বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ : অবশেষে দুদকের স্বীকারোক্তি




সাড়া জাগানো পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। একইসঙ্গে তাদের ‘দিনবদলের সনদে’ বলা হয়েছিল ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ নেয়ার কথা। ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী মহাজোট সরকার অনেক বিষয় নিয়ে মেতে উঠেছে। সফলতার রেকর্ড সৃষ্টির দাবিও করা হয়েছে। অথচ মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ ওয়াদাই অপূর্ণ রয়ে গেছে। দুর্নীতি ডালপালা বিস্তার করে সারাদেশ ছেয়ে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকসহ ঋণদাতা সংস্থাগুলোর ১২০ কোটি ডলার ঋণের পদ্মা সেতু প্রকল্পের কেলেঙ্কারি ভারতীয় সিরিয়ালের মতো দীর্ঘায়িত হয়েছে। এ নিয়ে লাফালাফিও কম হয়নি। কিন্তু অগ্রগতির বদলে অচলাবস্থাই স্থায়ী হয়ে উঠেছে। 
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণ প্রক্রিয়ার শুরুতেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একে আমলে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং এর বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে—বিশ্বব্যাংকের এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধেই পাল্টা দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন মহলের এমন ভূমিকার সমর্থনে অন্যদের মতো দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) লেজ নেড়েছিল। তারা অভিযুক্ত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীকে দুর্নীতিমুক্তির সার্টিফিকেট দিতে দেরি করেনি। সবকিছু দেখে-শুনে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল না করে পারেনি। মান বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাতম তুলেছিলেন আর নতুন যোগাযোগমন্ত্রী মালয়েশিয়া কার্ড নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই মানুষ ভুলে যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সবকিছু চুপসে যেতে দেরি হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়েছে সরকারকে। তাদের শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। দুদকও সব ভুলে তদন্ত শুরু করে। দীর্ঘ এক বছরের বেশি তদন্ত শেষে এখন তেতো গেলার মতোই দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতির অভিযোগ কবুল করেছেন। ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ একেই বলে ঘোলা করে পানি খাওয়া। সরকারও এতেই অভ্যস্ত দেখা যাচ্ছে।
এখন বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট একটি বিশেষ মহল অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা নিতে চেয়েছিল। এজন্য তারা পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত টেন্ডার আহ্বানের আগেই টেন্ডারপত্রটি পাঠিয়ে দিয়েছিল লাভালিন কর্তৃপক্ষের কাছে। এর বিনিময়ে ঘুষের টাকা পেতে বার বার রদবদল করা হয় টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি। এতই ক্ষমতাশালী তারা। তাই যখন বিশ্বব্যাংক থেকে অভিযোগ তোলা হয় তখন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিও চুপ থাকতে পারেননি। টাকাই এলো না দুর্নীতি হলো কেমন করে—প্রশ্ন তুলে মহা শোরগোল বাঁধিয়েছিল। টাকা আসার আগেও যে দুর্নীতি হয়, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করাও যে অপরাধ, এসবই ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এমন ভূমিকার পাশাপাশি তার উপদেষ্টা, যোগাযোগমন্ত্রী ও সেতু প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়াও দুর্নীতি প্রচেষ্টায় জড়িত হিসেবে লাভালিনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও প্রধানমন্ত্রীর জনৈক নিকটাত্মীয়ের নামও এখন সবার জানা। এসব কারণেই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চিঠি চালাচালি
কোনো কাজে আসেনি। শেষ পর্যন্ত দুদকের স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের সত্যতাই প্রমাণিত হলো। একইসঙ্গে সরকারের দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতাই আবারও মেনে নেয়া হলো।
এখন দুদকের পক্ষ থেকে দুর্নীতি প্রচেষ্টায় জড়িত বলে যাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে তারা সবাই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের এসব ব্যক্তিই পরস্পরের যোগসাজশে মহাদুর্নীতিতে মেতে উঠেছিল। তারা নিশ্চয়ই উচ্চ পর্যায় থেকেই সবুজ সঙ্কেত পেয়েছিল। বিশ্বব্যাংক থেকে অভিযোগ না উঠলে কথা ছিল না, বাড়া ভাতে ছাই পড়ায় বাস্তব কারণেই ক্ষমতাসীনরা এদের বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছিল। দুদকও বসে থাকতে পারেনি। কিন্তু কথায় বলে সত্য গোপন থাকে না। ফলে এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজটাই ঝুলে গেছে। এতে করে দেশের, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের হতাশাই শুধু নয়, মহাজোট সরকারের মহাদুর্নীতির কথাও বিশ্বজুড়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হলো। এখন দেখা যাক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদক কী করে? তারা কি সরকারের ধামাধরা হিসেবে নতুন খেলা শুরু করে, না কি দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের পরিকল্পনা উদ্ঘাটিত করে নিজেদের কার্যকরিতা প্রমাণ করে। শুধু স্বীকারোক্তিই দুদকের কাজ নয়। নিজেদের ‘মিথ্যাবাদী’ পরিচয় মুছে ফেলাও তাদের কর্তব্য।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads