১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে যখন আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে, তখন মধ্যস্থতা করার জন্য শেখ হাসিনা বিদেশী কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত, অন্যান্য কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের বক্তব্য প্রদানকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা তীব্র ভাষায় সমালোচনা করছেন!
প্রধানত, শেখ হাসিনার আবেদনের পরিপ্রেেিত মতাসীন সরকার এবং আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান বের করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। বস্তুত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশীদের হস্তেেপর সূচনা হয়, যখন ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা স্বয়ং কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ পাঠালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মধ্যস্থতা করে সন্তোষজনক সমাধান করে দেয়ার জন্য।
নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর থেকে শেখ হাসিনা যে জোরদার আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে দাবি আদায় করেছিলেন, বর্তমানে সেই একই দাবি আদায়ে আন্দোলনরত, বিএনপির জন্য তা একটি ‘রেডিমেড’ কর্মসূচি হতে পারে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ৩০ নভেম্বর এক জনসভায় ভাষণে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ৭ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে একটানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সহযোগিতা নিয়ে আন্দোলন করার কারণে পাঁচদলীয় ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ আওয়ামী লীগের আন্দোলনে শামিল হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে পৃথক আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে।
ইতঃপূর্বে ২১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠনের রূপরেখা দেয়ার জন্য বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। ২২ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদ বর্জনের ফলে সুপ্রিম কোর্টের রায় দ্বারা শূন্য হয়ে যাওয়া ১৪৫টি আসনে ১৫ ডিসেম্বর উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল ঘোষণা করে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো উপনির্বাচন প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বেতার-টেলিভিশনে জাতির প্রতি ভাষণ দেন। সে দিনই তার অনুরোধে প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস জাতীয় সংসদ অবলুপ্ত করে দিয়েছিলেন।
একই দিন বিরোধী দলগুলো পৃথকভাবে সপ্তাহব্যাপী র্যালি, মিছিল ইত্যাদি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে ২৮ নভেম্বর সব থানাপর্যায়ে এবং ২৯ নভেম্বর সব জেলাপর্যায়ে এ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিরোধী দল ৭ ডিসেম্বর রেল, সড়ক ও নদীপথ অবরোধ করার পর ৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দফতর অভিমুখে মহামিছিল পরিচালনার ঘোষণা দেয়।
২৬ নভেম্বর বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে টেলিফোন সংলাপ হয়। সংলাপে হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুরোধ জানান। সে সংলাপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম অভিমুখে ‘ট্রেন মিছিলে’ রওনা দেন।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বাণিজ্য ও শেয়ারবাজার সম্পর্কিত প্রধান উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সে সময় ‘এফবিসিসিআই’য়ের সভাপতি ছিলেন। প্রধানত তিনি কলকাঠি নাড়ানোয় ৮ নভেম্বর ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিবাদে ১৫ মিনিট কর্মবিরতি পালন করে। ১৯ নভেম্বর সালমান ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন ঘোষণা করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। অনেকেই এ তৎপরতাকে তার নিজের ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস বলেই ধরে নেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশীদের হস্তেেপর সূচনা হয় যখন ১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি শেখ হাসিনা স্বয়ং কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলকে অনুরোধ পাঠান মধ্যস্থতা করে একটি সন্তোষজনক সমাধান করে দেয়ার জন্য। সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়েন স্টেফান ঢাকায় পৌঁছলে শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলগুলোর নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। নিনিয়েনের মধ্যস্থতা করার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
অতঃপর ৪ সেপ্টেম্বর (১৯৯৫) মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রসচিব রবিন রাফায়েল তার নির্ধারিত সফরসূচিতে ঢাকা এসে মতাসীন এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রয়াস পান। কিছুকাল আগে শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, তখন রাফায়েলের সাথে তার বৈঠক হয়। ঢাকায় তার সম্মানে মার্কিন দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজে আমন্ত্রিতদের মধ্যে বিরোধী দলগুলোর ১১ নেতা-প্রতিনিধি আন-অফিসিয়ালি বৈঠক করে রবিন রাফায়েলের কাছে তাদের দাবি পয়েন্টগুলো তুলে ধরে আলোচনা করেন। কিন্তু এতেও কোনো নিষ্পত্তি হলো না।
মতাসীন দল ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র অগ্রণী প্রয়াস চালায়। এই পরিপ্রেেিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মেরিল সর্বাধিক তৎপর থাকেন। মেরিল একাধিকবার খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সাথে এবং উভয় দলের নেতার সাথে বৈঠক করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণে যুক্তরাজ্য, ভারত ও জাপানের দূতাবাস থেকেও বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু বিদেশী কূটনীতিকদের কোনো প্রয়াস কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার দিকে অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
ডিসেম্বরে বিদেশী কূটনীতিকদের সব প্রচেষ্টা চূড়ান্ত নিষ্ফলতার দিকে যেতে থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরিল সরকার পে বাণিজ্য ও তথ্যমন্ত্রী শামসুল ইসলাম এবং বিরোধী পে আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর সাথে একাধিকবার বৈঠক করেন। কিন্তু তাদের সমঝোতায় আনতে ব্যর্থ হন।
সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হওয়া নিশ্চিত ছিল। ১৯৯৬ সালের প্রারম্ভ থেকে শেখ হাসিনা নির্দলীয় নিরপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে তার আন্দোলনকে সরকারের পতনের ল্েয ধাবিত করে চূড়ান্তপর্যায়ের আন্দোলন শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা আদায় করে ছাড়েন।
এর ১৪ বছর পরে পুনরায় দেশের শাসনমতায় আসীন হয়ে শেখ হাসিনা সর্বপ্রথমেই সংসদকে দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করালেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারার পরিপ্রেেিত এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার আন্দোলন তার রাজনৈতিক জীবনের উজ্জ্বলতম কীর্তি হতে পারত।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন