বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১২

১৯৭৫ সালের আগস্ট ও নভেম্বর এবং জিয়ার ভূমিকা



শা হ আ হ ম দ রে জা
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে বলে এবারও ৭ নভেম্বরের প্রতি চরম অবহেলাই দেখানো হয়েছে। অথচ ৭ নভেম্বর সাধারণ কোনো দিন নয়। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ছাত্র-জনতা ও সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী ষড়যন্ত্র ও প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ফলে দেশের স্বাধীন মর্যাদাই শুধু সংহত ও সমুন্নত হয়নি, একই সঙ্গে দেশকে একদলীয় বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। ফিরে এসেছিল বরং বহুদলীয় গণতন্ত্র। সব মিলিয়েই ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী ও সেবাদাসদের পক্ষ থেকে চালানো হচ্ছে পাল্টা প্রচারণা। এই প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো বিশেষ গোষ্ঠী আবার নিজেদের মতো করে ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যাও হাজির করছেন। ক্ষমতার জোরে জাতির ওপর চাপাতে চাচ্ছেন তাদের অভিমত। এ সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও দু-চারটি মাত্র নয়।
প্রথম উদাহরণ হলো, ইতিহাসের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তারা বলেছেন, ‘ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এ অঞ্চলের মানুষ এ বিভক্তি মেনে নেয়নি।’ অন্যদিকে তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু অমন কোনো বক্তব্যকে সমর্থন করে না। ‘এ অঞ্চলের মানুষ’ দেশ বিভাগ বা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা সমর্থন করেনি কথাটাও কোনো দিক থেকে সত্য নয়। কারণ প্রথমত, ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটিসহ একাধিক পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি তখন কলকাতাকেন্দ্রিক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তার বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশে এবং তিনি সর্বতোভাবেই ‘এ অঞ্চলের মানুষ’ ছিলেন। দ্বিতীয়ত, ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে এক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রস্তাব পাস করা হয়েছিল। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন অবিভক্ত বাংলার আরেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক সম্পর্কের সবদিক থেকে ‘এ অঞ্চলের মানুষ’ ছিলেন বলেই তিনি পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবের নেতা ছিলেন। তার এই পরিচিতি প্রমাণ করে না যে, ‘এ অঞ্চলের মানুষ’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের জাতীয় নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ আসামের ক্ষমতায় গেছে, মওলানা ভাসানী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মওলানা ভাসানীর চেষ্টাতেই গণভোটের মধ্য দিয়ে আসামের অংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। মওলানা ভাসানীর বাড়ি সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে এবং তিনিও ‘এ অঞ্চলের মানুষ’ই ছিলেন! চতুর্থত, ১৯৪৭-এর বিভাগকালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমউদ্দিনও নিশ্চয়ই ‘এ অঞ্চলের মানুষ’ ছিলেন। এ চারটি মাত্র তথ্যের ভিত্তিতেই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওই বিশেষজনদের ইতিহাসবিষয়ক ব্যাখ্যা ও মন্তব্য মোটেও সঠিক নয়। বাস্তবে ক্ষমতার জোরে জাতির ওপর তারা খবরদারি ফলাতে চেয়েছেন।
এ পর্যন্ত এসে প্রশ্ন উঠতে পারে, ৭ নভেম্বর সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইতিহাসের এই ব্যাখ্যার কেন উল্লেখ করা হচ্ছে। উত্তর হলো, মূলত অমন চিন্তার আলোকেই সেবাদাসদের ওই গোষ্ঠীটি জাতীয় জীবনের অন্যকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তারা এমনকি দেশের সংবিধানের নাড়ি ধরেও টান মেরেছেন। যেমন ‘জুতা সেলাই’ থেকে ‘চণ্ডি পাঠ’ করতে গিয়ে এক উপলক্ষে তারা বলে বসেছেন, এরশাদ বাংলাদেশ পেনাল কোডের ১২১ (ক), ১২৪ এবং ১২৪ (ক) ধারায় অপরাধ করেছেন। এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সে কারণে এসব অভিযোগে এরশাদের বিচার হওয়া উচিত। এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হয়তো কথা বাড়াতে হতো না। অন্যদিকে বিশেষজনেরা অনেক পেছনে চলে গেছেন এবং নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক ইতিহাসের ব্যাখ্যা হাজির করতে গিয়ে বলেছেন, দেশে ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারির জন্য খন্দকার মোশতাক আহমদ ও জিয়াউর রহমান দায়ী। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ সংবিধানকে নিম্ন মর্যাদায় ঠেলে দিয়েছিলেন। এজন্য তারাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন। এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এরশাদও একই অপরাধে অপরাধী হয়েছেন। জিয়াউর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এনেছিলেন এবং সংবিধানের মূলস্তম্ভ ভঙ্গ করেছিলেন। এরশাদও জিয়ার পথ অনুসরণ করে এই ভঙ্গস্তম্ভ নিয়ে দেশ চালিয়ে গেছেন।
অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এমন ঢালাও মন্তব্যকে সমর্থন করে না। কারণ, জিয়াউর রহমানের কঠোর সমালোচনা করলেও বিশেষজনেরাই আবার এ কথাও বলেছেন, ‘প্রথম সামরিক শাসন’ জারি করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বাকশাল মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য। অর্থাত্ সামরিক শাসন জারি এবং মুজিব-উত্তর ক্ষমতার রদবদলে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বাস্তবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত সিপাহী-জনতার যে বিপ্লব দেশের মানুষকে বাকশালসৃষ্ট শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন সে বিপ্লবকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। তাছাড়া বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দরজা খুলে দেয়া ছিল জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় অবদান। এই পথ ধরে বাকশাল আমলে বাতিল হয়ে যাওয়া দলগুলো আবারও তত্পরতা চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। আওয়ামী লীগকেও রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ জিয়াউর রহমানই দিয়েছিলেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশেষ করে ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ কথাটার মধ্য দিয়ে ওই বিশেষজনেরা মুজিব হত্যাকাণ্ডের জন্যও জিয়াউর রহমানকে দায়ী করতে চেয়েছেন। এখানেও ইতিহাস কিন্তু তাদের সমর্থন করে না। ঘটনাপ্রবাহে ব্যর্থতা ও দায়দায়িত্বের জন্য আঙুল বরং এমন কারও কারও দিকেই উঠেছে, পরবর্তীকালে যারা ‘মুজিবভক্ত’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন। তত্কালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ তাদের মধ্যে একজন। এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী এবং শেখ মুজিবের ভাগ্নে শেখ ফজলুল করিম সেলিম। দলের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৯ সালের ১৯ ও ২২ আগস্ট আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে শেখ সেলিম বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম বলেছেন, সেদিন ভোর পৌনে পাঁচটা থেকে পাঁচটার মধ্যে তার বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মণির বাসভবনে এবং পৌনে ছয়টা থেকে ছয়টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের বাসভবনে হামলা হয়েছিল। মাঝখানের এক ঘণ্টার মধ্যে একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে বাসভবন থেকে ‘পালিয়ে’ যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন! উল্লেখ্য, ২২ আগস্টের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সফিউল্লাহ নিজেও ছিলেন সামনের সারিতে। তাকে লক্ষ্য করে শেখ সেলিমের সোজা কথা ছিল, সেনাপ্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’! তাছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেত। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শেখ সেলিম জানতে চেয়েছেন, এসবের রহস্য কী?
ওদিকে হঠাত্ আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি ডিফেন্সিভে চলে গিয়েছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ। দ্বিতীয় দফা আক্রমণের পরদিন, ২৩ আগস্ট একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাত্কারে শেখ সেলিমের অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে ‘নতুন ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না। রাষ্ট্রপতিকে হত্যার বিষয়ে তিনি নাকি কোনো তথ্যই জানতেন না! কারণ, ১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে তার হাত থেকে সরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে নেয়া হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি একেবারে ‘অন্ধ ও বধির’ হয়ে পড়েছিলেন! রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। সুতরাং হত্যাকাণ্ডে তার কোনো ‘ব্যর্থতা’ ছিল না। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব তার কাছে টেলিফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন—এই প্রচারণাকে অসত্য দাবি করে সফিউল্লাহ বলেছেন, রাষ্ট্রপতি নন, তিনিই রাষ্ট্রপতিকে টেলিফোন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছিলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স বোধহয় আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। ওরা সম্ভবত কামালকে মেরে ফেলেছে। তুমি দ্রুত ফোর্স পাঠাও।’ উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আপনি কি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোনো উত্তর দেননি, টেবিলের ওপর টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ পেয়েছিলেন সফিউল্লাহ। তারপর (দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে) বেশ কয়েক মিনিট তিনি ‘হ্যালো, হ্যালো’ করেছেন। কিন্তু জবাব পাননি। কিছুক্ষণ পর বেশকিছু গুলির শব্দ শুনেছিলেন। শুনে তার মনে হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি হয়তো আর বেঁচে নেই। সফিউল্লাহ দাবি করেছেন, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে তিনি হামলার প্রথম খবর পেয়েছিলেন। তার মাধ্যমেই তিনি ঢাকা ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে ধানমন্ডি যাওয়ার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু শাফায়াত জামিলের সেনারা নাকি ‘মুভ’ করেনি। এর মধ্যেই সফিউল্লাহ নাকি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল আহমদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে বের করে নিয়ে যান (অথচ সফিউল্লাহ নিজেই আবার বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার কাছ থেকে অন্য একটি বিশেষ অংশের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল!)। সফিউল্লাহ বলেছেন, উপ-সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও নাকি তার নির্দেশ অমান্য করেছিলেন!
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের নিহত হওয়ার ব্যাপারে সফিউল্লাহ নিশ্চিত খবর পেয়েছিলেন সকাল আটটার দিকে। তিনি তখন তার অফিসে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন (এই দু’জন নাকি তার টেলিফোনে দেয়া নির্দেশ পালন করেননি!)। ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য’ সফিউল্লাহ নাকি এরপর ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে সেখানকার সৈন্যদের মধ্যে ‘আনন্দের আভা’ দেখতে পেয়েছিলেন! ততক্ষণে ওই সৈন্যরাও নাকি ‘খুনিদের’ সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেখান থেকেই তাকে নাকি ‘চাপাচাপি’ করে রেডিও অফিসে নেয়া হয়েছিল। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত খন্দকার মোশতাক আহমদ তাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়েছিলেন এবং ‘কাজ শেষ হওয়ায় বিশ্রাম নিতে’ বলেছিলেন (জড়িত না থাকলে ‘অভিনন্দন’ জানানোর, ‘কাজ শেষ’ হওয়ার এবং ‘বিশ্রাম’ নেয়ার প্রশ্ন এসেছিল কিভাবে?)। সফিউল্লাহ তখন নাকি ‘বিরক্ত’ হয়ে রেডিও অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেজর ডালিম তার ‘পথরোধ’ করেছিলেন। ‘বাধ্য হয়ে’ তাকে নাকি তাহের উদ্দিন ঠাকুরের লিখে দেয়া বক্তব্য ‘পাঠ’ করতে হয়েছিল! মেজর ডালিমকে কেন গ্রেফতার করেননি—এ প্রশ্নের উত্তরে সফিউল্লাহ বলেছেন, পরিস্থিতি ‘কখনোই’ সে রকম ছিল না। তারা আমার সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে কথা বলেছে! মেজর ডালিম নাকি সফিউল্লাহর অফিসের দরজায় লাথি পর্যন্ত মেরেছিলেন! এরপর ২৪ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয় এবং তিনি ‘বাধ্য হয়ে’ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ায় চলে যান।
নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও লক্ষ্যণীয় যে, সফিউল্লাহর বক্তব্য থেকে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, সেনাপ্রধান হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ‘অন্ধ ও বধির’—১৯৭৪ সালে ডিজিএফআইকে শুধু নয়, রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বও তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। ইতিহাস জানা না থাকলে সফিউল্লাহর কথাগুলো অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। এজন্যই ‘তখনকার’ বাস্তবতা কেন ‘এখনকার’ মতো ছিল না—কথাটার ব্যাখ্যা দেয়া তার উচিত ছিল। তাহলে মানুষ জানতে পারত, কেন সফিউল্লাহ অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বস্তুত ‘তখনকার’ বাস্তবতার কারণ ছিল ‘জাতীয় রক্ষী বাহিনী’। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের দলীয় পেটোয়া বাহিনী হিসেবে এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। একথা জাতিকে জানানো সফিউল্লাহর দায়িত্ব ছিল যে, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটানোর গোপন লক্ষ্য নিয়ে সবদিক থেকে সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা অনেক বেশি দেয়া হয়েছিল রক্ষী বাহিনীকে। আরও সহজ কথায় বলা যায়, ‘তখনকার’ বাস্তবতায় সেনা বাহিনী ছিল ‘নামকাওয়াস্তে’—অনেকটা ঢাল-তলোয়ারবিহীন ‘নিধিরাম সরদারের’ মতো। অন্যদিকে ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও সর্বাধুনিক যানবাহন দিয়ে রক্ষী বাহিনীকে এমনভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছিল যাতে বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটানো যায়। কিন্তু রক্ষী বাহিনীর প্রশ্নে সফিউল্লাহ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। সফিউল্লাহ যদি এই তথ্যগুলো জানাতেন তাহলে জনগণ সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারত। তারা বুঝতে পারত, কেন ‘তখনকার’ বাস্তবতা ‘এখনকার’ মতো ছিল না এবং কেন ‘এখনকার’ সেনাবাহিনীকে ‘তখনকার’ সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘মিলিয়ে’ ফেলা উচিত নয়।
কিন্তু নিজে আওয়ামী শিবিরের লোক বলেই সফিউল্লাহ এসব তথ্য জানানো থেকে সুকৌশলে বিরত থেকেছেন। একই কারণে তার পক্ষে শেখ সেলিমের আক্রমণের জবাবে যুত্সই যুক্তি দেখানোও সম্ভব হয়নি। জনগণ জেনেছে, সফিউল্লাহ এমন ‘যোগ্য’ জেনারেলই ছিলেন যে, ‘খুনি’ মেজররা তার সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে কথা বলেছেন, তাকে ‘ধরে’ নিয়ে গেছেন রেডিও অফিসে এবং তাকে দিয়ে আনুগত্যের শপথ ‘পাঠ’ করিয়ে ছেড়েছেন! সফিউল্লাহ লক্ষ্য করেননি যে, এসবের প্রতিটিই ভারি লজ্জার কথা। তাছাড়া রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। সম্ভবত এজন্যই তার যুক্তিতে তেমন ‘ধার’ দেখা যায়নি। একই কারণে শেখ সেলিমের জবাব দিতে গিয়ে ‘পড়ি কি মরি’ অবস্থায় পড়েছিলেন সফিউল্লাহ। তার পক্ষে অন্য দু’চারজনও এসে হাজির হয়েছিলেন। ‘এই লজ্জা আমাদের সবারই, একা সফিউল্লাহর নয়’ শিরোনামে এরকম একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমদ চৌধুরী (দৈনিক প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট, ২০০৯)। আমিন আহমদ চৌধুরী অবশ্য সফিউল্লাহকে বাঁচাতে পারেননি। তার নিবন্ধে বরং এমন কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছে যেগুলো সফিউল্লাহর পক্ষে যায় না। যেমন সফিউল্লাহ যেখানে নানা কৌশলে জিয়াউর রহমানকে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছেন আমিন আহমদ চৌধুরী সেখানে লিখেছিলেন, ‘ট্রুপসের মধ্যে তার ব্যক্তিগত ইমেজ উঁচুতে থাকলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার (জিয়ার) অধীনে কোনো ট্রুপস ছিল না বা থাকার কথাও নয়। বস্তুত উপ-সেনা প্রধান হিসেবে ট্রুপসের ওপর তার কোনো কমান্ড ছিল না।’
কিছুটা দীর্ঘ হলেও তথ্যগুলো উল্লেখের কারণ হলো, এসবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো দূরবর্তী সংশ্লিষ্টতাও ছিল না জিয়াউর রহমানের। বাস্তবে জিয়া এসেছিলেন ৭ নভেম্বরকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে, যার সূচনার পেছনেও তার কোনো ভূমিকা ছিল না। সবকিছু ঘটেছিল ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বর। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর শেখ মুজিবেরই সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেননি। এই সুযোগে ঢাকা সেনানিবাসে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। অভ্যুত্থানটি ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ওদিকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। ফলে জনগণের পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে শুধু নয়, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বীকারোক্তি এবং তথ্য-প্রমাণেও সুনির্দিষ্টভাবেই জানা গেছে, বাংলাদেশকে ভারতের অধীনস্থ করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি ঘটানোর এবং হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। যে চেইন অব কমান্ড সশস্ত্র বাহিনীর অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, ষড়যন্ত্রকারীরা তা ভেঙে ফেলতে শুরু করেছিল। সিপাহীরা গরিবের সন্তান ও অল্প শিক্ষিত বলে ধনীর সন্তান অফিসাররা তাদের ওপর নির্যাতন চালান এবং সিপাহী ও অফিসারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকা অন্যায়—এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক স্লোগান তুলেছিল তারা। এর ফলে সশস্ত্র বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছিল। শুধু তা-ই নয়, একযোগে অফিসার মাত্রকেই হত্যা করার নিষ্ঠুর অভিযানও শুরু হয়েছিল। প্রতিটি বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ কেন্দ্র থেকে। সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন জাসদের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল অলম খান। তার সঙ্গে ছিলেন শেখ মুজিবের আমলে সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার লে. কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীর উত্তম। কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে জাসদসহ ষড়যন্ত্রকারীরা এমনভাবেই অফিসার হত্যা চালাতে চেয়েছিল যার পরিণতিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে একমাত্র তাহের ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি অফিসার থাকতে পারতেন না। আর তাহের নিজে যেহেতু ভারতীয় ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন, সেহেতু স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়াও সহজে সম্ভব হতো।
কিন্তু সিপাহী এবং নন-কমিশন্ড অফিসারদের সমন্বয়ে সেনা বাহিনীরই একটি অংশ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। জেনারেল জিয়াও বলিষ্ঠতার সঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ঝটিকা সফরে গেছেন তিনি। বলেছেন, তার এবং সিপাহী ও নন-কমিশন্ড অফিসারদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই একই মাতৃভূমির জন্য কাজ করছেন তারা। জিয়াউর রহমানের মতো একজন জনপ্রিয় জেনারেলের এ ধরনের তত্পরতা ও বক্তব্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনতিবিলম্বে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চেইন অব কমান্ড। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করে দেয়া সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল জিয়াউর রহমানের প্রধান অবদান। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ও তিনিই সংযোজন করেছিলেন। এসবই সম্ভব হয়েছিল ৭ নভেম্বরের কারণে। সব মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য দিক-নির্দেশনা হয়ে রয়েছে। কিন্তু দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, জাতীয় জীবনের অমন একটি দিক-পরিবর্তনকারী দিবসকে নিয়েও দেশে কুটিল রাজনীতি করা হচ্ছে। বলা দরকার, জিয়া যেখানে ঘটনাপ্রবাহে এসেছিলেন সেখানে এরশাদ ছিলেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। দূরপ্রসারী অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এমনভাবে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণের অভিনয় করেছিলেন, যাতে জিয়াকে নিন্দিত করা যায়। বিশেষজনেরাও এরশাদের সে কৌশলের জালেই আটকে গেছেন। এজন্যই তারা এমন এক বিচিত্র ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, যা পড়ে মনে হবে যেন জিয়া ও এরশাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! অথচ ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যায় দেখা যাবে, জিয়ার সঙ্গে কোনো দিক থেকেই এরশাদের তুলনা চলে না। ‘মোশতাক-জিয়া চক্র’ ধরনের উল্লেখ ও মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads