শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৩

আওয়ামী লীগ নেতা পারবেন না... পারবেন রাষ্ট্রপতি


এটা আর মোটেও নতুন খবর নয় যে, সরকারের যোগ্য বশংবদের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তফসিল ঘোাষণার মধ্য দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেশের রাজনৈতিক সংকটকে অনেক ভয়ংকর করে তুলেছেন। ৭১ ঘণ্টার অবরোধেও তার সম্বিত ফিরে আসেনি। অবরোধের শেষদিন গত ২৮ নবেম্বরও তিনি শুনিয়েছেন, পরিস্থিতি নাকি ভালোই আছে! ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীনরা যথারীতি সংবিধানের নাম জপে চলেছেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন যে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে সে কথাটাও আউড়ে চলেছেন তারা। অন্যদিকে বিরোধী দল ও দেশের বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি দৃশ্যপটে আসছেন বিদেশীরাও। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেছেন, তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর প্রধান দুই দলের সংলাপ বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত লী জুনও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সংলাপের তাগিদ দিয়ে বলেছেন, চীন একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, উন্নত এবং ‘স্বাধীন’ বাংলাদেশ দেখতে চায়। প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে চীন যে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে সে কথাও জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গণচীনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দেশী-বিদেশী আরো অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীও রয়েছেন, সঙ্গত নানা কারণে যাদের বক্তব্য তেমন গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে না। ফলে জানা যাচ্ছে না তাদের মনোভাব সম্পর্কেও। তা সত্ত্বেও দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ধরে নেয়া যায়, সাধারণ মানুষ তো বটেই, বাংলাদেশের ব্যাপারে যাদের সামান্য আগ্রহ রয়েছে তাদের সবাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ও ভীত হয়ে উঠেছেন। ড. কামাল হোসেনদের উদাহরণ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে ভিন্নমত এমনকি বিরোধিতা থাকলেও রাষ্ট্রপতির কাছে তারা ছুটে গেছেন আসলে দেশ, জনগণ এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাদের ভালোবাসার কারণে। কথাও তারা যথার্থই বলেছেন। সরকার যদি বিএনপিকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালায় তাহলে প্রাণবিনাশী সহিংসতাই শুধু সর্বাত্মক হতে থাকবে না, গণতন্ত্রও বিপর্যয়ের কবলে পড়বে। আর গণতন্ত্র যদি না থাকে তাহলে এক পর্যায়ে টান পড়বে দেশের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়েও। পরিণতিতে বিপন্ন হবে দেশের স্বাধীনতাও। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এ কথাটাই চীনের রাষ্ট্রদূতের মুখ থেকেও বেরিয়ে এসেছে। তিনি যখন বলেন, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশ শুধু নয়, চীন ‘স্বাধীন’ বাংলাদেশও দেখতে চায় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, চীন নিশ্চয়ই এমন কিছু লক্ষণ দেখতে পেয়েছে যার পরিণতিতে বাংলাদেশ এমনকি তার ‘স্বাধীনতা’ও খুইয়ে বসতে পারে। আমরা চীনের রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্যটিকে অত্যন্ত গুরুতর মনে করি।
একই কারণে সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে সম্প্রতি সবার চোখ নিবদ্ধ হয়েছে বঙ্গভবনের তথা রাষ্ট্রপতি আবদ;ুল হামিদ এডভোকেটের দিকে। রাষ্ট্রের প্রধান ‘অভিভাবক’ এবং ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে ভূমিকা পালনের জন্য রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে তার প্রতি ক্রমাগত অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এই অনুরোধ জানাতে এরই মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা বঙ্গভবনে গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর পরপর সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারাও রাষ্ট্রপতিকে বলেছেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকা সহিংসতাকে প্রতিহত না করা গেলে এবং প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো হলে গণতন্ত্র ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। মারাত্মক সে পরিণতির কবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সচেষ্ট হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়েছেন ড. কামাল হোসেনসহ বিশিষ্টজনেরা। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট নিতান্ত অসহায়ের মতো নিজের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, সদিচ্ছা থাকলেও তার পক্ষে ১৮ দলীয় জোট এবং বিশিষ্টজনদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করা বা তাদের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে তাদের বক্তব্য ও দাবিগুলোকে তিনি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।
ঘটনাপ্রবাহে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটের সদিচ্ছার দিকটিই বেশি গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে। সৃষ্টি হয়েছে সংশয়েরও। এর পেছনে বাস্তব কারণও রয়েছে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে আবদুল হামিদ এডভোকেট যখন স্পিকার ছিলেন তখনকার কিছু ঘটনা স্মরণ করলেই সংশয়ের কারণ জানা যাবে। যেমন ২০১১ সালের জুন মাসে বাজেট অধিবেশন চলাকালে সদস্যদের অনুপস্থিতির ব্যাপকতা দেখে রাগে-দুঃখে রসের হাঁড়ি খুলে তিনি বলে বসেছিলেন বাজেটের ওপর অলোচনার সময় মন্ত্রীদের চৌদ্দ আনাই অনুপস্থিত থাকেন। কোনো কারণে মন্ত্রিসভার চার আনা-ছয় আনা সদস্য অনুপস্থিত থাকতে পারেন কিন্তু ১৪ আনার অনুপস্থিতি অনাকাক্সিক্ষত। এ পর্যন্ত এসেই স্পিকার আবদুল হামিদের সম্ভবত মনে পড়েছিল, আনা’র হিসাব চলতো তাদের ছেলেবেলায়, যে হিসাবে ১৬ আনায় এক টাকা হতো। এখন চলছে একশ পয়সায় এক টাকার হিসাব। সে কারণে এখনকার এমপিরা হয়তো চৌদ্দ আনার গুরুত্ব নাও বুঝতে পারেন। এজন্যই তিনি এর পর পর বলেছিলেন, ৫০ শতাংশ মন্ত্রী উপস্থিত থাকলেও সংসদ অধিবেশনের চেহারা বদলে যাবে। বলা বাহুল্য, তৎকালীন মাননীয় স্পিকারের এই রস ও ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রথম অধিবেশন থেকে ক্ষমতাসীনদের আক্রমণাত্মক ভূমিকা ও বক্তব্যের কারণে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের এমপিরা সহজে সংসদের দিকে পা বাড়াননি। এমন অবস্থায় সরকারি দলের এমপিরা সংসদ ভবনকে জমজমাট করে রাখবেন বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে সংসদ শেষ পর্যন্তও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলেছে। সরকারি দলের এমপিরাও খুব কম সময়ই অধিবেশনে ঠিকমতো হাজির থেকেছেন। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, সংসদের কোনো কোনো বৈঠকে প্রথম সারিতে ৩০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজনকে উপস্থিত দেখা গেছে। এমনকি যারা প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন তেমন পাঁচজনের মধ্যেও চারজনকে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। বৈঠক শুরু হতে দেরি হয়েছে বেশ কয়েকদিন। কোরাম সংকট তো হয়েছেই। কিছু সদস্যকে শুধু ততোক্ষণই বৈঠকে দেখা গেছে, যতোক্ষণ প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থেকেছেন। আওয়ামী এমপিরা তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকেননি সেই মন্ত্রীরাও, প্রশ্নোত্তর পর্বে যাদের আগে থেকে থাকতে বলা হয়েছিল। মন্ত্রীরা উপস্থিত না থাকায় তাদের উদ্দেশে করা প্রশ্ন স্পিকারকে ‘পাস ওভার’ করতে হয়েছে। কখনো কখনো স্পিকারের কাছে অনেকটা সাফাই গাওয়ার সুরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মনে হয় ‘ওনার’ (অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর) একটু সময় দরকার। ওদিকে যারা উপস্থিত ছিলেন সে এমপিরাও নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব শুরু করেছেন। ফলে দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে স্পিকারকে বলতে হয়েছে, এভাবে পরস্পরের সঙ্গে কথা বললে তো সংসদ ‘মাছবাজার’ হয়ে যাচ্ছে!
অর্থাৎ সংসদকে কার্যকর করার এবং নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু বানানোর প্রশ্নে আওয়ামী মহাজোট ও শেখ হাসিনার সরকারকে কখনোই আগ্রহী দেখা যায়নি। সব মিলিয়েই নবম সংসদ প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারেনি। এমন অবস্থার অন্যতম কারণ ছিল বিরোধী দলকে বাইরে রাখার অপকৌশল। এ ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। যেমন সংসদের সামনের সারিতে বিরোধী দলকে আসন দেয়ার প্রশ্নে ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংখ্যার অনুপাতে বিরোধী দল সামনের সারিতে শতকরা বড়জোর ‘আড়াই থেকে পৌনে তিনটি’ আসন পেতে পারে। সেখানে তাদের চারটি আসন দেয়া হয়েছে। অথচ কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী আসনবণ্টনসহ সংসদের ভেতরের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে শুধু স্পিকারের। কিন্তু শতকরা অংকের হিসাব শিখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও স্পিকার হিসেবে আবদুল হামিদ কোনো প্রতিবাদ করেননি। কে জানে, তিনি আদৌ অপমানিত ও অসম্মানিত বোধ করেছিলেন কি না! অন্য কিছু ঘটনার মধ্য দিয়েও স্পিকার আবদুল হামিদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। একটি উদাহরণ হিসেবে ২০১০ সালের অক্টোবর অধিবেশনে স্পীকারের বিরুদ্ধে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বিষোদ্গারের কথা উল্লেখ করা যায়। সে বছর ১১ অক্টোবরের অধিবেশনে এমপিদের চোখে পড়ার মতো অনুপস্থিতি এবং এমপিদের গালগল্পে মশগুল থাকতে দেখে ক্ষুব্ধ স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদকে ‘মাছের বাজারের’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। পরদিনই লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে তাকে সংসদের ‘সার্ভেন্ট’ এবং মাছের বাজারের ‘আড়তদার’ বানিয়ে ছেড়েছিলেন! কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন স্পিকার আবদুল হামিদও তেমনি লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি।
স্পিকার হিসেবে আবদুল হামিদ এডভোকেটের এই ভূমিকা শেষ পর্যন্তও অব্যাহত ছিল। অর্থাৎ ‘মাননীয়’ স্পিকার হলেও সর্বতোভাবে তিনি আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবেই মাথা নিচু করে থেকেছেন। মাঝে-মধ্যে সংসদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি অবশ্য নাটকীয়তাও কম করেননি। যেমন ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সংসদেও দ্বাদশ অধিবেশনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানোর সময় তিনি বলেছিলেন, সংসদ কার্যকর থাকলেই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সুসংহত হয়। তার এই আহ্বানকে স্বাগত জানানো এবং ওই সময়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তার বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলেও না বলে পারা যায়নি যে, বিরোধী দল সব সময়ই অধিবেশনে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা একথাও বলেছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের উদ্যোগ নেয়া হলে তারা যোগ দেবেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর প্রতিটি সভায় অংশ নেয়া সত্ত্বেও বিরোধী দলের সদস্যরা কেন অধিবেশনে যাচ্ছিলেন না এবং স্পিকারকেই বা কেন নতুন করে আহ্বান জানাতে হয়েছিল তার কারণ লক্ষ্য করা দরকার। প্রকৃত কারণ যে ক্ষমতাসীন দলের অবজ্ঞা-অবহেলা এবং যথোচিত সম্মান ও সুযোগ না পাওয়া সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। উদাহরণ ধরে ধরে উল্লেখের পরিবর্তে এক কথায় বলা যায়, সংসদের অভ্যন্তরে প্রতিটি প্রশ্নেই ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছেন। গণতন্ত্রের আড়ালে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ও চিন্তার ভিত্তিতে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব তারা দেখাতেই পারেন। তাছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘গরম’ বলেও তো একটা কথা আছে! অন্যদিকে ঠিক এখানেই ছিল মাননীয় স্পিকারের দায়িত্ব। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, স্পিকার আবদুল হামিদ এডভোকেট কখনো, কোনো পর্যায়েই যথোচিতভাবে তার দায়িত্ব পালন করেননি। বিশেষ করে বিরোধী দলের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে তিনি কখনো নিরপেক্ষতার প্রমাণ রাখতে পেরেছেন তা বলার সুযোগ নেই বললেই চলে। আসন বণ্টনের উপলক্ষে স্পিকারের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর শতকরা অংকের হিসাব শেখানোর মতো কিছু তথ্যের উল্লেখ করলেই দেখা যাবে, সবকিছুই আবদুল হামিদ এডভোকেট এমনভাবে মেনে নিয়েছেনÑ যেভাবে সাধারণত অধীনস্থজনেরা মাথা নুইয়ে মেনে থাকেন। কথা বলার সুযোগ দেয়ার ব্যাপারেও স্পিকার ঠিক একজন আওয়ামী লীগ নেতার মতোই পক্ষপাতিত্ব করে এসেছেন। ফলে এমনকি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও খুব কম উপলক্ষেই তার বক্তব্য শেষ করতে পেরেছেন। তাকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিরোধী এমপিদের সম্মান ও অধিকার রক্ষার ব্যাপারেও ‘মাননীয়’ স্পিকার হিসেবে ব্যর্থতা ও অক্ষমতা দেখিয়েছেন আবদুল হামিদ এডভোকেট। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ যখন জানোয়ারের মতো পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছিল তখনও আবদুল হামিদ এডভোকেটকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। তিনি চিফ হুইপের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন কিংবা তার বাসায় গিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সান্ত¡¡না দিয়েছেন এমন কোনো খবর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখা যায়নি। চিফ হুইপকে যখন স্ট্রেচারে শুইয়ে জামিনের জন্য আদালতে নেয়া হয়েছে এবং তিনি যখন চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন তখনও স্পিকারের কোনো তৎপরতার কথা শোনা যায়নি। অথচ স্পিকার হিসেবে একজন সংসদ সদস্যের সম্মান, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যবস্থা করাও তার দায়িত্ব ছিল। বিশেষ করে জয়নুল আবদিন ফারুকের বিষয়ে দায়িত্ব অনেক বেশি ছিল এজন্য যে, একদিকে তিনি বিরোধী দলের চিফ হুইপ অন্যদিকে তাকে পেটানো হয়েছিল সংসদ ভবনেরই সামনের রাস্তায়। সুতরাং স্পিকারের পক্ষে দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগই থাকতে পারে না। কিন্তু আবদুল হামিদ এডভোকেট বুঝিয়ে ছেড়েছিলেন, স্পিকারের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলেও তখন পর্যন্তও তিনি সর্বান্তকরণে মফস্বলের একজন আওয়ামী লীগ নেতাই রয়ে গেছেন। এজন্যই পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ কোনো ব্যাপারেই তাকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে বিনা বিচারে পার তো পেয়েছেই, দোষী পুলিশ অফিসাররা উল্টো বুক ফুলিয়েও ঘুরে বেড়িয়েছে, পদোন্নতিও পেয়েছে। বিষয়টিকে কেবলই স্পিকারের ব্যর্থতা বলা যায় কি না, নাকি এর মধ্যে অযোগ্যতা, অবহেলা ও দলবাজির অভিযোগ আনারও অবকাশ ছিলÑ ‘আইনের মানুষ’ হিসেবে আবদুল হামিদ এডভোকেট নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখেছেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, মুখে বললেও সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতির ব্যাপারে ‘মাননীয়’ স্পিকার আবদুল হামিদ এডভোকেটের নিজেরও সত্যি তেমন আগ্রহ ছিল কি না? কারণ, জনগণের সচেতন অংশ সে সময় যথার্থই বলেছিলেন, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সুসংহত করার এবং সংসদকে কার্যকর করার জন্য বিরোধী দলকে অন্তত ‘জ্ঞান’ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বরং বলা হয়েছিল, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারায় ‘জ্ঞান’ দেয়ার নৈতিক অধিকার স্পিকার আবদুল হামিদ এডভোকেট অনেক আগেই খুইয়ে ফেলেছিলেন। এজন্যই সংসদকে সত্যি কার্যকর করতে চাইলে তার উচিত ছিল বিরোধী দলীয় সদস্যদের সম্মান, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি বলেই সংসদ তো ‘মাছের বাজার’ হয়ে থেকেছেই, ‘মাননীয়’ স্পিকারকেও ‘আড়তদারি’ করেই তার বাকি মেয়াদ পাড়ি দিতে হয়েছে (স্মরণ করা দরকার, মাননীয় স্পিকার নিজেই সংসদকে ‘মাছের বাজার’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন, যার জবাবে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী  ‘আড়তদার’ নামে সম্বোধন করে জাতিকে স্তম্ভিত করেছিলেন)। তার অবশ্য ভাগ্য ভালো, বেশি নিন্দিত হওয়ার আগেই তিনি ‘আড়তদারের’ চাকরি ছেড়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছেন।
এবার বর্তমান পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কথা ওঠার কারণ সম্পর্কে বলা দরকার। এরও কারণ তিনিই তৈরি করেছেন। তার বদৌলতে ‘কবর ও মাজার জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কাজ বা ক্ষমতা নেই’ জাতীয় কথাবার্তা মানুষকে বহু বছর ধরেই শুনতে হচ্ছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের সামনে রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর আড়ালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা নিজের তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন তার ফলে রাষ্ট্রপতিকে নাকি কবর ও মাজার জিয়ারত করার জন্যও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির জন্য হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়! রাষ্ট্রপতির হাত-পাও নাকি বেঁধে ফেলা হয়েছে! এসব সত্ত্বেও সংবিধানে কিন্তু এ কথাও বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতি যে কোনো বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে ‘পরামর্শ’ দিতে পারবেন। বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি যেহেতু ‘মহামান্য’ সেহেতু তার ‘পরামর্শ’ই নৈতিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার তথা সরকারের জন্য ‘নির্দেশ’ হয়ে উঠতে পারে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রপতি এমনকি নৈতিকভাবে চাপও সৃষ্টি করতে পারেন। এ ধরনের ব্যাখ্যার আলোকে বলা হচ্ছে, সংবিধানে যা কিছুই লেখা থাকুক না কেন, সাংবিধানিকভাবেই তিনি ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’। একই কারণে বেগম খালেদা জিয়া ও ড. কামাল হোসেনরা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের উদাহরণও বর্তমান রাষ্ট্রপতি অনুসরণ করতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রশ্নে ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস তখন বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবীসহ নাগরিক সমাজের অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাদের অভিমতের ভিত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রপতির সে ‘পরামর্শ’ অনুযায়ীই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। এটাই ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী। এর পর ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বর্তমান পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট ওই উদাহরণ অনুসরণ করলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সময়ের বিষয়ে পরিণত হতে পারে। গণতন্ত্র রক্ষাসহ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই রাষ্ট্রপতির উচিত প্রধানমন্ত্রীকে এমনভাবে ‘পরামর্শ’ দেয়া যাতে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার মতো প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। সংসদ এখনও বহাল থাকায় রাষ্ট্রপতি যে কোনো সময় অধিবেশন আহ্বান করতে এবং ১৮ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করাতে পারেন। আমরা অবশ্য জানি না, দেশ ও জাতির এই কঠিন সংকটকালে রাষ্ট্রপতি যথার্থই প্রধান অভিবাবক ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন কি না নাকি তিনি আবারও নিজেকে একজন আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে উপস্থিত করবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads