দেশে আজ যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান সর্বদলীয় সরকার নয়। বিরোধী দল দাবি করছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যে সরকার জাতীয় সংসদের নির্বাচন পরিচালনা করবে। উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধানে নির্বাচন পরিচালনার জন্য এই ব্যবস্থাই ছিল। দেশে দীর্ঘদিন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হবার পর সর্বপ্রথম ১৯৯০ সালে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হয়। এই ব্যবস্থা অবশ্য তখন সংবিধানে ছিল না, পরে ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের ফলেই নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এই সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই নির্বাচনের ফলাফল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপি পরাজয় বরণ করে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। এর আগে বাংলাদেশের ২৬ বছরের ইতিহাসে ক্ষমতাসীন দল কখনও পরাজিত হয়নি। কিন্তু সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর বাতিল করে। এই ক্ষেত্রে যে অজুহাতটিকে আওয়ামী লীগ সরকার দাঁড় করাচ্ছে সেটা হলো ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংবিধান লংঘন ও নিপীড়নমূলক আচরণ । কিন্তু এই অজুহাত বা যুক্তির মধ্যে কোনো সত্য নেই । ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষে বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের মেয়াদ শেষ হবার পর সাংবিধানিক বিধান অনুসারে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় আওয়ামী লীগের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের কারণেই সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ভিন্ন একটি সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের কোনো কাজের কোনো দায় সংবিধান কিংবা সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর বর্তায় না। অতএব এই অজুহাত তুলে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বাতিল হওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। এই কারণেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন একদিকে যেমন সরকারি জোটের বাইরে সব দলই চাচ্ছে, তেমনি জনগণও এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থারই পক্ষে। কয়েকদিন আগে সর্বশেষ জনমত জরিপেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছে শতকরা ৭৭ ভাগ মানুষ আর এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা বলেছে তাদের সংখ্যা শতকরা মাত্র ১৯ ভাগ। সুতরাং সব বিরোধী দলের দাবি এবং দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মতামত সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে রয়েছে।
সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প কোনো অবস্থাতেই সর্বদলীয় সরকার নয় এবং সংবিধানে সর্বদলীয় সরকারের কোনো স্বীকৃতি নেই এবং তাদের পাওয়ার এন্ড ফাংশন কোনো কিছুই বলা হয়নি। এই সরকারকে চলমান মন্ত্রিসভার মতই কাজ করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হবেন সর্বেসর্বা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এই সরকারের প্রধান হবেন ইতোমধ্যে তা বলা হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। সুতরাং এই সরকার কার্যত আওয়ামী লীগেরই সরকার হবে। অতএব, সর্বদলীয় সরকার একটি স্লোগান মাত্র, এর কার্যকারিতা আশাই করা যায় না কিংবা এর কোনো কার্যকারিতাই থাকবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্যে আন্দোলনরত দলগুলো সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে না নেবার কারণই এটা।
আমরা মনে করি সরকার যদি একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু নির্বাচন চান তাহলে সর্বদলীয় সরকারকে দিয়ে তা হবে না। আর যদি ১৯৯০ সালের আগে যখন ক্ষমতাসীন সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করতো এবং যখন ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কোনো দলের পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব ছিল না, সেই অবস্থায় ফিরে যেতে চান তাহলে সর্বদলীয় সরকার একটা বাহন হতে পারে। আমরা মনে করি এটা দেশের জন্যে শান্তির পথ নয়। বিএনপিও একসময় একতরফা নির্বাচন করেছে, কিন্তু সে সরকার এক মাসও টিকেনি। জনতার জয় হয়েছে। এবারের অবস্থা আরও ভিন্নতর। ১৯৯৬ সালে জনগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে তেমন পরিচিতই ছিল না, তারা এ নিয়ে তেমন কোনো সোচ্চার ভূমিকা পালন করেনি। কিন্তু বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে জনগণ খ্বুই সচেতন এবং বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর চাইতেও তারা অগ্রগামী রয়েছে। সুতরাং সরকার এই জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সর্বদলীয় সরকারের বদলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দিকে আবার ফিরে আসতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন