরপরও অপরাধীরা পৌর চেয়ারম্যানের বাড়িতেই ছিল। কিন্তু প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক না করায় সময় অতিবাহিত হয়। এভাবে আরো তিন দিন পার হয়।
২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসক তার বাসভবনে পুলিশ সুপারের সঙ্গে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য বৈঠকে বসেন। উভয়ে পৌর চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে গ্রেফতারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছান। সন্ধ্যা ৭টার দিকে সরকারি দলের সংসদ সদস্য হারুন-অর-রশীদ জেলা প্রশাসকের বাসভবনে আসেন।
সৌজন্য আলাপের পর সংসদ সদস্য জেলা প্রশাসককে এই বলে তার বাসভবন ত্যাগ করেন যে তিনি পৌর চেয়ারম্যান আবু তাহেরের বাড়িতে দলের কিছু বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার জন্য যাচ্ছেন। সংসদ সদস্য হারুন পৌর চেয়ারম্যানের বাড়িতে আধ ঘণ্টা অবস্থান করেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে অপরাধীরা তার পিছু পিছু নিচে নামে এবং মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারে চড়ে সংসদ সদস্যের গাড়ির পিছু পিছু রায়পুরার দিকে চলে যায়। পুরো ঘটনাটি ঘটেছে পুলিশের চোখের সামনে। অথচ তারা নিষ্ক্রিয় ছিল।
তারা সংখ্যায় ৮ জন ছিল । সরকারি দলের সংসদ সদস্যের গাড়ির বহরের সঙ্গে থাকা অবস্থায় গ্রেফতার করলে সরকারি মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে ভেবে অপহরণকারীদের ধরা হয়নি। এই ঘটনা নিয়ে একটি হৈচৈ ও দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে, তারা সেটা বোঝেননি।
১৯ জুলাই ২০১১ বিপ্লবের মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফ সংক্রান্ত একটি চিঠি নুরুল ইসলাম হত্যা মামলার বিচারিক আদালত চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। চিঠিটি পাঠিয়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক নূরশেদ আহমেদ ভূঁইয়া। চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং কারা শাখা-২ এর পি-২০/২০১১ (অংশ) ২৭০, তারিখ ১১/০৭/২০১১ এবং কারা অধিদফতরের স্মারক নং পিডি/পরি/৭/২০১১/১৬৭৫(৩) তারিখ ১৭/০৭/২০০১-এর বরাত দিয়ে বলা হয়, উপরোক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত স্মারকের আলোকে মহোদয়ের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বিষয়োক্ত বন্দিকে বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রাম-৪৮/২০০৩ মামলায় মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দির পিতা কর্তৃক ছেলের প্রাণভিক্ষার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদন্ড মওকুফ করা হলো লিখে স্বাক্ষর করেছেন। তাই সংশ্লিষ্ট বন্দি গত ১৪/০৭/২০০১ তারিখে মৃত্যুদন্ড হতে খালাস পেয়ে অন্য মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবে বর্তমানে অত্র কারাগারে আটক আছে।
বিপ্লবের ফাঁসির দন্ড রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত আইনের শাসনকে ব্যাহত করেছে। একাধিক মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিপ্লবের দন্ড মওকুফ করে দেয়া একটি খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলো। এতে আইনি শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে।
সংবিধানে যে কোনো আসামিকে ক্ষমা করে দেয়ার ক্ষমতা ও এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির রয়েছে। কিন্তু ফাঁসির আসামি বিপ্লবের দন্ড মওকুফ করে তিনি সাংবিধানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এতে নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার নুরুল ইসলামের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলো।
জঘন্য খুনী বিপ্লবকে মাফ করে দেয়ার পর রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তার স্ত্রী আইভি রহমান হত্যাকান্ডের বিচার চাওয়ার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন নুরুল ইসলামের বিধবা স্ত্রী রাশিদা ইসলাম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির উচিত হবে এখন আইভি রহমানের হত্যা মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দিয়ে ওই ঘটনায় জড়িতদের ক্ষমা করে দেয়া। কারণ, তিনি যেমন স্ত্রী হারিয়েছেন, আমিও স্বামী হারিয়েছি। আমার স্বামী হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়ে স্ত্রী হত্যার বিচার করার অধিকার তার নেই।
রাশিদা ইসলাম আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার পিতার হত্যাকারীদের বিচার করে দ্রুততার সঙ্গে তাদের ফাঁসি কার্যকর করেছেন। যারা পলাতক আছেন তাদেরও ধরে এনে ফাঁসি দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অথচ তার সরকারের প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে নুরুল ইসলামের খুনিদের ক্ষমা করে তাদের আরও খুন করার লাইসেন্স দিচ্ছেন। তিনি যেমন পিতার হত্যাকারীদের বিচার চাওয়ার বা করার অধিকার রাখেন তেমনি আমার এতিম সন্তানরাও পিতৃহত্যার বিচার পাওয়ার, খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর দেখার অধিকার রাখে।
রাশিদা ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার আছে মৃত্যুদন্ডের আসামিকে ক্ষমা করার। তাই বলে এমন জঘন্য খুনিদের তিনি ক্ষমা করে দেবেন এটা ভাবতেও অবাক লাগছে। কোনো সভ্য দেশে দলীয় বিবেচনায় খুনিদের এভাবে ছেড়ে দেয়ার দৃষ্টান্ত নেই। রাশিদা ইসলাম বলেন, তাহের পরিবার শুধু আমার স্বামী নুরুল ইসলামকেই নয়, আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে খুন, গুম ও চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। গোটা এলাকাবাসীর জীবন তারা বিপন্ন করে তুলেছে। তারা যদি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে আষ্কারা পায় তখন তাদের খুনের নেশা আরও বেড়ে যাবে। আমাদের মতো নিরীহ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নতুন করে হুমকির মুখে পড়বে। একটা স্বাধীন দেশে যদি খুনি ক্ষমা পেয়ে যায়, তাহলে কোথায় আইনের শাসন। এই খুনির ক্ষমা হয় কিভাবে?
রাশিদা ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলবো-আমার অসহায় এতিম সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে আপনি খুনি তাহের পরিবারের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করুন। কারণ, আপনি যেমন আপনার পিতার হত্যাকারীদের বিচারকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছেন, তেমনি আমার সন্তানরাও তার নিরপরাধ পিতার খুনিদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর দেখতে চায়। তা না হলে আল্লাহ খুনির প্রশ্রয়দানকারীদের বিচারও অবশ্যই করবেন। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২১ জুলাই ২০১১)
২৮ জুলাই ২০১১ একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি খুনি বিপ্লবের দন্ড মওকুফের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে কিনা? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে দেশের বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাগুলো দ্রুত নিত্তির জন্য গঠিত মনিটরিং সেলের সভা শেষে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি বিপ্লবকে আইন ও সংবিধান মেনেই রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছেন বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বিপ্লবকে ক্ষমা করে তার সাংবিধানিক এখতিয়ার প্রয়োগ করেছেন।
খুনের আসামিকে ক্ষমা করে দেয়ায় ইতিহাসে এক জঘন্য নজির স্থাপিত হলো। রাষ্ট্রপতি কী কারণে কোন অবস্থায় খুনিকে ক্ষমা করেছেন জানি না। তিনি খুনিকে আরও শক্তি-সামর্থ্যসহ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এতে সমাজে অপরাধ বাড়বে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভয় কমবে। নতুন গডফাদার সৃষ্টি হবে। প্রমাণ হিসেবে ১ আগস্ট ২০১১ তারিখের ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
এদিন লক্ষ্মীপুরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়িবহরে হামলা চালায় সরকারি দলের ক্যাডাররা। দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছোট ছেলে শিবলুর নেতৃত্বে এ হামলায় কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। বহরে থাকা সাংবাদিকদের মাইক্রোবাসসহ তিনটি প্রাইভেট কার ও পাঁচটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে হামলাকারীরা। আহতরা লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা  নেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকা থেকে গিয়ে লক্ষ্মীপুর ও সেনবাগে স্থানীয় বিএনপি আয়োজত পৃথক দুটি সমাবেশে যোগ দেন। বেলা আড়াইটার দিকে লক্ষ্মীপুর শহরের ওয়েলকাম কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত জেলা বিএনপির মহাসমাবেশে তিনি প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন। সমাবেশ শেষে গাড়িবহর স্থানীয় সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বাড়ির দিকে রওনা হলে লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা তাহের বাহিনীর সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। বহরের পেছনের দিকে সাংবাদিকদের গাড়িসহ তিনটি মাইক্রোবাস হামলার শিকার হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা রেডিও টুডে'র চিফ রিপোর্টার সাহাবউদ্দিন চৌধুরী, বার্তা ২৪ ডটনেটের স্টাফ রিপোর্টার মহসিন হোসেন, দৈনিক আমাদের সময়ের তারেক, সালমান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া মঞ্জু, আজিজুল হাকিম আরজুসহ ১৩ জনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হয়। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা এগিয়ে এলে তারাও লাঞ্ছিত হন। এতে তিন সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।
তাহেরের খুনি ছেলে বিপ্লবের ফাঁসির দন্ড রাষ্ট্রপতির মওকুফ এবং তার ছোট ছেলের নেতৃত্বে বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা! সেনবাগের সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ হামলাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি খুনিদের ক্ষমা করে দিয়ে বিরোধী মত দমনে কাজে লাগাচ্ছেন- এটা লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসী তাহেরের ছেলেরা দেশবাসীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। পরিকল্পিতভাবে সরকার পুরো দেশ ও জাতিকে আক্রান্ত করে চলছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads