শওকত মাহমুদ
|
তারেক রহমান অথবা না—তারেক রহমান; বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে এলিট সমাজে এই বিতর্কের রাঁদেভু তো কম হলো না। আজ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৪৮তম জন্মদিনে আসুন না এই সত্য কবুল করি, অজস্র অপপ্রচার টপকে তিনি আজ এই অবারিত স্ব্বীকৃতিতে উজ্জ্বল যে, আগামীর অবশ্যম্ভাবী দেশনায়ক তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিচালনাধীন রাষ্ট্রের পরহিংসাময় এবং অসংখ্য ছিদ্রান্ব্বেষী তদন্তেও তার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্খলন শনাক্ত হয়নি। এই না হওয়ার ঘটনা অথবা রাষ্ট্রের এক নম্বর খলনায়ক হিসেবে তাকে সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস সর্বোপরি এত ঝঞ্ঝায় বিরল এক আত্মশক্তিতে নিজেকে সুস্থির রাখার গুণে তিনি আরও লোকনন্দিত হয়েছেন। বাংলাদেশের অগণন মানুষের সরল উপলব্ধিতে জনপ্রিয়তার তুল্যদণ্ডে আজ বাংলাভাষী রাজনীতিকদের মধ্যে বেগম জিয়ার শীর্ষস্থানের পর তারেক রহমানেরই অবস্থান।
পত্রিকায় কলাম লেখার সুযোগ আছে, গায়ের জোরে কতকগুলো কথা লিখে দিলাম অথবা জন্মদিনের মওকা পাওয়া গেছে বলে প্রশস্তি ঝেড়ে দিলাম, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। ধ্রুবকের মতো এই সত্য বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলি-কণায় বিরাজমান হয়ে উঠেছে যে, এই দেশের পরিচালনা ভার তারেক রহমানের ওপর অর্পিত হবে এবং তিনি দীর্ঘ সময় রাজনীতিকে প্রভাবিত ও প্রবাহিত করবেন। সিনা টানটান করে এই কথাটা বললে এ মুহূর্তে টিকা-টিপ্পনি জুড়ে দেয়ার লোক খুবই কম। রাজনীতিবিদদের আমলনামা আঁচ করতে চাওয়ার আস্পর্ধা নাগরিকের দিক থেকে অপরাধ নয়। সেই সন্ধিত্সায় কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি এবং সে সবের উত্তর অনায়াসে পেয়ে যাওয়াটাও সম্ভব।
বাংলাদেশের কোন্ রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব নির্ধারিত হয়ে আছে দলের নেতা-কর্মীদের আনন্দময় সম্মতিতে? তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে ২০০৯-এ বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’—এই স্লোগানের প্রবল উচ্চারণে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেছে। শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার সন্তান রূপে নয় বরং এই দলের পরীক্ষিত, অপরিহার্য এবং অনিবার্য সেনাপতি হিসেবে দল তাকে চেয়েছে। ‘তারেক রহমান : অপেক্ষায় বাংলাদেশ’ গ্রন্থের পর্যালোচনা মতে, তিনি ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। ’৯১-র সংসদ নির্বাচনের সময় ক্যাম্পেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৯৭ থেকে বনানীতে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে নিয়মিত সক্রিয় হন। ২০০১ সালে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির গবেষণা, মনিটরিং ও নির্বাচন পরিচালনা সেলটির অগ্রণী ভূমিকা সবারই জানা। চাইলে সরকারেও যোগ দিতে পারতেন, কিন্তু দলকে সুসংগঠিত করতেই তার প্রচণ্ড আগ্রহ। ২০০২ সালের ২২ জুন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নিযুক্ত করেন। তৃণমূল-সঞ্চারী এই তরুণ বিভাগীয় প্রতিনিধি সভাগুলো করে রাজনীতিতে নতুন গতি যোগ করেন। তারেক রহমানের আগমন বা উত্থানকে উপ-মহাদেশের পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকে আসা রাজনীতিকদের সঙ্গে তুলনা করা চলে না এ জন্য যে, সোনিয়া-রাজীব, বেনজীর-আসিফ-বিলওয়াল, বেগম খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা যেমনি করে সৃষ্ট শূন্যতায় দলের অনুরোধে দায়িত্ব নিয়েছেন, তারেক রহমান নিজেকে দেশ-দল-মাটি মানুষের পারস্পরিক অন্বয়ের আত্মদহনে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। ভোগের চেয়ে ত্যাগের মানসিকতা এই তরুণের মধ্যে প্রবল। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়েছেন বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনও নিশ্চল। সম্ভবত আগ্রহীও নন। তারেক রহমানের মতো মাটি-মানুষের অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে শূন্যতা হলে সজীব ওয়াজেদ এক সময়ে দায়িত্ব নিলেও নিতে পারেন। তারেক রহমানের কম বয়সে বড় দায়িত্ব নিয়ে মহলবিশেষের ছড়ানো বিভ্রান্তি সম্পর্কে আলোচ্য গ্রন্থটির বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল শহীদ জিয়া যখন প্রেসিডেন্ট হন তার বয়স ছিল ৪১ বছর ৩ মাস। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মধ্য-মঞ্চে তিনি যখন আবির্ভূত হন তখন তিনি ৩৯ বছর ১০ মাসের টগবগে তরুণ। ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় বেগম খালেদা জিয়ার বয়স ৩৯ বছর। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হয় তখন তার বয়স ৩৪। রাজীব গান্ধী ৪০ বছর বয়সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সবশেষে বলব, জাতীয় ঘটনাপ্রবাহ এবং রাজনীতিকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য তারেক রহমানের হয়েছে। পিতার মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা, মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিজয় দেখা, ৭ নভেম্বরে জাতীয় বিপ্লবকে ভেতর থেকে অনুভব করা, শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা এবং উন্নয়নে উন্নয়নে বাংলাদেশকে সবল করার মহোত্সব, কদর্য সামরিক শাসন ও আওয়ামী দুঃশাসনকে প্রত্যক্ষ করা — সব অভিজ্ঞতাই তার রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি উঠতে পারে এভাবে, বাংলাদেশের কোন রাজনীতিবিদ মিথ্যা মামলায়, দৈহিক নির্যাতনে সবচেয়ে বেশি পীড়িত হয়েছেন? এক নিঃশ্বাসে যে নাম নেয়া যায় তাহলো তারেক রহমান। ১/১১’র মূল টার্গেট তারেক রহমান। ওই সময় শিশুরা এই রটনায় বড় হয়ে উঠেছিল যে, তারেক রহমান গণতন্ত্র ও সুশাসনের খলনায়ক। হাওয়া ভবন ছিল যত্তোসব অনিয়মের উত্স। তাকে ঘিরে হিন্দি সিনেমার মতো গল্প বানিয়ে, গল্প ছড়িয়ে কী বিষাক্ত ধিক্কারই না দেগে দেয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র বিনাশের সেই কালোক্ষণে তারেক-গিবতই হয়ে উঠেছিল লিভিং স্পেন্সের নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা অভিযোগে শহীদ মঈনুল রোড়ের বাড়ি থেকে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গং গুনে গুনে ১৩টি মামলা দিয়েছিল। কোনোটিতেই তারেক রহমান সরাসরি আসামি নন। কারণ তিনি প্রজাতন্ত্রের কোনো পদেই ছিলেন না, কোনো সরকারি নথিতে নেই তার স্বাক্ষর। মামলাগুলোর কথিত আসামিদের ধরে পিটিয়ে সাজানো স্বীকারোক্তি ছিল তারেক রহমানকে ফাঁসানোর অস্ত্র। ১৩টির মধ্যে ১১টি উচ্চ আদালতের রায়ে স্থগিত হয়ে যায়। কাফরুল থানায় দ্রুত বিচার আইনে ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল যে মামলাটি হয়, তাতে তারেককে ফাঁসাতে মরিয়া ১/১১’র অবৈধ সরকার দু’দিনের ব্যবধানে দু’বার আইন সংশোধন করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তা আমলে নেয়নি। বাকি দুই মামলার মধ্যে ‘দিনকাল’ মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলা বিচারাধীন। মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় পরে তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছে। একুশে আগস্টের মামলায় ফাঁসানোর পাঁয়তারা আছে। অথচ সে সবেও তিনি মূল আসামি নন। সে সময়ে তার ৫৫৪ দিনের কারাবাস ছিল মানবাধিকার বিপর্যয়ের এক লোমহর্ষক ইতিহাস। আমরা কি কোনো রাজনীতিককে এর আগে দেখেছি যে র্যাবের বর্ম পরিয়ে মাথায় হেলমেট সেঁটে কোর্টে হাজির করানো হয়েছে? বহু রাজনীতিক বহুবার জেল খেটেছেন। কিন্তু তাদের এমন অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন সইতে হয়নি। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের পরিবারের কেউ তো নয়ই, কারাগারের অন্ধকার সেলে থাকতে থাকতে কারও চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। অসুখে মৃত্যুর পথে এগিয়েছেন, গোয়েন্দা সেলে বর্বরতার শিকারও হয়েছেন। কিন্তু রিমান্ডের নামে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার সমকালীন স্মৃতি আর নেই। লন্ডনে আমাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি সেই রক্তাক্ত অতীতকে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর ইলেকট্রিক শকসহ নানাভাবে দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক ওপর থেকে বারবার নিচে ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র দয়া হয়নি। ওদের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমাকে কষ্টে কষ্টে মেরে ফেলা। তারপর আবার কারাগারে। কোনো ডাক্তার আসে না, চিকিত্সা হয় না। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। কোমরের ভাঙা হাড়ের যন্ত্রণা যে কী অসহ্য তা বলে বোঝাতে পারব না।’ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আদালতে তিনি জীবনের নিরাপত্তা চাইলেন। বললেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ। কোনো সন্ত্রাসী নই।’ ২৯ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০৮’র ৯ জুন অ্যাম্বুলেন্সে করে আদালতে নেয়া হলে কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারেও বসে থাকতে পারেননি। ১২টি মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০০৮-এর ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। পিজি হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়া মা বেগম খালেদা জিয়ার বুকে বেদনার্ত তারেকের রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন পিজি হাসপাতালের বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল। ১১ সেপ্টেম্বর চিকিত্সার জন্য লন্ডন যাত্রা। চার বছর পেরিয়ে গেছে। আগের চেয়ে অনেক সুস্থ, তবে এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কিন্তু কখনও পুরোপুরি সুস্থ হবেন না। তবে অসম্ভব উঁচু তার মনোবল। কত ঋজু তার আত্মিক ভঙ্গিমা—‘তিক্ত অতীত ভুলে এখন সামনের দিকে এগোতে চাই। একদিন আমি ফিরব। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্নের রূপায়ন ঘটাবো।’
তারেক রহমানের জন্য মিথ্যা মামলা আর শারীরিক নির্যাতনই কি একমাত্র শাস্তি? নজিরবিহীন এক মিডিয়া-বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন তিনি। এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ, আওয়ামীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, ডিজিএফআইয়ের বানানো প্রতিবেদন ও প্রদত্ত তথ্য গ্রোগ্রাসে গিলেছে আর উগড়েছে। দুর্নীতির কত না গল্প আর ভুয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির খবর ছেপেছে। সেসব লাল শিরোনাম গণতন্ত্রকেই ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ছিল ওই অপপ্রচার। এখনও কি বন্ধ হয়েছে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় বসেই সেই বিদ্বিষ্ট প্রচারণা, আন্তর্জাতিক মহলে তাকে বিষিয়ে তোলা, যুক্তরাজ্য থেকে তাকে ফেরত আনার জন্য মন্ত্রী পাঠানো, লবিয়িং করা, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো, বহু রকমের বই প্রকাশ—কম করেনি। কিন্তু কাজ হয়নি। নীরবে-নিভৃতে যন্ত্রণা বুকে চেপে তিনি প্রবাসে থেকেছেন। সময়ের বিচারের উত্কাঙ্ক্ষায় সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে নির্বাসিত রেখেছেন, রাজনৈতিকভাবে একা থাকার বিবাগী সৃজন সুখকে পাখা মেলতে দিয়েছেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের এনলাইটেনমেন্টে। দুঃসহ অতীত ও বর্তমানকে সয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজকে ভেতর থেকে গড়ে তুলেছেন। আমার মনে হয়, তারেক রহমান তার জীবদ্দশায় কারও মানবাধিকার খর্ব করেননি, বিরুদ্ধে লেখার জন্য কোনো সাংবাদিককে গ্রেফতার করাননি, সংবাদপত্রের অফিসে তালা মারেননি, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে কাজ করেননি। গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র-বান্ধব জিয়া পরিবারের ঐতিহ্য তিনি সমুন্নত রেখেছেন। উল্টো অনেক মিডিয়া হাউসের জন্ম তার শুভেচ্ছায় হয়েছে, ‘সমকাল’ পত্রিকাটির ডিক্লারেশন তিনিই দিয়েছিলেন। অথচ আজকে যখন তারেক রহমানকে ‘এনিমি অব দ্য স্টেট’ বানানোর অশুভ প্রক্রিয়া চলে, আমরা নিরুচ্চার। এমনকি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অভিজন সমাজের কেউ কেউ আছেন যারা মুখ খুলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। আমরা সবাই বলি, আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি। আইনের শাসনের অর্থ হলো, শত অপরাধী আইনের ফাঁক- ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন কোনো শাস্তি বা দুর্ভোগ না পোহায়। তারেক রহমানের মতো নিরপরাধ ব্যক্তিকে নিয়ে যা করা হয়েছে, তা আজ পরিষ্কার। এ মুহূর্তে আইনের শাসন মানে প্রথমে তারেক রহমানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও মামলামুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করা।
তারেক-গিবত যত হয়েছে, জীবদ্দশায় আর কোনো রাজনীতিকের বেলায় এমনটি হয়নি। পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা আসরের ব্যাখ্যায় আলেম সমাজ বলে থাকেন, কারও নামে গিবত অর্থাত্ মিথ্যা প্রচার করা হলে এই পাপের জন্য আল্লাহ গিবতকারীকে ক্ষমা করতে পারেন না। ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র তারই আছে, যিনি গিবতের শিকার। গিবত এমনই মহাপাপ, যে ব্যক্তি অপরের নামে গিবত গায়, সে ব্যক্তির আমলনামায় তখন যে পুণ্য ছিল তা গিবতের শিকার ব্যক্তির আমলনামায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। তারেক রহমান নিশ্চয়ই এদিক দিয়ে ভাগ্যবান।
সবশেষে যে প্রশ্নটি ওঠা জরুরি, আগামীতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন এমন কোনো রাজনীতিকের কোনো ঘোষিত স্বপ্নের জানান পেয়েছি কি আমরা? নির্দ্বিধায় বলতে পারি তারেক রহমানের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি। মাটি ও মানুষকে জাগিয়ে বাংলাদেশকে আপন সম্পদে স্বয়ম্ভর করা, আধুনিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো, প্রান্তিক মানুষকে অগ্রে রেখে রাজনীতিকে বিকাশ করা, গণতন্ত্রের আত্মাকে সজীব-সচল করা—সবই তার ঘোষিত স্বপ্ন। শহীদ জিয়ার স্বপ্নেরই এক সময়োচিত সমপ্রসারণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অথবা এর সুঠাম-স্বনির্ভর অভিযাত্রার সঙ্গে জিয়া পরিবারের যে আত্মিক বন্ধন, তার ধারাবাহিকতায় তারেক রহমান আজ অজেয় উত্তরাধিকারে স্থিত হয়েছেন। ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিক আয়োজিত গোলটেবিল সংলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস ২০২৫ সালের বাংলাদেশ হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, অর্থনৈতিকভাবে সফল, উন্নত একটি গণতান্ত্রিক দেশ—যাকে অন্যরা শ্রদ্ধা করবে, বিশ্ববাসী সম্মানের সঙ্গে তাকাবে। এই হচ্ছে আমার এবং আমার প্রজন্মের সব বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন।’ কৃষির উন্নয়ন এবং তাকে ভিত্তি করে শিল্পের বিকাশ সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, কৃষকের জন্য ভালো বীজ দেয়া, গরিবের সঙ্গে হাঁস-মুরগির প্রতিপালনসহ অসংখ্য কাজে তিনি হাত বাড়িয়েছেন আগ্রহ ভরে। গ্রামে গ্রামে জরিপ চালিয়েছেন কত মাছ, ফল, ধান হয় প্রতি গ্রামে। সাগরে ও নদীতে জেগে ওঠা পলিকে সোনা বানানোর রূপকল্পও তার নাগালের বাইরে নয়। ‘একটু উদ্যোগ, একটু চেষ্টা, এনে দেবে সফলতা’—এই কর্তব্যতন্ত্রকে ছড়িয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন প্রতিটি জনপদে মানবিকতার বিকাশ হোক, সবাই সবার জন্য হয়ে উঠুক। রাজনীতি এবং উন্নয়নে এ উচ্চারণের নেতা তারেক রহমানই। বাংলাদেশের বাঁচা এর ওপরই নির্ভর করছে।
একথা খোদ তারেক রহমানও বলতে পারবেন না, অতীতে তিনি কোনো ভুল করেননি। কাজ করলেই ভুল হয়। কিন্তু অপপ্রচারের আয়তন আর ভুলের পরিসর কখনও এক রকম ছিল না তার জন্য। তিলকে তাল করা হয়েছে স্রেফ এই উদীয়মান নেতাকে রুখে দেয়ার জন্য। ‘আমাকে দিয়ে কখন কে কোন স্বার্থে কী কাজ করাতে চেয়েছে, সব সময় তা পাহারা দেয়া সম্ভব ছিল না। হতে পারে কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু যখনই আমার নজরে এসেছে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।’ জর্জ ফ্রিডম্যান নামে আমেরিকার নামকরা রাজনৈতিক গণক ‘নেক্সট হানড্রেড ইয়ারস’ বইয়ের ভূমিকায় রাজনীতিবিদদের ভুল সম্পর্কে বলেছেন—
It is the delight of all societies to belittle their political leaders and leaders surely do make mistakes. But the mistakes they make, when carefully examined, are rarely stupid. More likely mistakes are forced on them by circumstances... politicians are rarely free actors.
(রাজনৈতিক নেতাদের খাটো করতে সব সমাজই এক ধরনের মজা পায় এবং নেতারা অবশ্যই ভুল করে থাকেন। তবে সতর্ক বিচারে সেসবকে আহাম্মকি বলা যাবে খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান, পারিপার্শ্বিকতাই বাধ্য করে ভুল ঘটাতে। রাজনীতিবিদরা প্রায়ই প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন না।)
৪৮তম জন্মদিনে আগামীর দেশনায়ককে শুভেচ্ছা। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ তিনি। তারেক রহমানকে ধরে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দিন শেষ। এ ক্ষেত্রে সরকারের তাবত্ ক্ষমতা নিঃশেষ আর আন্তর্জাতিক মহলেও তার সম্পর্কে বিভ্রান্তির অবসান হয়ে গেছে। তিনি কবে ফিরবেন—আজকের বাংলাদেশে একটি এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কতিপয়ের ভ্রূকুটি বাদ দিলে, দেশবাসী তার বাংলাদেশ-কাঁপানো প্রত্যাবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ৪৯তম জন্মদিন অবশ্যই বাংলাদেশে তাকে নিয়ে আমরা পালন করব ।
লেখক : উইকলি ইকোনমিক টাইমসের সম্পাদক
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব
পত্রিকায় কলাম লেখার সুযোগ আছে, গায়ের জোরে কতকগুলো কথা লিখে দিলাম অথবা জন্মদিনের মওকা পাওয়া গেছে বলে প্রশস্তি ঝেড়ে দিলাম, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। ধ্রুবকের মতো এই সত্য বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলি-কণায় বিরাজমান হয়ে উঠেছে যে, এই দেশের পরিচালনা ভার তারেক রহমানের ওপর অর্পিত হবে এবং তিনি দীর্ঘ সময় রাজনীতিকে প্রভাবিত ও প্রবাহিত করবেন। সিনা টানটান করে এই কথাটা বললে এ মুহূর্তে টিকা-টিপ্পনি জুড়ে দেয়ার লোক খুবই কম। রাজনীতিবিদদের আমলনামা আঁচ করতে চাওয়ার আস্পর্ধা নাগরিকের দিক থেকে অপরাধ নয়। সেই সন্ধিত্সায় কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি এবং সে সবের উত্তর অনায়াসে পেয়ে যাওয়াটাও সম্ভব।
বাংলাদেশের কোন্ রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব নির্ধারিত হয়ে আছে দলের নেতা-কর্মীদের আনন্দময় সম্মতিতে? তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে ২০০৯-এ বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’—এই স্লোগানের প্রবল উচ্চারণে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করেছে। শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার সন্তান রূপে নয় বরং এই দলের পরীক্ষিত, অপরিহার্য এবং অনিবার্য সেনাপতি হিসেবে দল তাকে চেয়েছে। ‘তারেক রহমান : অপেক্ষায় বাংলাদেশ’ গ্রন্থের পর্যালোচনা মতে, তিনি ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হন। ’৯১-র সংসদ নির্বাচনের সময় ক্যাম্পেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৯৭ থেকে বনানীতে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে নিয়মিত সক্রিয় হন। ২০০১ সালে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির গবেষণা, মনিটরিং ও নির্বাচন পরিচালনা সেলটির অগ্রণী ভূমিকা সবারই জানা। চাইলে সরকারেও যোগ দিতে পারতেন, কিন্তু দলকে সুসংগঠিত করতেই তার প্রচণ্ড আগ্রহ। ২০০২ সালের ২২ জুন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নিযুক্ত করেন। তৃণমূল-সঞ্চারী এই তরুণ বিভাগীয় প্রতিনিধি সভাগুলো করে রাজনীতিতে নতুন গতি যোগ করেন। তারেক রহমানের আগমন বা উত্থানকে উপ-মহাদেশের পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকে আসা রাজনীতিকদের সঙ্গে তুলনা করা চলে না এ জন্য যে, সোনিয়া-রাজীব, বেনজীর-আসিফ-বিলওয়াল, বেগম খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা যেমনি করে সৃষ্ট শূন্যতায় দলের অনুরোধে দায়িত্ব নিয়েছেন, তারেক রহমান নিজেকে দেশ-দল-মাটি মানুষের পারস্পরিক অন্বয়ের আত্মদহনে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। ভোগের চেয়ে ত্যাগের মানসিকতা এই তরুণের মধ্যে প্রবল। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়েছেন বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখনও নিশ্চল। সম্ভবত আগ্রহীও নন। তারেক রহমানের মতো মাটি-মানুষের অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে শূন্যতা হলে সজীব ওয়াজেদ এক সময়ে দায়িত্ব নিলেও নিতে পারেন। তারেক রহমানের কম বয়সে বড় দায়িত্ব নিয়ে মহলবিশেষের ছড়ানো বিভ্রান্তি সম্পর্কে আলোচ্য গ্রন্থটির বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল শহীদ জিয়া যখন প্রেসিডেন্ট হন তার বয়স ছিল ৪১ বছর ৩ মাস। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মধ্য-মঞ্চে তিনি যখন আবির্ভূত হন তখন তিনি ৩৯ বছর ১০ মাসের টগবগে তরুণ। ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় বেগম খালেদা জিয়ার বয়স ৩৯ বছর। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হয় তখন তার বয়স ৩৪। রাজীব গান্ধী ৪০ বছর বয়সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সবশেষে বলব, জাতীয় ঘটনাপ্রবাহ এবং রাজনীতিকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য তারেক রহমানের হয়েছে। পিতার মুখ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনা, মুক্তিযুদ্ধ ও তার বিজয় দেখা, ৭ নভেম্বরে জাতীয় বিপ্লবকে ভেতর থেকে অনুভব করা, শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা এবং উন্নয়নে উন্নয়নে বাংলাদেশকে সবল করার মহোত্সব, কদর্য সামরিক শাসন ও আওয়ামী দুঃশাসনকে প্রত্যক্ষ করা — সব অভিজ্ঞতাই তার রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি উঠতে পারে এভাবে, বাংলাদেশের কোন রাজনীতিবিদ মিথ্যা মামলায়, দৈহিক নির্যাতনে সবচেয়ে বেশি পীড়িত হয়েছেন? এক নিঃশ্বাসে যে নাম নেয়া যায় তাহলো তারেক রহমান। ১/১১’র মূল টার্গেট তারেক রহমান। ওই সময় শিশুরা এই রটনায় বড় হয়ে উঠেছিল যে, তারেক রহমান গণতন্ত্র ও সুশাসনের খলনায়ক। হাওয়া ভবন ছিল যত্তোসব অনিয়মের উত্স। তাকে ঘিরে হিন্দি সিনেমার মতো গল্প বানিয়ে, গল্প ছড়িয়ে কী বিষাক্ত ধিক্কারই না দেগে দেয়া হয়েছিল। গণতন্ত্র বিনাশের সেই কালোক্ষণে তারেক-গিবতই হয়ে উঠেছিল লিভিং স্পেন্সের নিয়মিত ঘটনা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা অভিযোগে শহীদ মঈনুল রোড়ের বাড়ি থেকে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন গং গুনে গুনে ১৩টি মামলা দিয়েছিল। কোনোটিতেই তারেক রহমান সরাসরি আসামি নন। কারণ তিনি প্রজাতন্ত্রের কোনো পদেই ছিলেন না, কোনো সরকারি নথিতে নেই তার স্বাক্ষর। মামলাগুলোর কথিত আসামিদের ধরে পিটিয়ে সাজানো স্বীকারোক্তি ছিল তারেক রহমানকে ফাঁসানোর অস্ত্র। ১৩টির মধ্যে ১১টি উচ্চ আদালতের রায়ে স্থগিত হয়ে যায়। কাফরুল থানায় দ্রুত বিচার আইনে ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল যে মামলাটি হয়, তাতে তারেককে ফাঁসাতে মরিয়া ১/১১’র অবৈধ সরকার দু’দিনের ব্যবধানে দু’বার আইন সংশোধন করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট তা আমলে নেয়নি। বাকি দুই মামলার মধ্যে ‘দিনকাল’ মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলা বিচারাধীন। মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় পরে তারেক রহমানকে জড়ানো হয়েছে। একুশে আগস্টের মামলায় ফাঁসানোর পাঁয়তারা আছে। অথচ সে সবেও তিনি মূল আসামি নন। সে সময়ে তার ৫৫৪ দিনের কারাবাস ছিল মানবাধিকার বিপর্যয়ের এক লোমহর্ষক ইতিহাস। আমরা কি কোনো রাজনীতিককে এর আগে দেখেছি যে র্যাবের বর্ম পরিয়ে মাথায় হেলমেট সেঁটে কোর্টে হাজির করানো হয়েছে? বহু রাজনীতিক বহুবার জেল খেটেছেন। কিন্তু তাদের এমন অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন সইতে হয়নি। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের পরিবারের কেউ তো নয়ই, কারাগারের অন্ধকার সেলে থাকতে থাকতে কারও চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। অসুখে মৃত্যুর পথে এগিয়েছেন, গোয়েন্দা সেলে বর্বরতার শিকারও হয়েছেন। কিন্তু রিমান্ডের নামে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার সমকালীন স্মৃতি আর নেই। লন্ডনে আমাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি সেই রক্তাক্ত অতীতকে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন ‘২০০৭-এর ৩১ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকাকালে আমার ওপর ইলেকট্রিক শকসহ নানাভাবে দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল অনেক ওপর থেকে বারবার নিচে ফেলে দেয়া। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু ওইসব অফিসারের বিন্দুমাত্র দয়া হয়নি। ওদের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আমাকে কষ্টে কষ্টে মেরে ফেলা। তারপর আবার কারাগারে। কোনো ডাক্তার আসে না, চিকিত্সা হয় না। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়। কোমরের ভাঙা হাড়ের যন্ত্রণা যে কী অসহ্য তা বলে বোঝাতে পারব না।’ ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে আদালতে তিনি জীবনের নিরাপত্তা চাইলেন। বললেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের নামে চোখ বেঁধে রিমান্ডে নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা আমাকে নিগৃহীত করা হয়েছে। আমি একজন রাজনীতিবিদ। কোনো সন্ত্রাসী নই।’ ২৯ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০৮’র ৯ জুন অ্যাম্বুলেন্সে করে আদালতে নেয়া হলে কাঠগড়ায় হুইল চেয়ারেও বসে থাকতে পারেননি। ১২টি মামলায় জামিন পাওয়ার পর ২০০৮-এর ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তি পান। পিজি হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়া মা বেগম খালেদা জিয়ার বুকে বেদনার্ত তারেকের রোদন ও বাষ্পরুদ্ধ কথোপকথন পিজি হাসপাতালের বাতাসকে ভারি করে তুলেছিল। ১১ সেপ্টেম্বর চিকিত্সার জন্য লন্ডন যাত্রা। চার বছর পেরিয়ে গেছে। আগের চেয়ে অনেক সুস্থ, তবে এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কিন্তু কখনও পুরোপুরি সুস্থ হবেন না। তবে অসম্ভব উঁচু তার মনোবল। কত ঋজু তার আত্মিক ভঙ্গিমা—‘তিক্ত অতীত ভুলে এখন সামনের দিকে এগোতে চাই। একদিন আমি ফিরব। বাংলাদেশ নিয়ে আমার স্বপ্নের রূপায়ন ঘটাবো।’
তারেক রহমানের জন্য মিথ্যা মামলা আর শারীরিক নির্যাতনই কি একমাত্র শাস্তি? নজিরবিহীন এক মিডিয়া-বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন তিনি। এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ, আওয়ামীদের কথা না হয় বাদই দিলাম, ডিজিএফআইয়ের বানানো প্রতিবেদন ও প্রদত্ত তথ্য গ্রোগ্রাসে গিলেছে আর উগড়েছে। দুর্নীতির কত না গল্প আর ভুয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির খবর ছেপেছে। সেসব লাল শিরোনাম গণতন্ত্রকেই ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ছিল ওই অপপ্রচার। এখনও কি বন্ধ হয়েছে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় বসেই সেই বিদ্বিষ্ট প্রচারণা, আন্তর্জাতিক মহলে তাকে বিষিয়ে তোলা, যুক্তরাজ্য থেকে তাকে ফেরত আনার জন্য মন্ত্রী পাঠানো, লবিয়িং করা, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো, বহু রকমের বই প্রকাশ—কম করেনি। কিন্তু কাজ হয়নি। নীরবে-নিভৃতে যন্ত্রণা বুকে চেপে তিনি প্রবাসে থেকেছেন। সময়ের বিচারের উত্কাঙ্ক্ষায় সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে নির্বাসিত রেখেছেন, রাজনৈতিকভাবে একা থাকার বিবাগী সৃজন সুখকে পাখা মেলতে দিয়েছেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের এনলাইটেনমেন্টে। দুঃসহ অতীত ও বর্তমানকে সয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজকে ভেতর থেকে গড়ে তুলেছেন। আমার মনে হয়, তারেক রহমান তার জীবদ্দশায় কারও মানবাধিকার খর্ব করেননি, বিরুদ্ধে লেখার জন্য কোনো সাংবাদিককে গ্রেফতার করাননি, সংবাদপত্রের অফিসে তালা মারেননি, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে কাজ করেননি। গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র-বান্ধব জিয়া পরিবারের ঐতিহ্য তিনি সমুন্নত রেখেছেন। উল্টো অনেক মিডিয়া হাউসের জন্ম তার শুভেচ্ছায় হয়েছে, ‘সমকাল’ পত্রিকাটির ডিক্লারেশন তিনিই দিয়েছিলেন। অথচ আজকে যখন তারেক রহমানকে ‘এনিমি অব দ্য স্টেট’ বানানোর অশুভ প্রক্রিয়া চলে, আমরা নিরুচ্চার। এমনকি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অভিজন সমাজের কেউ কেউ আছেন যারা মুখ খুলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। আমরা সবাই বলি, আইনের শাসনে আমরা বিশ্বাস করি। আইনের শাসনের অর্থ হলো, শত অপরাধী আইনের ফাঁক- ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন নিরপরাধ যেন কোনো শাস্তি বা দুর্ভোগ না পোহায়। তারেক রহমানের মতো নিরপরাধ ব্যক্তিকে নিয়ে যা করা হয়েছে, তা আজ পরিষ্কার। এ মুহূর্তে আইনের শাসন মানে প্রথমে তারেক রহমানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও মামলামুক্ত পরিবেশে রাজনীতি করা।
তারেক-গিবত যত হয়েছে, জীবদ্দশায় আর কোনো রাজনীতিকের বেলায় এমনটি হয়নি। পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা আসরের ব্যাখ্যায় আলেম সমাজ বলে থাকেন, কারও নামে গিবত অর্থাত্ মিথ্যা প্রচার করা হলে এই পাপের জন্য আল্লাহ গিবতকারীকে ক্ষমা করতে পারেন না। ক্ষমা করার অধিকার একমাত্র তারই আছে, যিনি গিবতের শিকার। গিবত এমনই মহাপাপ, যে ব্যক্তি অপরের নামে গিবত গায়, সে ব্যক্তির আমলনামায় তখন যে পুণ্য ছিল তা গিবতের শিকার ব্যক্তির আমলনামায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। তারেক রহমান নিশ্চয়ই এদিক দিয়ে ভাগ্যবান।
সবশেষে যে প্রশ্নটি ওঠা জরুরি, আগামীতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন এমন কোনো রাজনীতিকের কোনো ঘোষিত স্বপ্নের জানান পেয়েছি কি আমরা? নির্দ্বিধায় বলতে পারি তারেক রহমানের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি। মাটি ও মানুষকে জাগিয়ে বাংলাদেশকে আপন সম্পদে স্বয়ম্ভর করা, আধুনিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো, প্রান্তিক মানুষকে অগ্রে রেখে রাজনীতিকে বিকাশ করা, গণতন্ত্রের আত্মাকে সজীব-সচল করা—সবই তার ঘোষিত স্বপ্ন। শহীদ জিয়ার স্বপ্নেরই এক সময়োচিত সমপ্রসারণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অথবা এর সুঠাম-স্বনির্ভর অভিযাত্রার সঙ্গে জিয়া পরিবারের যে আত্মিক বন্ধন, তার ধারাবাহিকতায় তারেক রহমান আজ অজেয় উত্তরাধিকারে স্থিত হয়েছেন। ২০০৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিক আয়োজিত গোলটেবিল সংলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস ২০২৫ সালের বাংলাদেশ হবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, অর্থনৈতিকভাবে সফল, উন্নত একটি গণতান্ত্রিক দেশ—যাকে অন্যরা শ্রদ্ধা করবে, বিশ্ববাসী সম্মানের সঙ্গে তাকাবে। এই হচ্ছে আমার এবং আমার প্রজন্মের সব বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন।’ কৃষির উন্নয়ন এবং তাকে ভিত্তি করে শিল্পের বিকাশ সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, কৃষকের জন্য ভালো বীজ দেয়া, গরিবের সঙ্গে হাঁস-মুরগির প্রতিপালনসহ অসংখ্য কাজে তিনি হাত বাড়িয়েছেন আগ্রহ ভরে। গ্রামে গ্রামে জরিপ চালিয়েছেন কত মাছ, ফল, ধান হয় প্রতি গ্রামে। সাগরে ও নদীতে জেগে ওঠা পলিকে সোনা বানানোর রূপকল্পও তার নাগালের বাইরে নয়। ‘একটু উদ্যোগ, একটু চেষ্টা, এনে দেবে সফলতা’—এই কর্তব্যতন্ত্রকে ছড়িয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন প্রতিটি জনপদে মানবিকতার বিকাশ হোক, সবাই সবার জন্য হয়ে উঠুক। রাজনীতি এবং উন্নয়নে এ উচ্চারণের নেতা তারেক রহমানই। বাংলাদেশের বাঁচা এর ওপরই নির্ভর করছে।
একথা খোদ তারেক রহমানও বলতে পারবেন না, অতীতে তিনি কোনো ভুল করেননি। কাজ করলেই ভুল হয়। কিন্তু অপপ্রচারের আয়তন আর ভুলের পরিসর কখনও এক রকম ছিল না তার জন্য। তিলকে তাল করা হয়েছে স্রেফ এই উদীয়মান নেতাকে রুখে দেয়ার জন্য। ‘আমাকে দিয়ে কখন কে কোন স্বার্থে কী কাজ করাতে চেয়েছে, সব সময় তা পাহারা দেয়া সম্ভব ছিল না। হতে পারে কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু যখনই আমার নজরে এসেছে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।’ জর্জ ফ্রিডম্যান নামে আমেরিকার নামকরা রাজনৈতিক গণক ‘নেক্সট হানড্রেড ইয়ারস’ বইয়ের ভূমিকায় রাজনীতিবিদদের ভুল সম্পর্কে বলেছেন—
It is the delight of all societies to belittle their political leaders and leaders surely do make mistakes. But the mistakes they make, when carefully examined, are rarely stupid. More likely mistakes are forced on them by circumstances... politicians are rarely free actors.
(রাজনৈতিক নেতাদের খাটো করতে সব সমাজই এক ধরনের মজা পায় এবং নেতারা অবশ্যই ভুল করে থাকেন। তবে সতর্ক বিচারে সেসবকে আহাম্মকি বলা যাবে খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান, পারিপার্শ্বিকতাই বাধ্য করে ভুল ঘটাতে। রাজনীতিবিদরা প্রায়ই প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেন না।)
৪৮তম জন্মদিনে আগামীর দেশনায়ককে শুভেচ্ছা। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ তিনি। তারেক রহমানকে ধরে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দিন শেষ। এ ক্ষেত্রে সরকারের তাবত্ ক্ষমতা নিঃশেষ আর আন্তর্জাতিক মহলেও তার সম্পর্কে বিভ্রান্তির অবসান হয়ে গেছে। তিনি কবে ফিরবেন—আজকের বাংলাদেশে একটি এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কতিপয়ের ভ্রূকুটি বাদ দিলে, দেশবাসী তার বাংলাদেশ-কাঁপানো প্রত্যাবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ৪৯তম জন্মদিন অবশ্যই বাংলাদেশে তাকে নিয়ে আমরা পালন করব ।
লেখক : উইকলি ইকোনমিক টাইমসের সম্পাদক
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন