জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস
১৯৭৫ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত ঘটনাবহুল। এই বছরের যাত্রা শুরু জরুরি অবস্থার মধ্যে। ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন জাতিকে বিস্মিত ও হতাশ করেছিল। ১৬ জুন সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া প্রায় সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ায় পরিস্থিতি আরো অস্বাভাবিক ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। এরপর তার দল আওয়ামী লীগের অন্যতম সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ এই পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বহুদলীয় ব্যবস্থা তথা গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে অদূরভবিষ্যতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আবারো অস্থিতিশীলতার কারণে জাতি শঙ্কামুক্ত হতে পারেনি। ২ নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ হঠাৎ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে অভ্যুত্থানের পথে ক্ষমতা দখল করেন। একই সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক নৃশংসভাবে নিহত হন। পরবর্তী কয়েক দিনে পরিস্থিতি এতই অনিয়ন্ত্রিত ও উদ্বেগজনক হয়ে পড়ে যে, সরকারের কোনো অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছিল না। ৬ নভেম্বর রাতে সিপাহিরা একজোট হয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে আনেন। তাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। সবাই রাজপথে নেমে জিয়াকে স্বাগত এবং সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন দেশকে মহা বিপদ থেকে রক্ষার জন্য। সেনাপ্রধান জিয়াকে এ সময়ে রাষ্ট্রচালনার গুরুদায়িত্ব স্বীয় কাঁধে তুলে নিতে হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতার এমন পরিবর্তন নজিরবিহীন।
আজকের এই দিনে আমরা ’৭৫-এর সেই দিনের অনবদ্য জাতীয় প্রতিরোধের বীর নায়কদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। সেই সঙ্কটক্ষণে সেনা-জনতা যাকে দেশচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিল, যিনি দৃঢ়হস্তে রাষ্ট্রতরীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শত প্রতিকূলতার সমুদ্রতরঙ্গ উপেক্ষা করে এবং যিনি এ দেশের বৈরী শক্তির হাতে জীবন দিয়েছেন শেষ পর্যন্তÑ সেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি।
সাতই নভেম্বরের আদর্শ হচ্ছে দেশপ্রেম, জাতীয় মর্যাদা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামি মূল্যবোধ। দলীয় বা গোষ্ঠীগত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে গোটা জাতির স্বার্থে চিন্তাভাবনা ও তৎপরতা পরিচালনার তাগিদ দেয় দিনটি। আজ অতীতের সেই দিবসের স্মরণ যেন প্রকৃত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও আত্মমর্যাদাবান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জোগায়। আমাদের শপথ নিতে হবে ঘরের ষড়যন্ত্র ও বাইরের আগ্রাসীর সাহসী মোকাবেলার জন্য।
এই ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় দিনে আমরা আহ্বান জানাই, আসুন, হিংসাবিদ্বেষ ভুলে সবাই এক হয়ে দেশ থেকে চিরতরে দূর করি বিভাজনের রাজনীতি, শোষণের অর্থনীতি এবং অবক্ষয়ের সংস্কৃতি। গণঐক্যের শক্তিবলে গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিকাশ এবং মৌলিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করি। বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে ও সম্মিলিত সংগ্রামে অবসান ঘটাই সন্ত্রাস-সহিংসতা, দুর্নীতি-দলীয়করণ, ক্ষমতার দম্ভ ও অপপ্রয়োগসমেত সমাজ, সরকার, রাষ্ট্র ও রাজনীতির যাবতীয় কলুষ-কালিমার।
আসুন দল-মতÑ শ্রেণী-ধর্ম নির্বিশেষে সব বাংলাদেশী নাগরিক সাতই নভেম্বরের অবিনাশী চেতনা ও অনিঃশেষ প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হই। ’৭৫-এর মতো ২০১২তেও স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা জাতির জন্য সর্বাধিক জরুরি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আজকের দিনটি পালনের লক্ষ্য হলো, স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং জাতি বিভাজনের সর্বপ্রকার চক্র ও চক্রান্ত নস্যাৎ করার ইস্পাতকঠিন অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়ন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন