বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১২

এখনি না রুখলে ভয়াবহ বিপর্যয়

সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি
রাজধানীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন শাখা থেকে গত তিন বছরে ভুয়া ঋণপত্রের মাধ্যমে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী ও বেসরকারি মালিকানাধীন প্রাইম ব্যাংক থেকেই জালিয়াতি হয়েছে সাত হাজার ৩১৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া এক থেকে ৩০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংকসহ ২২টি ব্যাংক থেকে। দুর্নীতিবাজেরা এসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে এ বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।  সহযোগী একটি দৈনিকের এ খবরটি দেশের অর্থনীতির জন্য শুধু উদ্বেগজনকই নয়, একই সাথে আর্থিক খাতে বড় রকমের এক বিপর্যয় নামার পূর্বাভাসও বটে। স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারের সময় এই দৈনিকটির এক উপসম্পাদকীয় দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। এর শিরোনাম ছিল ‘উলটপালট করে দে মা লুটে পুটে খাই’। সাম্প্রতিক কালে দেশের ব্যাংকিং খাতে হলমার্ক কেলেঙ্কারিসহ ঋণ জালিয়াতি ও ঋণপত্র জালিয়াতি নিয়ে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে কলামটির লেখক বেঁচে থাকলে একই শিরোনামে আরেকটি আলোচিত লেখা উপহার দিতে পারতেন।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের সময় যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তার অনেকটাই হয়তো এ সময়ে পূরণ হয়নি। গণতন্ত্র এখনো নানামুখী অনিশ্চয়তার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। ধনী-গরিব বৈষম্য আমরা দূর করতে পারিনি। কিন্তু আর্থসামাজিক অনেক ক্ষেত্রে আমরা অর্জনও করেছি অনেক কিছু। গত দুই দশকে মাথাপিছু আয় কয়েক গুণ বেড়েছে। রফতানি খাতের অর্জন অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। শিল্পায়নে একটি মজবুত ভিত তৈরি হয়েছে। এই অর্জনের পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এ দেশের ব্যাংকিং খাত। অতীতে রাজনৈতিক সরকারের সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সরকারি দলের সমর্থকদের নিয়োগদানের দৃষ্টান্ত পাওয়া যেত। কিন্তু তারা ছিলেন দেশের অর্থনীতি-শিল্প-বাণিজ্যর সাথে সম্পৃক্ত বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। বর্তমান সরকারের আমলে সে ঐতিহ্য আর রাখা যায়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগের নেতা-নেত্রীদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের না আছে ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতা, না আছে দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন। তাদের স্বপ্ন যেন একটাইÑ যে ক’দিন সময় পাই আখের গুছিয়ে নিই। এ ধরনের পরিচালকদের চাওয়া পূরণ করে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ মেরে দেয়ার মানসিকতার মতলবি উদ্যোক্তার অভাবও বাংলাদেশে নেই। এই দুয়ের সমন্বয়ে গত তিন বছর ব্যাংকের তহবিল হাতিয়ে নেয়ার যে প্রতিযোগিতা, তারই একটি চিত্র ফুটে উঠেছে প্রতিবেদনটিতে।
বাংলাদেশে এর আগেও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। তবে অঙ্ক ছিল শত কোটি টাকার ঘরে। তাতেই দেশের গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। এর প্রতিকারে ব্যাংকিং খাতে সংস্কারসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এখন কোনো ব্যাংকের ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তার পক্ষে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সহজ হয় না। যেকোনো বড় অঙ্কের ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো-সিআইবির ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। ঋণ জালিয়াতি কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ায় তানভীরের মতো মতলববাজ হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীরা এবার ঋণপত্র জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার যোগসাজশেই হলমার্ক এবং একই ঘরানার প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লিখিত সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পেরেছে। এ নিয়ে দুদক কাজ করছে। কিন্তু দুদক এক দিকে যেমন রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে নয়, তেমনিভাবে এ ধরনের জালিয়াতি উদঘাটনের জন্য যে ধরনের দক্ষ জনবল দরকার তা প্রতিষ্ঠানটিতে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারত। ব্যাংকটির ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু সুর চৌধুরী জনবল ঘাটতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বিষয়ে ভালোভাবে তদারকি করতে পারছে না বলে যে কথা বলেছেন, তা এ ব্যাংকে কাজ করেছেন এমন কোনো শীর্ষ কর্মকর্তা মানবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাই হলমার্ক জালিয়াতি উদঘাটন করেছেন। কিন্তু এক রহস্যজনক কারণে তাদের সামনে এগোতে দেয়া হয়নি। সময় থাকতে আরো যেসব ব্যাংকে অনুসন্ধান চালানোর সুপারিশ সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে করা হয়েছিল, তা চেপে রেখে জালিয়াতদের সময় করে দেয়া হয়েছে ফাইল গুছিয়ে নিতে। জালিয়াতির টাকার গন্তব্য নিয়ে অনুসন্ধানের সুপারিশ বাস্তবায়নেও এগোয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, ব্যাংকের লুটে নেয়া টাকা উদ্ধারে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার, তা না নিয়ে দুদকের মামলার ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো এক দিকে তহবিল সঙ্কটে অচলাবস্থার মুখে পড়ছে, অন্য দিকে ব্যাংকের বিপুল টাকা মেরে দিয়েও পার পাওয়ার নজির স্থাপন হতে যাচ্ছে।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতির স্বার্থে এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দেশ ও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়। ক্ষমতায় এক দল আসবে এক দল যাবে কিন্তু দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ  ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং দুদকের কর্তাদের বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যাংক জালিয়াতি রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা  নিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads