দেশে সংঘাতময় এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত জনগণ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকটে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারো কথাই শুনছে না সরকার। অথচ দেশের মানুষ চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। গণতন্ত্রের কথা বললেও সরকার জনগণের চাওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকার তার সাজানো ছকেই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজপথে ককটেল ফুটছে, গুলী চলছে। হতাহত হচ্ছে দেশের মানুষ। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে দোষারোপের রাজনীতি। দেশে আজ যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার দায় সরকার কোনাভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না। একদিনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বিগত বছরগুলোতে সরকার একদিকে বিরোধী জোটের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়েছে, অপরদিকে ইচ্ছেমত সংবিধান সংশোধন করেছে এবং তৈরি করেছে নিত্য-নতুন আইন। এসব কর্মকা- দেশ ও জনগণের স্বার্থে করলে কারো কিছু বলার ছিল না, কিন্তু সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার প্রবণতা স্পষ্ট হওয়ায় ক্ষোভ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ভুল স্বীকার করছে না বরং সংবিধানের দোহাই নিয়ে চাতুর্যের পথ অবলম্বন করে জাতিকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জ্বলন্ত এমন পরিস্থিতিতেও সরকার দেশ ও জনগণের দিকে তাকিয়ে ঔদার্যপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। ক্ষমতাকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে রেখেছেন তারা। এর বড় প্রমাণ তাদের ‘নির্বাচনকালীন সরকার’। জনগণ মহাজোট সরকার ও বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করছে না। শুধু নামের পার্থক্য মানুষের কাছে অর্থহীন বিষয় বলে মনে হচ্ছে। এরপরও সরকার থেমে নেই। চাতুর্যের পথেই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন আবারও চিঠি দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। গত বুধবার পৃথক পৃথক চিঠিতে দুই নেত্রীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংলাপে বসে বিদ্যমান সংকট দূর করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। জাতিসংঘ মহাসচিবের মত দেশের জনগণও চায় দুই নেত্রীর মধ্যে একটি অর্থপূর্ণ সংলাপ। তবে বাস্তব কারণেই এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বটাই প্রধান। সরকার আন্তরিক না হলে সংলাপের আয়োজন ও বাস্তবায়ন কোনটাই সম্ভব নয়Ñ এ কথা জনগণ বেশ ভালভাবেই জানে। তাই সংলাপের ব্যাপারে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী কী ভূমিকা পালন করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বর্তমান সময়ে দেশের জনগণের দৃষ্টি সংলাপ পরিস্থিতির পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মকা-ের দিকেও নিবদ্ধ রয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভা ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ হিসেবে কেবল রুটিন কাজ পরিচালনা করার কথা। নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এই সরকার। নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা নয় তাদের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচনকালীন সরকার নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, আন্তর্জাতিক চুক্তি করছে। নির্বাচন কমিশনের অনুমতি ছাড়াই প্রশাসনে রদবদল করছে। গ্রেফতার করছে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের। এমন আচরণ লক্ষ্য করে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। ফলে নির্বাচনকালীন এই সরকারের আমলেও আবার বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্দলীয় সরকারের যৌক্তিকতাই প্রমাণিত হলো।
শুধু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নয়, নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সিদ্ধান্তও নিচ্ছে বর্তমান সরকার। এ প্রসঙ্গে টিকফা চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়, উল্লেখ করা যায় নির্বাচন কমিশনকে এড়িয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন উদ্যোগের কথা। এখানে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা একধাপ বৃদ্ধি করে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং সহকারী শিক্ষকদের একধাপ বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের বেতন স্কেলও বাড়বে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক মিলিয়ে সারাদেশের প্রায় ৪ লাখ শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। আমরা শিক্ষকদের ন্যায্য সুবিধা লাভের বিরোধী নই, কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বিশাল এ পেশাজীবী গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া কি নির্বাচনকালীন সরকারের রুটিন কাজের মধ্যে পড়ে? এতে কি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না? এসব কারণেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর নির্বাচনী আচরণবিধির প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনও নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা প্রসঙ্গে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান সরকার যেভাবে আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করতে চাইছে, তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। এমন অবস্থায় একদলীয় সাজানো নির্বাচনের বদলে সংলাপের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের চিঠিতেও তেমন বার্তা পাওয়া গেছে। বর্তমান সরকার তথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন একটি পরীক্ষার সম্মুখীন। আর সে পরীক্ষাটি হলো, তিনি দল ও ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষা করবেন, নাকি রক্ষা করবেন জাতীয় স্বার্থ? এক্ষেত্রে তিনি কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তার উপরই নির্ভর করবে ইতিহাসে তার স্থান। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন