ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
গত রোববার এক মুদি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দোকান মালিক কারও সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিলেন। কর্মচারী আমার চাহিদার জিনিসপত্র বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। দোকান মালিককে সম্ভবত ফোনের ও প্রান্ত থেকে কেউ বলছিলেন যে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে তো বিএনপি হরতাল ডাকবে। তাহলে পাইকারি পণ্য পৌঁছাবেন কীভাবে? দোকান মালিক তাকে বিরক্ত হয়ে বলছিলেন, ‘আরে রাখ তোর বিএনপি, বিএনপি’র হরতালে কিছু হয় না। মাল তুই রেডি রাখ। আমি গিয়ে নিয়ে আসব। আর বিএনপি হরতাল করতেও পারবে না। বিএনপি করবে হরতাল!’
এ উক্তি শুনে আমি খানিকটা থতমতো খেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো, এ যেনো ১৮ দলের প্রতি সাধারণ মানুষের এক ধরনের অনাস্থা। তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে অবিশ্বাসও বটে। সংশয় যে আমার মনেও ছিলো না, এমন নয়। মনে হচ্ছিলো কোথায় যেনো কিছু একটার ঘাটতি আছে। আমি রাজনীতিবিদ নই। রাজনীতির নিপুণ কলাকৌশল আমার জানা নেই। এই তফসিল ঘোষণার আগেই দেশজুড়ে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। এর মধ্যে সরকারের লোকেরা দু’টো নাটক করে বসলো। তার একটি হলো মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মধ্যে সংলাপের নাটক। মিডিয়ায় সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী। তা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াই বলি, আর প্রিন্ট মিডিয়াই বলি। দেশের একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র এমন ভাষায় রিপোর্ট করল যে, তাদের দু’জন রিপোর্টারের একজন সৈয়দ আশরাফের ঘাড়ের উপর বসে ছিলেন। আর একজন ছিলেন মির্জা ফখরুলের ঘাড়ে। আর গ্রীনিচ মান অনুযায়ী নির্ধারিত সঠিক সময়ের ঘড়ি ছিলো তাদের হাতে। তাতে লেখা হয়েছে, মির্জা ফখরুল বারবার গাড়ী বদলিয়ে অলি-গলি ঘুরে বৈঠক স্থলে হাজির হন। সৈয়দ আশরাফও তাই। একেবারে সাতটা সাত মিনিট। আলোচনা শেষে তারা একইভাবে অলি-গলি পেরিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু ঐ দুই রিপোর্টার তাদের কাউকেই ধরতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করতে পারলেন না, আপনাদের মধ্যে কী আলোচনা হলো।
আমার এই ৪২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে সাংবাদিকতার নামে এমন ছোটগল্পের অবতারণা আমি খুব কমই দেখেছি। এর আগে এটা শুধু দেখেছি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়। সেখানকার এক রিপোর্টার রিপোর্টের নামে এরকম ছোটগল্প রচনায় অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমি তাকে চিনতাম না। এখনও চিনি না। কিন্তু তাকে এক নজর দেখে জীবন ধন্য করতে চেয়েছিলোম। সেটি আর হয়ে ওঠেনি। তারপর এই রিপোর্টটি পড়লাম। সরকারপন্থী সকল সংবাদপত্র একেবারে ভোমা লীড করে বসলো। আশরাফ-ফখরুল বৈঠক। সরকারের স্তাবক টকশোওয়ালারা রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিলেন, বরফ গলছে। যদিও মির্জা ফখরুল ইসলাম রাতেই জানালেন যে, সৈয়দ আশরাফের সাথে তার এ ধরনের বৈঠক হয়নি। এটা গুজব এবং চলমান আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করাই এই গুজবের উদ্দেশ্য। সৈয়দ আশরাফও দাবি করলেন না যে, তার সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইলসামের কোনরূপ বৈঠক হয়েছে। তারপরও প্রিণ্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ধুমধাড়াক্কা চলতেই থাকলো।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর অহমদকে নিয়ে। এরশাদ যখন সকাল-বিকাল ভোল পাল্টিয়ে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন, তখন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন কাজী জাফর আহমদ। কারণ তার আগে এরশাদ বারবার বলেছেন যে, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তারাও যাবেন না। এটাই তার শেষ কথা। কিন্তু এরশাদের জীবনের শেষ কথা বলে কেউ কোনদিন কিছু দেখেনি। তিনি সকালে যে কথা বলেন, দুই-এক ঘণ্টার ব্যবধানে তার একেবারে উল্টো কথা বলতে কখনও কসুর করেন না। তিনি বলেছিলেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে গেলে লোকে তার মুখে থুতু দেবে। তার চেয়ে বরং জেলে পচে মরাও ভালো। কিন্তু মাত্র একদিনের ব্যবধানে তিনি বলে বসলেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন। কারণ, তা নাহলে দেশের মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে।
এই খবরে কাজী জাফর আহমদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং তিনি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন সেখান থেকে এক বিবৃতিতে তিনি এরশাদের এই সিদ্ধান্তকে হঠকারি বলে ঘোষণা করেন এবং জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে এই নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর বাকী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। এ খবরে বেশ বিচলিত হয়ে পড়ে সরকার। তারপর কোথা থেকে মিডিয়ায় এক বিবৃতি আসে যে, কাজী জাফর আহমদ ঐ বিবৃতি তো দেনইনি বরং এরকম বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ায় তিনি এরশাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এরশাদ বলেছেন, কাজী জাফর এরকম বিবৃতি দিতেই পারেন না। কারণ তিনি তার ফ্যামিলি মেম্বার। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালে কাজী জাফর আহমদ ও তার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, তিনি আগের বিবৃতি প্রত্যাহারের কোন ঘোষণা দেননি। এবং তার পূর্ববর্তী মনোভাবই বহাল রয়েছে। এসব ধূ¤্রজাল সৃষ্টি করে সরকার জনগণের ভিতরে যে তাতানো ভাব বিরাজ করছে তা খানিকটা স্তিমিত করে দিতে চেয়েছিলো। জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিলো। তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি।
কিন্তু আমার বরাবর মনে হয়েছে যে, শুধু ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মী নয় এই সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, নিপীড়ন, লুণ্ঠনের প্রতিবাদে গোটা দেশের মানুষই এখন মুখর। গত এক বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন, হরতাল, ধর্মঘট, প্রতিরোধের মাধ্যমে জনগণ তার প্রমাণ রেখেছে। এর আগে ১৮ দলীয় জোট যখন পরপর দু’বার ৬০ ঘণ্টা এবং তারপর ৮৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিলো, তখন দেখা গেলো সারাদেশের মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাস্তায় নেমে এসেছে। তখনই মনে হয়েছিলো, এখন গোটা দেশের জনগণ একদিকে আর সরকার তাদের প্রতিপক্ষে।
কিন্তু নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগের দুইদিন সারাদেশে একটি থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। ১৮ দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, যেই মুহূর্তে একদলীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে, সেই মুহূর্ত থেকেই দেশ অচল করে দেয়া হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাথানত শেখ রকিবউদ্দীন আহমদ সোমবার দুপুরেই ঘোষণা করেছিলেন যে, রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন। কার্যত তখনই তিনি মিডিয়াকে জানিয়ে দেন যে, কবে, কোন তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, মনোনয়ন পত্র জমা দেয়া হবে, বাছাই করা হবে ইত্যাদি। এরপর থেকেই টেলিভিশনগুলোর স্ক্রলে নির্বাচনী সিডিউল প্রচার করা শুরু হয়। তখনো থমথমেই ছিলো গোটা পরিস্থিতি। বিএনপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা কারাগারে। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরা কারাগারে। সর্বশেষ সোমবার আটক হয়েছেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ.স.ম হান্নান শাহ। বাইরে আছেন আর দুই-একজন মাত্র। একদিকে সরকার আলোচনার ডাক দেয়, অপরদিকে বিএনপি’র নেতাদের একের পর এক কারাবন্দী করতে থাকে।
ফলে এটি যে নিছকই সরকারের শঠতা সেটা বুঝতে আর কারও বাকী থাকে না। সরকার স্পষ্টতই বুঝে গিয়েছিলো যে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট যদি নির্বাচনে আসে, তবে তাদের ভরাডুবি সুনিশ্চিত। সেকারণে যেভাবেই হোক তাদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। ১৮ দলীয় জোটের দাবি একটিই ছিলো। আর তা হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তারা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করুক, তারপর আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হবে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়। উল্লেখ্য, এর আগে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক ভাষণে বলেছিলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না, জনগনের ভালো চান। তাহলে পদত্যাগ করে দেখাতেন, তিনি যা বলেন তা তিনি বাস্তবিকই করার জন্যই বলেন। একথা শুনে শেখ হাসিনা বরং প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা তার নিজের হাতেই তুলে নিলেন। মন্ত্রীরা বলতে গেলে এখন এক একজন ঠুঁটো জগন্নাথ। নিজ মন্ত্রণালয়ের একজন পিয়নকেও বদলি করার বা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। ফলে জো হুকুম, জো হুজুর বলা ছাড়া এদের আর কোন কাজ নেই। এ অবস্থায় বিরোধী দলের নির্বাচনে যাওয়া আত্মহননেরই শামিল। সুতরাং সঙ্গত কারণেই বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
যে কথা বলছিলাম। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে প্রায় দু’দিন সারাদেশে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। কী হবে? কী ঘটবে? বেগম খালেদা জিয়া কাকে নিয়ে রাজনীতি করবেন। প্রায় সব নেতা জেলে। কেউ কেউ আত্মগোপনে। তবে কি শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন বাংলাদেশে চিরস্থায়ী হয়ে রইবে? কিন্তু পরিস্থিতি আদপেই সেরকম ছিলো না। জনগণ প্রস্তুতই ছিলো। যে শেখ রকিবউদ্দীন এতোদিন বড়াই করছিলেন যে, নির্বাচনে কিছুতেই সেনা মোতায়েন করা হবে না। সেখানে তিনি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এই বলে সাহস জোগালেন যে, ভিডিপি আনছার পুলিশ বিজিবি তো নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োজিত থাকবেই, সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হবে। কাজী রকিব ভাবখানা এমন করলেন যে, আশরাফ-ফখরুল আলোচনা শুরু হয়ে গেছে একটা সমঝোতা হবেই। তখন তিনি বলেছিলেন, ২৪শে জানুয়ারির পরও নির্বাচন করা যাবে। তারপর তিনি হুট করেই বললেন, ঢের অপেক্ষা করেছেন আর বিলম্ব করা সম্ভব নয়। এখানেও অস্পষ্ট রইলো না যে, কোন এক অদৃশ্য শক্তির হাতে ক্রীড়নক মাত্র তিনি। অতএব তফসিল ঘোষণা করে দিলেন।
নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট পরে, ভাষণের দু’টি প্যারাগ্রাফ দু’বার করে পড়ে শিডিউল ঘোষণা করলেন তিনি। নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণার পর ১৮ দলের তরফ থেকে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গিয়েছিলো। কিন্তু সারাদেশে জনগণ সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করেনি। রকিবের ঘোষণা শোনা মাত্রই সারাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। এবং ঘণ্টাখানেকের ভেতরই সারাদেশ অচল করে দিলো। বিচ্ছিন্ন করে দেয় রাজধানী ঢাকা থেকে। এরপর আসে অবরোধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।
আমরা জানি যে, শেখ হাসিনার সরকার জনগণের কোনো তোয়াক্কাই করে না। জনমতেরও কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। শুধুমাত্র পেশী শক্তির জোরে তারা ক্ষমতায় আসীন হতে চায়। আমরা একথা বারবার বলেছি যে, শুধু পেশী শক্তি দিয়ে জনগণকে রুখে দেয়া যায় না। বরং জনগণই দেশে দেশে, যুগে যুগে সমস্ত স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসকের পরাভূত করে ইতিহাসে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশেও সেরকম উদাহরণ বিরল নয়। শেখ মুজিব গেছেন, ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ জনগণ বিপ্লব সাধন করেছে। স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়েছে। এ সরকারও জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাতে পরাভূত হতে বাধ্য। জনতার জয় হবেই, ইনশাআল্লাহ!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন